শরহু মাআ’নিল আছার- ইমাম ত্বহাবী রহঃ
২১. মাকরুহ বিষয়াদির বর্ণনা
হাদীস নং: ৬৬৬০
আন্তর্জাতিক নং: ৬৬৬১
যে ব্যক্তি বাগানের নিকট দিয়ে অতিক্রম করে, তার জন্য উক্ত বাগানের ফল খাওয়া জায়েয কি না?
৬৬৬০-৬১। আবু বাকরা ......... মিকদাদ ইবন আসওয়াদ বলেন, একবার আমি ও আমার একজন সাথী এলাম আর তখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় আমাদের শ্রবণশক্তি ও দর্শনশক্তি বিলুপ্ত হবার উপক্রম হলো। আমরা মানুষের কাছে আমাদের প্রয়োজন পেশ করলাম, কিন্তু কেউ-ই আমাদের মেহমানদারী করল না। তারপর আমরা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হলাম। অতঃপর আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা বড় কঠিন ক্ষুধার্ত হয়েছি এবং আমরা নিজেদেরকে ক্ষুধা নিবারণের জন্য মানুষের কাছে পেশ করেছি কিন্তু তারা কেউ আমাদের মেহমানদারী করেনি। অতএব আমরা আপনার নিকট এসেছি। তখন তিনি আমাদেরকে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন। সে সময় তাঁর নিকট চারটি বকরী ছিল। তিনি বললেন, হে মিক্বদাদ! এগুলো দোহন কর এবং প্রতি দু'জনকে দুধ ভাগ করে দাও। এবং তিনি (রাবী) দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন।
. মুহাম্মাদ ইবন খুযায়মা …… আব্দুর রহমান ইবন আবু লায়লা মিকদাদ ইবন আমর হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি এবং আমার এক সাথী মদীনায় আগমন করলাম, অতঃপর তিনি অনুরূপ বর্ণনা করেন।
দেখুন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সাহাবা-ই কিরাম তাঁদের মেহমানদারী করেননি অথচ তাঁদের এতই প্রয়োজন ছিল যা হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে। তারপরও কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাদেরকে তিরষ্কার করেননি। এটা এ কথাই প্রমাণ করে যে, মানুষের ওপর মেহমানদারী করা যে তিনি ওয়াজিব করেছিলেন, তা মানসূখ হয়ে গেছে। আর আমরা এই গ্রন্থেই পূর্বে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হতে তাঁর এ বাণী উল্লেখ করেছি : مال المسلم على المسلم , كحرمة دمه “একজন মুসলমানের মাল অন্য এক মুসলমানের ওপর ঠিক তদ্রুপ হারাম, যেমন তার খুন তার ওপর হারাম।” আর এ বিষয়ে নিম্নে এ হাদীস ও বর্ণিত হয়েছে :
. মুহাম্মাদ ইবন খুযায়মা …… আব্দুর রহমান ইবন আবু লায়লা মিকদাদ ইবন আমর হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি এবং আমার এক সাথী মদীনায় আগমন করলাম, অতঃপর তিনি অনুরূপ বর্ণনা করেন।
দেখুন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সাহাবা-ই কিরাম তাঁদের মেহমানদারী করেননি অথচ তাঁদের এতই প্রয়োজন ছিল যা হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে। তারপরও কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাদেরকে তিরষ্কার করেননি। এটা এ কথাই প্রমাণ করে যে, মানুষের ওপর মেহমানদারী করা যে তিনি ওয়াজিব করেছিলেন, তা মানসূখ হয়ে গেছে। আর আমরা এই গ্রন্থেই পূর্বে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হতে তাঁর এ বাণী উল্লেখ করেছি : مال المسلم على المسلم , كحرمة دمه “একজন মুসলমানের মাল অন্য এক মুসলমানের ওপর ঠিক তদ্রুপ হারাম, যেমন তার খুন তার ওপর হারাম।” আর এ বিষয়ে নিম্নে এ হাদীস ও বর্ণিত হয়েছে :
6660 - مَا حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرَةَ قَالَ: ثنا أَبُو دَاوُدَ , قَالَ: ثنا سُلَيْمَانُ بْنُ الْمُغِيرَةِ , قَالَ: ثنا ثَابِتٌ , عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي لَيْلَى قَالَ: ثنا الْمِقْدَادُ بْنُ الْأَسْوَدِ قَالَ: جِئْتُ أَنَا وَصَاحِبٌ لِي , قَدْ كَادَتْ أَنْ تَذْهَبَ أَسْمَاعُنَا وَأَبْصَارُنَا مِنَ الْجُوعِ , فَجَعَلْنَا نَتَعَرَّضُ لِلنَّاسِ فَلَمْ يُضِفْنَا أَحَدٌ. فَأَتَيْنَا النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ أَصَابَنَا جُوعٌ شَدِيدٌ , فَتَعَرَّضْنَا لِلنَّاسِ فَلَمْ يُضِفْنَا أَحَدٌ فَأَتَيْنَاكَ. [ص:243] فَذَهَبَ بِنَا إِلَى مَنْزِلِهِ , وَعِنْدَهُ أَرْبَعَةُ أَعْنُزٍ , فَقَالَ: «يَا مِقْدَادُ , أَحْلِبْهُنَّ , وَجَزِّئِ اللَّبَنَ كُلَّ اثْنَيْنِ جُزْءًا» وَذَكَرَ حَدِيثًا طَوِيلًا
6661 - حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ خُزَيْمَةَ، قَالَ: ثنا حَجَّاجٌ، قَالَ ثنا حَمَّادٌ، عَنْ ثَابِتٍ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي لَيْلَى، عَنِ الْمِقْدَادِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ: قَدِمْتُ الْمَدِينَةَ أَنَا وَصَاحِبٌ لِي , ثُمَّ ذَكَرَ مِثْلَهُ أَفَلَا تَرَى أَنَّ أَصْحَابَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يُضَيِّفُوهُمْ , وَقَدْ بَلَغَتْ بِهِمِ الْحَاجَةُ إِلَى مَا ذَكَرَ فِي هَذَا الْحَدِيثِ , ثُمَّ لَمْ يُعَنِّفْهُمْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى ذَلِكَ. فَدَلَّ مَا ذَكَرْنَا عَلَى نَسْخِ مَا كَانَ أَوْجَبَ عَلَى النَّاسِ مِنَ الضِّيَافَةِ. وَقَدْ ذَكَرْنَا فِيمَا تَقَدَّمَ مِنْ كِتَابِنَا هَذَا , عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَالُ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ , كَحُرْمَةِ دَمِهِ»
6661 - حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ خُزَيْمَةَ، قَالَ: ثنا حَجَّاجٌ، قَالَ ثنا حَمَّادٌ، عَنْ ثَابِتٍ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي لَيْلَى، عَنِ الْمِقْدَادِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ: قَدِمْتُ الْمَدِينَةَ أَنَا وَصَاحِبٌ لِي , ثُمَّ ذَكَرَ مِثْلَهُ أَفَلَا تَرَى أَنَّ أَصْحَابَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يُضَيِّفُوهُمْ , وَقَدْ بَلَغَتْ بِهِمِ الْحَاجَةُ إِلَى مَا ذَكَرَ فِي هَذَا الْحَدِيثِ , ثُمَّ لَمْ يُعَنِّفْهُمْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى ذَلِكَ. فَدَلَّ مَا ذَكَرْنَا عَلَى نَسْخِ مَا كَانَ أَوْجَبَ عَلَى النَّاسِ مِنَ الضِّيَافَةِ. وَقَدْ ذَكَرْنَا فِيمَا تَقَدَّمَ مِنْ كِتَابِنَا هَذَا , عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَالُ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ , كَحُرْمَةِ دَمِهِ»
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটি দীর্ঘ এক বর্ণনার অংশ বিশেষ। বর্ণনাটিতে হযরত মিকদাদ রাযি. নিজ জীবনের একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন। ঘটনাটি শিক্ষণীয় ও চিত্তাকর্ষী। তাই তার বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করা যাচ্ছে। হযরত মিকদাদ রাযি. বলেন-
"আমি ও আমার দুই সঙ্গী মদীনায় আসলাম। দীর্ঘ অনাহারের কারণে আমাদের চোখ-কান যাওয়ার উপক্রম হল। আমরা নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের সামনে তুলে ধরছিলাম। কিন্তু তাদের কেউ আমাদের গ্রহণ করছিল না। শেষে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলাম। তিনি আমাদের নিয়ে নিজ গৃহে গেলেন। সেখানে তিনটি ছাগল ছিল। তিনি বললেন, তোমরা এগুলোর দুধ দোওয়াও। আমরা সকলে মিলে পান করব। আমরা সেগুলোর দুধ দোওয়াতাম। প্রত্যেকে নিজ অংশ পান করত আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অংশ আমরা তুলে রাখতাম। তিনি রাতের বেলা এসে আমাদেরকে এমনভাবে সালাম দিতেন যে, কোনও ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম ভাঙত না আর জাগ্রত ব্যক্তি তা শুনতে পেত। তারপর মসজিদে এসে নামায পড়তেন। তারপর ফিরে এসে সেই দুধ পান করতেন। একদিনকার কথা, আমি আমার অংশের দুধ পান করলাম। এ অবস্থায় শয়তান এসে আমাকে বলল, মুহাম্মাদ তো আনসারদের কাছে যাবেন। তারা তাকে আদর-আপ্যায়ন করবে। তিনি তাদের কাছে যা পাবেন তাতে এইটুকুন দুধের কোনও প্রয়োজন তার থাকবে না। তার কথায় আমি উঠে ওই দুধের কাছে গেলাম এবং তা পান করে ফেললাম। ওই দুধ যখন আমার পেটে গেল, তখন আমার হুঁশ হল। কিন্তু এখন তো ওই দুধ ফিরে পাওয়ার কোনও উপায় নেই। এবার শয়তান আমাকে লজ্জা দিতে থাকল। বলল, তুমি এটা কী করেছ? মুহাম্মাদের ভাগের দুধটা খেয়ে ফেললে? এখন এসে যখন দুধ পাবেন না, তখন তোমাকে বদদু'আ দেবেন। তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমার দুনিয়া ও আখিরাত সব যাবে। আমার একটা চাদর ছিল। আমি সেটি দিয়ে পা ঢাকতে গেলে মাথা খুলে যেত। মাথা ঢাকলে পা বের হয়ে পড়ত। আমার আর ঘুম আসছিল না। কিন্তু আমার সঙ্গীদু'জন ঘুমিয়ে গেল। আমি যা করেছি তারা তো তা করেনি। তারপর যথাসময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলেন। তিনি যথারীতি সালাম দিলেন। তারপর মসজিদে গিয়ে নামায পড়লেন। নামায শেষে ফিরে আসলেন এবং তাঁর দুধের ঢাকনা খুললেন। দেখলেন পাত্রে কিছুই নেই। তিনি আসমানের দিকে মাথা তুললেন। আমি মনে মনে বললাম, এখন আমার প্রতি বদদু'আ করবেন আর আমি ধ্বংস হয়ে যাব। কিন্তু তিনি বললেন, হে আল্লাহ! যে আমাকে খাবার খাইয়েছে, তুমি তাকে খাওয়াও। আর যে আমাকে পান করিয়েছে, তুমি তাকে পান করাও। এ দু'আ শুনে আমি আমার চাদরটি নিলাম এবং সেটি গায়ে জড়ালাম। তারপর ছুরি নিয়ে ছাগলগুলোর কাছে গেলাম। দেখতে লাগলাম কোনটি বেশি মোটাতাজা। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য সেটি জবাই করব (যাতে আমি ওই দু'আর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারি)। কিন্তু দেখতে পেলাম দুধে তার প্রত্যেকটির ওলান পরিপূর্ণ। আমি যে পাত্রে নবী-পরিবারের জন্য দুধ দোওয়ানো হয় সেটি খুঁজে বের করলাম। তারপর তাতে দুধ দোওয়াতে থাকলাম। পাত্র ভরে গেল। আমি তা নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি আজ রাতে দুধ পান করেছ? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি পান করুন। তিনি পান করলেন। তারপর আমাকে দিলেন। বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পান করুন। তিনি পান করলেন। তারপর আমাকে দিলেন। যখন বুঝলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিতৃপ্ত হয়ে গেছেন এবং আমি তাঁর দু'আ পেয়ে গেছি, তখন হেসে দিলাম। হাসতে হাসতে মাটিতে পড়ে গেলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তাঁর এ অবস্থা দেখে একটা কিছু আঁচ করতে পারলেন। তিনি) বললেন, হে মিকদাদ! নিশ্চয়ই তুমি একটা মন্দ কাজ করেছ। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আজ এই এই কাণ্ড ঘটেছে। তিনি বললেন, এটা আল্লাহর রহমত ছাড়া কিছু নয়। তুমি আমাকে আগে বললে না কেন, তাহলে আমাদের ওই দুই বন্ধুদের জাগাতাম এবং তারাও এর অংশ পেত? আমি বললাম, আপনাকে যিনি সত্যসহ পাঠিয়েছেন তার কসম! যখন আপনি পেয়েছেন এবং আপনার সঙ্গে আমিও পেয়েছি, তখন আর কে পেল বা না পেল তাতে আমার কিছু আসে-যায় না।"
এ হাদীছটি দ্বারা জানা যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম কী কঠিন অভাব-অনটনের ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। অনাহারে থাকতে হযরত মিকদাদ রাযি. ও তাঁর দুই সঙ্গীর শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ অবস্থায় তারা এই আশায় অন্যান্য সাহাবীদের সামনে উপস্থিত হতেন যে, তাদেরকে দেখলে তারা তাদের অনাহারক্লিষ্ট অবস্থা বুঝতে পারবেন, ফলে তাঁদের ক্ষুধা মেটানোর কোনও ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তাদেরও তো অবস্থা ছিল একইরকম। নিজেরাও অনাহারে দিন কাটাচ্ছিলেন। তাদের ক্ষুধা মেটাবেন কী দিয়ে? তাই তাদের কেউই এ তিন ক্ষুধার্তকে গ্রহণ করতে পারছিলেন না।
শেষে তারা যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে হাজির হলেন এবং তিনি তাদের ক্ষুধাকাতর অবস্থা বুঝতে পারলেন, তখন তাদেরকে নিজ গৃহে নিয়ে গেলেন। তারপর যা-কিছু হল তা তো উল্লিখিত বর্ণনার মধ্যেই আছে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আখলাক-চরিত্রে সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত। ছিলেন অতিথি পরায়ণ, বিনয়ী, ত্যাগী, সহমর্মী, মহানুভব, আরও কত কী! অন্যের ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, তাই সালাম দিতেন সংযত আওয়াজে। ঘুম মানুষের সুস্থ থাকার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। ঘুমের ব্যাঘাত হলে কষ্ট হয়, স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। তাই কারও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো উচিত নয়। সকলের বড়, কুলমাখলূকের বাদশা ও মাথার মুকুট হয়েও সাধারণ জনদের স্বাস্থ্য, আরাম ও বিশ্রামের দিকে এমন সতর্ক দৃষ্টি রাখা সকলের কাজ নয়। এ মহানুভবতা তাঁরই বিশেষত্ব।
নিজে ক্ষুধার্ত। রোজ পাত্রে রাখা সামান্য একটু দুধ দ্বারা ক্ষুধা মেটান। আজও সেই দুধ দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করবেন। কিন্তু পাত্রে কিছুই পেলেন না। এ নিয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করলেন না। এরকম পরিস্থিতিতে লোকে কত কিই না করে। কিন্তু নিজ খাবার না পাওয়াটা মহানুভবতার বাদশার কাছে এমন কিছু বিষয় নয়, যা নিয়ে অভিযোগ তোলা যায়। তিনি সবসময়ই শোকরগুযার। এখন ক্ষুধার্ত বটে, কিন্তু এর আগে কত পানাহার করা হয়েছে। কতজন তাকে আপন সাধ্যমতো পানাহার করিয়েছে। সেই কৃতজ্ঞতায় তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করছেন। সর্বাবস্থায় আল্লাহ-অভিমুখিতাই তাঁর স্বভাব। তিনি দু’আ করেছেন– হে আল্লাহ! যে আমাকে খাবার খাইয়েছে তুমি তাকে খাওয়াও, আর যে আমাকে পান করিয়েছে তুমি তাকে পান করাও। দু'আ কারওটাই বৃথা যায় না। তাঁর দু'আ তো বৃথা যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ দু'আর বরকত নগদই পাওয়া গেল অবেলায় ছাগলের ওলান দুধে ভরে গেল। হযরত মিকদাদ রাযি. ছাগল জবাই করতে গিয়ে দেখেন ছাগলের ওলান দুধে ভরা। এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মু'জিযা। তিনি মন্তব্য করেন, এটা আল্লাহর রহমত ছাড়া কিছু নয়। তাঁর রহমতেই অবেলায় অসময়ে এভাবে দুধ পাওয়া গেল। এ দুধ রহমতের। এ দুধ বরকতের। তাই তিনি অপর দুই সঙ্গীকে খাওয়ানো হল না বলে আফসোস করছেন।
হাদীছটিতে সালামের আদব শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, রাতের বেলা বা অন্যদের বিশ্রামের সময় সালাম দিতে হবে সংযত আওয়াজে, যাতে তা কেবল জাগ্রত ব্যক্তিই শুনতে পায়, যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের যেন ঘুম না ভাঙ্গে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইইি ওয়াসাল্লাম রাতের বেলা ঘরে আসলে এভাবেই সালাম দিতেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নিজ আচরণে অন্যের বিশ্রাম ও ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
খ. ঘুম ও বিশ্রামের সময় সংযত আওয়াজে সালাম দেওয়া চাই, যাতে ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম ভেঙ্গে না যায়।
গ. নিজের কাছে যা আছে তা দ্বারা ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করা চাই।
ঘ. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মু'জিযা সত্য। তাতে বিশ্বাস রাখতে হবে।
ঙ. হাদীছটি দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের কঠিন অভাব-অনটন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
"আমি ও আমার দুই সঙ্গী মদীনায় আসলাম। দীর্ঘ অনাহারের কারণে আমাদের চোখ-কান যাওয়ার উপক্রম হল। আমরা নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের সামনে তুলে ধরছিলাম। কিন্তু তাদের কেউ আমাদের গ্রহণ করছিল না। শেষে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলাম। তিনি আমাদের নিয়ে নিজ গৃহে গেলেন। সেখানে তিনটি ছাগল ছিল। তিনি বললেন, তোমরা এগুলোর দুধ দোওয়াও। আমরা সকলে মিলে পান করব। আমরা সেগুলোর দুধ দোওয়াতাম। প্রত্যেকে নিজ অংশ পান করত আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অংশ আমরা তুলে রাখতাম। তিনি রাতের বেলা এসে আমাদেরকে এমনভাবে সালাম দিতেন যে, কোনও ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম ভাঙত না আর জাগ্রত ব্যক্তি তা শুনতে পেত। তারপর মসজিদে এসে নামায পড়তেন। তারপর ফিরে এসে সেই দুধ পান করতেন। একদিনকার কথা, আমি আমার অংশের দুধ পান করলাম। এ অবস্থায় শয়তান এসে আমাকে বলল, মুহাম্মাদ তো আনসারদের কাছে যাবেন। তারা তাকে আদর-আপ্যায়ন করবে। তিনি তাদের কাছে যা পাবেন তাতে এইটুকুন দুধের কোনও প্রয়োজন তার থাকবে না। তার কথায় আমি উঠে ওই দুধের কাছে গেলাম এবং তা পান করে ফেললাম। ওই দুধ যখন আমার পেটে গেল, তখন আমার হুঁশ হল। কিন্তু এখন তো ওই দুধ ফিরে পাওয়ার কোনও উপায় নেই। এবার শয়তান আমাকে লজ্জা দিতে থাকল। বলল, তুমি এটা কী করেছ? মুহাম্মাদের ভাগের দুধটা খেয়ে ফেললে? এখন এসে যখন দুধ পাবেন না, তখন তোমাকে বদদু'আ দেবেন। তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমার দুনিয়া ও আখিরাত সব যাবে। আমার একটা চাদর ছিল। আমি সেটি দিয়ে পা ঢাকতে গেলে মাথা খুলে যেত। মাথা ঢাকলে পা বের হয়ে পড়ত। আমার আর ঘুম আসছিল না। কিন্তু আমার সঙ্গীদু'জন ঘুমিয়ে গেল। আমি যা করেছি তারা তো তা করেনি। তারপর যথাসময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলেন। তিনি যথারীতি সালাম দিলেন। তারপর মসজিদে গিয়ে নামায পড়লেন। নামায শেষে ফিরে আসলেন এবং তাঁর দুধের ঢাকনা খুললেন। দেখলেন পাত্রে কিছুই নেই। তিনি আসমানের দিকে মাথা তুললেন। আমি মনে মনে বললাম, এখন আমার প্রতি বদদু'আ করবেন আর আমি ধ্বংস হয়ে যাব। কিন্তু তিনি বললেন, হে আল্লাহ! যে আমাকে খাবার খাইয়েছে, তুমি তাকে খাওয়াও। আর যে আমাকে পান করিয়েছে, তুমি তাকে পান করাও। এ দু'আ শুনে আমি আমার চাদরটি নিলাম এবং সেটি গায়ে জড়ালাম। তারপর ছুরি নিয়ে ছাগলগুলোর কাছে গেলাম। দেখতে লাগলাম কোনটি বেশি মোটাতাজা। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য সেটি জবাই করব (যাতে আমি ওই দু'আর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারি)। কিন্তু দেখতে পেলাম দুধে তার প্রত্যেকটির ওলান পরিপূর্ণ। আমি যে পাত্রে নবী-পরিবারের জন্য দুধ দোওয়ানো হয় সেটি খুঁজে বের করলাম। তারপর তাতে দুধ দোওয়াতে থাকলাম। পাত্র ভরে গেল। আমি তা নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি আজ রাতে দুধ পান করেছ? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি পান করুন। তিনি পান করলেন। তারপর আমাকে দিলেন। বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পান করুন। তিনি পান করলেন। তারপর আমাকে দিলেন। যখন বুঝলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিতৃপ্ত হয়ে গেছেন এবং আমি তাঁর দু'আ পেয়ে গেছি, তখন হেসে দিলাম। হাসতে হাসতে মাটিতে পড়ে গেলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তাঁর এ অবস্থা দেখে একটা কিছু আঁচ করতে পারলেন। তিনি) বললেন, হে মিকদাদ! নিশ্চয়ই তুমি একটা মন্দ কাজ করেছ। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আজ এই এই কাণ্ড ঘটেছে। তিনি বললেন, এটা আল্লাহর রহমত ছাড়া কিছু নয়। তুমি আমাকে আগে বললে না কেন, তাহলে আমাদের ওই দুই বন্ধুদের জাগাতাম এবং তারাও এর অংশ পেত? আমি বললাম, আপনাকে যিনি সত্যসহ পাঠিয়েছেন তার কসম! যখন আপনি পেয়েছেন এবং আপনার সঙ্গে আমিও পেয়েছি, তখন আর কে পেল বা না পেল তাতে আমার কিছু আসে-যায় না।"
এ হাদীছটি দ্বারা জানা যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম কী কঠিন অভাব-অনটনের ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। অনাহারে থাকতে হযরত মিকদাদ রাযি. ও তাঁর দুই সঙ্গীর শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ অবস্থায় তারা এই আশায় অন্যান্য সাহাবীদের সামনে উপস্থিত হতেন যে, তাদেরকে দেখলে তারা তাদের অনাহারক্লিষ্ট অবস্থা বুঝতে পারবেন, ফলে তাঁদের ক্ষুধা মেটানোর কোনও ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তাদেরও তো অবস্থা ছিল একইরকম। নিজেরাও অনাহারে দিন কাটাচ্ছিলেন। তাদের ক্ষুধা মেটাবেন কী দিয়ে? তাই তাদের কেউই এ তিন ক্ষুধার্তকে গ্রহণ করতে পারছিলেন না।
শেষে তারা যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে হাজির হলেন এবং তিনি তাদের ক্ষুধাকাতর অবস্থা বুঝতে পারলেন, তখন তাদেরকে নিজ গৃহে নিয়ে গেলেন। তারপর যা-কিছু হল তা তো উল্লিখিত বর্ণনার মধ্যেই আছে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আখলাক-চরিত্রে সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত। ছিলেন অতিথি পরায়ণ, বিনয়ী, ত্যাগী, সহমর্মী, মহানুভব, আরও কত কী! অন্যের ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, তাই সালাম দিতেন সংযত আওয়াজে। ঘুম মানুষের সুস্থ থাকার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। ঘুমের ব্যাঘাত হলে কষ্ট হয়, স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। তাই কারও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো উচিত নয়। সকলের বড়, কুলমাখলূকের বাদশা ও মাথার মুকুট হয়েও সাধারণ জনদের স্বাস্থ্য, আরাম ও বিশ্রামের দিকে এমন সতর্ক দৃষ্টি রাখা সকলের কাজ নয়। এ মহানুভবতা তাঁরই বিশেষত্ব।
নিজে ক্ষুধার্ত। রোজ পাত্রে রাখা সামান্য একটু দুধ দ্বারা ক্ষুধা মেটান। আজও সেই দুধ দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করবেন। কিন্তু পাত্রে কিছুই পেলেন না। এ নিয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করলেন না। এরকম পরিস্থিতিতে লোকে কত কিই না করে। কিন্তু নিজ খাবার না পাওয়াটা মহানুভবতার বাদশার কাছে এমন কিছু বিষয় নয়, যা নিয়ে অভিযোগ তোলা যায়। তিনি সবসময়ই শোকরগুযার। এখন ক্ষুধার্ত বটে, কিন্তু এর আগে কত পানাহার করা হয়েছে। কতজন তাকে আপন সাধ্যমতো পানাহার করিয়েছে। সেই কৃতজ্ঞতায় তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করছেন। সর্বাবস্থায় আল্লাহ-অভিমুখিতাই তাঁর স্বভাব। তিনি দু’আ করেছেন– হে আল্লাহ! যে আমাকে খাবার খাইয়েছে তুমি তাকে খাওয়াও, আর যে আমাকে পান করিয়েছে তুমি তাকে পান করাও। দু'আ কারওটাই বৃথা যায় না। তাঁর দু'আ তো বৃথা যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ দু'আর বরকত নগদই পাওয়া গেল অবেলায় ছাগলের ওলান দুধে ভরে গেল। হযরত মিকদাদ রাযি. ছাগল জবাই করতে গিয়ে দেখেন ছাগলের ওলান দুধে ভরা। এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মু'জিযা। তিনি মন্তব্য করেন, এটা আল্লাহর রহমত ছাড়া কিছু নয়। তাঁর রহমতেই অবেলায় অসময়ে এভাবে দুধ পাওয়া গেল। এ দুধ রহমতের। এ দুধ বরকতের। তাই তিনি অপর দুই সঙ্গীকে খাওয়ানো হল না বলে আফসোস করছেন।
হাদীছটিতে সালামের আদব শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, রাতের বেলা বা অন্যদের বিশ্রামের সময় সালাম দিতে হবে সংযত আওয়াজে, যাতে তা কেবল জাগ্রত ব্যক্তিই শুনতে পায়, যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের যেন ঘুম না ভাঙ্গে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইইি ওয়াসাল্লাম রাতের বেলা ঘরে আসলে এভাবেই সালাম দিতেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নিজ আচরণে অন্যের বিশ্রাম ও ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
খ. ঘুম ও বিশ্রামের সময় সংযত আওয়াজে সালাম দেওয়া চাই, যাতে ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম ভেঙ্গে না যায়।
গ. নিজের কাছে যা আছে তা দ্বারা ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করা চাই।
ঘ. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মু'জিযা সত্য। তাতে বিশ্বাস রাখতে হবে।
ঙ. হাদীছটি দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের কঠিন অভাব-অনটন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
