আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৭- নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৫১৫
৩৪৬। কোন কিছু নামায নষ্ট করে না বলে যিনি মত পোষণ করেন
৪৯১। ইসহাক ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) ..... নবী (ﷺ) এর সহধর্মিণী আয়িশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতে উঠে নামাযে দাঁড়াতেন আর আমি তাঁর ও কিবলার মাঝখানে আড়াআড়িভাবে তাঁর পারিবারিক বিছানায় শুয়ে থাকতাম।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হানাফী মাযহাবের ফকীহ ও আলিমগণের মতে মহিলাকে স্পর্শ করার কারণে পুরুষ বা মহিলা কারোই অযূ ভঙ্গ হয় না। এ মাস'আলায় নিম্নলিখিত হাদীসসমূহ প্রাণিধানযোগ্য :

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كُنتُ أمد رجلي في قبلة النَّبِي (ﷺ) وَهُوَ يُصَلَّى فَإِذَا سَجدَ غمَرَنِي فَرَفَعَتُهَا فَإِذَا قَامَ مَدَدتها

১. উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তাহাজ্জুদের সময় আমি নবী করীম (সা)-এর সামনে আমার পা লম্বা করে শুয়ে থাকতাম। তিনি যখন সিজদা যেতেন আমার পায়ে মৃদু চাপ দিতেন, তখন আমি পা গুটিয়ে নিতাম। অতঃপর তিনি দণ্ডয়মান হলে আমি তা প্রসারিত করতাম।"

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كُنتُ أنَامُ بَيْنَ يَدَى رَسُولِ اللهِ (ﷺ) ورجلاي في قِبلَتِهِ فَإِذا سَجَدَ غَمَزَنِي فَقَبَضْتُ رِجْلِي وَإِذَا قَامَ بَسَطَتْهَا قالت والبيوت يَوْمَئِذٍ ليس فيها مصابيح

২. হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সামনে ঘুমিয়ে থাকতাম, তখন আমার পা থাকত নবী (সা)-এর সিজদার স্থানে ছড়ানো। তিনি যখন সিজদায় যেতেন হাত দ্বারা আমার পায়ে মৃদু চাপ দিতেন আমি পা গুটিয়ে নিতাম। তিনি সিজদা থেকে উঠে গেলে পুনরায় পা লম্বা করে দিতাম। তখন ঘরে বাতি থাকত না।”

عن عائشة رضى الله عَنْهَا قَالَتْ فَقَدْتُ رَسُولَ الله (ﷺ) لَيْلَةً مِّن الْفِرَاشِ فَالْتَمَسْتُه فوقعت يدي على بطن قدمِهِ وَهُوَ فِي الْمَسْجِد وَهُمَا مَنْصُوبَتَانِ وَهُوَ يَقُولُ اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ برضاك من سخطك

৩. হযরত আয়েশা (রা) বলেন, এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বিছানার (নির্দিষ্ট স্থানে) না পেয়ে তাঁকে (হাত দিয়ে) খুঁজতে লাগলাম। এ সময় আমার হাত তাঁর পা মোবারকের তলায় পতিত হয়। তিনি তখন সিজদায় রত ছিলেন এবং তাঁর পা দু'টো খাড়া অবস্থায় ছিল । তিনি বলছিলেন : (অনুবাদ) হে আল্লাহ্! আমি আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমে ক্রোধ থেকে পানাহ চাচ্ছি

উপরোক্ত হাদীসগুলোতে দেখা যাচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা) নামাযে রত অবস্থায় আয়েশা (রা)-কে হাত দিয়ে মৃদু চাপ দিয়েছেন তাঁর পা সরিয়ে নেয়ার জন্য। আয়েশা (রা) পা সরিয়ে নিয়েছেন এবং সিজদা শেষে পুনরায় পা ছড়িয়ে দিয়েছেন। পরবর্তী রাক'আতে ও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। যদি মহিলাকে স্পর্শ করা দ্বারা অযূ ভেঙ্গে যায়, তাহলে বলতে হয় যে, নবীজীর নামাযটি অসম্পূর্ণ থেকেছে। আর এরূপ বলার আদৌ কোন সুযোগ নেই। তেমনিভাবে তৃতীয় হাদীসে দেখা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) নামাযে থাকাকালে আয়েশা (রা)-এর হাত তাঁর পা মোবারকের তলা স্পর্শ করেছে। যদি স্পর্শ অযূ ভঙ্গ হওয়ার কারণ হত তবে নবী করীম (সা) সে সময় সিজদায় থাকতেন না, বরং নুতন করে অযূ করার জন্য উঠে পড়তেন। কিন্তু হাদীসের কোথাও কোন আভাসও পাওয়া যায় না। সুতরাং এ সকল হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, পুরুষ ও মহিলা একে অপরকে স্পর্শ করার দরুন অযু ভঙ্গ হয় না, হানাফীগণ এই অভিমতকেই তাঁদের মাযহাব হিসাবে গ্রহণ করেছেন।

এর বিপরীতে অন্যান্য ইমামগণ বলেন যে এ অবস্থায় অযূ ভেঙ্গে যাবে। এ সম্পর্কে তারা যে দলীল প্রদান করেন তা মূলত পুরুষ মহিলাকে স্পর্শ করা সম্পর্কিত কোন আয়াত বা হাদীস নয়, বরং সেটি নারী পুরুষের মিলন সম্পর্কিত, একটি আয়াতের অংশমাত্র। শরীর অপবিত্র হয়ে যাওয়ার দরুন অযু করা জরুরী এমন কতক অবস্থায় বর্ণনা প্রদান করার পর মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন : أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ "অথবা তোমরা মহিলাদের সাথে মিলিত হলে (তোমাদের পবিত্রতা বিনষ্ট হবে।)” এ আয়াতাংশের অপর মুতাওয়াতির কিরা'আত হচ্ছে أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ “অথবা তোমরা মহিলাদের স্পর্শ করলে"। উক্ত ফকীহগণ মহিলাকে স্পর্শ করা অযূ ভঙ্গের কারণ হিসাবে বিবেচনা করেন বলে তাঁরা উল্লিখিত আয়াতের এ কিরা'আতটিকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন ।এ রায় বহাল রাখার জন্য أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ পড়ার সময়ও এর অর্থ ধরেন, 'স্পর্শ করা', মিলন নয় ।"

পক্ষান্তরে হানাফী ফকীহ ও আলিমগণ উক্ত মতাবলম্বী ফকীহগণের দলীল ও বক্তব্যের জবাবে বলেন যে, কুরআনুল করীমে ; বাক্যটি তায়াম্মুম-এর আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে। এর পূর্বে বলা হয়েছেঃ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِّنكُم مِّنَ الْغَائِطِ যদি তোমাদের কেউ শৌচস্থন থেকে ফিরে আসে'। এটি حدث اصغر হাদাসে আসগার বুঝায়, আর হাদাসে আসগার অযূ জরুরী করে। অতএব এ অবস্থায় উক্ত তায়াম্মুম করার বৈধতা প্রতীয়মান হয়। যদি আয়াতের পরবর্তী অংশ لَامَسْتُمُ দ্বারা 'স্পর্শ করার' অর্থ গ্রহণ করা হয়, তাহলে দ্বারার হাদাসে আসগার বুঝাবে। তখন হাদাসে আকবার যা গোসল জরুরী করে, এরূপ হাদাসের বেলায় তায়াম্মুম করার বৈধতা সম্পর্কে এ আয়াত থেকে কোন নির্দেশ পাওয়া যায় না। কিন্তু যদি لَامَسْتُمُ এর অর্থ গ্রহণ করা হয় 'স্বামী-স্ত্রীর মিলন' তাহলে হাদাসে আকবারের পরিস্থিতিতেও যে তায়াম্মুম কার্যকরী হয় তা আয়াতের মাধ্যমে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সকল ইমাম ও আলিম এ কথায় একমত যে, হাদাসে আকবার ও হাদাসে আসগার উভয় পরিস্থিতিতেই তায়াম্মুম করা বৈধ। তাই لَامَسْتُمُ -এর অর্থ মিলন ধরা হলে কুরআনেও এ কথার স্বাক্ষ্য ও সমর্থন পাওয়া যায় যা এ জাতীয় নির্দেশ না থাকার চাইতে অবশ্যই উত্তম। তা ছাড়া, لَامَسْتُمُ শব্দটি باب مفاعلة -এর শব্দ। আরবী ভাষাবিদ মাত্রই জানেন যে, مفاعلة এর একটি উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব হচ্ছে مشاركت অর্থাৎ বাক্যের কর্তা ও কর্ম সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াতে উভয়ের শরীক থাকা। 'মিলন' বা সঙ্গম অর্থ গ্রহণে ও বিশেষত্ব বাস্তবসম্মত হয়। কিন্তু 'স্পর্শ করা' অর্থে এর মধ্যে উভয়ের শরীক থাকা বুঝা যায় না। যদি উল্লিখিত শব্দটিকে 'একে অপরকে স্পর্শ করা', অর্থে গ্রহণ করা হয় তবে তা দ্বারাও 'মিলনই বা সঙ্গমই 'বুঝিয়ে থাকে। এ ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে উল্লিখিত শব্দটিকে এ ক্ষেত্রে মিলন বা সঙ্গম অর্থে গ্রহণ করাই যথাযথ ও বাস্তবসম্মত।

হানাফী মাযহাবের আলিমগণ বলেন, দ্বিতীয় মুতাওয়াতির কিরাআতটি গ্রহণ করা হলেও এ আয়াতাংশের অর্থ হবে মিলন বা সঙ্গম, স্পর্শ করা নয়। হাফিয ইবন জারীর (র) তাফসীর গ্রন্থে সহীহ সনদ সংশ্লিষ্ট আয়াত সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা)-এর প্রদত্ত ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এখানে لَامَسْتُمُ শব্দটি স্পর্শ করা অর্থে গ্রহণ না করে মিলন বা সঙ্গম অর্থে গ্রহণ করতে হবে। তিনি এ ব্যাখ্যার স্বপক্ষে কুরআনের সে সকল আয়াত উপস্থাপন করেছেন। বাহ্যিকভাবে যেগুলোর অর্থ হয় স্পর্শ করা, কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সেগুলো মিলন অর্থই গৃহীত হয়ে থাকে। যেমন: وَإِن طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِن قَبْلِ أَن تَمَسُّوهُنَّ যদি তোমরা তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে (অর্থাৎ মিলন সংঘটনের পূর্বে) তাদেরকে তালাক দাও। ২৬

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ আয়াতাংশ -এর সাথে আলোচ্য মাসআলাটি মোটেই সম্পর্কিত নয়, বরং তার সম্পর্ক অন্য মাস'আলার সাথে। এর বিপরীতে উল্লিখিত হাদীসগুলো আলোচিত বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত এবং নিজ বক্তব্যে সুস্পষ্ট। তাই স্বভাবিকভাবে এক্ষেত্রে হাদীসের দলীল এবং তার দ্বারা সাব্যস্তকৃত রায়ই প্রাধান্য পাওয়ার উপযোগী বলে বিবেচিত হবে!
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন