শরহু মাআ’নিল আছার- ইমাম ত্বহাবী রহঃ

৪. যাকাতের অধ্যায়

হাদীস নং: ৩০২৫
আন্তর্জাতিক নং: ৩০২৬
৩. নারীর জন্য তার সম্পদের যাকাত আপন স্বামীকে দেয়া বৈধ কি-না?
৩০২৫-২৬। ফাহাদ (রাহঃ) ..... আব্দুল্লাহ (রাযিঃ)-এর স্ত্রী যায়নাব (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি
বলেছেন,একবার আমি মসজিদে ছিলাম এবং নবী করীম (ﷺ) আমাকে মসজিদে দেখলেন এবং বললেনঃ “তােমরা সাদাকা দাও, তোমাদের অলংকার থেকে হলেও”। যায়নাব (রাযিঃ) (তাঁর স্বামী) আব্দুল্লাহর (রাযিঃ) ও কিছুসংখ্যক ইয়াতীম যা তার প্রতিপালনে ছিল, তাদের খরচ ও ব্যয়ভার চালাতেন। তিনি আব্দুল্লাহ (রাযিঃ)-কে বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কে জিজ্ঞাস কর, আমি আমার মালের সাদাকা থেকে যদি তোমার ও সেই সব
ইয়াতীমদের খরচ ও ব্যয়ভার গ্রহণ করি যারা আমার প্রতিপালনে রয়েছে তাহলেও জায়িয হবে কিনা ? তিনি বললেন, তুমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর নিকট গিয়ে নিজে জিজ্ঞাসা কর। তখন আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর নিকট গেলাম। আমি গিয়ে দরজায় এক আনসারী মহিলাকে পেলাম। তিনিও আমার মত অভিন্ন মাসআলা জিজ্ঞাসা
করতে এসেছিলেন। (এমন সময়) বিলাল (রাযিঃ) আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি বললাম, আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি বললাম, আমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা কর- আমি আমার সাদাকা থেকে যদি আমার স্বামী ও আমার প্রতিপালনে
যেসব ইয়াতীম রয়েছে তাদের খরচ ও ব্যয়ভার গ্রহণ করি তাহলে তা জায়িয হবে কিনা ? আর আমরা
বললাম আমাদের পরিচয় জানাবে না (আমরা কারা)। তিনি বলেন, বিলাল (রাযিঃ) প্রবেশ করলেন এবং তাঁকে
জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, তাঁরা দুইজন কারা ? তিনি বললেন, যায়নাব। তিনি বললেন, সে কোন্
যায়নাব ? তিনি বললেন, আব্দুল্লাহ্ (রাযিঃ)-এর স্ত্রী। তিনি (উত্তরে) বললেন, হ্যাঁ, তার জন্য (দ্বিগুণ) সাওয়াব।
(একটি) আত্মীয়তা রক্ষার সাওয়াব আরেকটি সাদাকার।

আনূ জা'ফর (তাহাবী র) বলেনঃ একদল আলিম এ মত গ্রহণ করেছেন যে, নারীর জন্য নিজ স্বামীকে
নিজের সম্পদের যাকাত প্রদান করা জায়িয আছে। তারা এ বিষয়ে এই হাদীস দ্বারা প্রমাণ পেশ করেন। এই
মতের প্রবক্তাদের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফ (রাহঃ) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রাহঃ) অন্যতম। পক্ষান্তরে এই বিষয়ে
অপরাপর আলিমগণ তাদের বিরােধিতা করেছেন, তাঁদের মধ্যে ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) অন্যতম। তাঁরা
বলেছেনঃ নারীর জন্য নিজ মালের যাকাত স্বামীকে প্রদান করা জায়িয নয়। যেমনিভাবে স্বামীর জন্য নিজ
মালের যাকাত স্ত্রীকে দেয়া জায়িয নয়।

প্রথমােক্ত মত পােষণকারীদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দলের দলীল এই যে, যায়নাব (রাযিঃ)-এর হাদীসে প্রথম দলের
দলীল, যা তারা দ্বিতীয় দলের বিরুদ্ধে পেশ করেছিলেন, তাতে উক্ত সাদাকা যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ হাদীসে তার উপর নির্দিষ্ট করেছেন, বস্তুত তা ছিল যাকাত ব্যতীত অন্য নফল সাদাকা। আর তা নিম্নোক্ত হাদীসে
ব্যক্ত হয়েছেঃ
26 - 3025 - حَدَّثَنَا فَهْدٌ , قَالَ: ثنا عُمَرُ بْنُ حَفْصِ بْنِ غِيَاثٍ , قَالَ: ثنا أَبِي , عَنِ الْأَعْمَشِ , قَالَ: حَدَّثَنِي شَقِيقٌ , عَنْ عَمْرِو بْنِ الْحَارِثِ , عَنْ زَيْنَبَ امْرَأَةِ عَبْدِ اللهِ , قَالَ: فَذَكَرْتُهُ لِإِبْرَاهِيمَ , فَحَدَّثَنِي إِبْرَاهِيمُ , عَنْ أَبِي عُبَيْدَةَ , عَنْ عَمْرِو بْنِ الْحَارِثِ , عَنْ زَيْنَبَ امْرَأَةِ عَبْدِ اللهِ , مِثْلَهُ سَوَاءً قَالَتْ: " كُنْتُ فِي الْمَسْجِدِ فَرَآنِي النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمَسْجِدِ فَقَالَ: «تَصَدَّقْنَ وَلَوْ مِنْ حُلِيِّكُنَّ» وَكَانَتْ زَيْنَبُ تُنْفِقُ عَلَى عَبْدِ اللهِ وَأَيْتَامٍ فِي حِجْرِهَا فَقَالَتْ لِعَبْدِ اللهِ: سَلْ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , أَيُجْزِئُ عَنِّي إِنْ أَنْفَقْتُ عَلَيْكَ، وَعَلَى أَيْتَامٍ فِي حِجْرِي مِنَ الصَّدَقَةِ؟ قَالَ: سَلِي أَنْتِ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. فَانْطَلَقْتُ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , فَوَجَدْتُ امْرَأَةً مِنَ الْأَنْصَارِ عَلَى الْبَابِ , حَاجَتُهَا مِثْلُ حَاجَتِي. فَمَرَّ عَلَيْنَا بِلَالٌ , فَقُلْتُ: سَلْ لَنَا رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: هَلْ يُجْزِئُ عَنِّي أَنْ أَتَصَدَّقَ عَلَى زَوْجِي وَأَيْتَامٍ فِي حِجْرِي مِنَ الصَّدَقَةِ؟ وَقُلْنَا: لَا تُخْبِرُ بِنَا. قَالَتْ: فَدَخَلَ فَسَأَلَهُ , فَقَالَ مَنْ هُمَا؟ قَالَ: زَيْنَبُ , قَالَ أَيِ الزَّيَانِبِ هِيَ؟ قَالَ: امْرَأَةُ عَبْدِ اللهِ؟ فَقَالَ نَعَمْ يَكُونُ لَهَا أَجْرُ الْقَرَابَةِ وَأَجْرُ الصَّدَقَةِ " قَالَ أَبُو جَعْفَرٍ: فَذَهَبَ قَوْمٌ إِلَى أَنَّ الْمَرْأَةَ جَائِزٌ لَهَا أَنْ تُعْطِيَ زَوْجَهَا مِنْ زَكَاةِ مَالِهَا , وَاحْتَجُّوا فِي ذَلِكَ بِهَذَا الْحَدِيثِ , وَمِمَّنْ ذَهَبَ إِلَى ذَلِكَ , أَبُو يُوسُفَ , وَمُحَمَّدٌ رَحِمَهُمَا اللهُ. وَخَالَفَهُمْ فِي ذَلِكَ آخَرُونَ , مِنْهُمْ أَبُو حَنِيفَةَ رَحِمَهُ اللهُ , فَقَالُوا: لَا يَجُوزُ لِلْمَرْأَةِ أَنْ تُعْطِيَ زَوْجَهَا مِنْ زَكَاةِ مَالِهَا , كَمَا لَا يَجُوزُ لَهُ أَنْ يُعْطِيَهَا مِنْ زَكَاةِ مَالِهِ. وَكَانَ مِنَ الْحُجَّةِ لَهُمْ عَلَى أَهْلِ الْمَقَالَةِ الْأُولَى , فِي حَدِيثِ زَيْنَبَ الَّذِي احْتَجُّوا بِهِ عَلَيْهِمْ , أَنَّ تِلْكَ الصَّدَقَةَ الَّتِي حَضَّ عَلَيْهَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي ذَلِكَ الْحَدِيثِ إِنَّمَا كَانَتْ مِنْ غَيْرِ الزَّكَاةِ. وَقَدْ بَيَّنَ ذَلِكَ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলা সাহাবীদেরকে বিশেষভাবে দান-সদাকা করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। হাদীছে আছে-

تصدقن يا معشر النساء ولو من حليكن

(হে নারী সম্প্রদায়! তোমরা সদাকা কর তোমাদের অলংকারাদি থেকে হলেও)। অর্থাৎ‍ সদাকা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল। এর দ্বারা গুনাহ মাফ হয় এবং জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন تصدقوا، فإن الصدقة فكاككم من النار ‘তোমরা সদাকা কর। সদাকা তোমাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তির বিনিময়।৯৩ কাজেই সকলের জন্যই এ আমল জরুরি।

দান-সদাকা সাধারণত টাকাপয়সা ও খাদ্যসামগ্রী করা হয়ে থাকে। কিন্তু সকলের হাতে সবসময় তা থাকে না, বিশেষত মহিলাদের কাছে। তবে কিছু না কিছু অলংকার তাদের থাকেই। স্বভাবগতভাবে অলংকারের প্রতি মহিলাদের আকর্ষণও থাকে, যে কারণে গরীব হলেও তারা কিছু না কিছু অলংকার গড়িয়ে নেয়। বলাবাহুল্য এটা দু'দিনের সম্পদ, দু'দিনের শোভা। বড়জোর মৃত্যু পর্যন্ত কাছে থাকে। জান্নাতের অলংকারই আসল অলংকার। তা কোনওদিন হাতছাড়া হবে না। জান্নাত পেতে হলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাই এবং চাই পাপের মার্জনা। এ উদ্দেশ্যে দুনিয়ার সবটা সম্পদও যদি দান করে দেওয়া যায়, তাও তুচ্ছই বটে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَلَوْ أَنَّ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لَافْتَدَوْا بِهِ مِنْ سُوءِ الْعَذَابِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

“যারা জুলুমে লিপ্ত হয়েছে, যদি দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ তাদের থাকত এবং তার সমপরিমাণ আরও, তবে কিয়ামতের দিন নিকৃষ্টতম শাস্তি হতে বাঁচার জন্য তা সবই মুক্তিপণস্বরূপ দিয়ে দিত।৯৪

এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে অন্ততপক্ষে নিজেদের অলংকার থেকে হলেও সদাকা করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
হাদীছে আছে-হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি.-এর স্ত্রী যায়নাব রাযি. সে নসীহতে খুব প্রভাবিত হলেন এবং দান-সদাকা করবেন বলে মনস্থ করলেন। ওদিকে তাঁর স্বামী হযরত ইবন মাস'উদ রাযি. ছিলেন একজন গরীব সাহাবী। আয়-রোযগার কম ছিল। হযরত যায়নাব রাযি. ভাবলেন তিনি যা দান সদাকা করবেন তা স্বামীকেই দিয়ে দেবেন কি না। আবার স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে দান-সদাকা করলে তা সঠিক হবে কি না সে প্রশ্নও ছিল। তাই হযরত যায়নাব রাযি. এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলেন। হাদীসে আছে হযরত যায়নাব রাযি. হযরত বিলাল রাযি.কে অনুরোধ করলেন যেন তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন যে, তারা যদি তাদের স্বামীদেরকে এবং তাদের প্রতিপালনের অধীনে যে ইয়াতীমগণ আছে তাদেরকে দান-সদাকা করে, তবে তা সঠিক হবে কি না। হযরত বিলাল রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বিষয়টি উল্লেখ করলেন। হাদীসে আছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জিজ্ঞাসার জবাবে বললেন, এটা করলে তারা দ্বিগুণ ছাওয়াব পাবে। এক তো সদাকা করার ছাওয়াব, দ্বিতীয়ত আত্মীয়ের সহযোগিতা করার ছাওয়াব।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দান-সদাকা করার উৎসাহ লাভ হয়।

খ. এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় স্ত্রী তার স্বামীকে দান-সদাকা করতে পারে এবং তাতে দ্বিগুণ ছাওয়াব পাওয়া যায়।

গ. হাদীছটি দ্বারা আরও জানা যায় যে, মহিলাদের জন্য পৃথকভাবে ওয়াজ-নসীহতের ব্যবস্থা থাকা চাই।

ঘ. সরকারি ব্যবস্থাপনায় পুরুষ-নারী সকলের জন্যই আদেশ-উপদেশদানের কার্যক্রম চালু থাকা উচিত।

ঙ. দীনী কোনও বিষয়ে মনে খটকা জাগলে উলামায়ে কেরামের কাছে জিজ্ঞেস করে তার সমাধান নেওয়া চাই।

৯৩, বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩০৮৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৮০৬০

৯৪. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৪৭
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
ত্বহাবী শরীফ - হাদীস নং ৩০২৫ | মুসলিম বাংলা