শরহু মাআ’নিল আছার- ইমাম ত্বহাবী রহঃ

৪. যাকাতের অধ্যায়

হাদীস নং: ৩০২৪
সুস্থ-সবল দরিদ্র ব্যক্তির জন্য সাদাকা হালাল কি-না।
৩০২৪। ইবন আবী দাউদ (রাহঃ) …… আব্দুল্লাহ ইবনুস সা'দী (রাহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি একবার উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিঃ)-এর খিলাফত যুগে তাঁর নিকট এলেন। উমর (রাযিঃ) তাকে বললেন, আমি কি বর্ণনা করব না ? তুমি নিশ্চয় লোকদের কাজের দায়িত্বশীল হয়েছ, তোমাকে যখন কাজের বিনিময় প্রদান করা হয় তুমি তা অপছন্দ কর। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি অপছন্দ করি। উমর (রাযিঃ) বললেন, এতে তোমার কি উদ্দেশ ? (এমনটি কেন কর ?)। আমি বললাম, আমার নিকট অনেক ঘোড়া ও গোলাম বিদ্যমান আছে এবং আমি নিজে ব্যবসাও করি। আমি চাচ্ছি আমার বিনিময় (বেতন-ভাতা) মুসলমানদের জন্য সাদাকা হয়ে যাক। এতে উমর (রাযিঃ) বললেন, তুমি এমনটি করবে না। (বরং নিয়ে নাও)। তুমি যা চাচ্ছ আমিও তা চেয়ে ছিলাম। নবী করীম (ﷺ) আমাকে বিনিময় (ভাতা) দিচ্ছিলেন, আমি (এতে) বলছিলাম, আমার চাইতে যে ব্যক্তি অধিক অভাবগ্রস্ত তাকে তা দান করুন। তারপর একবার তিনি আমাকে কিছু সম্পদ দান করলেন, আমি তাঁকে সে কথাই বললাম । নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ ওটি নিয়ে নাও এবং নিজ মালিকানার অন্তর্ভুক্ত করে নাও। সুতরাং এরূপ সম্পদ থেকে যা তোমার কাছে আসবে অথচ তুমি তা প্রত্যাশা করনি এবং যাচনাও করনি, তাহলে তা নিয়ে নেবে। আর যা এরূপভাবে না আসে, তার পিছনে ছুটবে না।
তাহাবী (রাহঃ) বলেনঃ এই হাদীসেও যাচনা করা নিষিদ্ধ হওয়ার কথা ব্যক্ত হয়েছে।
তাকে বলা হবে যে, এটি সাদাকা এর সম্পদ ছিল না, বরং তা ছিলো সেই সমস্ত সম্পদ, যা ইমাম (রাষ্ট্র প্রধান) লোকদের জন্য বন্টন করতেন। তা ধনী-দরিদ্র (সকলের জন্য) বন্টন করতেন। যেমনিভাবে উমর (রাযিঃ) যখন দফতরসমূহ লিপিবদ্ধ করেছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সাহাবীগণের জন্য ভাগ নির্ধারণ করেছেন তিনি ধনী-দরিদ্র সকলের জন্য তা নির্ধারণ করেছেন। উক্ত সম্পদসমূহ যা লোকদেরকে দিয়েছিলেন তা দারিদ্র্যের কারণে দেননি, বরং তাতে তাদের অধিকার থাকার কারণে দিয়েছিলেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) উমর (রাযিঃ)-এর জন্য যখন তাঁকে তা থেকে দান করেছিলেন তাঁর সেই উক্তিকে অপছন্দ করেছেন, যাতে তিনি বলেছিলেনঃ “আমার চাইতে যে ব্যক্তি অধিক অভাবগ্রস্ত তাকে তা দান করুন।” অর্থাৎ আমি তোমাকে তা এই জন্য দিচ্ছি না যে তুমি অভাবগ্রস্ত, বরং আমি তোমাকে তা অন্য কারণে দিয়েছি । তারপর তিনি তাঁকে বলেছেনঃ তুমি তা নিয়ে নাও এবং তা তোমার মালিকানার অন্তর্ভুক্ত করে নাও। এতেও প্রমাণিত হয় যে, তা সাদাকার সম্পদ থেকে ছিল না। যেহেতু ফকীরের জন্য সাদাকা থেকে এরূপ বস্তু নেয়া উচিত নয়, যা সম্পদ হিসাবে গ্রহণ করা হয়, তার সওয়াল দ্বারা হোক বা সওয়াল ব্যতীত। তারপর তিনি বলেছেনঃ “সুতরাং এরূপ সম্পদ থেকে যা তোমার কাছে আসবে” যার হুকুম এটি। “অথচ তুমি তার 'মুশরিফ' অর্থাৎ প্রত্যাশাকারী ছিলে না” অর্থাৎ তা তুমি প্রত্যাশা ব্যতীত গ্রহণ করছ। আর 'ইশরাফ' বলা হয় “যা থেকে তোমাকে নিষেধ করা হয়েছে তার ইচ্ছা পোষণ করা।” আবার তাঁর উক্তি- ولا مشرف -এর মধ্যে এ সম্ভাবনাও আছে যে, তুমি মুসলমানদের সম্পদ থেকে প্রাপ্য অপেক্ষা অধিক গ্রহণ করবে না তাহলে তা হবে তাতে লোভ করা। তা থেকে এমন কিছু যাচনা করনি, যা তোমার প্রাপ্য নয়। আমাদের মতে এটিই হচ্ছে এই অনুচ্ছেদের সঠিক বিশ্লেষণ। আল্লাহ্ উত্তম জ্ঞাত আছেন। পক্ষান্তরে সাদাকার সম্পদ সম্পর্কে যে সমস্ত হাদীস এসেছে তার অর্থাবলী আমরা এই অনুচ্ছেদের শুরু ভাগে উল্লেখ করে এসেছি।
3024 - وَهُوَ مَا حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي دَاوُدَ , قَالَ: ثنا أَبُو الْيَمَانِ , قَالَ: أنا شُعَيْبٌ , عَنِ الزُّهْرِيِّ , قَالَ: ثنا السَّائِبُ بْنُ يَزِيدَ أَنْ حُوَيْطِبَ بْنَ عَبْدِ الْعُزَّى أَخْبَرَهُ أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ السَّعْدِيِّ أَخْبَرَهُ أَنَّهُ قَدِمَ عَلَى عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فِي خِلَافَتِهِ , فَقَالَ لَهُ عُمَرُ: أَلَمْ أُحَدَّثْ أَنَّكَ تَلِي مِنْ أَعْمَالِ النَّاسِ أَعْمَالًا , فَإِذَا أُعْطِيتَ الْعُمَالَةَ كَرِهْتَهَا فَقَالَ: نَعَمْ. فَقَالَ عُمَرُ: فَمَا تُرِيدُ إِلَى ذَلِكَ؟ قُلْتُ: إِنَّ لِي أَفْرَاسًا وَأَعْبُدًا وَأَنَا أَتَّجِرُ , وَأُرِيدُ أَنْ يَكُونَ عُمَالَتِي صَدَقَةً عَلَى الْمُسْلِمِينَ. فَقَالَ عُمَرُ: فَلَا تَفْعَلْ , فَإِنِّي قَدْ كُنْتُ أَرَدْتُ الَّذِي أَرَدْتَ , وَقَدْ " كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعْطِينِي الْعَطَاءَ فَأَقُولُ: أَعْطِهِ مَنْ هُوَ أَفْقَرُ إِلَيْهِ مِنِّي , حَتَّى أَعْطَانِي مَرَّةً مَالًا، فَقُلْتُ لَهُ ذَلِكَ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «خُذْهُ فَتَمَوَّلْهُ فَمَا جَاءَكَ مِنْ هَذَا الْمَالِ , وَأَنْتَ غَيْرُ مُشْرِفٍ , وَلَا سَائِلٍ , فَخُذْهُ , وَمَا لَا فَلَا تُتْبِعْهُ نَفْسَكَ» . قَالَ: فَفِي هَذَا الْحَدِيثِ تَحْرِيمُ الْمَسْأَلَةِ أَيْضًا. قِيلَ لَهُ: لَيْسَ هَذَا عَلَى أَمْوَالِ الصَّدَقَاتِ , إِنَّمَا هَذَا عَلَى الْأَمْوَالِ الَّتِي يَقْسِمُهَا الْإِمَامُ عَلَى النَّاسِ , فَيَقْسِمُهَا عَلَى أَغْنِيَائِهِمْ وَفُقَرَائِهِمْ. كَمَا فَرَضَ عُمَرُ لِأَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِينَ دَوَّنَ الدَّوَاوِينَ , فَفَرَضَ لِلْأَغْنِيَاءِ مِنْهُمْ وَلِلْفُقَرَاءِ , فَكَانَتْ تِلْكَ الْأَمْوَالُ يُعْطَاهَا النَّاسُ , لَا مِنْ جِهَةِ الْفَقْرِ , وَلَكِنْ لِحُقُوقِهِمْ فِيهَا. فَكَرِهَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِعُمَرَ , حِينَ أَعْطَاهُ الَّذِي كَانَ أَعْطَاهُ مِنْهَا قَوْلُهُ: «أَعْطِهِ مَنْ هُوَ أَفْقَرُ إِلَيْهِ مِنِّي» . أَيْ: إِنِّي لَمْ أُعْطِكَ ذَلِكَ لِأَنَّكَ فَقِيرٌ , إِنَّمَا أَعْطَيْتُكَ ذَلِكَ لِمَعْنًى آخَرَ غَيْرِ الْفَقْرِ. ثُمَّ قَالَ لَهُ خُذْهُ , فَتَمَوَّلْهُ فَدَلَّ ذَلِكَ أَيْضًا أَنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَمْوَالِ الصَّدَقَاتِ , لِأَنَّ الْفَقِيرَ لَا يَنْبَغِي لَهُ أَنْ يَأْخُذَ مِنَ الصَّدَقَاتِ مَا يَتَّخِذُهُ مَالًا , كَانَ ذَلِكَ عَنْ مَسْأَلَةٍ مِنْهُ أَوْ عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ. ثُمَّ قَالَ: " فَمَا جَاءَكَ مِنْ هَذَا الْمَالِ الَّذِي هَذَا حُكْمُهُ , وَأَنْتَ غَيْرُ مُشْرِفٍ , أَيْ تَأْخُذُهُ بِغَيْرِ إِشْرَافٍ. وَالْإِشْرَافُ: أَنْ تُرِيدَ بِهِ مَا قَدْ نُهِيتَ عَنْهُ. وَقَدْ يَحْتَمِلُ قَوْلُهُ وَلَا مُشْرِفٍ أَيْ: وَلَا تَأْخُذْ مِنْ أَمْوَالِ الْمُسْلِمِينَ أَكْثَرَ مِمَّا يَجِبُ لَكَ فِيهَا , فَيَكُونُ ذَلِكَ شَرَفًا فِيهَا وَلَا سَائِلٍ أَيْ: وَلَا سَائِلٍ مِنْهَا مَا لَا يَجِبُ لَكَ. فَهَذَا وَجْهُ هَذَا الْبَابِ، عِنْدَنَا، وَاللهُ أَعْلَمُ. فَأَمَّا مَا جَاءَ فِي أَمْوَالِ الصَّدَقَاتِ , فَقَدْ أَتَيْنَا بِمَعَانِي ذَلِكَ , فِيمَا تَقَدَّمَ ذِكْرُهُ , مِنْ هَذَا الْبَابِ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত উমর রাযি. বলেন- (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে কিছু দান করতে চাইলে আমি বলি)। এখানে (দান) দ্বারা গনীমতের অংশ বোঝানো হয়েছে। ইমাম তহাবী রহ. বলেন, এ হাদীছে যে দানের কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা সদাকা-যাকাত বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং ইমাম (সরকার) ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল মুসলিমের মধ্যে যা বণ্টন করে থাকে, সেই অর্থ-সম্পদ বোঝানো হয়েছে। কাজেই এ দেওয়াটা দারিদ্র্যের কারণে নয়; বরং হক ও প্রাপ্য হিসেবে ছিল।

أَعْطِهِ مَنْ هُوَ أَفْقَرُ إِلَيْهِ مِنيْ (এটা আমার চেয়ে যার বেশি প্রয়োজন তাকে দিন)। হযরত উমর রাযি. এ কথা বলেছিলেন এ কারণে যে, তাঁর জানা ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার প্রতি লোভ করতে নিষেধ করেন। তিনি অর্থ-সম্পদ বাড়ানোর ফিকিরে পড়াটা পসন্দ করেন না। আর তাঁর নিজের যা আছে তাতে তাঁর চলে যায়। কাজেই এ অবস্থায় শুধু শুধু বাড়তি সম্পদ গ্রহণ করা কেন? কিন্তু তাঁর এ প্রত্যাখ্যান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পসন্দ করেননি। কেননা তিনি তো তা তাঁর দারিদ্র্য বিবেচনায় দিতে চাননি কিংবা তাঁর চাওয়ার কারণেও নয়; বরং তাঁর হক ও অধিকার হিসেবে দিতে চেয়েছিলেন। সুতরাং তিনি বললেন-
خُذْهُ إِذَا جَاءَكَ مِنْ هذَا الْمَالِ شَيْء وَأَنْتَ غَيْرُ مُشْرِفٍ وَلَا سَائِل، فَخُذْهُ فَتَمَوَّلْهُ (তুমি এটা গ্রহণ করো। এই সম্পদ থেকে কোনওকিছু যদি তোমার কাছে এ অবস্থায় আসে যে, তুমি তার আকাঙ্ক্ষাকারীও নও এবং প্রার্থনাকারীও নও, তবে তা গ্রহণ করো এবং তাকে নিজ সম্পদ বানিয়ে নাও)। এ আদেশ পরামর্শমূলক, বাধ্যতামূলক নয়। বোঝা গেল বিনা চাওয়ায় বা মনের আগ্রহ ছাড়া যদি কারও পক্ষ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু আসে, তবে তা গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক নয়। চাইলে গ্রহণ করতেও পারে, নাও করতে পারে। তবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু গ্রহণ করতে বলেছেন, তাই গ্রহণ করাটাই উত্তম, তাতে দাতা যেমনই হোক। দাতা সাধারণ ব্যক্তি হোক, শাসক হোক, ন্যায়পরায়ণ হোক, ফাসেক হোক, সর্বাবস্থায় তার দেওয়া হাদিয়া গ্রহণ করা জায়েয। যদি তা হারাম বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত বলে জানা না থাকে, তবে গ্রহণ করাই উত্তম। কেননা নিজের বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে তা দ্বারা দান-সদাকা করে পুণ্যার্জনের সুযোগ হয়। হযরত আয়েয ইবনে আমর আল মুযানী রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ عُرِضَ عَلَيْهِ شَيْءٌ مِنْ هَذَا الرِّزْقِ مِنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ، وَلَا إِشْرَافِ نَفْسٍ فَلْيُوَسِّعْ لَهُ فِي رِزْقِهِ، فَإِنْ كَانَ بِهِ عَنْهُ غِنًى فَلْيُوَجِّهْهُ إِلَى مَنْ هُوَ أَحْوَجُ إِلَيْهِ مِنْهُ
চাওয়া ও লোভ ব্যতিরেকে যদি এ রিযিকের কিছু কারও সামনে পেশ করা হয়, তবে সে যেন তা গ্রহণ করে নিজ জীবিকায় সচ্ছলতা আনে। যদি তার প্রয়োজন না পড়ে, তবে যেন তার চেয়ে যে ব্যক্তি বেশি অভাবগ্রস্ত তার কাছে পাঠিয়ে দেয়।(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩২৭৬)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْهَدِيَّةُ رِزْقٌ مِنْ رِزْقِ اللهِ ، فَمَنْ أهْدِيَ لَهُ شَيْءٌ فَلْيَقْبَلْهُ، لَا يَرُدُّهُ، وَلْيُكَافِى عَلَيْهِ
‘হাদিয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযিক। কাজেই কাউকে কোনও জিনিস হাদিয়া দেওয়া হলে সে যেন তা গ্রহণ করে এবং ফেরত না দেয়। তারপর হাদিয়াদাতাকে যেন তার কোনও বিনিময় দেয়।( ইবন আব্দুল বার, আল-ইসতিযকার ৪১৬৯৪)

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বলেন, যে-কেউ আমাকে হাদিয়া দেয়, আমি তা গ্রহণ করে নিই। তবে আমি কারও কাছে চাওয়া পসন্দ করি না। হযরত আবুদ দারদা রাযি. থেকেও অনুরূপ বর্ণিত আছে। হযরত মু'আবিয়া রাযি. উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর কাছে মাঝেমধ্যেই হাদিয়া পাঠাতেন। তিনি তা গ্রহণও করতেন। হযরত মু'আবিয়া রাযি. একবার হযরত হুসায়ন রাযি.-এর কাছে চার হাজার দিরহাম হাদিয়া পাঠান। তিনি তা গ্রহণ করে নেন। মুখতার ছাকাফী একজন জালেম শাসনকর্তা ছিল। তা সত্ত্বেও তার পাঠানো হাদিয়া হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. গ্রহণ করতেন। ইমাম মুহাম্মাদ ইবন আলী আল-বাকির রহ.-কে শাসকদের পাঠানো হাদিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, যদি জানা থাকে তা জবরদখল করা বা হারাম মাল, তবে তা গ্রহণ করো না। আর সেরকম কিছু জানা না থাকলে গ্রহণ করো।

শাসক যদি জালেম হয় এবং জনগণ থেকে অর্থ-সম্পদ গ্রহণে বৈধ-অবৈধের বাছ-বিচার না করে, তবে তার দেওয়া হাদিয়া গ্রহণ না করাই শ্রেয়। আমাদের পূর্বসুরী তাবি'ঈন, তাবে-তাবি'ঈন ও তাদের পরবর্তীকালের বুযুর্গানে দীনের অনেকেই এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতেন। ইমাম মুহাম্মাদ ইবন সীরীন রহ., মাসরূক রহ., আবু রাযীন রহ., সুফয়ান ছাওরী রহ., আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ., ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. প্রমুখ মহান ব্যক্তিবর্গ সরকারি উপহার-উপঢৌকন গ্রহণ করা হতে বিরত থাকতেন।

فَخُذْهُ فَتَمَوَّلُهُ (তবে তা গ্রহণ করো এবং তাকে নিজ সম্পদ বানিয়ে নাও)। তারপর তোমার এখতিয়ার। তুমি চাইলে তা নিজ প্রয়োজনেও ব্যয় করতে পার, চাইলে দান-খয়রাতও করতে পার। যেমন হাদীসে আছে- فَإِنْ شِئْتَ كُلْهُ، وَإِنْ شِئْتَ تَصَدَّقْ بِهِ (তারপর চাইলে তুমি তা খাও এবং চাইলে দান করে দাও)। এই বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উমর রাযি.-কে অধিকতর ছাওয়াব হাসিলের উপায় বাতলে দিলেন। কেননা হযরত উমর রাযি. তাঁকে দেওয়া সম্পদ গ্রহণ না করার যে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন কিংবা নিজের উপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার যে মানসিকতা প্রকাশ করেছিলেন তাও নেকীর কাজ ছিল বটে, কিন্তু সম্পদ নিজ মালিকানায় নিয়ে তা দান-সদাকা করা অধিকতর পুণ্যের কাজ। কারণ কোনও সম্পদের মালিক হওয়ার পর তাতে এক রকম মায়া-মমতা জন্ম নেয়। এ অবস্থায় তা দান করতে গেলে মনের উপর বেশ চাপ পড়ে। নফসকে দমন করেই তা দান করা সম্ভব হয়। এ কারণে তাতে ছাওয়াবও বেশি হয়।

এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে হালাল অর্থ-সম্পদ গ্রহণ না করা অপেক্ষা সুবন্দোবস্ত করা ও দান-খয়রাতের লক্ষ্যে তা গ্রহণ করাটাই উত্তম।

وَما لَا، فلا تُتْبِعْهُ نَفْسَكَ (আর যা এরূপ নয়, তুমি নিজেকে তার অনুগামী বানিয়ো না)। অর্থাৎ যা তোমার চাওয়ার দ্বারা আসে কিংবা যার প্রতি তোমার লোভ থাকে, তা গ্রহণ করো না)। কেননা তাতে বরকত থাকে না। কারও কাছে কিছু চাইলে ও অনেক সময় ভয়ে বা লজ্জায় পড়ে দিয়ে থাকে, খুশিমনে দেয় না। অন্যের মাল ততক্ষন পর্যন্ত পুরোপুরি হালাল হয় না, যতক্ষণ না সে তা খুশিমনে দেয়। এমনিভাবে যে মালের প্রতি লোভ থাকে, তার জন্য অপেক্ষা করা হয় এবং তাতে নফস যুক্ত হয়। এটাও বরকতের পক্ষে বাধা। তাই এরূপ মাল থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অর্থ-সম্পদ আল্লাহ তা'আলার নি'আমত। তার মূল্যায়ন করা চাই।

খ. হাদিয়া গ্রহণ করা উত্তম, যদি তা হারাম উপায়ে অর্জিত বলে জানা না থাকে।

গ. নিতান্ত ঠেকা না হলে কারও কাছে কিছু চাইতে নেই।

ঘ. সম্পদের প্রতি লোভ করতে নেই। বিশেষত অন্যের মালিকানাধীন সম্পদে।

ঙ. সদুদ্দেশ্যে অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় করা জায়েয।

চ. যদি দান-খয়রাতের নিয়ত থাকে, তবে সম্পদ গ্রহণ করাটা গ্রহণ না করা অপেক্ষা উত্তম।

ছ. দীনদার মান্যগণ্য ব্যক্তির দেওয়া হাদিয়া প্রত্যাখ্যান না করা আদবের দাবি।

জ. নিজ স্বার্থের উপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য।

ঝ. অধীন ও সম্পৃক্তজনদের কল্যাণকর কাজের পরামর্শ দেওয়া চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
ত্বহাবী শরীফ - হাদীস নং ৩০২৪ | মুসলিম বাংলা