আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫১- কুরআনের তাফসীর অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৪৭২৯
২৪৫২. আল্লাহ তাআলার বাণীঃ তারা এমন যারা অস্বীকার করে নিজেদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী এবং তার সাথে তাদের সাক্ষাতের বিষয়। ফলে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়।
৪৩৭৪। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, কিয়ামতের দিন একজন খুব মোটা ব্যক্তি আসবে। কিন্তু সে আল্লাহর নিকট মশার ডানার চেয়েও ক্ষুদ্র হবে। তারপর তিনি বলেন, পাঠ করো, ‘কিয়ামতের দিন তাদের কাজের কোন গুরুত্ব রাখব না।[১] ইয়াহিয়াহ ইবনে বুকায়র (রাহঃ) ......... আবু যিনাদ থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণিত আছে।

[১] পুণ্য মনে করে তারা যে সকল কর্ম করেছে, তাদের কোন ওযন থাকবে না। অর্থাৎ সেগুলো কোন কাজে আসবে না।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে যে মোটাতাজা ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে তার ওজন একটা মশার ডানা বরাবর হবে না, কেউ কেউ এর আক্ষরিক অর্থই গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ আখেরাতে ব্যক্তিকেও ওজন দেওয়া হবে। এটাও অসম্ভব নয়। এক হাদীছ দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত আছে-

أمر النبي صلى الله عليه وسلم عبد الله بن مسعود أن يصعد شجرة فيأتيه منها بشيء، فنظر أصحابه إلى ساق عبد الله فضحكوا من حموشة ساقيه، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ما تضحكون؟ لرجل عبد الله أثقل في الميزان من أحد

'নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি.-কে একটি গাছে চড়ে তা থেকে কিছু আনার হুকুম দিলেন। তাঁর সঙ্গীগণ তাঁর পায়ের গোছার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলেন। কারণ তাঁর পায়ের গোছা ছিল খুব চিকন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা হাসছ কেন? মীযানে আব্দুল্লাহর পা উহুদ পাহাড়ের চেয়েও বেশি ভারী হবে।২৫৫
তবে কুরআন-হাদীছের সাধারণ ভাষ্য এটাই যে, কিয়ামতে ওজন করা হবে বান্দার আমল। কাজেই হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি.-এর 'পায়ের ওজন' বলে তিনি তাঁর পায়ের ব্যবহার দ্বারা যে সৎকর্মসমূহ করেছেন তার ওজন বোঝানো উদ্দেশ্য। যেমন হিজরত করা, জিহাদে যাওয়া, রোগী দেখতে যাওয়া, কোনও মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাওয়া ইত্যাদি। এ হিসেবে আলোচ্য হাদীছে যে মোটাতাজা ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে 'তার ওজন মশার ডানা বরাবরও হবে না', এর অর্থ হবে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তি কোনও গুরুত্ব ও মর্যাদা পাবে না। বলা হয়ে থাকে, তার কোনও ওজন নেই। এর মানে তার কোনও গুরুত্ব ও মর্যাদা নেই। সব ভাষায়ই এরকম ব্যবহার আছে।
তবে এ হাদীছে ওজন দ্বারা ব্যক্তির গায়ের ওজন বোঝানো হোক বা তার মর্যাদা বোঝানো হোক, উভয় অবস্থায়ই হাদীছটি দ্বারা স্থূলতার নিন্দা বোঝা যায়। অর্থাৎ ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে শরীর মোটাতাজা করা কিছু ভালো কাজ নয়। আখেরাতে আল্লাহ তাআলার কাছে শরীর মোটা হওয়া বা চেহারা-সুরত সুন্দর হওয়ার দ্বারা কোনও গুরুত্ব পাওয়া যাবে না। সেদিন মর্যাদা ও গুরুত্ব লাভ হবে কেবলই আমল দ্বারা। আমল যার মন্দ হবে এবং যার অন্তর ঈমান ও হিদায়াত থেকে বঞ্চিত থাকবে, তার গতি হবে জাহান্নাম। এরূপ লোক সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا “আমি কিয়ামতের দিন তাদের কোনও ওজন গণ্য করব না।২৫৬
অর্থাৎ যারা কাফের তাদের যেহেতু ঈমান নেই আর ঈমান ছাড়া কোনও সৎকর্ম গ্রহণযোগ্য নয়, তাই কিয়ামতে তাদের এমন কোনও সৎকর্ম থাকবে না, যা ওজন করা যাবে। তার যা থাকবে তা কেবলই পাপ ও অসৎকর্ম। অসৎকাজের প্রতিদান জাহান্নামের আযাব। সুতরাং তাদের শেষ গন্তব্য জাহান্নাম।
এমন বহু অমুসলিম আছে, বাহ্যদৃষ্টিতে তারা অনেক বড় বড় সৎকর্ম করে থাকে। তা যত বড়ই সৎকর্ম করুক না কেন, আখেরাতে তাদের জন্য কোনও পুরস্কার নেই। হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি. বলেন, তিহামার পর্বতশ্রেণীর মত বড় বড় আমল উপস্থিত করা হবে, কিন্তু তার কোনও ওজন থাকবে না। বস্তুত আমলের ওজন হয় ঈমান ও ইখলাসের দ্বারা। তাই প্রত্যেকের এদিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত। কেবল দেহপালন এবং সেজন্য ভালো খাবার, ভালো থাকা ও ভালো পোশাকের পেছনে পড়ে থাকা উচিত নয়। যে শরীর ঈমান ও সৎ আমল দ্বারা সজ্জিত নয়, আখেরাতে সে শরীর বিপদই বয়ে আনবে। আজ আমাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুই হয়ে গেছে শরীর। আমাদের যাবতীয় চিন্তা-ফিকির ও চেষ্টা-মেহনত শরীরকেন্দ্রিক, যা কিনা মুমিনদের নয়; বরং কাফেরদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَالَّذِينَ كَفَرُوا يَتَمَتَّعُونَ وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَهُمْ

আর যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তারা (দুনিয়ায়) মজা লুটছে এবং চতুষ্পদ জন্তু যেভাবে খায়, সেভাবে খাচ্ছে। তাদের শেষ ঠিকানা জাহান্নাম।২৫৭
মুমিন ব্যক্তিও যদি তাদের মত হয়ে যায়, তার যাবতীয় কাজকর্ম হয় ভোগ বিলাসিতার জন্য এবং তার সবটা সময় ব্যয় হয় ফুর্তি করা ও মজা লোটার আয়োজনে, তবে কোথায় গেল ঈমানের দাবি? কোথায় ইসলামী দায়িত্ব-কর্তব্য পালন? যার লক্ষ্যবস্তু নানা পদ ও নানা বর্ণের পানাহার, দিন দিন তার লোভ-লালসা বেড়েই চলে। বাড়তে থাকে তার অলসতা ও আখেরাতবিমুখতা। এরূপ ব্যক্তির রাত কাটে ঘুমে আর দিন কাটে বিভ্রান্তিকর ধান্ধাবাজিতে। এই যার অবস্থা, কিভাবে তার আখেরাতে মুক্তির আশা থাকে?
আখেরাতের মুক্তি নির্ভর করে ঈমান নিয়ে মৃত্যুর উপর। ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুর জন্য দরকার আমৃত্যু ঈমানী সাধনা তথা সৎকর্মের প্রতিযোগিতা। শরীরের সাধনায় লিপ্ত থেকে সে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। সে কারণেই এ হাদীছসহ আরও বহু হাদীছে মোটাতাজা শরীরের নিন্দা করা হয়েছে। মোটাতাজা দ্বারা কেবল বাহ্যিক স্থূলতাই বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং বোঝানো উদ্দেশ্য এমন শরীর, যা হয়ে যায় যাবতীয় ধ্যান-জ্ঞান ও সাধনার লক্ষ্যবস্তু।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছটির শিক্ষা হচ্ছে, কোনও মুমিনের উচিত নয় শরীর মোটাতাজা করা তথা শরীরকে সাধনার লক্ষ্যবস্তু বানানো; বরং তার কর্তব্য রূহের পরিপুষ্টিতে মনোযোগ দেওয়া অর্থাৎ অন্তরে ঈমান ও ইখলাস পরিপক্ক করে তোলার চেষ্টা করা, যা দ্বারা আমলে ওজন পয়দা হয়।

২৫৫. আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ২৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯২০; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ৩২২৩২; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮৫১৬; মুসনাদে আবূ ইয়ালা, হাদীছ নং ৫৩৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭০৬৯

২৫৬. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ১০৫

২৫৭. সূরা মুহাম্মাদ (৪৭), আয়াত ১২
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন