আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৫১- কুরআনের তাফসীর অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৪৬৪২
২৩৮৩. আল্লাহর বাণীঃ তুমি ক্ষমাপরায়নতা অবলম্বন কর, সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং অজ্ঞদেরকে উপেক্ষা কর (৭ঃ ১৯৯)
৪২৮৭। আবুল ইয়ামান (রাহঃ) ......... ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, উয়াইনা ইবনে হিসন ইবনে হুযাইফা এসে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র হুর ইবনে কায়সের কাছে অবস্থান করলেন। উমর (রাযিঃ) যাদেরকে পার্শ্বে রাখতেন হুর হলেন তাদের মধ্যে একজন। কারীবৃন্দ, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই উমর ফারূক (রাযিঃ) এর মজলিসের সদস্য এবং উপদেষ্টা ছিলেন। এরপর উয়াইনা তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে ডেকে বললেন, এই আমীরের কাছে তো তোমার একটা মর্যাদা আছে, সুতরাং তুমি আমার জন্য তাঁর কাছে প্রবেশের একটা অনুমতি নিয়ে দাও। তিনি বললেন হ্যাঁ, তাঁর কাছে আমি আপনার প্রবেশের প্রার্থনা করব।
ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, এরপর হুর অনুমতি প্রার্থনা করলেন ‘উয়াইনার জন্য এবং উমর (রাযিঃ) অনুমতি দিলেন। উয়াইনা উমরের কাছে গিয়ে বললেন, হ্যাঁ আপনি তো আমাদেরকে বেশী বেশী দানও করেন না এবং আমাদের মাঝে ন্যায় বিচারও করেন না। উমর (রাযিঃ) ক্রোধান্বিত হলেন এবং তাকে কিছু একটা করাতে উদ্যত হলেন। তখন হুর বললেন, আমিরুল মু’মিনীন! আল্লাহ তাআলা তো তাঁর নবী (ﷺ) কে বলেছেন, ‘‘ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর’ সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং অজ্ঞদেরকে উপেক্ষা কর’’ আর এই ব্যক্তি তো নিঃসন্দেহে অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত। (হুর যখন তাঁর নিকট এটা তিলাওয়াত করলেন তখন) আল্লাহর কসম তখন উমর (রাযিঃ) আয়াতের অমান্য করেননি। উমর আল্লাহর কিতাবের বিধানের সামনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতেন, অর্থাৎ তা অতিক্রম করতেন না।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ বর্ণনায় হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর সঙ্গে ‘উয়ায়না ইবন হিসনের আচরণ, তার প্রতি উমর রাযি.-এর রেগে যাওয়া এবং তাতে হুর ইবন কায়স রাযি.-এর মধ্যস্থতা করার কথা আছে। সুতরাং প্রথমে 'উয়ায়না ইবন হিসন ও হুর ইবন কায়স রাযি.-এর পরিচয় জেনে নেওয়া দরকার।

‘উয়ায়না ইবন হিসন :
'উয়ায়না ইবন হিসন বনূ ফাযারা গোত্রের লোক। তিনি এ গোত্রের একজন নেতা ছিলেন। তার উপনাম আবূ মালিক। মক্কাবিজয়ের আগে ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কাবিজয় ও হুনায়নের যুদ্ধে শরীক ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর তিনি মুরতাদ হয়ে যান। এক বর্ণনা অনুযায়ী মুরতাদ হওয়ার কারণে হযরত 'উমর ফারূক রাযি. তাকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু অপর এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, হযরত উছমান রাযি.-এর জমানায়ও তিনি জীবিত ছিলেন। ইবন হাজার আসকালানী রহ. বলেন, সম্ভবত তাকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার পর খুব শীঘ্র তাওবা করেন এবং পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
যাহোক ‘উয়ায়নার গোত্র মরুভূমি এলাকায় বসবাস করতেন। মরুবাসীদের স্বভাবগত রুক্ষতা ও কঠোরতা তার চরিত্রেও ছিল, যে কারণে মাঝেমধ্যে তিনি এমনসব আচরণ করতেন, যা ইসলামী আদব-কায়দার সাথে খাপ খায় না। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেও তার মনে ইসলামের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা পুরোপুরি দানা বাঁধেনি, যে কারণে তাকে ‘মুআল্লাফাতুল-কুলূব’-এর মধ্যে গণ্য করা হতো। মুআল্লাফাতুল-কুলূব বলা হয় ওই সমস্ত নওমুসলিমদেরকে, ইসলামের প্রতি পুরোপুরি আকৃষ্ট করার জন্য যাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করা হতো।

হুর্র ইবন কায়স রাযি.
হযরত হুর্র ইবন কায়স রাযি. বনূ ফাযারা গোত্রের লোক এবং উয়ায়না ইবন হিসনের ভাতিজা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক যুদ্ধ থেকে মদীনায় ফিরে আসলে বনূ ফাযারার দশ-বারোজন লোকের একটি প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তাদের মধ্যে হুর্র ইবন কায়স রাযি.-ও ছিলেন। তিনি ছিলেন সকলের ছোট।
তিনি একজন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ সাহাবী ছিলেন। কুরআন মাজীদের প্রচুর ইলম হাসিল করেছিলেন, যে কারণে তিনি কারী ও আলেম নামে অভিহিত হয়েছিলেন।
এ বর্ণনায় যেমনটা দেখা যায় হযরত উমর ফারূক রাযি, তাঁকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন এবং তরুণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নিজ পরামর্শসভার একজন সদস্য করে নিয়েছিলেন।
কৌতূহলের বিষয় হলো, হুর্র রাযি.-এর একজন পুত্র ছিল শী‘আ, তাঁর এক কন্যা ছিল খারিজী, তাঁর স্ত্রী ছিল মু'তাযিলা এবং তাঁর এক বোন ছিল মুরজিয়া (যে সম্প্রদায়ের মতে অন্তরের ঈমানই যথেষ্ট, আমলের কোনও মূল্য নেই)। এ কারণে হযরত হুর্র রাযি. তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আমার ও তোমাদের অবস্থা হলো এরকম, যেমনটা কুরআন মাজীদে আছে-كُنَّا طَرَائِقَ قِدَدًا (আর আমরা বিভিন্ন পথের অনুসারী ছিলাম)২১৯ ।

হাদীছটির ব্যাখ্যা
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর সভাষদবর্গ সম্পর্কে বলেন-

وَكَانَ الْقُرَّاءُ أَصْحَابَ مَجْلِسِ عُمَرَ وَمُشَاوَرَتِهِ، كُهُولًا كَانُوا أَوْ شُبَّانًا

(কুরআন মাজীদে বেশি অভিজ্ঞজনরাই ছিল উমর রাযি.-এর সভাষদ ও পরামর্শক, তাতে তারা প্রবীণ হোক বা যুবক)। হযরত উমর ফারূক রাযি. সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যারা বিশিষ্ট আলেম ছিলেন তাদেরকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। বড় বড় পদেও তাদেরকেই নিয়োগ দান করতেন। বিশেষত তাঁর পরামর্শসভার সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইলমী যোগ্যতাকেই বিশেষভাবে বিবেচনা করতেন। এ কারণেই কোনও কোনও যুবক সাহাবীও তাঁর পরামর্শসভার সদস্য হতে পেরেছিলেন। আবার সুযোগ্য আলেম না হওয়ায় অনেক প্রবীণকেও এ পদে মনোনীত করা হয়নি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. নিজেও একজন তরুণ সাহাবী হওয়া সত্ত্বেও এ সম্মান লাভ করতে পেরেছিলেন। কারও কারও পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আপত্তি উঠলে খলীফা উমর রাযি. সকলের সামনে তাঁর ইলমী দক্ষতা প্রমাণ করিয়ে দেখিয়েছিলেন। এর দ্বারা খলীফার দৃষ্টিতে উলামার গুরুত্ব ও মর্যাদা কত বেশি ছিল তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উম্মতকে খুলাফায়ে রাশিদীনের আদর্শ অনুসরণের জোর তাগিদ করেছেন। সুতরাং হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর এ নীতি পরবর্তীকালীন শাসকদের অনুসরণ করা উচিত ছিল। কিন্তু কালক্রমে এ উম্মতের শাসকগণ এ নীতি সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায়। তাদের কাছে উলামার বিশেষ মর্যাদা নেই। ফলে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদেরকে মনোনীত করার কথা ভাবা হয় না। মনোনয় দেওয়া হতে থাকে এমনসব লোককে, যাদের কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে কোনও জ্ঞান নেই।
দীন ও শরীআত সম্পর্কে অজ্ঞ-অপরিচিত লোকদের সভাষদ করায় রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি উত্তরোত্তর দীনের আলো থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। একপর্যায়ে রাষ্ট্র হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ। আজ মুসলিম জাহানের অধিকাংশ রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এটা শাসক শ্রেণীর পক্ষ হতে উলামাকে উপেক্ষা-অবজ্ঞা করারই পরিণাম। এ ঘোর অন্ধকার থেকে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। সে লক্ষ্যে কর্তব্য ইলম ও উলামার হৃত মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মেহনতে অবতীর্ণ হওয়া। চাই সকলের সর্বাত্মক মেহনত।
উয়ায়না ইবন হিসন হযরত উমর ফারূক রাযি.-কে লক্ষ্য করে যে বললেন-

يَا ابْنَ الْخَطَّابِ، وَاللَّهِ مَا تُعْطِينَا الْجَزْلَ، وَلَا تَحْكُمُ بَيْنَنَا بِالْعَدْلِ

(হুম, হে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহর কসম! না তুমি আমাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দাও, আর না আমাদের মধ্যে ইনসাফের সঙ্গে শাসন কর)। এটা তার নিতান্তই ধৃষ্টতা। অসত্যও বটে। কেননা উমর ফারূক রাযি.-এর ন্যায়পরায়ণতা বিশ্বখ্যাত। জনগণের সম্পদ বণ্টনে তিনি কোনওরকম পক্ষপাতিত্ব করেছেন বলে প্রমাণ নেই। শাসন ও বিচারকার্যে কঠিনভাবে ন্যায়-নিষ্ঠা অবলম্বন করতেন। কোনও ক্ষেত্রেই যাতে কুরআন-সুন্নাহ থেকে সরে না যান, সে লক্ষ্যে পরামর্শ করে সব কাজ করতেন। তাঁর পরামর্শসভার সদস্যও ছিল সকল জ্ঞানী-গুণী সাহাবী, যেমনটা এ বর্ণনায় বলা হয়েছে। এ অবস্থায় তাঁর দ্বারা কোনওরকম অবিচার হবে তা অসম্ভব। কাজেই উয়ায়নার অভিযোগ সর্বাংশে ভিত্তিহীন।
তিনি অভিযোগ করছেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর পরই এ উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি সম্পর্কে। অথচ তার নিজের অবস্থা হলো এই যে, ইসলামের উপর ধরে রাখার জন্য যাদের মনোরঞ্জনের দরকার হয়েছিল তিনি তাদের একজন। আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর মুরতাদও হয়ে গিয়েছিলেন। এহেন এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে বেইনসাফীর অভিযোগ কতইনা হাস্যকর। এ কারণে হযরত উমর রাযি.-এর ক্রুদ্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি তো হযরত উমর রাযি., কুরআনের সীমারেখার ভেতর থাকতে যিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। তা থাকার লক্ষ্যেই কুরআন-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক বানিয়েছিলেন। সুতরাং যেই না হুর্র ইবন কায়স রাযি. বললেন, আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে বলেছেন-

خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ

‘(হে নবী!) তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।২২০- অমনি গলে গেলেন। হুর্র ইবন কায়স রাযি. বোঝাতে চাচ্ছিলেন, আল্লাহ তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে যে হুকুম দিয়েছেন তার আসল লক্ষ্যবস্তু তো আমরাই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এ আয়াতে বর্ণিত চরিত্রের উপরই অধিষ্ঠিত ছিলেন। আমাদের কর্তব্য তাঁর আদর্শ অনুসরণ করা। উয়ায়না ইবন হিসন একজন অজ্ঞ ব্যক্তি। তার অজ্ঞতাসুলভ মন্তব্য উপেক্ষা করারই উপযুক্ত। আপনি তাকে উপেক্ষা করুন। সুতরাং তিনি তাকে উপেক্ষা করলেন।
এ আয়াতটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে তিনটি আদেশ করা হয়েছে। ক. ক্ষমাপরায়ণ হওয়া; খ. সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও গ. অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য করা।

ক্ষমাশীলতার গুরুত্ব
العفو শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে। তার মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ক্ষমাপরায়ণতা। এ আয়াতটি যখন নাযিল হয় তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জিবরীল 'আলাইহিস সালামকে এর অর্থ জিজ্ঞেস করেছিলেন। হযরত জিবরীল ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা'আলার কাছ থেকে জেনে এসে তাঁকে বললেন, এ আয়াতে আপনাকে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, যে ব্যক্তি আপনার উপর জুলুম করবে, আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। যে ব্যক্তি আপনাকে বঞ্চিত করবে, আপনি তার প্রতি উদারতা প্রদর্শন করবেন। আর যে ব্যক্তি আপনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আপনি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবেন।
এর সারকথা হচ্ছে অন্যের প্রতি ক্ষমাশীলতার আচরণ করা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা জীবন মানুষের সঙ্গে ক্ষমাশীল হয়েই থেকেছেন। তিনি কখনও কারও থেকে প্রতিশোধ নেননি। মক্কাবিজয়ের দিন তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণের অবারিত সুযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রাণের শত্রুদেরকেও এদিন ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন সাধারণ ক্ষমা। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আজ তোমরা আমার কাছে কেমন ব্যবহার আশা কর? তারা বলেছিল, ভালো ব্যবহার। আপনি একজন মহান ভাই, মহান ভাইয়ের পুত্র। তিনি ঘোষণা করলেন-

اذْهَبُوا فَأَنْتُمُ الطُّلَقَاءُ

‘যাও, তোমরা সবাই মুক্ত।২২১

তিনি আরও বলেছিলেন-

(أَقُولُ كَمَا قَالَ يُوْسُفُ: (لَا تَثْرِيْبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّحِمِينَ

‘ইয়ুসুফ আলাইহিস সালাম যেমন বলেছিলেন, তেমনি আমিও বলছি, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি শ্রেষ্ঠতম দয়ালু।২২২
বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উন্নত চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর ক্ষমাশীলতাও ছিল অসাধারণ। তা সত্ত্বেও তাঁকে যে এ আদেশ করা হয়েছে তা মূলত উম্মতকে শেখানোর জন্য ।

সৎকাজের আদেশের গুরুত্ব
দ্বিতীয় হুকুম করা হয়েছে সৎকাজের আদেশ দেওয়া সম্পর্কে।العرف এ শব্দটি প্রথন ও দ্বিতীয় আয়াতে ব্যবহৃত المعروف-এর সমার্থক। সর্বপ্রকার সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। অন্যের দেওয়া কষ্ট ও জুলুম ক্ষমা করার পাশাপাশি হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, তাদেরকে সৎকাজের আদেশও কর। কেননা জালিম ও কষ্টদাতার সংশোধনও জরুরি। তার সংশোধন না হলে তার জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকবে আর এভাবে অপরাপর মানুষও তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং জুলুম থেকে ফেরানোর জন্য তাকে ন্যায় ও ইনসাফের শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। সেজন্যই আদেশ করা হয়েছে যে, সৎকাজের নির্দেশ দাও।
এ আদেশ কেবল দুঃখ-কষ্টদাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সৎকাজের নির্দেশ সকলের জন্যই প্রয়োজন। যারা অসৎকাজ করে তাদের জন্য প্রয়োজন অসৎকাজ থেকে ফেরানোর লক্ষ্যে, আর যারা সৎকাজ করে তারা যাতে তাতে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং সৎকাজে আরও বেশি উন্নতি লাভ করে, সে লক্ষ্যে সৎকাজের উপদেশ তাদের জন্যও উপকারী। যারা এ দায়িত্ব পালনে রত থাকে, তাদের নিজেদেরও এটা দুনিয়া ও আখেরাতের প্রভূত কল্যাণ সাধন করে।

অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য করা
এ আয়াতে তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছে- অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য কর। অর্থাৎ যারা জুলুম- অত্যাচার করে তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেওয়ার পরও হয়তো দেখা যাবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ অতি জেদী চরিত্রের হওয়ায় নিজেদের সংশোধন করছে না। এত উন্নত আচরণ করা সত্ত্বেও তাদের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসছে না। আগের মতই অন্যায় ও অসৎকাজ করে যাচ্ছে। এরূপ ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলা। তাদের অন্যায় আচরণে উত্তেজিত হয়ে গেলে নিজের আখলাক-চরিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই তাদের পাশ কাটিয়ে চলাই শ্রেয়।
ইবন কাছীর রহ. পাশ কাটানোর একটা ব্যাখ্যা এরকমও করেছেন যে, তাদের দুর্ব্যবহারের উত্তর দুর্ব্যবহার দ্বারা নয়; বরং সদ্ব্যবহার দ্বারা করা চাই। এমন নয় যে, তাদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সৎকাজের আদেশ করা ছেড়ে দেওয়া হলো।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, কোনও কারণে কেউ রেগে গেলে উপস্থিত লোকদের কর্তব্য তাকে রাগ সংযত করার ও ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য নসীহত করা।

খ. কুরআন ও হাদীছের দ্বারা নসীহত করলে তা বেশি ফলপ্রসূ হয়।

গ. নসীহত প্রসঙ্গে যার সামনে কুরআন ও হাদীছ পেশ করা হবে, তার কর্তব্য কুরআন- হাদীছের আদব রক্ষা করা ও নসীহত কবুল করা।

ঘ. আল্লাহ তা'আলা যাদেরকে ক্ষমতার অধিকারী করেন, তাদের কর্তব্য 'উলামা ও পরহেযগার লোকদেরকে পরামর্শসভার সদস্য বানানো ও তাদের পরামর্শমত কাজ করা।

২১৯. সূরা জিন্ন (৭২), আয়াত ১১

২২০. সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯

২২১. বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৮২৭৬

২২২. বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৮২৭৫; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১২৩৪; তহাবী, শারহু মাআনিল আছার, হাদীছ নং ৫৪৫৪
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সহীহ বুখারী - হাদীস নং ৪২৮৭ | মুসলিম বাংলা