মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
৩১- সাহাবায়ে কিরামের রাঃ মানাকিব ও ফাযায়েল
হাদীস নং: ৬১৪০
প্রথম অনুচ্ছেদ - নবী (সা.) -এর পরিবার-পরিজনদের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য
৬১৪০। হযরত যায়দ ইবনে আরকাম (রাঃ) বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী "খোম" নামক জলাশয়ের নিকট দাড়াইয়া আমাদিগকে ভাষণ দান করিলেন। প্রথমে আল্লাহর হামদ ও সানা বর্ণনা করিলেন, ইহার পর ওয়ায ও নসীহত করিলেন, অতঃপর বলিলেন: আম্মা বা'দ সাবধান! হে লোক সকল! নিশ্চয় আমি একজন মানুষই, অচিরেই আমার নিকট আল্লাহর দূত (মালাকুল মউত) আসিবে, তখন আমি আমার রবের আহ্বানে সাড়া দিব। আমি তোমাদের মাঝে দুইটি মূল্যবান সম্পদ রাখিয়া যাইতেছি। তন্মধ্যে প্রথমটি হইল; "আল্লাহর কিতাব", ইহার মধ্যে রহিয়াছে হেদায়ত ও আলো। অতএব, তোমরা আল্লাহর কিতাবকে খুব শক্তভাবে আড়াইয়া ধর এবং দৃঢ়তার সাথে উহার বিধি-বিধান মানিয়া চল। (বর্ণনাকারী বলেন,) আল্লাহর কিতাবের নির্দেশাবলী কঠোরভাবে মানিয়া চলিবার জন্য তিনি খুব বেশী উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করিলেন। অতঃপর বলিলেন, আর (দ্বিতীয়টি হইল) আমার আহলে বায়ত। আমি তোমাদিগকে আমার আহলে বায়ত সম্পর্কে আল্লাহর তরফ হইতে বিশেষ নসীহত করিতেছি। আমি তোমাদিগকে আমার আহলে বায়ত সম্পর্কে বিশেষ নসীহত করিতেছি। অপর এক রেওয়ায়তে আছে, আল্লাহর কিতাব হইল আল্লাহর রশি। যেই ব্যক্তি উহার আনুগত্য করিবে, সে হেদায়তের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর যে উহাকে পরিত্যাগ করিবে, সে পথভ্রষ্ট, গোমরাহ। —মুসলিম
وَعَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ قَالَ: قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا فِينَا خَطِيبًا بِمَاءٍ يُدْعَى: خُمًّا بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ فَحَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ وَوَعَظَ وَذَكَّرَ ثُمَّ قَالَ: أمَّا بعدُ أَلا أيُّها النَّاس فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَنِي رَسُولُ رَبِّي فَأُجِيبَ وَأَنَا تَارِكٌ فِيكُمُ الثَّقَلَيْنِ: أَوَّلُهُمَا كِتَابُ اللَّهِ فِيهِ الْهُدَى وَالنُّورُ فَخُذُوا بِكِتَابِ اللَّهِ وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ فَحَثَّ عَلَى كِتَابِ اللَّهِ وَرَغَّبَ فِيهِ ثُمَّ قَالَ: «وَأَهْلُ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي» وَفِي رِوَايَة: «كتاب الله عز وَجل هُوَ حَبْلُ اللَّهِ مَنِ اتَّبَعَهُ كَانَ عَلَى الْهُدَى وَمَنْ تَرَكَهُ كَانَ عَلَى الضَّلَالَةِ» . رَوَاهُ مُسلم
হাদীসের ব্যাখ্যা:
আলোচ্য হাদীছটি হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি. থেকে বর্ণনা করেছেন ইয়াযীদ ইবন হায়্যান রহ.। তিনি, হুসায়ন ইবন সাবরা রহ. ও আমর ইবন মুসলিম রহ.- এ তিনজন মিলে হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি.-এর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। তখন হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি. বিদায় হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে পবিত্র মক্কা ও মদীনার মাঝখানে ‘গাদীরে খুম’ নামক এক জলাশে তীরে প্রদত্ত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষণের অংশবিশেষ তাদের সামনে বর্ণনা করলেন। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা ইরশাদ করেছিলেন-
أَلا أَيُّهَا النَّاسُ، فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ رسولُ ربِّي فَأُجيبَ
(হে লোক সকল! আমি একজন মানুষমাত্র। হয়তো অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত এসে যাবে এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দেব)। 'আমি একজন মানুষ মাত্র' বলে তিনি তাঁর সম্পর্কে বাড়াবাড়িমূলক আকীদা-বিশ্বাস তৈরির ব্যাপারে সাবধান করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন মরণশীল মানুষ হওয়া
অন্যান্য নবীদের সত্যতার প্রমাণস্বরূপ যেমন বিভিন্ন মু'জিযা ও অলৌকিক ঘটনাবলী প্রকাশ করা হয়েছিল, তেমনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর সত্যতা সম্পর্কেও বহু নিদর্শন দেখানো হয়েছে। তাঁর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন কুরআন মাজীদ। আল্লাহ তাআলার কালাম হওয়ায় কোনও মানুষের পক্ষে কুরআন মাজীদের সর্বপ্রকার ছোট সূরার মত একটি সূরাও তৈরি করা সম্ভব নয়। তাছাড়া তাঁর আঙ্গুলের ফাঁক থেকে পানির ফোয়ারা ছুটেছে, সামান্য এক পেয়ালা দুধে বহু লোকের ক্ষুধা মিটেছে, তাঁর আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদ দু'টুকরো হয়েছে, রাতের সামান্য সময়ের মধ্যে পবিত্র মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে সপ্তাকাশ সফর করে এসেছেন, ক্ষুধার্ত উট তাঁর কাছে এসে মালিকের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছে, এ জাতীয় আরও বহু মু'জিযা দেখে কারও দ্বারা তাঁর সম্পর্কে এ বিশ্বাস তৈরির আশঙ্কা ছিল যে, তিনি মানুষ নন; বরং আল্লাহর অবতার বা তাঁর ক্ষমতাসম্পন্ন কোনও সত্তা (না'ঊযু বিল্লাহি মিন যালিক), যেমন এক শ্রেণীর লোক এ কালে বলছে যে, তিনি আল্লাহর নূরের সৃষ্টি। এ জাতীয় ভ্রান্ত আকীদা প্রতিরোধকল্পে তাঁর পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, আমি তো একজন মানুষই। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ
‘বলে দাও, আমি তো তোমাদের মত একজন মানুষই। (তবে) আমার প্রতি এই ওহী আসে যে, তোমাদের মাবুদ কেবল একই মাবুদ।'১৮৩
অর্থাৎ মানুষ হওয়ার ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য নেই। তবে হাঁ, আমি যেহেতু একজন নবী বরং শ্রেষ্ঠতম ও সর্বশেষ নবী এবং আমার প্রতি ওহী নাযিল হয়, তাই নবুওয়াতের অপরিহার্য গুণাবলী আমার মধ্যে বিদ্যমান আছে। যেমন গুনাহ না করা, সর্বোচ্চ পর্যায়ের আখলাক-চরিত্রের অধিকারী হওয়া, নিখুঁত জ্ঞানবুদ্ধি থাকা, সাহসিকতা ও আল্লাহনির্ভরতার সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত থাকা ইত্যাদি।
মানুষ মাত্রই মরণশীল। তিনি যখন একজন মানুষ তখন স্বাভাবিকভাবেই একদিন তাঁরও মৃত্যু হবে। তাঁর আগেও যত নবী-রাসূল এসেছিলেন তাদের মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ
'আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একজন রাসূল বৈ তো নন। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে ।১৮৪
অন্যত্র ইরশাদ-
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ
(হে রাসূল!) নিশ্চয় তুমি মরণশীল এবং তারাও অবশ্যই মরণশীল।১৮৫
সুতরাং সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার এ চিরন্তন বিধান অনুযায়ী একদিন তাঁরও মৃত্যু হবে। সে কথাই তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত মালাকুল মাওত এসে যাবে। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আমি তোমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে কবরের জগতে চলে যাব।
কুরআন মাজীদ আঁকড়ে ধরে রাখার তাগিদ
তাঁর এ ঘোষণায় শ্রোতামণ্ডলীর অন্তরে ভয় জাগার কথা যে, তিনি যতদিন জীবিত আছেন মানুষকে হিদায়াতের পথ দেখাচ্ছেন। তাঁর দ্বারা যে-কোনও জটিলতার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। তিনি চলে যাওয়ার পর কে তাদের পথ দেখাবে? আপতিত সমস্যার সমাধান তখন কিভাবে নেওয়া যাবে? তিনি এ ভয় ও শঙ্কার নিরসনকল্পে ইরশাদ করেন-
انا تارك فيكم ثقلين (আমি তোমাদের মধ্যে দু'টি ভার রেখে যাচ্ছি)। ভার মানে মর্যাদাবান ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আরবীতে যে-কোনও মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ বস্তু ও বিষয়কে ثقل (ভার) বলে। বাংলায়ও বলা হয়, ওজনদার কথা বা ওজনদার লোক। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ কথা ও মর্যাদাবান লোক। এ হাদীছে যে দু'টি বিষয় রেখে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, অত্যন্ত মর্যাদাবান হওয়ায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে দু'টোকে ثقل শব্দে ব্যক্ত করেছেন। কী সে দু'টো বিষয়? সামনে তিনি এর ব্যাখ্যা করছেন-
أَوَّلهُما كِتابُ اللَّهِ، فِيهِ الهُدى وَالنُّورُ (তার প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। তাতে আছে হিদায়াত ও আলো)। অর্থাৎ প্রথমটি হচ্ছে কুরআন মাজীদ। তাতে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য হিদায়াত ও পথনির্দেশ আছে। তাতে আছে পথচলার আলো। আমি দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পরও এ হিদায়াত ও আলো তোমাদের মধ্যে থাকবে। কিয়ামত পর্যন্ত তা সুরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা আছে। কেউ তা বিকৃত করতে পারবে না। তোমাদের দোজাহানের মুক্তি ও সফলতার লক্ষ্যে অনুসরণীয় সবকিছুই এতে বিদ্যমান আছে। যে-কোনও পরিস্থিতিতেই এ কিতাব তোমাদের পথ দেখাবে। যত জটিল সমস্যাই হোক না কেন, এর আলোকে তোমরা তার সমাধান করতে পারবে। এর অনুসরণ করলে তোমাদের পথ হারানোর কোনও ভয় নেই। কোনও জটিলতার আবর্তে পড়ে থাকার কোনও আশঙ্কা নেই। যেমন অপর এক বর্ণনায় আছে-
وَهُو حبْلُ اللَّه، منِ اتَّبَعه كَانَ عَلَى الهُدى، ومَنْ تَرَكَهُ كانَ عَلَى ضَلالَةٍ
(আর তা হচ্ছে আল্লাহর রশি। যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে সে হিদায়াতের উপর থাকবে। আর যে তা পরিত্যাগ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে)। সুতরাং তোমাদের কাজ কেবল সর্বাবস্থায় এ কিতাব আঁকড়ে ধরে থাকা।
অতঃপর তিনি কুরআন মাজীদ আঁকড়ে ধরে রাখার প্রতি উৎসাহ দান করেন। কোনও অবস্থায়ই তা থেকে বিচ্যুত না হওয়ার তাগিদ দেন। প্রকাশ থাকে যে, কুরআন আঁকড়ে ধরার জন্য হাদীছের অনুসরণ অপরিহার্য। কুরআনের সঙ্গে হাদীছের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কাজেই কুরআনের পাশাপাশি হাদীছকেও আঁকড়ে ধরতে হবে। বিদায় হজ্জেরই অপর এক ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ، لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ
‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে ধরে রাখবে, কস্মিনকালেও পথভ্রষ্ট হবে না –আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নত।১৮৬
তারপর দ্বিতীয় বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন-
وأَهْلُ بَيْتِي، أُذكِّركم اللَّه في أهلِ بيْتي، أذكِّرُكم اللَّه في أهل بيتي
(আমার আহলে বায়ত। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি)। অর্থাৎ দ্বিতীয় যে মর্যাদাপূর্ণ বিষয় তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি তা হচ্ছে আমার আহলে বায়ত। সাবধান! তোমরা তাদের মর্যাদা রক্ষা করো। কিছুতেই তাদের অমর্যাদা করো না।
হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি, যখন হাদীছটি বর্ণনা করা শেষ করলেন, তখন হুসায়ন ইবন সাবরা রহ. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ তাঁর আহলে বায়ত কি না। তিনি স্বীকার করলেন যে, তারাও আহলে বায়ত। তবে তিনি আরও বৃহত্তর অর্থে আহলে বায়তের ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন- তবে (সাধারণভাবে) আহলে বায়ত বলতে তাদেরকে বোঝানো হয়, যাদের জন্য সদাকা (খাওয়া) হারাম করা হয়েছে। আর তারা হচ্ছেন- আলীর বংশধরগণ, আকীলের বংশধরগণ, জাফরের বংশধরগণ এবং আব্বাসের বংশধরগণ। পরিভাষায় তাদেরকে সায়্যিদ বলা হয়। তাদের জন্য সদাকা অর্থাৎ যাকাত, ফিতরা, মানত ইত্যাদি খাওয়া জায়েয নয়। আরও বৃহত্তর পরিসরে বনূ হাশিমের জন্যও সদাকা যাকাত খাওয়া খারাম।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
এ হাদীছটির মধ্যে আমাদের জন্য বহু শিক্ষা রয়েছে। যেমন-
ক. মুসলিম উম্মাহ'র মধ্যে আহলে বায়তের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাদের সে মর্যাদা রক্ষা করা সকলের অবশ্যকর্তব্য।
খ. কুরআন মাজীদ আল্লাহর কিতাব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজের রচনা নয়।
গ. যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদ শক্ত করে ধরে রাখবে, সে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, পথভ্রষ্টতার শিকার হবে না।
ঘ. কুরআনই আলো। সর্বপ্রকার অন্ধকার ও পাশববৃত্তি থেকে মুক্ত আলোকিত জীবন গড়ার একমাত্র উপায় কুরআনের অনুসরণ।
ঙ. বক্তব্য ও ভাষণ দেওয়ার আগে আল্লাহ তাআলার হাম্দ ও ছানা পড়ে নেওয়া চাই।
চ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা আমাদের মা। তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা-ভক্তি বজায় রাখতে হবে।
ছ. আহলে বায়ত ও বনূ হাশিমের জন্য যাকাত-সদাকা ভোগ করা হারাম।
জ. দীনী ইলম শেখার জন্য গভীর জ্ঞানসম্পন্ন মুত্তাকী-পরহেযগার উস্তায বেছে নেওয়া চাই।
ঝ. দীনী ইলম অর্জনের জন্য উস্তাযের কাছে যাওয়া চাই। এ মহামূল্যবান সম্পদ ঘরে বসে অর্জন করা যায় না।
১৮৩. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ১১০
১৮৪. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৪৪
১৮৫. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৩০
১৮৬. মুআত্তা মালিক, হাদীছ নং ৬৭৮
أَلا أَيُّهَا النَّاسُ، فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ رسولُ ربِّي فَأُجيبَ
(হে লোক সকল! আমি একজন মানুষমাত্র। হয়তো অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত এসে যাবে এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দেব)। 'আমি একজন মানুষ মাত্র' বলে তিনি তাঁর সম্পর্কে বাড়াবাড়িমূলক আকীদা-বিশ্বাস তৈরির ব্যাপারে সাবধান করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন মরণশীল মানুষ হওয়া
অন্যান্য নবীদের সত্যতার প্রমাণস্বরূপ যেমন বিভিন্ন মু'জিযা ও অলৌকিক ঘটনাবলী প্রকাশ করা হয়েছিল, তেমনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর সত্যতা সম্পর্কেও বহু নিদর্শন দেখানো হয়েছে। তাঁর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন কুরআন মাজীদ। আল্লাহ তাআলার কালাম হওয়ায় কোনও মানুষের পক্ষে কুরআন মাজীদের সর্বপ্রকার ছোট সূরার মত একটি সূরাও তৈরি করা সম্ভব নয়। তাছাড়া তাঁর আঙ্গুলের ফাঁক থেকে পানির ফোয়ারা ছুটেছে, সামান্য এক পেয়ালা দুধে বহু লোকের ক্ষুধা মিটেছে, তাঁর আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদ দু'টুকরো হয়েছে, রাতের সামান্য সময়ের মধ্যে পবিত্র মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে সপ্তাকাশ সফর করে এসেছেন, ক্ষুধার্ত উট তাঁর কাছে এসে মালিকের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছে, এ জাতীয় আরও বহু মু'জিযা দেখে কারও দ্বারা তাঁর সম্পর্কে এ বিশ্বাস তৈরির আশঙ্কা ছিল যে, তিনি মানুষ নন; বরং আল্লাহর অবতার বা তাঁর ক্ষমতাসম্পন্ন কোনও সত্তা (না'ঊযু বিল্লাহি মিন যালিক), যেমন এক শ্রেণীর লোক এ কালে বলছে যে, তিনি আল্লাহর নূরের সৃষ্টি। এ জাতীয় ভ্রান্ত আকীদা প্রতিরোধকল্পে তাঁর পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, আমি তো একজন মানুষই। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ
‘বলে দাও, আমি তো তোমাদের মত একজন মানুষই। (তবে) আমার প্রতি এই ওহী আসে যে, তোমাদের মাবুদ কেবল একই মাবুদ।'১৮৩
অর্থাৎ মানুষ হওয়ার ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য নেই। তবে হাঁ, আমি যেহেতু একজন নবী বরং শ্রেষ্ঠতম ও সর্বশেষ নবী এবং আমার প্রতি ওহী নাযিল হয়, তাই নবুওয়াতের অপরিহার্য গুণাবলী আমার মধ্যে বিদ্যমান আছে। যেমন গুনাহ না করা, সর্বোচ্চ পর্যায়ের আখলাক-চরিত্রের অধিকারী হওয়া, নিখুঁত জ্ঞানবুদ্ধি থাকা, সাহসিকতা ও আল্লাহনির্ভরতার সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত থাকা ইত্যাদি।
মানুষ মাত্রই মরণশীল। তিনি যখন একজন মানুষ তখন স্বাভাবিকভাবেই একদিন তাঁরও মৃত্যু হবে। তাঁর আগেও যত নবী-রাসূল এসেছিলেন তাদের মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ
'আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একজন রাসূল বৈ তো নন। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে ।১৮৪
অন্যত্র ইরশাদ-
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ
(হে রাসূল!) নিশ্চয় তুমি মরণশীল এবং তারাও অবশ্যই মরণশীল।১৮৫
সুতরাং সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার এ চিরন্তন বিধান অনুযায়ী একদিন তাঁরও মৃত্যু হবে। সে কথাই তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত মালাকুল মাওত এসে যাবে। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আমি তোমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে কবরের জগতে চলে যাব।
কুরআন মাজীদ আঁকড়ে ধরে রাখার তাগিদ
তাঁর এ ঘোষণায় শ্রোতামণ্ডলীর অন্তরে ভয় জাগার কথা যে, তিনি যতদিন জীবিত আছেন মানুষকে হিদায়াতের পথ দেখাচ্ছেন। তাঁর দ্বারা যে-কোনও জটিলতার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। তিনি চলে যাওয়ার পর কে তাদের পথ দেখাবে? আপতিত সমস্যার সমাধান তখন কিভাবে নেওয়া যাবে? তিনি এ ভয় ও শঙ্কার নিরসনকল্পে ইরশাদ করেন-
انا تارك فيكم ثقلين (আমি তোমাদের মধ্যে দু'টি ভার রেখে যাচ্ছি)। ভার মানে মর্যাদাবান ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আরবীতে যে-কোনও মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ বস্তু ও বিষয়কে ثقل (ভার) বলে। বাংলায়ও বলা হয়, ওজনদার কথা বা ওজনদার লোক। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ কথা ও মর্যাদাবান লোক। এ হাদীছে যে দু'টি বিষয় রেখে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, অত্যন্ত মর্যাদাবান হওয়ায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে দু'টোকে ثقل শব্দে ব্যক্ত করেছেন। কী সে দু'টো বিষয়? সামনে তিনি এর ব্যাখ্যা করছেন-
أَوَّلهُما كِتابُ اللَّهِ، فِيهِ الهُدى وَالنُّورُ (তার প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। তাতে আছে হিদায়াত ও আলো)। অর্থাৎ প্রথমটি হচ্ছে কুরআন মাজীদ। তাতে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য হিদায়াত ও পথনির্দেশ আছে। তাতে আছে পথচলার আলো। আমি দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পরও এ হিদায়াত ও আলো তোমাদের মধ্যে থাকবে। কিয়ামত পর্যন্ত তা সুরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা আছে। কেউ তা বিকৃত করতে পারবে না। তোমাদের দোজাহানের মুক্তি ও সফলতার লক্ষ্যে অনুসরণীয় সবকিছুই এতে বিদ্যমান আছে। যে-কোনও পরিস্থিতিতেই এ কিতাব তোমাদের পথ দেখাবে। যত জটিল সমস্যাই হোক না কেন, এর আলোকে তোমরা তার সমাধান করতে পারবে। এর অনুসরণ করলে তোমাদের পথ হারানোর কোনও ভয় নেই। কোনও জটিলতার আবর্তে পড়ে থাকার কোনও আশঙ্কা নেই। যেমন অপর এক বর্ণনায় আছে-
وَهُو حبْلُ اللَّه، منِ اتَّبَعه كَانَ عَلَى الهُدى، ومَنْ تَرَكَهُ كانَ عَلَى ضَلالَةٍ
(আর তা হচ্ছে আল্লাহর রশি। যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে সে হিদায়াতের উপর থাকবে। আর যে তা পরিত্যাগ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে)। সুতরাং তোমাদের কাজ কেবল সর্বাবস্থায় এ কিতাব আঁকড়ে ধরে থাকা।
অতঃপর তিনি কুরআন মাজীদ আঁকড়ে ধরে রাখার প্রতি উৎসাহ দান করেন। কোনও অবস্থায়ই তা থেকে বিচ্যুত না হওয়ার তাগিদ দেন। প্রকাশ থাকে যে, কুরআন আঁকড়ে ধরার জন্য হাদীছের অনুসরণ অপরিহার্য। কুরআনের সঙ্গে হাদীছের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কাজেই কুরআনের পাশাপাশি হাদীছকেও আঁকড়ে ধরতে হবে। বিদায় হজ্জেরই অপর এক ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ، لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ
‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে ধরে রাখবে, কস্মিনকালেও পথভ্রষ্ট হবে না –আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নত।১৮৬
তারপর দ্বিতীয় বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন-
وأَهْلُ بَيْتِي، أُذكِّركم اللَّه في أهلِ بيْتي، أذكِّرُكم اللَّه في أهل بيتي
(আমার আহলে বায়ত। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি)। অর্থাৎ দ্বিতীয় যে মর্যাদাপূর্ণ বিষয় তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি তা হচ্ছে আমার আহলে বায়ত। সাবধান! তোমরা তাদের মর্যাদা রক্ষা করো। কিছুতেই তাদের অমর্যাদা করো না।
হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি, যখন হাদীছটি বর্ণনা করা শেষ করলেন, তখন হুসায়ন ইবন সাবরা রহ. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ তাঁর আহলে বায়ত কি না। তিনি স্বীকার করলেন যে, তারাও আহলে বায়ত। তবে তিনি আরও বৃহত্তর অর্থে আহলে বায়তের ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন- তবে (সাধারণভাবে) আহলে বায়ত বলতে তাদেরকে বোঝানো হয়, যাদের জন্য সদাকা (খাওয়া) হারাম করা হয়েছে। আর তারা হচ্ছেন- আলীর বংশধরগণ, আকীলের বংশধরগণ, জাফরের বংশধরগণ এবং আব্বাসের বংশধরগণ। পরিভাষায় তাদেরকে সায়্যিদ বলা হয়। তাদের জন্য সদাকা অর্থাৎ যাকাত, ফিতরা, মানত ইত্যাদি খাওয়া জায়েয নয়। আরও বৃহত্তর পরিসরে বনূ হাশিমের জন্যও সদাকা যাকাত খাওয়া খারাম।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
এ হাদীছটির মধ্যে আমাদের জন্য বহু শিক্ষা রয়েছে। যেমন-
ক. মুসলিম উম্মাহ'র মধ্যে আহলে বায়তের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাদের সে মর্যাদা রক্ষা করা সকলের অবশ্যকর্তব্য।
খ. কুরআন মাজীদ আল্লাহর কিতাব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজের রচনা নয়।
গ. যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদ শক্ত করে ধরে রাখবে, সে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, পথভ্রষ্টতার শিকার হবে না।
ঘ. কুরআনই আলো। সর্বপ্রকার অন্ধকার ও পাশববৃত্তি থেকে মুক্ত আলোকিত জীবন গড়ার একমাত্র উপায় কুরআনের অনুসরণ।
ঙ. বক্তব্য ও ভাষণ দেওয়ার আগে আল্লাহ তাআলার হাম্দ ও ছানা পড়ে নেওয়া চাই।
চ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা আমাদের মা। তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা-ভক্তি বজায় রাখতে হবে।
ছ. আহলে বায়ত ও বনূ হাশিমের জন্য যাকাত-সদাকা ভোগ করা হারাম।
জ. দীনী ইলম শেখার জন্য গভীর জ্ঞানসম্পন্ন মুত্তাকী-পরহেযগার উস্তায বেছে নেওয়া চাই।
ঝ. দীনী ইলম অর্জনের জন্য উস্তাযের কাছে যাওয়া চাই। এ মহামূল্যবান সম্পদ ঘরে বসে অর্জন করা যায় না।
১৮৩. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ১১০
১৮৪. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৪৪
১৮৫. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৩০
১৮৬. মুআত্তা মালিক, হাদীছ নং ৬৭৮
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
