মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৩০- নবীজী সাঃ এর মর্যাদা ও শামাঈল অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৯৬৬
- নবীজী সাঃ এর মর্যাদা ও শামাঈল অধ্যায়
তৃতীয় অনুচ্ছেদ - রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর ওফাতের পর সাহাবীদের মক্কাহ্ হতে হিজরত করা সম্পর্কে
৫৯৬৬। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর ইনতেকালের সময় নিকটবর্তী হয়, তখন তাঁহার গৃহে অনেক লোক উপস্থিত ছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)ও ছিলেন। এই সময় নবী (ﷺ) বলিলেনঃ আস, আমি তোমাদের জন্য একটি (স্মরণ) লিপি লিখিয়া দিয়া যাই, যাহাতে তোমরা ইহার পর কখনও গোমরাহ না হও। তখন হযরত ওমর (রাঃ) বলিলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর উপর এখন রোগ-যন্ত্রণা প্রবল হইয়া পড়িয়াছে। (কাজেই এই সময় তাহাকে কষ্ট দেওয়া উচিত নহে) আর তোমাদের কাছে কোরআন মজীদ রহিয়াছে, সুতরাং আল্লাহর কিতাবই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। এই নিয়া গৃহে উপস্থিত লোকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল এবং তাহারা বিতর্কে লিপ্ত হইয়া পড়িলেন। তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ বলিলেন, কাগজ-কলম লইয়া আস, যেন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তোমাদের জন্য কিছু লিখিয়া দেন। আবার কেহ সেই কথাই বলিলেন, যাহা হযরত ওমর (রাঃ) বলিয়াছেন। অতঃপর যখন হৈ চৈ এবং মতবিরোধ চরমে পৌঁছিল, তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিলেন, তোমরা আমার নিকট হইতে উঠিয়া যাও। (অধস্তন বর্ণনাকারী) উবায়দুল্লাহ্ বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস [(রাঃ) অত্যন্ত দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে] বলিতেন, ইহা একটি বিপদ, চরম বিপদ, যাহা লোকদের মতবিরোধ ও শোরগোলের আকৃতিতে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এবং তাঁহার অসিয়ত লিখিয়া দেওয়ার ইচ্ছার মধ্যে অন্তরাল হইয়া দাঁড়াইল।
আর সুলায়মান ইবনে আবু মুসলিম আহওয়ালের রেওয়ায়তে আছে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলিলেন, হায় বৃহস্পতিবার! কতই বেদনাদায়ক বৃহস্পতিবার! এই কথা বলিয়া তিনি এমনভাবে কাঁদিতে লাগিলেন যে, তাঁহার অশ্রুতে নীচের বালু-কংকর পর্যন্ত ভিজিয়া গিয়াছিল। (সুলায়মান বলেন,) আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, হে ইবনে আব্বাস! বৃহস্পতিবার দিনের ব্যাপারটি কি ? তিনি বলিলেন, এইদিন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর রোগ-যন্ত্রণা খুব বাড়িয়া গিয়াছিল। তখন তিনি বলিয়াছিলেন, অস্থিখণ্ড (লিখার উপকরণ) লইয়া আস, আমি তোমাদের জন্য এমন লিপি লিখিয়া দিব, যাহার পর তোমরা কখনও গোমরাহ হইবে না। তখন লোকেরা কলহে লিপ্ত হইল। অথচ নবীর সম্মুখে কলহ করা সমীচীন ছিল না। এই সময় কেহ কেহ বলিলেন, তাঁহার অবস্থা কেমন? তবে কি তিনি প্রলাপ করিতেছেন ? তাঁহাকে জিজ্ঞাসা কর। কেহ কেহ তাহাকে বারবার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। সেই সময় তিনি বলিলেন, আমাকে ছাড়িয়া দাও, আমাকে আমার অবস্থায় থাকিতে দাও। আমি যেই অবস্থায় আছি, তাহা ঐ অবস্থা হইতে অনেক উত্তম, যেইদিকে তোমরা আমাকে ডাকিতেছ। অতঃপর তিনি তাহাদিগকে তিনটি বিষয়ে নির্দেশ দিলেন। (এক) মুশরিকদিগকে আরব উপদ্বীপ হইতে বহিষ্কার করিবে। (দুই) আমি যেইভাবে প্রতিনিধিদলকে সসম্মানে পুরস্কৃত করিতাম, (আমার পরে) সেইভাবে তাহাদিগকে পুরস্কৃত করিবে। আর ইবনে আব্বাস (রাঃ) তৃতীয়টি হইতে নীরব থাকেন, অথবা তিনি বলিয়াছেন; কিন্তু আমি (সুলায়মান) তাহা ভুলিয়া গিয়াছি। সুফিয়ান বলেন, ইহা সুলায়মানের কথা। — মোত্তাঃ
كتاب الفضائل والشمائل
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: لَمَّا حُضِرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَفِي الْبَيْتِ رِجَالٌ فِيهِمْ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَلُمُّوا أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُ» . فَقَالَ عُمَرَ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدْ غَلَبَ عَلَيْهِ الْوَجَعُ وَعِنْدَكُمُ الْقُرْآنُ حَسْبُكُمْ كِتَابُ اللَّهِ فَاخْتَلَفَ أَهْلُ الْبَيْتِ وَاخْتَصَمُوا فَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ: قَرِّبُوا يَكْتُبْ لَكُمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم. وَمِنْهُم يَقُولُ مَا قَالَ عُمَرُ. فَلَمَّا أَكْثَرُوا اللَّغَطَ وَالِاخْتِلَافَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «قُومُوا عَنِّي» . قَالَ عُبَيْدُ اللَّهِ: فَكَانَ ابنُ عباسٍ يَقُول: إِن الرزيئة كل الرزيئة مَا حَالَ بَيْنَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَبَيَّنَ أَنْ يَكْتُبَ لَهُمْ ذَلِكَ الْكِتَابَ لِاخْتِلَافِهِمْ وَلَغَطِهِمْ وَفِي رِوَايَةِ سُلَيْمَانَ بْنِ أَبِي مُسْلِمٍ الْأَحْوَلِ قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: يَوْمُ الْخَمِيسِ وَمَا يَوْمُ الْخَمِيسِ؟ ثُمَّ بَكَى حَتَّى بَلَّ دَمْعُهُ الْحَصَى. قُلْتُ: يَا ابْنَ عَبَّاسٍ وَمَا يَوْمُ الْخَمِيسِ؟ قَالَ: اشْتَدَّ بِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَجَعُهُ فَقَالَ: «ائْتُونِي بِكَتِفٍ أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لَا تَضِلُّوا بَعْدَهُ أَبَدًا» . فَتَنَازَعُوا وَلَا يَنْبَغِي عِنْدَ نَبِيٍّ تَنَازُعٌ. فَقَالُوا: مَا شَأْنُهُ أَهَجَرَ؟ اسْتَفْهِمُوهُ فَذَهَبُوا يَرُدُّونَ عَلَيْهِ. فَقَالَ: «دَعُونِي ذَرُونِي فَالَّذِي أَنَا فِيهِ خَيْرٌ مِمَّا تَدْعُونَنِي إِلَيْهِ» . فَأَمَرَهُمْ بِثَلَاثٍ: فَقَالَ: «أَخْرِجُوا الْمُشْرِكِينَ مِنْ جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَأَجِيزُوا الْوَفْدَ بِنَحْوِ مَا كُنْتُ أُجِيزُهُمْ» . وَسَكَتَ عَنِ الثَّالِثَةِ أَوْ قَالَهَا فَنَسِيتُهَا قَالَ سُفْيَانُ: هَذَا مِنْ قَول سُلَيْمَان. مُتَّفق عَلَيْهِ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ওলামায়ে কেরামের মতে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এই ক্ষেত্রে দ্বীন-ইসলামের অসম্পূর্ণ নূতন কোন বিধান লিখিয়া দিতে চাহেন নাই। কেননা, ইহার পূর্বেই الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ আয়াত নাযিল হয়, উহা হইতে স্পষ্ট যে, দ্বীন-ইসলাম পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। উহা অসম্পূর্ণ রাখিয়া রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) দুনিয়া হইতে বিদায় নিতেছেন না; বরং এখন তিনি কোন সংক্ষিপ্ত কিংবা প্রচ্ছন্ন বিধানের ব্যাখ্যা প্রদান করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন। এই রহস্যটি হযরত ওমর (রাঃ) উপলব্ধি করিতে পারিয়া বলিয়াছিলেন, আমাদের কাছে আল্লাহর কিতাব বিদ্যমান, রাসূলের গোটা জীবনালেখ্য আমাদের সম্মুখে অতিবাহিত হইয়াছে। উপরন্তু আমাদের কাছে আছে আল্লাহ্ প্রদত্ত প্রজ্ঞা ও জ্ঞান। সুতরাং এই অন্তিম সময় তাঁহাকে কষ্ট দেওয়া উচিত হইবে না। এই গূঢ় রহস্যটি অনেকেই বুঝিতে পারেন নাই বিধায় বিতর্কের অবতারণা ঘটিয়াছে। হযরত ওমর (রাঃ)-এর এই উপলব্ধিটির সত্যতা ইহা হইতেও প্রমাণিত হয় যে, এই ঘটনা ঘটিয়াছিল বৃহস্পতিবারে। আর নবী (ﷺ) ইনতেকাল করেন পরবর্তী সোমবারে। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) যদি সত্য সত্যই নূতন কোন বিধান লিখিয়া দেওয়ার ইচ্ছা করিয়া থাকিতেন, তাহা হইলে অসুস্থতা ও ওফাতের মধ্যকার চার-পাঁচ দিনের দীর্ঘ অবকাশে তাহা নিশ্চয়ই সম্পন্ন করিতেন।
এই প্রসঙ্গে শিয়া সম্প্রদায়ের এই ধারণাটিও অবান্তর যে, তাহারা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হযরত আলী (রাঃ)-এর সপক্ষে প্রথম খলীফা নিযুক্তির বিষয়টি লিখিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন, আর হযরত ওমর (রাঃ) এই কথাটি উপলব্ধি করিতে পারিয়াই উহার বিরোধিতা করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা তাহাদের একটি নিছক ধারণা মাত্র। কোরআন, হাদীস বা ইতিহাসের দ্বারা ইহার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। “জাযীরাতুল আরব”— বা আরব উপদ্বীপ বলিতে আদন (এডেন) হইতে ইরাক এবং ইয়ামন হইতে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড বুঝায়।
রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর তৃতীয় অসিয়তটি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। কাযী আয়ায বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) অন্তিম সময় স্বহস্তে হযরত উসামা ইবনে যায়দের নেতৃত্বে যেই সেনাদল অভিযানে পাঠানোর জন্য গঠন করিয়াছিলেন, উহাকে যেন অবশ্যই প্রেরণ করা হয়। আবার কেহ কেহ বলিয়াছেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর রওযা শরীফকে যেন এবাদতগাহে পরিণত না করা হয়, সেই সতর্ক নিষেধ-বাণীই ছিল তৃতীয় অসিয়ত।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান