মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৩০- নবীজী সাঃ এর মর্যাদা ও শামাঈল অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৮৭৭
- নবীজী সাঃ এর মর্যাদা ও শামাঈল অধ্যায়
প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৭৭। হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, খন্দকের যুদ্ধের প্রাক্কালে আমরা পরিখা খনন করিতেছিলাম। এই সময় এক খণ্ড শক্ত পাথর দেখা দিল। তখন লোকেরা আসিয়া নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলিল, পরিখা খননকালে একটি শক্ত পাথর দেখা দিয়াছে (যাহা কোদাল কিংবা শাবল দ্বারা ভাংগা যাইতেছে না)। তখন নবী (ছাঃ) বলিলেন আচ্ছা, আমি নিজেই খন্দকে নামিব। অতঃপর তিনি দাঁড়াইলেন, সেই সময় তাহার পেটে পাথর বাধা ছিল। আর আমরাও তিন দিন পর্যন্ত কিছুই খাইতে পাই নাই। এমতাবস্থায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোদাল হাতে লইয়া পাথরটির উপর আঘাত করিলে উহা চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া বালুকণায় পরিণত হয়।
হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, [নবী (ছাঃ)-কে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত অবস্থায় দেখিতে পাইয়া] আমি আমার স্ত্রীর নিকট আসিয়া বলিলাম, তোমার কাছে কি খাওয়ার মত কিছু আছে ? কেননা, আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভীষণ ক্ষুধার্ত দেখিয়াছি। তখন সে একটি চামড়ার পাত্র হইতে এক সা পরিমাণ যব বাহির করিল আর আমাদের পোষা একটি বকরীর বাচ্চা ছিল। তখন আমি সেই বাচ্চাটি যবাহ করিলাম এবং আমার স্ত্রীও যব পিষিল। অবশেষে আমরা হ্যাঁড়িতে গোশত চড়াইলাম। অতঃপর আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসিয়া তাহাকে চুপে চুপে বলিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। আমরা আমাদের ছোট একটি বকরীর বাচ্চা যবাহ করিয়াছি। আর এক সা' যব ছিল, আমার স্ত্রী তাহা পিষিয়াছে, সুতরাং, আপনি আরও কয়েকজনকে সঙ্গে লইয়া চলুন।
(জাবের বলেন, আমার এই কথা শুনিয়া) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চ স্বরে সকলকে ডাকিয়া বলিলেন, হে পরিখা খননকারীগণ। আস, তোমরা তাড়াতাড়ি চল, জাবের তোমাদের জন্য খাবার তৈয়ার করিয়াছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন, তুমি যাও, কিন্তু আমি না আসা পর্যন্ত গোশতের ডেকচি নামাইবে না এবং খামীর হইতে রুটিও তৈয়ার করিবে না। ইহার পর তিনি (লোকজনসহ) উপস্থিত হইলেন। তখন আমার স্ত্রী আটার খামীরগুলি নবী (ছাঃ)-এর সম্মুখে আগাইয়া দিলে তিনি উহাতে মুখের লালা মিশাইলেন এবং বরকতের জন্য দোআ করিলেন। অতঃপর ডেকচির কাছে অগ্রসর হইয়া উহাতেও লালা মিশাইয়া বরকতের জন্য দোআ করিলেন। ইহার পর তিনি (আমার স্ত্রীকে লক্ষ্য করিয়া) বলিলেন, তুমি আরও রুটি প্রস্তুতকারিণীকে ডাক, যাহারা তোমার সাথে রুটি বানায় এবং চুলার উপর হইতে ডেকচি না নামাইয়া উহা হইতে লইয়া পরিবেশন কর।
(হযরত জাবের বলেন,) সাহাবীদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। আমি আল্লাহর কসম করিয়া বলিতেছি——সকলে তৃপ্তি সহকারে খাইয়া চলিয়া যাওয়ার পরও সালুনভর্তি ডেকচি ফুটিতেছিল এবং প্রথম অবস্থার ন্যায় আটার খামীর হইতে রুটি প্রস্তুত হইতেছিল। মোত্তাঃ
كتاب الفضائل والشمائل
وَعَن جَابر قا ل إِنَّا يَوْمَ الْخَنْدَقِ نَحْفِرُ فَعَرَضَتْ كُدْيَةٌ شَدِيدَةٌ فجاؤوا الْنَبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالُوا: هَذِهِ كُدْيَةٌ عَرَضَتْ فِي الْخَنْدَقِ فَقَالَ: «أَنَا نَازِلٌ» ثُمَّ قَامَ وَبَطْنُهُ مَعْصُوبٌ بِحَجَرٍ وَلَبِثْنَا ثَلَاثَةَ أَيَّام لانذوق ذوقا فَأَخَذَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمِعْوَلَ فَضَرَبَ فَعَادَ كَثِيبًا أَهْيَلَ فَانْكَفَأْتُ إِلَى امْرَأَتِي فَقُلْتُ: هَلْ عِنْدَكِ شَيْءٌ؟ فَإِنِّي رَأَيْتُ بِالنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَمْصًا شَدِيدًا فَأَخْرَجَتْ جراباً فِيهِ صاعٌ من شعير وَلنَا بَهْمَةٌ دَاجِنٌ فَذَبَحْتُهَا وَطَحَنَتِ الشَّعِيرَ حَتَّى جَعَلْنَا اللَّحْمَ فِي الْبُرْمَةِ ثُمَّ جِئْتُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم فساررتُه فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ ذَبَحْنَا بُهَيْمَةً لَنَا وَطَحَنْتُ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ فَتَعَالَ أَنْتَ وَنَفَرٌ مَعَكَ فَصَاحَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَا أهلَ الخَنْدَق إِن جَابِرا صَنَعَ سُوراً فَحَيَّ هَلًا بِكُمْ» فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تُنْزِلُنَّ بُرْمَتَكُمْ وَلَا تَخْبِزُنَّ عَجِينَكُمْ حَتَّى أَجِيءَ» . وَجَاءَ فَأَخْرَجْتُ لَهُ عَجِينًا فَبَصَقَ فِيهِ وَبَارَكَ ثُمَّ عَمَدَ إِلَى بُرمْتنا فبصقَ وَبَارك ثمَّ قَالَ «ادعِي خابزة فلتخبز معي وَاقْدَحِي مِنْ بُرْمَتِكُمْ وَلَا تُنْزِلُوهَا» وَهُمْ أَلْفٌ فَأَقْسَمَ بِاللَّهِ لَأَكَلُوا حَتَّى تَرَكُوهُ وَانْحَرَفُوا وَإِنَّ بُرْمَتَنَا لَتَغِطُّ كَمَا هِيَ وَإِنَّ عَجِينَنَا لَيُخْبَزُ كَمَا هُوَ. مُتَّفق عَلَيْهِ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীসের ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

হযরত জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রাযি. খন্দকের যুদ্ধকালীন একদিনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, পরিখা খননকালে একটি বিশাল কঠিন পাথর প্রকাশ পেয়েছিল। সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে সেটি ভেঙ্গে খননের কাজ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই নেমে তার উপর কুড়াল চালালেন। অমনি সেটি ঝরঝরে বালুরাশিতে পরিণত হয়ে গেল।

যখন তিনি পাথরটির উপর কুঠার চালাচ্ছিলেন, তখন তিনি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিলেন। ক্ষুধার কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে তাঁর পেটে পাথর বাঁধা ছিল। যেখানে যুবক ও শক্তিশালী সাহাবীদের পক্ষে পাথরটি ভাঙ্গা সম্ভব হচ্ছিল না, সেখানে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুঠারের আঘাতে সেটি কীভাবে ভেঙ্গে গেল, বিশেষত যখন তাঁর পেটে পাথরও বাঁধা? নিশ্চয়ই এটা ছিল তাঁর একটি মু'জিযা। এর বিস্তারিত বিবরণ হযরত বারা' ইবন আযিব রাযি.-এর একটি বর্ণনায় আছে। তাতে বলা হয়েছে-
فقال: «بسم الله» فضرب ضربة، فكسر ثلث الحجر، وقال: «الله أكبر أعطيت مفاتيح الشام، والله إني لأبصر قصورها الحمر من مكاني هذا». ثم قال: «بسم الله» وضرب أخرى، فكسر ثلث الحجر، فقال: «الله أكبر، أعطيت مفاتيح فارس، والله إني لأبصر المدائن، وأبصر قصرها الأبيض من مكاني هذا»، ثم قال: «بسم الله وضرب ضربة أخرى فقلع بقية الحجر، فقال: «الله أكبر أعطيت مفاتيح اليمن، والله إني لأبصر أبواب صنعاء من مكاني هذا
‘তিনি বিসমিল্লাহ বলে পাথরে একটি আঘাত করলেন। পাথরটির তিন ভাগের একভাগ কেটে গেল। তিনি বললেন, আল্লাহু আকবার, আমাকে শামের চাবিগুলো দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি এই মুহূর্তে তথাকার লাল প্রাসাদগুলো দেখতে পাচ্ছি। তারপর দ্বিতীয় আঘাত করলেন। তাতে তিন ভাগের আরও একভাগ কেটে গেল। তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার, আমাকে পারস্যের চাবিসমূহ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি এই মুহূর্তে (পারস্যের রাজধানী) মাদাইনের শ্বেত প্রাসাদ দেখতে পাচ্ছি। তারপর তৃতীয় আঘাত করলেন এবং বললেন, বিসমিল্লাহ। এবার পাথরটির অবশিষ্টাংশ কেটে গেল। তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার, আমাকে ইয়ামানের চাবিসমূহ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি এই মুহূর্তে এ জায়গা থেকে (রাজধানী) সান'আর দরজাগুলো দেখতে পাচ্ছি।

অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যেক আঘাতে পাথরটি থেকে আগুনের ফুলকি বের হয়েছিল এবং তার আলোয় সমগ্র মদীনা আলোকিত হয়ে উঠেছিল। প্রত্যেকবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহু আকবার বলে উঠেন এবং তাঁর সঙ্গে সাহাবীগণও। শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানান যে, সে আগুনের আলোয় তিনি একেকটি দেশের অট্টালিকাসমূহ দেখতে পেয়েছিলেন আর হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তাঁকে সুসংবাদ শুনিয়েছিলেন যে, তাঁর উম্মত এসব দেশ জয় করবে।

এ যুদ্ধকালে সবাই ছিলেন ক্ষুধার্ত। তিনদিন পর্যন্ত কারও কিছু খাওয়া হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেটে পাথর বেঁধে রেখেছিলেন। আরও অনেক সাহাবীর পেটে পাথর বাঁধা ছিল। হযরত জাবির রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষুধার্ত অবস্থা সইতে পারছিলেন না। একটা কিছু ব্যবস্থা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। অনুমতি নিয়ে বাড়িতে গেলেন। বাড়িতে কিছু যব ও একটি বকরির বাচ্চা ছিল। তা দ্বারা খাওয়ার ব্যবস্থা করে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে আসলেন। হযরত জাবির রাযি. বলেন-
(আমি বললাম, আমার সামান্য কিছু খাবার আছে। ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি উঠুন এবং আপনার সঙ্গে দু-একজন লোকও)। এক বর্ণনায় আছে, খাবার খুব কম থাকায় তিনি চাচ্ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাই যান। তাঁর স্ত্রীও সতর্ক করে দিয়েছিলেন যাতে বেশি লোক নিয়ে না আসেন। যেমন এক রেওয়ায়েতে আছে-
لا تفضحني برسول الله ﷺ ومن معه (দেখুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীদের কাছে আমাকে যেন বেইজ্জত না করেন)। অর্থাৎ আমাদের খাবার তো খুব কম। যদি বেশি লোক নিয়ে আসেন, আমরা তাদের তৃপ্তিভরে খাওয়াতে পারব না। সেটা আমাদের জন্য বড় লজ্জার কারণ হবে। তাই বুঝেশুনে মেহমান আনবেন।

এ কারণেই হযরত জাবির রাযি. শুরুতে বলে নিয়েছেন আমার সামান্য কিছু খাবার আছে। এক বর্ণনায় আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কানে কানে খাদ্যের পরিমাণ উল্লেখ করেছিলেন যে, তা একটি ছাগল এবং এক সা' পরিমাণ যব। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সামান্য খাবার সবাই মিলে খেতে চাইলেন। তাই আনসার ও মুহাজির যারাই খন্দক খননের কাজে নিয়োজিত ছিলেন, সবাইকেই সঙ্গে যাওয়ার জন্য বললেন। যেমন এক রেওয়ায়েতে আছে, তিনি ডেকে বললেন-
يا أهل الخندق : إن جابرا قد صنع سورا فحيهلا بكم (হে পরিখা খননকারীগণ। জাবির তোমাদের জন্য ভোজের আয়োজন করেছে। তোমরা দ্রুত চলো)। তিনি তো সম্পূর্ণরূপে তাওয়াক্কুল করে অভ্যস্ত। বিশ্বাস ছিল আল্লাহ তা'আলার উপর যথাযথ ভরসা করে খেলে এই সামান্য খাবারই সকলের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে তিনি হযরত জাবির রাযি.-কেও এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, (তুমি যাকে অল্প বলছ, প্রকৃতপক্ষে তা) প্রচুর (ও) উত্তম (খাবার)।

তারপর তিনি খাদ্যে বরকত হওয়ার লক্ষ্যে হযরত জাবির রাযি.-কে বললেন, তুমি তাকে (স্ত্রীকে) বলো আমি না আসা পর্যন্ত যেন চুলা থেকে হাঁড়ি ও রুটি না নামায়। তারপর তিনি আনসার ও মুহাজিরদের নিয়ে হযরত জাবির রাযি.-এর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলেন। এত লোক দেখে তাঁর স্ত্রী ভড়কে গেলেন। প্রথমে তো স্বামীকে নানা কথা বলে তিরস্কার করলেন।

এক বর্ণনায় আছে, হযরত জাবির রাযি. নিজেও খুব পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলেন, এতসংখ্যক লোক আসায় আমি যে কী পরিমাণ লজ্জাবোধ করছিলাম তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মনে মনে বললাম, মাত্র এক সা' যব ও একটি ছাগলছানা, অথচ মেহমান এত লোক! এখন কী হবে?

তাঁর স্ত্রী ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী। তিনি যখন জানতে পারলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সবই জানানো হয়েছে, তখন তিনি আশ্বস্ত হয়ে গেলেন যে, তিনি জেনেশুনেই যখন এত লোক নিয়ে এসেছেন, তখন নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনও হেকমত আছে। পেরেশানির কোনও কারণ নেই। হয়তো তাঁর উপস্থিতির বরকতে এ সামান্য খাবারেই সকলের প্রয়োজন মিটে যাবে।

বাড়িতে পৌঁছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে আটার খামিরায় ও গোশতের হাঁড়িতে খানিকটা থুতু দিলেন। সঙ্গে বরকতের জন্য দুআ করলেন। সেইসঙ্গে রুটি তৈরি করতে পারে এমন কোনও প্রতিবেশী মহিলাকে ডেকে আনার হুকুম করলেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের থুতু অন্যদের মত নয়। তাঁর শরীরের ঘামেও তো ছিল মিশকের চেয়েও বেশি সুরভি। সুতরাং পবিত্র মুখের থুতুতে অমৃতের আস্বাদ ও প্রাণকাড়া সুরভি তো থাকবেই। তাই খাবারে তা দেওয়াতে খাবারের অমর্যাদা হয়নি; বরং তা স্বতন্ত্র মহিমা লাভ করেছে। পবিত্র মুখের সে থুতুর সঙ্গে ছিল দু'আর মিলন। নূরুন ‘আলা নূর। বরকত তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল। আটার খামিরা যদিও সামান্য, কিন্তু সে বরকতের কারণে রুটি তৈরিতে সাহায্যকারীর প্রয়োজন পড়েছিল।

সুতরাং রুটি তৈরি হতে থাকল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তা বিতরণের দায়িত্ব নিলেন। তিনি রুটি টুকরো টুকরো করে তার উপর গোশত রাখতে থাকলেন। প্রত্যেকবার তা নেওয়ার পর হাঁড়ি ও চুলা ঢেকে রাখছিলেন আর তা সাহাবীদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছিলেন। এভাবে সে খাবার খেয়ে সকলে পরিতৃপ্ত হয়ে গেলেন। তারপরও কিছু অবশিষ্ট থাকল। বরং দ্বিতীয় বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, আটার খামিরা ও হাঁড়ির গোশত আগে যেমন ছিল তেমনিই রয়ে গেল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (হযরত জাবির রাযি. এর স্ত্রীকে) বললেন- كلي هذا وأهدي ، فإن الناس اصابتهم مجاعة (তুমি এটি খাও এবং হাদিয়া দাও। মানুষ বড় ক্ষুধার্ত)। এক বর্ণনায় আছে, হযরত জাবির রাযি. বলেন, আমরা সারাটা দিন সেই খাবার নিজেরাও খেয়েছিলাম এবং মানুষের মধ্যেও বিতরণ করছিলাম। আল্লাহু আকবার! মাত্র এক সা খাবার ও ছোট্ট একটি ছাগলছানা। এক হাজার মানুষ তৃপ্তির সঙ্গে তা খেল। তারপর দিনভর তা সেই পরিবারটির খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর পর লোকজনের মধ্যে অবারিতভাবে বিতরণও করা হল।

এটা আল্লাহ তা'আলার কুদরতের মহিমা। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের সবকিছুতে এভাবেই বরকত দিয়ে থাকেন, বিশেষত বান্দাগণ যদি সবরের সঙ্গে তাঁর হুকুম পালনে রত থাকে। আনসার ও মুহাজিরগণ তিন দিনের না খাওয়া ছিলেন। ক্ষুধার কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে তাঁদেরকে পেটে পাথর পর্যন্ত বাধতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুম পালনে তাঁরা বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেননি। সেই ক্ষুধার্ত শরীর নিয়ে মাটি কেটে পরিখা খননের মত কঠিন কাজও তাঁরা খুশিমনে করে যাচ্ছিলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের প্রতি বেহদ্দ খুশি ছিলেন। এই সবর ও আনুগত্যের যে পুরস্কার পরকালের জন্য বরাদ্দ আছে, তা তো আছেই। দুনিয়ায়ও আল্লাহ তা'আলা তার খানিকটা প্রকাশ দেখিয়ে দিলেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ক্ষুধার অশেষ কষ্টের মধ্যেও আল্লাহর হুকুম পালনে যত্নবান থাকা চাই ।

খ. নবীদের মু'জিযা সত্য। তাতে অবিশ্বাস করা ঈমানের পরিপন্থী।

গ. যুদ্ধজয়ে আল্লাহ তা'আলার উপর নির্ভরতার পাশাপাশি সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থাও গ্রহণ করা চাই। এটাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা।

ঘ. নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ক্ষুধার্তদের ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করা উচিত।

ঙ. ক্ষুধার্ত ব্যক্তি নিজ মুরুব্বি ও মাননীয় কেউ হলে সে ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে তার সেবা করা চাই।

চ. অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।

ছ. স্ত্রীর কর্তব্য অতিথি আপ্যায়নে স্বামীর সহযোগিতা করা।

জ. আপ্যায়নকারীর উপর আস্থা থাকলে নিমন্ত্রিত ব্যক্তি সঙ্গে অতিরিক্ত লোক নিয়ে আসতে পারে।

ঝ. আপ্যায়নকারী ও তার পরিবারবর্গের বাড়তি কষ্ট না হয়, অতিথির সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি।

ঞ. অতিথির কর্তব্য পরিবেশিত খাবারে বরকতের জন্য দুআ করা।

ট. অতিথির উচিত আপ্যায়নের কাজে প্রয়োজনে গৃহকর্তার সহযোগিতা করা।

ঠ. খাদ্য ঢেকে রাখা বরকত পাওয়ার পক্ষে সহায়ক।

ড. আপ্যায়ন শেষে খাবার বেঁচে থাকলে যতটুকু সম্ভব প্রতিবেশীদের মধ্যে তা বিতরণ করা চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান