মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
২৯- সৃষ্টির সূচনা ও কিয়ামত পরবর্তী বর্ণনা
হাদীস নং: ৫৭০৭
- সৃষ্টির সূচনা ও কিয়ামত পরবর্তী বর্ণনা
প্রথম অনুচ্ছেদ - সৃষ্টির সূচনা ও নবী-রাসূলদের আলোচনা
৫৭০৭। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেনঃ একদা হযরত আইউব (আঃ) নগ্নাবস্থায় গোসল করিতেছিলেন, এমনি অবস্থায় তাহার উপর সোনালী পঙ্গপাল পতিত হইল। তখন আইউব (আঃ) সেইগুলিকে দ্রুত ধরিয়া ধরিয়া কাপড়ে রাখিতে লাগিলেন। তখন তাঁহার পরওয়ারদিগার তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেনঃ হে আইউব। তুমি যাহা দেখিতেছ, আমি কি উহা হইতে তোমাকে অমুখাপেক্ষী করিয়া দেই নাই! জবাবে তিনি বলিলেন: হ্যাঁ, নিশ্চয় আপনার ইজ্জতের কসম। কিন্তু আপনার বরকত ও কল্যাণ হইতে তো আমি অভাবমুক্ত নই। -বুখারী
كتاب أحوال القيامة وبدء الخلق
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: بَيْنَا أَيُّوبُ يَغْتَسِلُ عُرْيَانًا فَخَرَّ عَلَيْهِ جَرَادٌ مِنْ ذَهَبٍ فَجَعَلَ أَيُّوبُ يَحْثِي فِي ثَوْبِهِ فَنَادَاهُ رَبُّهُ: يَا أَيُّوبُ أَلَمْ أَكُنْ أَغْنَيْتُكَ عَمَّا تَرَى؟ قَالَ: بَلَى وَعِزَّتِكَ وَلَكِن لَا غنى بِي عَن بركتك . رَوَاهُ البُخَارِيّ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম ছিলেন বনী ইসরাঈলের একজন নবী। বলা হয়ে থাকে, তিনি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ৫ম বংশধর। তাফসীরবিদ ও ঐতিহাসিকগণের বর্ণনা অনুযায়ী তাঁর জনপদ ছিল বুসরা। এটা ফিলিস্তীনের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ শহর। প্রাচীনকালে এটি একটি বাণিজ্যিক নগরী ছিল। তাওরাতের একাধিক জায়গায় শহরটির নাম পাওয়া যায়।
হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম একজন সচ্ছল ও ধনী লোক ছিলেন। তাঁর ছিল ক্ষেত-খামার, ফলের বাগান, গবাদি পশুসহ অনেক ধন-সম্পদ। তাঁর বহু সন্তান-সন্ততি ছিল। সকলেই নেককার। প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে তাঁর স্ত্রীর নাম রাহমা*।(*রাহীমা নয় যেমনটা লোকমুখে প্রসিদ্ধ।) তিনি একজন শোকরগুযার ও নেককার নারী ছিলেন। হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম ছিলেন খুবই ধৈর্যশীল ও শোকরগুযার ব্যক্তি। একবার আল্লাহ তা'আলা বিপদ-আপদ দ্বারা তাঁকে পরীক্ষা করেন। তাঁর ধন-সম্পদ, ক্ষেত-খামার ও গবাদি পশু সব ধ্বংস হয়ে যায়। ছেলে-মেয়েদেরও মৃত্যু হয়ে যায়। নিজেও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। বন্ধু-বান্ধব সকলে তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। পুণ্যবতী স্ত্রী একা রাহমাই তাঁর সঙ্গে থেকে যান। তিনি পরম বিশ্বস্ততার পরিচয় দেন। অবিরাম স্বামীর সেবাযত্ন করতে থাকেন। তারা স্বামী-স্ত্রী দীর্ঘকাল কষ্ট-ক্লেশের জীবন যাপন করেন। কখনও ভাগ্যের উপর দোষারোপ করেননি। কোনও অভিযোগ-অনুযোগের ভাষা উচ্চারণ করেননি। সবরের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকেন এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে বিপদমুক্তির জন্য দু'আয় রত থাকেন। কুরআন মাজীদে তাঁর দু'আর কথা এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ (83)
এবং আইয়ূবকে দেখো, যখন সে নিজ প্রতিপালককে ডেকে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমার এই কষ্ট দেখা দিয়েছে এবং তুমি তো দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু।(সূরা আম্বিয়া (২১), আয়াত ৮৩)
পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা তাঁর দু'আ কবুল করেন। কঠিন রোগ থেকে তাঁকে মুক্তিদান করেন। সেজন্য এক অলৌকিক ব্যবস্থা করা হয়। আল্লাহ তা'আলার হুকুমে তিনি পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটিতে আঘাত করেন। তাতে এক ঝরনা বের হয়ে আসে। সে ঝরনার পানি ছিল ঠাণ্ডা ও সুপেয়। তাঁকে সেই পানিতে গোসল করতে বলা হয়। এর ফলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَاذْكُرْ عَبْدَنَا أَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الشَّيْطَانُ بِنُصْبٍ وَعَذَابٍ (41) ارْكُضْ بِرِجْلِكَ هَذَا مُغْتَسَلٌ بَارِدٌ وَشَرَابٌ (42)
আমার বান্দা আইয়ূবকে স্মরণ করো, যখন সে নিজ প্রতিপালককে ডেকে বলেছিল, শয়তান আমাকে দুঃখ ও কষ্টে জড়িয়েছে। (আমি তাকে বললাম) তুমি তোমার পা দ্বারা মাটিতে আঘাত করো। নাও, এই তো গোসলের ঠাণ্ডা পানি এবং পানীয়।(সূরা সোয়াদ (৩৮), আয়াত ৪১-৪২)
আল্লাহ তা'আলা তাঁর সমস্ত ধন-সম্পদ তাঁকে ফিরিয়ে দেন। মৃত সন্তানদের জীবিত করে দেন কিংবা তাদের সমসংখ্যক সন্তান নতুনভাবে দান করেন। এভাবে তিনি আগের চেয়ে আরও বেশি সচ্ছলতা ও সুখের জীবন লাভ করেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَكَشَفْنَا مَا بِهِ مِنْ ضُرٍّ وَآتَيْنَاهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُمْ مَعَهُمْ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَذِكْرَى لِلْعَابِدِينَ (84)
আমি তার দু'আ কবুল করলাম এবং সে যে কষ্টে আক্রান্ত ছিল তা দূর করে দিলাম। আর তাকে তার পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সমপরিমাণ আরও, যাতে আমার পক্ষ হতে রহমতের প্রকাশ ঘটে এবং ইবাদতকারীদের লাভ হয় স্মরণীয় শিক্ষা।(সূরা আম্বিয়া (২১), আয়াত ৮৪)
ঐতিহাসিকদের মতে হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম ৯৩ বছর জীবিত ছিলেন। তিনি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন ৭০ বছর বয়সে। সুস্থ হওয়ার পর ২০ বছর জীবিত ছিলেন।
بَيْنَا أَيُّوبُ عَلَيْهِ السَّلَامُ يَغْتَسِلُ عُرْيَانًا (হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম বিবস্ত্র হয়ে গোসল করছিলেন)। অন্যের দৃষ্টির আড়ালে বিবস্ত্র হয়ে গোসল করা জায়েয। যারা সাদামাটা জীবনযাপন করে, অতিরিক্ত কাপড় রাখে না, তাদের তো এরূপ করতেই হয়। বহু আল্লাহওয়ালাই এরকম ছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের শুরুর যমানা এভাবেই কেটেছিল। অনেক নবী রাসূলই খুবই সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। কাজেই তাদের বিবস্ত্র হয়ে গোসল করাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, বিশেষত এটা যখন জায়েযও।
فَخَرَّ عَلَيْهِ جَرَادٌ مِنْ ذَهَبٍ (এ অবস্থায় তাঁর উপর সোনার ফড়িং পতিত হয়)। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে- خَرَّ عَلَيْهِ رِجْلُ جَرَادٍ مِنْ ذَهَب (তাঁর উপর একপাল সোনার ফড়িং পড়ল)।(সহীহ বুখারী: ৭৪৯৩; মুসনাদুল হুমায়দী: ১০৯১; মুসনাদে আহমাদ: ৭৩০৯) আরেক বর্ণনায় আছে- بَيْنَمَا أَيُّوْبُ يَغْتَسِلُ عُرْيَانًا أمْطِرَ عَلَيْهِ جَرَادٌ مِنْ ذَهَبٍ (আইয়ূব বিবস্ত্র হয়ে গোসল করছিলেন। এ অবস্থায় তাঁর উপর সোনার ফড়িংয়ের বৃষ্টি হয়)।(সহীহ ইবন হিব্বান: ৬২২৯; মুসনাদ আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৫৭৭; মুসনাদুল বাযযার: ৯৫৫০) অর্থাৎ তাঁর উপর সোনার ফড়িং পড়তে থাকে বৃষ্টির মতো। এটা ছিল তাঁর একটি মু'জিযা। অলৌকিকভাবে আল্লাহ তা'আলা তাঁর উপর আসমান থেকে সোনার ফড়িং ঝরাতে থাকেন। সেগুলো বাস্তবিকই প্রাণবিশিষ্ট ফড়িং ছিল, যার দেহটা ছিল স্বর্ণের, নাকি বাহ্যিক কাঠামোটা ফড়িংয়ের মতো ছিল, কিন্তু তার কোনও প্রাণ ছিল না? উভয়ই সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে কী ছিল তা আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। আল্লাহ তা'আলার পক্ষে প্রাণবিশিষ্ট স্বর্ণের ফড়িং সৃষ্টি করা অসম্ভব কিছু নয়। তিনি যা ইচ্ছা করেন, কেবল 'হও' বললেই তা হয়ে যায়। সোনার ফড়িংগুলো দেখামাত্রই হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম গোসল রেখে সেগুলো দু'হাতে কুঁড়াতে লাগলেন এবং তাঁর কাপড়ের ভেতর জমা করতে থাকলেন।
বাহ্যদৃষ্টিতে মনে হয় সম্পদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। কিন্তু কোনও নবী দুনিয়ার সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট থাকেন না। তাহলে কেন তিনি এ কাজ করছিলেন? এ রহস্য মানুষের সামনে স্পষ্ট করে দেওয়ার দরকার ছিল। সে লক্ষ্যেই আল্লাহ তা'আলা তাঁকে ডেকে বললেন-
يَا أَيُّوْبُ، أَلَمْ أَكُنْ أَغْنَيْتَكَ عَمَّا تَرى؟ (হে আইয়ূব! তুমি যা দেখছ তা থেকে আমি কি তোমাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করিনি)? আল্লাহ তা'আলা এ কথা তাঁকে সরাসরিও বলতে পারেন, আবার কোনও ফিরিশতার মাধ্যমেও বলতে পারেন। তাঁর ঐশ্বর্যের জীবন ছিল শুরুতে এবং শেষে। মাঝখানে ছিল অভাব-অনটনের ও পরীক্ষার জীবন। এ ঘটনা ঠিক কোন সময়কার, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
আল্লাহ তা'আলার এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম বন্ধ তাৎপর্যপূর্ণ উত্তর দেন। এমন সারগর্ভ ও চমৎকার জবাব একজন নবীর পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। তিনি বলে ওঠেন-
بَلَى وَعِزَّتِكَ، وَلَكِنْ لَا غِنَى بِي عَنْ بَرَكَتِكَ (আপনার মহিমার শপথ! অবশ্যই করেছেন। কিন্তু আপনার বরকত থেকে আমার প্রয়োজন মিটে যাওয়ার নয়)। অর্থাৎ অবশ্যই আপনি আমাকে ধনী বানিয়েছেন। আমাকে প্রচুর ধন-সম্পদ দিয়েছেন। সেদিকে লক্ষ করলে এ সোনার ফড়িংয়ের কোনও প্রয়োজন আমার নেই। এর প্রতি আমার কোনও লোভও নেই। আপনি আমার অন্তর লোভ-লালসা থেকে মুক্ত রেখেছেন। কিন্তু বিষয়টা তো বরকতের। এসবের জন্য আমি কোনও মেহনত করিনি। আমি এগুলো চাইওনি। আপনি নিজ রহমত ও অনুগ্রহে অলৌকিকভাবে এগুলো আমার উপর বর্ষণ করেছেন। আপনার এ রহমতের দান আমি তো উপেক্ষা করতে পারি না। আমি সর্বদাই আপনার রহমতের ভিখারি। আপনি যখন একান্তই নিজ দয়ায় এগুলো আমার উপর বর্ষণ করেছেন, তখন আপনার বান্দা হিসেবে এগুলো আমি না কুঁড়িয়ে পারি কি?
বস্তুত সোনার ফড়িংগুলো কুঁড়ানো ছিল হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালামের বন্দেগীর প্রকাশ। আল্লাহর দান গ্রহণ না করা এক রকম ঔদ্ধত্য। কোনও নবীর ক্ষেত্রে তা কল্পনারও অতীত। এটাও বলা যায় যে, তা কুঁড়ানোটা ছিল হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালামের কৃতজ্ঞতাবোধের প্রকাশ। আল্লাহ তা'আলার দান গ্রহণ করার দ্বারাই তো মুখে ও মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ হয়। একজন কৃতজ্ঞ বান্দা সে সুযোগ তো গ্রহণ করতে চাইবেই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবীগণের মু'জিযা সত্য। তাতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।
খ. আল্লাহ তা'আলা ধন-সম্পদ দিয়ে বান্দাকে পরীক্ষা করে থাকেন।
গ. আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ গ্রহণ করতে হবে কৃতজ্ঞতাবোধের সঙ্গে; লোভের বশে নয়।
ঘ. আল্লাহ তা'আলা যাকে ধন-সম্পদ দেন, তার উচিত তা প্রকাশ করা ও সেজন্য কৃতজ্ঞ থাকা।
ঙ. যে সম্পদ লোভ-লালসা ছাড়া পাওয়া যায়, তা বরকতপূর্ণ হয়।
চ. বান্দার উচিত সর্বদা আল্লাহ তা'আলার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা।
হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম একজন সচ্ছল ও ধনী লোক ছিলেন। তাঁর ছিল ক্ষেত-খামার, ফলের বাগান, গবাদি পশুসহ অনেক ধন-সম্পদ। তাঁর বহু সন্তান-সন্ততি ছিল। সকলেই নেককার। প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে তাঁর স্ত্রীর নাম রাহমা*।(*রাহীমা নয় যেমনটা লোকমুখে প্রসিদ্ধ।) তিনি একজন শোকরগুযার ও নেককার নারী ছিলেন। হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম ছিলেন খুবই ধৈর্যশীল ও শোকরগুযার ব্যক্তি। একবার আল্লাহ তা'আলা বিপদ-আপদ দ্বারা তাঁকে পরীক্ষা করেন। তাঁর ধন-সম্পদ, ক্ষেত-খামার ও গবাদি পশু সব ধ্বংস হয়ে যায়। ছেলে-মেয়েদেরও মৃত্যু হয়ে যায়। নিজেও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। বন্ধু-বান্ধব সকলে তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। পুণ্যবতী স্ত্রী একা রাহমাই তাঁর সঙ্গে থেকে যান। তিনি পরম বিশ্বস্ততার পরিচয় দেন। অবিরাম স্বামীর সেবাযত্ন করতে থাকেন। তারা স্বামী-স্ত্রী দীর্ঘকাল কষ্ট-ক্লেশের জীবন যাপন করেন। কখনও ভাগ্যের উপর দোষারোপ করেননি। কোনও অভিযোগ-অনুযোগের ভাষা উচ্চারণ করেননি। সবরের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকেন এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে বিপদমুক্তির জন্য দু'আয় রত থাকেন। কুরআন মাজীদে তাঁর দু'আর কথা এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ (83)
এবং আইয়ূবকে দেখো, যখন সে নিজ প্রতিপালককে ডেকে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমার এই কষ্ট দেখা দিয়েছে এবং তুমি তো দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু।(সূরা আম্বিয়া (২১), আয়াত ৮৩)
পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা তাঁর দু'আ কবুল করেন। কঠিন রোগ থেকে তাঁকে মুক্তিদান করেন। সেজন্য এক অলৌকিক ব্যবস্থা করা হয়। আল্লাহ তা'আলার হুকুমে তিনি পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটিতে আঘাত করেন। তাতে এক ঝরনা বের হয়ে আসে। সে ঝরনার পানি ছিল ঠাণ্ডা ও সুপেয়। তাঁকে সেই পানিতে গোসল করতে বলা হয়। এর ফলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَاذْكُرْ عَبْدَنَا أَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الشَّيْطَانُ بِنُصْبٍ وَعَذَابٍ (41) ارْكُضْ بِرِجْلِكَ هَذَا مُغْتَسَلٌ بَارِدٌ وَشَرَابٌ (42)
আমার বান্দা আইয়ূবকে স্মরণ করো, যখন সে নিজ প্রতিপালককে ডেকে বলেছিল, শয়তান আমাকে দুঃখ ও কষ্টে জড়িয়েছে। (আমি তাকে বললাম) তুমি তোমার পা দ্বারা মাটিতে আঘাত করো। নাও, এই তো গোসলের ঠাণ্ডা পানি এবং পানীয়।(সূরা সোয়াদ (৩৮), আয়াত ৪১-৪২)
আল্লাহ তা'আলা তাঁর সমস্ত ধন-সম্পদ তাঁকে ফিরিয়ে দেন। মৃত সন্তানদের জীবিত করে দেন কিংবা তাদের সমসংখ্যক সন্তান নতুনভাবে দান করেন। এভাবে তিনি আগের চেয়ে আরও বেশি সচ্ছলতা ও সুখের জীবন লাভ করেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَكَشَفْنَا مَا بِهِ مِنْ ضُرٍّ وَآتَيْنَاهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُمْ مَعَهُمْ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَذِكْرَى لِلْعَابِدِينَ (84)
আমি তার দু'আ কবুল করলাম এবং সে যে কষ্টে আক্রান্ত ছিল তা দূর করে দিলাম। আর তাকে তার পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সমপরিমাণ আরও, যাতে আমার পক্ষ হতে রহমতের প্রকাশ ঘটে এবং ইবাদতকারীদের লাভ হয় স্মরণীয় শিক্ষা।(সূরা আম্বিয়া (২১), আয়াত ৮৪)
ঐতিহাসিকদের মতে হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম ৯৩ বছর জীবিত ছিলেন। তিনি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন ৭০ বছর বয়সে। সুস্থ হওয়ার পর ২০ বছর জীবিত ছিলেন।
بَيْنَا أَيُّوبُ عَلَيْهِ السَّلَامُ يَغْتَسِلُ عُرْيَانًا (হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম বিবস্ত্র হয়ে গোসল করছিলেন)। অন্যের দৃষ্টির আড়ালে বিবস্ত্র হয়ে গোসল করা জায়েয। যারা সাদামাটা জীবনযাপন করে, অতিরিক্ত কাপড় রাখে না, তাদের তো এরূপ করতেই হয়। বহু আল্লাহওয়ালাই এরকম ছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের শুরুর যমানা এভাবেই কেটেছিল। অনেক নবী রাসূলই খুবই সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। কাজেই তাদের বিবস্ত্র হয়ে গোসল করাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, বিশেষত এটা যখন জায়েযও।
فَخَرَّ عَلَيْهِ جَرَادٌ مِنْ ذَهَبٍ (এ অবস্থায় তাঁর উপর সোনার ফড়িং পতিত হয়)। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে- خَرَّ عَلَيْهِ رِجْلُ جَرَادٍ مِنْ ذَهَب (তাঁর উপর একপাল সোনার ফড়িং পড়ল)।(সহীহ বুখারী: ৭৪৯৩; মুসনাদুল হুমায়দী: ১০৯১; মুসনাদে আহমাদ: ৭৩০৯) আরেক বর্ণনায় আছে- بَيْنَمَا أَيُّوْبُ يَغْتَسِلُ عُرْيَانًا أمْطِرَ عَلَيْهِ جَرَادٌ مِنْ ذَهَبٍ (আইয়ূব বিবস্ত্র হয়ে গোসল করছিলেন। এ অবস্থায় তাঁর উপর সোনার ফড়িংয়ের বৃষ্টি হয়)।(সহীহ ইবন হিব্বান: ৬২২৯; মুসনাদ আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৫৭৭; মুসনাদুল বাযযার: ৯৫৫০) অর্থাৎ তাঁর উপর সোনার ফড়িং পড়তে থাকে বৃষ্টির মতো। এটা ছিল তাঁর একটি মু'জিযা। অলৌকিকভাবে আল্লাহ তা'আলা তাঁর উপর আসমান থেকে সোনার ফড়িং ঝরাতে থাকেন। সেগুলো বাস্তবিকই প্রাণবিশিষ্ট ফড়িং ছিল, যার দেহটা ছিল স্বর্ণের, নাকি বাহ্যিক কাঠামোটা ফড়িংয়ের মতো ছিল, কিন্তু তার কোনও প্রাণ ছিল না? উভয়ই সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে কী ছিল তা আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। আল্লাহ তা'আলার পক্ষে প্রাণবিশিষ্ট স্বর্ণের ফড়িং সৃষ্টি করা অসম্ভব কিছু নয়। তিনি যা ইচ্ছা করেন, কেবল 'হও' বললেই তা হয়ে যায়। সোনার ফড়িংগুলো দেখামাত্রই হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম গোসল রেখে সেগুলো দু'হাতে কুঁড়াতে লাগলেন এবং তাঁর কাপড়ের ভেতর জমা করতে থাকলেন।
বাহ্যদৃষ্টিতে মনে হয় সম্পদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। কিন্তু কোনও নবী দুনিয়ার সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট থাকেন না। তাহলে কেন তিনি এ কাজ করছিলেন? এ রহস্য মানুষের সামনে স্পষ্ট করে দেওয়ার দরকার ছিল। সে লক্ষ্যেই আল্লাহ তা'আলা তাঁকে ডেকে বললেন-
يَا أَيُّوْبُ، أَلَمْ أَكُنْ أَغْنَيْتَكَ عَمَّا تَرى؟ (হে আইয়ূব! তুমি যা দেখছ তা থেকে আমি কি তোমাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করিনি)? আল্লাহ তা'আলা এ কথা তাঁকে সরাসরিও বলতে পারেন, আবার কোনও ফিরিশতার মাধ্যমেও বলতে পারেন। তাঁর ঐশ্বর্যের জীবন ছিল শুরুতে এবং শেষে। মাঝখানে ছিল অভাব-অনটনের ও পরীক্ষার জীবন। এ ঘটনা ঠিক কোন সময়কার, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
আল্লাহ তা'আলার এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম বন্ধ তাৎপর্যপূর্ণ উত্তর দেন। এমন সারগর্ভ ও চমৎকার জবাব একজন নবীর পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। তিনি বলে ওঠেন-
بَلَى وَعِزَّتِكَ، وَلَكِنْ لَا غِنَى بِي عَنْ بَرَكَتِكَ (আপনার মহিমার শপথ! অবশ্যই করেছেন। কিন্তু আপনার বরকত থেকে আমার প্রয়োজন মিটে যাওয়ার নয়)। অর্থাৎ অবশ্যই আপনি আমাকে ধনী বানিয়েছেন। আমাকে প্রচুর ধন-সম্পদ দিয়েছেন। সেদিকে লক্ষ করলে এ সোনার ফড়িংয়ের কোনও প্রয়োজন আমার নেই। এর প্রতি আমার কোনও লোভও নেই। আপনি আমার অন্তর লোভ-লালসা থেকে মুক্ত রেখেছেন। কিন্তু বিষয়টা তো বরকতের। এসবের জন্য আমি কোনও মেহনত করিনি। আমি এগুলো চাইওনি। আপনি নিজ রহমত ও অনুগ্রহে অলৌকিকভাবে এগুলো আমার উপর বর্ষণ করেছেন। আপনার এ রহমতের দান আমি তো উপেক্ষা করতে পারি না। আমি সর্বদাই আপনার রহমতের ভিখারি। আপনি যখন একান্তই নিজ দয়ায় এগুলো আমার উপর বর্ষণ করেছেন, তখন আপনার বান্দা হিসেবে এগুলো আমি না কুঁড়িয়ে পারি কি?
বস্তুত সোনার ফড়িংগুলো কুঁড়ানো ছিল হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালামের বন্দেগীর প্রকাশ। আল্লাহর দান গ্রহণ না করা এক রকম ঔদ্ধত্য। কোনও নবীর ক্ষেত্রে তা কল্পনারও অতীত। এটাও বলা যায় যে, তা কুঁড়ানোটা ছিল হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালামের কৃতজ্ঞতাবোধের প্রকাশ। আল্লাহ তা'আলার দান গ্রহণ করার দ্বারাই তো মুখে ও মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ হয়। একজন কৃতজ্ঞ বান্দা সে সুযোগ তো গ্রহণ করতে চাইবেই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবীগণের মু'জিযা সত্য। তাতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।
খ. আল্লাহ তা'আলা ধন-সম্পদ দিয়ে বান্দাকে পরীক্ষা করে থাকেন।
গ. আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ গ্রহণ করতে হবে কৃতজ্ঞতাবোধের সঙ্গে; লোভের বশে নয়।
ঘ. আল্লাহ তা'আলা যাকে ধন-সম্পদ দেন, তার উচিত তা প্রকাশ করা ও সেজন্য কৃতজ্ঞ থাকা।
ঙ. যে সম্পদ লোভ-লালসা ছাড়া পাওয়া যায়, তা বরকতপূর্ণ হয়।
চ. বান্দার উচিত সর্বদা আল্লাহ তা'আলার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)