মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৯- সৃষ্টির সূচনা ও কিয়ামত পরবর্তী বর্ণনা

হাদীস নং: ৫৭০৪
- সৃষ্টির সূচনা ও কিয়ামত পরবর্তী বর্ণনা
প্রথম অনুচ্ছেদ - সৃষ্টির সূচনা ও নবী-রাসূলদের আলোচনা
৫৭০৪। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন: হযরত ইবরাহীম (আঃ) তিনবার ব্যতীত আর কখনও মিথ্যা বলেন নাই। ইহার মধ্যে দুইবার ছিল শুধু আল্লাহ্ পাকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য। যেমন— তিনি বলিয়াছিলেন, “আমি রুম” এবং তাঁহার অপর কথাটি হইল, “বরং তাহাদের এই বড় মূর্তিটিই ইহা করিয়াছে।" (আর একটি ছিল তাহার নিজস্ব ব্যাপারে।) রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেন, একদা হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁহার স্ত্রী সারা এক যালিম শাসনকর্তার এলাকায় (মিসরে আসিয়া পৌঁছিলেন। শাসনকর্তাকে খবর দেওয়া হইল যে, এখানে একজন লোক আসিয়াছে, তাহার সঙ্গে আছে অতি সুন্দরী এক রমণী। রাজা তখন ইবরাহীম (আঃ)-এর কাছে (লোক) পাঠাইল। সে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল। এই রমণীটি কে? ইবরাহীম (আঃ) জওয়াব দিলেন, আমার (দ্বীনী ভগ্নি। অতঃপর ইবরাহীম (আ:) সারার কাছে আসিলেন এবং তাহাকে বলিলেন, হে সারা। যদি এই যালিম জানিতে পারে যে, তুমি আমার স্ত্রী তাহা হইলে সে তোমাকে আমার নিকট হইতে জোরপূর্বক ছিনাইয়া লইবে। সুতরাং যদি সে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তখন বলিয়া দিবে তুমি আমার ভগ্নি। মূলতঃ তুমি আমার দ্বীনী বোন। বস্তুতঃ আমি এবং তুমি ছাড়া এই যমীনের উপর আর কোন মু'মেন নাই। এইবার রাজা সারার নিকট (তাহাকে আনিবার জন্য) লোক পাঠাইল। তাহাকে উপস্থিত করা হইল। অপরদিকে ইবরাহীম (আঃ) নামায পড়ার জন্য দাঁড়াইয়া গেলেন। অতঃপর সারা যখন রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করিলেন তখন রাজা তাহাকে ধরিবার জন্য হাত বাড়াইল, তখনই সে আল্লাহর গযবে পাকড়াও হইল। অন্য বর্ণনায় রহিয়াছে—তাহার দম বন্ধ হইয়া গেল, এমন কি যমীনে পা মারিতে লাগিল। যালিম (অবস্থা বেগতিক দেখিয়া সারাকে বলিল : আমার জন্য আল্লাহর কাছে দো'আ কর, আমি তোমার ক্ষতি করিব না। তখন সারা (তাহার জন্য) আল্লাহর কাছে দো'আ করিলেন। ফলে সে মুক্তি পাইল । অতঃপর সে দ্বিতীয়বার তাহাকে ধরিবার জন্য হাত বাড়াইল। তখন সে পূর্বের ন্যায় কিংবা আরও কঠিনভাবে পাকড়াও হইল। এইবারও সে বলিল আমার জন্য আল্লাহর কাছে দো'আ কর, আমি তোমার কোন অনিষ্ট করিব না। সুতরাং সারা আবারও আল্লাহর কাছে দো'আ করিলেন। ফলে সে মুক্তি পাইয়া গেল। তখন সে রাজা তাহার একজন দারোয়ানকে ডাকিয়া বলিলঃ তোমরা তো আমার কাছে কোন মানুষকে আন নাই; বরং তোমরা আমার কাছে আনিয়াছ একটি শয়তানকে। ইহার পর সে সারার খেদমতের জন্য 'হাজেরা' নামে একটি রমণী)-কে দান করিল। অতঃপর সারা ইবরাহীমের কাছে ফিরিয়া আসিলেন, তখনও তিনি দাড়াইয়া নামায পড়িতেছিলেন। (নামাযের মধ্যেই) হাতের ইশারায় সারাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ঘটনা কি হইল ? সারা বলিলেন, আল্লাহ্ তা'আলা কাফেরের চক্রান্ত তাহারই বক্ষে পাল্টা নিক্ষেপ করিয়াছেন (অর্থাৎ, নস্যাৎ করিয়া দিয়াছেন) এবং সে আমার খেদমতের জন্য 'হাজেরাকে দান করিয়াছে। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হাদীসটি বর্ণনা করিয়া বলিলেন, হে আকাশের পানির সন্তান। অর্থাৎ হে আরববাসীগণ! এই 'হাজেরাই তোমাদের আদি মাতা। – মোত্তা
كتاب أحوال القيامة وبدء الخلق
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَمْ يَكْذِبْ إِبْرَاهِيمُ إِلَّا فِي ثَلَاثَ كَذَبَاتٍ: ثِنْتَيْنِ مِنْهُنَّ فِي ذَاتِ اللَّهِ قولُه (إِني سَقيمٌ) وقولُه (بلْ فعلَه كبيرُهم هَذَا) وَقَالَ: بَيْنَا هُوَ ذَاتَ يَوْمٍ وَسَارَةُ إِذْ أَتَى عَلَى جَبَّارٍ مِنَ الْجَبَابِرَةِ فَقِيلَ لَهُ: إِن هَهُنَا رَجُلًا مَعَهُ امْرَأَةٌ مِنْ أَحْسَنِ النَّاسِ فَأَرْسَلَ إِلَيْهِ فَسَأَلَهُ عَنْهَا: مَنْ هَذِهِ؟ قَالَ: أُخْتِي فَأَتَى سَارَةَ فَقَالَ لَهَا: إِنَّ هَذَا الْجَبَّارَ إِنْ يَعْلَمْ أَنَّكِ امْرَأَتِي يَغْلِبُنِي عَلَيْكِ فَإِنْ سألكِ فأخبِريهِ أنَّكِ أُختي فإِنكِ أُخْتِي فِي الْإِسْلَامِ لَيْسَ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ مُؤْمِنٌ غَيْرِي وَغَيْرُكِ فَأَرْسَلَ إِلَيْهَا فَأُتِيَ بِهَا قَامَ إِبْرَاهِيمُ يُصَلِّي فَلَمَّا دَخَلَتْ عَلَيْهِ ذَهَبَ يَتَنَاوَلُهَا بِيَدِهِ. فَأُخِذَ - وَيُرْوَى فَغُطَّ - حَتَّى رَكَضَ بِرِجْلِهِ فَقَالَ: ادْعِي اللَّهَ لِي وَلَا أَضُرُّكِ فَدَعَتِ اللَّهَ فَأُطْلِقَ ثُمَّ تَنَاوَلَهَا الثَّانِيَةَ فَأُخِذَ مِثْلَهَا أَوْ أَشَدُّ فَقَالَ: ادْعِي اللَّهَ لِي وَلَا أَضُرُّكِ فَدَعَتِ اللَّهَ فَأُطْلِقَ فَدَعَا بَعْضَ حجَبتِه فَقَالَ: إِنَّكَ لم تأتِني بِإِنْسَانٍ إِنَّمَا أَتَيْتَنِي بِشَيْطَانٍ فَأَخْدَمَهَا هَاجَرَ فَأَتَتْهُ وَهُوَ قائمٌ يُصلي فأوْمأَ بيدِه مَهْيَمْ؟ قَالَتْ: رَدَّ اللَّهُ كَيْدَ الْكَافِرِ فِي نَحْرِهِ وَأَخْدَمَ هَاجَرَ قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ: تِلْكَ أُمُّكُمْ يَا بَنِي مَاءِ السَّمَاءِ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীসে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর তিনটি মিথ্যা বলা সম্পর্কে যাহা উক্ত হইয়াছে, প্রকৃতপক্ষে উহা মিথ্যা ছিল না; বরং যে তিন সময় তিনি এই তিনটি কথা বলিয়াছিলেন, তাহা ছিল খুবই নাজুক এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়। তাই তখন তিনি দ্ব্যর্থবোধক বাক্য ব্যবহার করিয়াছেন। আর শ্রোতারা প্রকাশ্য অর্থ বুঝিয়া নিয়াছে। অথচ তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল উহার অন্তর্নিহিত অর্থ। (আরবী পরিভাষায় ইহাকে تورية তাওরিয়া বলা হয়।) 'আমি রুগ্ন বা পীড়িত, এখানে শারীরিক ও মানসিক পীড়া উভয়টিই হইতে পারে। বস্তুতঃ জাতির প্রতিমা পূজা ও তাহাদের অনাচারে তিনি মানসিকভাবে পীড়িতই ছিলেন। তাই লোকজন তাঁহাকে উৎসব মেলায় যাইতে বলায় তিনি স্বীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করিয়া শহরে থাকিয়া যান। সকলে মেলায় চলিয়া গেলে তিনি তাহাদের দেব-মন্দিরে ঢুকিয়া সমস্ত মূর্তি ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া ফেলিলেন এবং প্রধান মূর্তিটির কাঁধে কুঠারখানা ঝুলাইয়া রাখিয়া দিলেন। লোকজন ফিরিয়া আসিয়া যখন দেব-দেবীর এই দুরবস্থা ও পরিণতি দেখিল, তখন তাহারা নিশ্চিতভাবে বলিয়া উঠিল যে, এই কাজ ইব্রাহীমই করিয়াছে। সুতরাং তাঁহাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল। তিনি বলিলেন; বরং এই বড় মূর্তিটাই এই কাজ করিয়াছে। তোমরা উহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ। এই কথাটি তিনি নিজের আত্মরক্ষার জন্য বলেন নাই; বরং বলিয়াছেন, উহার পূজারীদের ভুল ভাংগান এবং সত্য উপলব্ধি করানোর জন্য। কারণ, যে দেবতা সঙ্গী-সাথী দেব-দেবীকে রক্ষা করিতে পারে না, নিজের সাফাই গাইতে জানে না এবং সে যে এই কাজ করে নাই; বরং ইব্রাহীম (আঃ)-ই ইহা করিয়াছেন, এই কথাটুকু পর্যন্ত বলিতে পারে না, এমন অথর্ব মূক ও জড়পদার্থের পূজা করিয়া কি লাভ? এই কথাটি বুঝানোই ছিল ইব্রাহীম (আঃ)-এর উদ্দেশ্য। আর স্ত্রী ‘সারাকে' ভগ্নি বলিয়া পরিচয় দেওয়াও মিথ্যা নহে। কারণ, সমস্ত মু'মেন নর-নারী পরস্পরে ভাই-বোন। এই ব্যভিচারী রাজার রীতি ছিল অভিলষিত রমণীর স্বামীকে হত্যা করা। তাই হযরত ইব্রাহীম (আঃ) দ্ব্যর্থক শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। বস্তুতঃ এইরূপ ক্ষেত্রে কাহারও ক্ষতি না করিয়া এই রকম শব্দ ব্যবহার করা প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা নহে। আরববাসীদিগকে ‘আকাশের পানির সন্তান' বলিয়া হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধরের পবিত্রতা ও উচ্চ মর্যাদার প্রতি ইংগিত করা হইয়াছে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান