মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৩৫২
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - ভয় ও কান্না
৫৩৫২। হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, একদা নবী (ﷺ) নামাযের উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া দেখিলেন লোকেরা যেন হাসিতেছে। তখন তিনি বলিলেনঃ যদি তোমরা স্বাদ বিধ্বংসী অর্থাৎ, মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ করিতে তাহা হইলে উহা তোমাদিগকে বিরত রাখিত যাহা আমি দেখিতেছি উহা হইতে। কাজেই তোমরা সেই স্বাদ বিধ্বংসী মৃত্যুকে খুব বেশী স্মরণ কর। প্রতিদিনই কবর নিজের ভাষায় এই কথা বলিতে থাকে, আমি পরিবার-পরিজনদের হইতে দূরবর্তী একটি ঘর। আমি একটি নিঃসঙ্গ একাকী ঘর, আমি মাটির ঘর, আমি পোকা-মাকড়ের ঘর। এবং মু'মিন বান্দাকে যখন দাফন করা হয়, তখন কবর এই বলিয়া তাহাকে সম্বর্ধনা জানায়, তোমার আগমন মোবারক হউক, তুমি আপনজনের কাছেই আসিয়াছ। আমার পৃষ্ঠের উপরে যাহারা বিচরণ করিতেছে, তাহাদের সকলের চাইতে তুমিই ছিলে আমার নিকট অধিক প্রিয়। আজ আমাকেই তোমার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রক স্থির করা হইয়াছে। এবং তোমাকে আমার নিকট ন্যস্ত করা হইয়াছে। অচিরেই তুমি দেখিতে পাইবে আমি তোমার সহিত কিরূপ উত্তম আচরণ করি। অতঃপর নবী (ﷺ) বলিলেনঃ তখন তাহার দৃষ্টির প্রান্তসীমা পর্যন্ত কবর প্রশস্ত হইয়া যাইবে এবং তাহার জন্য বেহেশতের দিকে একটি দরওয়াজা খুলিয়া দেওয়া হইবে! আর যখন পাপী অথবা কাফেরকে দাফন করা হয়, তখন কবর তাহাকে বলে, তোমার আগমন কল্যাণকর নহে এবং তুমি আপনজনের নিকট আস নাই। বস্তুতঃ যাহারা আমার পৃষ্ঠের উপর বিচরণ করিতেছে তাহাদের সকলের চাইতে তুমিই ছিলে আমার নিকট সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত। আজ আমাকেই তোমার উপর পরিচালক বানান হইয়াছে। তোমাকে আমার নিকট ন্যস্ত করা হইয়াছে। শীঘ্রই দেখিতে পাইবে আমি তোমার সাথে কি ব্যবহার করি। নবী করীম (ﷺ) বলেনঃ তখন তাহার কবর তাহার উপর চাপ সৃষ্টি করিবে, এমনকি তাহার পাঁজরের হাড় একটি আরেকটির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িবে। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) নিজের উভয় হাতের অঙ্গুলীগুলি একটিকে আরেকটির মধ্যে ঢুকাইয়া (পাঁজরের হাড় ঢুকার দৃশ্যই ইঙ্গিতে) দেখাইলেন। তারপর বলিলেনঃ সেই নাফরমান কাফেরের জন্য সত্তরটি বিষধর অজগর নির্ধারণ করা হইবে (উহাদের বিষের ক্রিয়া এত বেশী হইবে যে,) যদি উহাদের একটি এই পৃথিবীতে একবার ফুঁক মারে তাহা হইলে কিয়ামত পর্যন্ত উহার বিষের ক্রিয়ায় একটি ঘাসও জন্মাইবে না। অবশেষে তাহাকে হিসাব-নিকাশে উপস্থিত করানো পর্যন্ত উক্ত অজগরসমূহ তাহাকে দংশন করিতে ও ছোবল মারিতে থাকিবে। বর্ণনাকারী আবু সাঈদ বলেন, ইহার পর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিলেনঃ মূলতঃ কবর হইল বেহেশতের বাগানসমূহের একটি বাগান অথবা দোযখের গর্তসমূহের একটি গর্ত। —তিরমিযী
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ: خَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِصَلَاةٍ فَرَأَى النَّاسَ كَأَنَّهُمْ يَكْتَشِرُونَ قَالَ: أَمَا إِنَّكُمْ لَوْ أَكْثَرْتُمْ ذِكْرَ هَادِمِ اللَّذَّاتِ لَشَغَلَكُمْ عَمَّا أَرَى الْمَوْتُ فَأَكْثِرُوا ذكر هَادِم اللَّذَّات الْمَوْت فَإِنَّهُ لَا يأتِ على الْقَبْر يومٌ إِلَّا تَكَلَّمَ فَيَقُولُ: أَنَا بَيْتُ الْغُرْبَةِ وَأَنَا بَيْتُ الْوَحْدَةِ وَأَنَا بَيْتُ التُّرَابِ وَأَنَا بَيْتُ الدُّودِ وَإِذَا دُفِنَ الْعَبْدُ الْمُؤْمِنُ قَالَ لَهُ الْقَبْرُ: مَرْحَبًا وَأَهْلًا أَمَا إِنْ كُنْتَ لَأَحَبُّ مَنْ يَمْشِي عَلَى ظَهْرِي إِلَيَّ فَإِذْ وُلِّيتُكَ الْيَوْمَ وَصِرْتَ إِلَيَّ فَسَتَرَى صَنِيعِي بِكَ . قَالَ: فَيَتَّسِعُ لَهُ مَدَّ بَصَرِهِ وَيُفْتَحُ لَهُ بَابٌ إِلَى الْجَنَّةِ وَإِذَا دُفِنَ الْعَبْدُ الْفَاجِرُ أَوِ الْكَافِرُ قَالَ لَهُ الْقَبْرُ: لَا مَرْحَبًا وَلَا أَهْلًا أَمَا إِنْ كُنْتَ لَأَبْغَضَ مَنْ يَمْشِي عَلَى ظَهْرِي إِلَيَّ فَإِذْ وُلِّيتُكَ الْيَوْمَ وَصِرْتَ إِلَيَّ فَسَتَرَى صَنِيعِي بِكَ قَالَ: «فَيَلْتَئِمُ عَلَيْهِ حَتَّى يَخْتَلِفَ أَضْلَاعُهُ» . قَالَ: وَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِأَصَابِعِهِ. فَأَدْخَلَ بَعْضَهَا فِي جَوْفِ بَعْضٍ. قَالَ: «وَيُقَيَّضُ لَهُ سَبْعُونَ تِنِّينًا لَوْ أَنَّ وَاحِدًا مِنْهَا نَفَخَ فِي الْأَرْضِ مَا أَنْبَتَتْ شَيْئًا مَا بَقِيَتِ الدُّنْيَا فَيَنْهَسْنَهُ وَيَخْدِشْنَهُ حَتَّى يُفْضِي بِهِ إِلَى الْحِسَابِ» قَالَ: وَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّمَا الْقَبْرُ رَوْضَةٌ مِنْ رِيَاضِ الْجَنَّةِ أَوْ حُفْرَةٌ مِنْ حُفَرِ النَّارِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. হাদীসটির তাৎপর্য হইল কবরকে ভয় করতঃ সর্বদা নেক আমলে আত্মনিয়োগ করাই বাঞ্চনীয়। কেননা, কবর হইল দুনিয়ার শেষ ও আখেরাতের প্রথম ষ্টেশন। আর ইহাই স্বাভাবিক, প্রথম ষ্টেশনের অবস্থা দেখিয়া সহজে অনুমান করা যাইবে পরবর্তী ঘাটসমূহে যথা—ময়দানে হাশর, মীযান ও পুলছেরাত প্রভৃতি স্থানের অবস্থা কিরূপ হইবে?

২. এ হাদীছে মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করতে বলা হয়েছে। মৃত্যুকে বলা হয়েছে স্বাদ-আহ্লাদ বিনাশকারী। অতিরিক্ত আনন্দ-ফুর্তি ও স্বাদ-আহ্লাদ ঈমান-আমলের পক্ষে নেহাৎ ক্ষতিকর। তাই ঈমান-আমল রক্ষার তাগিদে এর থেকে বাঁচা দরকার। তা বাঁচা সম্ভব মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করার দ্বারা।

কেউ যখন আনন্দ-ফুর্তিতে থাকে, তখন যদি কারও মৃত্যুসংবাদ আসে, তবে মুহূর্তের মধ্যে অন্তর থেকে আনন্দ-ফুর্তি উবে যায়। আর তা যদি কোনও প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ হয়, তবে আনন্দের স্থানে বিষাদ ছেয়ে যায়। মানুষের কাছে নিজ প্রাণই সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়। ফুর্তির সময় যদি সেই প্রাণ মালাকুল মাওতের কবজায় চলে যাওয়ার কথা স্মরণ হয়ে যায়, তবে এক মুহূর্তও সে ফুর্তি বাকি থাকতে পারে না।

বেশি আনন্দ-ফুর্তি মানুষের মন শক্ত করে দেয়। শক্ত মন ফুর্তিভরে পাপকর্মে লিপ্ত হয়। নরম মনের মানুষ পাপ করলেও ভয়-ভীতির সঙ্গে করে। কিন্তু শক্ত মনের মানুষ তা করে স্পর্ধার সঙ্গে। তাই মন যাতে শক্ত না হতে পারে, সে লক্ষ্যে ফুর্তিনাশা মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করা চাই। তা স্মরণ করতে হবে মনে মনেও এবং মুখেও। মুখে পরস্পরে মৃত্যুর আলোচনা করলে তার সুফল বেশি পাওয়া যায়। যে অন্তরে মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত থাকে, সে অন্তর সহজে পাপকর্মের দিকে ঝুঁকবে না; বরং ইবাদত-আনুগত্য করতেই বেশি আগ্রহী হবে।

একদিন আয়ু ফুরিয়ে যাবে। মালাকুল মাওত এসে প্রাণ সংহার করবে। আমার চেয়ে অল্প বয়সেরও বহু লোককে ইহজগৎ ত্যাগ করতে হয়েছে। আমার সমবয়সী অনেকেও এ জগৎ ছেড়ে চলে গেছে। আমাকেও একদিন চলে যেতে হবে। মৃত্যু থেকে রেহাই নেই কারও। মৃত্যুর যন্ত্রণা বড় কঠিন যন্ত্রণা। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ
মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যিই আসবে।(সূরা কাফ (৫০), আয়াত ১৯)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَات
নিশ্চয়ই মৃত্যুর আছে অনেক যন্ত্রণা।(সহীহ বুখারী: ৪৪৪৯)

কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, মৃত্যুর সর্বাপেক্ষা লঘু যন্ত্রণা তরবারির একশটি আঘাতের সমান। এ যদি হয় লঘু যন্ত্রণা, তবে কঠিন যন্ত্রণা কেমন! হযরত উমর রাযি. মৃত্যুযন্ত্রণা সম্পর্কে হযরত কা'ব ইবন উবাঈ রাযি.-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি উত্তরে বলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! মৃত্যু হল আদমসন্তানের উদরে বিপুল কাঁটাযুক্ত একটা গাছের মতো। যে কাঁটাগুলো তার প্রতিটি শিরা ও প্রতিটি জোড়ায় বিদ্ধ হয়ে আছে। এ অবস্থায় প্রচণ্ড বাহুবলসম্পন্ন এক ব্যক্তি সেই গাছটি ধরে টেনে বের করছে (এবার ভাবুন এতে সে ব্যক্তির কেমন কষ্ট হবে? মৃত্যুযন্ত্রণা এরকমই)। এ কথা শুনে হযরত উমর রাযি. কাঁদতে থাকলেন (আল্লাহ তা'আলা আমাদের সে যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করুন)।

সুস্থ-অসুস্থ প্রত্যেকের মৃত্যু সম্পর্কে এসব কথা নিয়মিত ভাবা উচিত। নিয়মিত ভাবতে থাকলে অন্তরে এ চিন্তা বসে যাবে। ফলে প্রতিটি কথা ও কাজ এ চিন্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। মৃত্যুচিন্তা ধনীর ধনের দর্প চূর্ণ করে। মৃত্যুর পাশে বিপুল ধনকেও বড় অল্প মনে হয়, বড় তুচ্ছ মনে হয়। মৃত্যুচিন্তা দরিদ্রকে তার দারিদ্র্যে তুষ্ট রাখে। তাকে লোভী হতে দেয় না। মৃত্যুচিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে সর্বস্তরের মানুষকে। সুতরাং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও শরী'আতের অনুসরণ করার পক্ষে মৃত্যুচিন্তা সর্বাপেক্ষা বেশি সহায়ক। সে কারণেই এ হাদীছ আমাদেরকে মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করতে বলেছে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এ হাদীছের উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অতিরিক্ত আনন্দ-ফুর্তি ঈমান-আমলের পক্ষে ক্ষতিকর।

খ. আনন্দ-ফুর্তির সীমালঙ্ঘন রোধে মৃত্যুচিন্তা খুব কার্যকর।

গ. কখনও-সখনও নয়; বরং বেশি বেশি পরিমাণে মৃত্যুর কথা চিন্তা করতে হবে।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৫৩৫২ | মুসলিম বাংলা