মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়

হাদীস নং: ৫২৬৮
- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়
প্রথম অনুচ্ছেদ - আশা আকাঙ্ক্ষা ও উদ্বেগ প্রসঙ্গ
৫২৬৮। হযরত আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) বলেন, একদা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি চতুর্ভুজ আঁকিলেন এবং উহার মধ্যে একটি রেখা টানিলেন যাহা চতুর্ভূজ অতিক্রম করিয়া বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। অতঃপর মধ্য রেখাটির উভয় পার্শ্বে অনেকগুলি ছোট ছোট রেখা আঁকিয়া বলিলেন: (মনে কর মধ্য রেখাটি) ইহা মানুষ। আর ইহা (অর্থাৎ, চতুর্ভুজ) তাহার বয়সের সীমা, যাহা তাহাকে ঘিরিয়া রহিয়াছে। আর ঐ রেখার বাহিরের অংশটি তাহার আকাঙ্ক্ষা। আর এই সমস্ত ছোট ছোট রেখাগুলি তাহার বিপদ-মুসীবত (যাহাতে সে আপতিত হইতে পারে)। যদি সে একটি বিপদ হইতে রক্ষা পায় তবে পরবর্তী বিপদে আক্রান্ত হয়। যদি সেইটা হইতেও রক্ষা পায় তবে এর পরেরটিতে আক্রান্ত হয়। বুখারী
كتاب الرقاق
بَاب الأمل والحرص الْفَصْل الأول
عَن عبد الله قَالَ: خَطَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَطًّا مُرَبَّعًا وَخَطَّ خَطًّا فِي الْوَسَطِ خَارِجًا مِنْهُ وَخَطَّ خُطُطًا صِغَارًا إِلَى هَذَا الَّذِي فِي الْوَسَطِ مِنْ جَانِبِهِ الَّذِي فِي الْوَسَطِ وفقال: «هَذَا الْإِنْسَانُ وَهَذَا أَجَلُهُ مُحِيطٌ بِهِ وَهَذَا الَّذِي هُوَ خَارِجُ أَمَلِهِ وَهَذِهِ الْخُطُوطُ الصِّغَارُ الْأَعْرَاضُ فَإِنْ أَخْطَأَهُ هَذَا نَهَسَهُ هَذَا وَإِنْ أخطأه هَذَا نهسه هَذَا» . رَوَاهُ البُخَارِيّ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. الأمل ও الحرص মূলে আরবী শব্দ দুইটি প্রায় কাছাকাছি অর্থে ব্যবহৃত হয়। কোরআনে বিভিন্ন আয়াতে উহা লোভ-লালসা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। যেমন— ذَرْهُمْ يَأْكُلُوا وَيَتَمَتَّعُوا وَيُلْهِهِمُ الْأَمَلُ ۖ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ অর্থঃ ‘উহারা যাহা করে করুক, খাইতে থাকুক, ভোগ করিতে থাকুক এবং আশা উহাদিগকে মোহাচ্ছন্ন রাখুক—অচিরেই উহারা বুঝিবে।' অপর এক আয়াতে আছে ; لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم অর্থঃ ‘তোমাদের নিকট এমন একজন রাসূল আসিয়াছেন, যিনি তোমাদের মধ্যের-ই একজন। তোমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া তাঁহার পক্ষে-দুঃসহ কষ্টদায়ক, তোমাদের সার্বিক কল্যাণেরই তিনি কামনাকারী।' এই পর্যায়ে অনেক আয়াতই কোরআনে উল্লেখ রহিয়াছে।
লোভ-লালসা বা আশা-আকাঙ্ক্ষা করা পার্থিব ধন-সম্পদ কিংবা দুনিয়াবী পদমর্যাদা প্রভৃতির ব্যাপারে মন্দ বটে। তবে এলমে দ্বীন ও ইসলামী জ্ঞান অর্জনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা পোষণ বা জেহাদে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদির আকাঙ্ক্ষা প্রশংসনীয়। এই হিসাবে বলা যায়, আশা-আকাঙ্ক্ষা বা লোভ-লালসার ভাল-মন্দ উভয় দিক রহিয়াছে। সুতরাং ক্ষেত্রবিশেষে তাহা নিরূপণ করা হইবে। অত্র অধ্যায়ের হাদীসসমূহের আলোকে নির্ধারণ করা যাইবে কোন্ কোন্ পর্যায়ে উহা ভাল বা মন্দ।
অর্থাৎ, প্রতিটি মানুষ বয়সসীমার আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ। চতুর্দিক হইতে বয়সসীমা তথা মৃত্যু তাহাকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে। কিন্তু তাহার উচ্চাকাঙ্ক্ষার সীমানা হায়াতের চাইতেও অনেক দূরে। বিপদ-আপদ হইতে এড়াইয়া গেলেও আকাঙ্ক্ষার মাঝপথে মৃত্যু তাহাকে পাইয়া বসিবেই। চিত্রের মাধ্যমে ইহার উপমাঃ

২. এ হাদীছটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার ভেতর মানুষের জীবনযাপন, এর মধ্যেও তার বড় বড় ও লম্বা-চওড়া আশা পোষণ এবং এ অবস্থার মধ্যেই অকস্মাৎ মৃত্যুর আগমন, চিত্রের সাহায্যে মানুষের এ তিন অনুষঙ্গ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি একটি চতুর্ভুজ আঁকেন। তার মাঝখান থেকে একটি রেখা টানেন। রেখাটি চতুর্ভুজের সীমানা ভেদ করে বাইরে চলে আসে। তারপর আরও কতগুলো রেখা টানেন। সেগুলোর এক মাথা মাঝখানের রেখাটির দিকে, অন্য মাথা চতুর্ভুজের সীমানার দিকে। অনেকটা এরকম-
_____________________
|____________________|_______
|___|___|___|__|__|_____|

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিত্রটির যে ব্যাখ্যা দেন তা এরকম যে, মাঝখানের লম্বা রেখাটি যেন মানুষ। রেখাটির যে অংশ চতুর্ভুজ ভেদ করে সামনে চলে গেছে, তা মানুষের আশা। চতুর্ভুজটি মানুষের আয়ু, যা তাকে ঘিরে রেখেছে। এর বাইরে তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। ছোট ছোট রেখাগুলো বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ ও বালা-মসিবত। মানুষের জীবনে এসব হানা দিতে থাকে। সে একটি থেকে রক্ষা পায়, তো আরেকটিতে আক্রান্ত হয়। আবার আরেকটি থেকে বেঁচে যায়, তো অন্য একটি তাকে বিদ্ধ করে। এভাবেই চলতে থাকে। ওদিকে তার আশা কিছু পূর্ণ হয়, তো কিছু বাকি থেকে যায়। এক পর্যায়ে তার আয়ু শেষ হয়ে যায়। ফলে তার মৃত্যু ঘটে। ওদিকে আশার অনেকখানিই থেকে যায় অপূর্ণ। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে এমনও হয় যে, বেশিরভাগ বালা-মসিবত থেকেই সে রেহাই পেয়ে যায়। হয়তো জীবনে কোনও মসিবতেই সে পড়ে না। তা যতই নিরাপদ থাকুক না কেন, মৃত্যু তো অবধারিত। একসময় তাকে মরতেই হবে। কিন্তু আশার অনেকখানি অপূর্ণ থেকে যাবে।

সারকথা, মানুষের আয়ু সীমিত। সীমিত আয়ুর ভেতর মানুষ অনেক বড় বড় আশা করে। সেসব আশা পূরণের চেষ্টায় জীবনের অনেকখানি ব্যয় করে ফেলে। হয়তো অনেক কিছুই হয় বৃথাচেষ্টা। তা তার দুনিয়ায়ও কোনও কাজে আসে না, আখিরাতেও না। কিংবা দুনিয়ায় হয়তো কিছুটা কাজে আসে, কিন্তু আখিরাতে তার কোনওই ফায়দা নেই। ওদিকে আছে নানা বালা-মসিবত। তার ভেতর দিয়েই মানুষকে চলতে হয়। কম মানুষই তা থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকে। তা মানবজীবনের অবধারিত অনুষঙ্গ। এ অবস্থায় মানুষের দরকার জীবনের এসব অনুষঙ্গ মেনে নিয়ে সময়ের সুষ্ঠু ব্যবহার। বাড়তি আশা না করে ইহজীবনের জন্য যা না হলেই নয় তাতে সন্তুষ্ট থেকে পরকালীন সাফল্য কীভাবে অর্জন করা যায় তাতেই সচেষ্ট থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে গড়িমসি করা নেহাৎ ভুল। হঠাৎ করেই মৃত্যু এসে যাবে। তখন কিছুই করার থাকবে না। তার আগেই যা করার করে নেওয়া চাই।

প্রকাশ থাকে যে, আশা-আকাঙ্ক্ষা যেহেতু মানুষের সহজাত, তাই এটা সম্পূর্ণরূপে নিন্দনীয় নয়। জীবনে এর প্রয়োজন আছে বলেই মানুষকে এটা দেওয়া হয়েছে। এ না হলে মানুষ সংসারজীবন যাপন করত না। এ না হলে মানুষ চাষাবাদ করত না। এ না হলে শিল্পকারখানা গড়ে উঠত না। ভেতরে আশা-আকাঙ্ক্ষা সক্রিয় না থাকলে কেউ সন্তান লালন-পালন করত না। জীবনের যত নির্মাণ ও উন্নয়ন, তা মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। সুতরাং মানবমনে এটা আল্লাহ তা'আলার এক মহান দান। কাজেই এমনিতে একে খারাপ বলা যায় না। এটা খারাপ হয় তখনই, যখন সীমালঙ্ঘন করে। এজন্যই হাদীছে আশা'র নিন্দা করা হয়নি। নিন্দা করা হয়েছে দীর্ঘ আশার। অতিরিক্ত আশা মন শক্ত করে। অতিরিক্ত আশা মানুষকে নীতিভ্রষ্ট করে। অতিরিক্ত আশা পরিণামে মানুষকে নৈরাশ্যের শিকার করে, যা মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবন বরবাদ করে দেয়। তাই অন্তরে আশা-আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই পোষণ করতে হবে, তবে মাত্রাতিরিক্ত নয়; বরং সীমার ভেতরে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মানুষের আয়ু বড় সীমিত। তাই আশা-আকাঙ্ক্ষাও সীমার মধ্যে রাখতে হবে।

খ. বিপদ-আপদ ও বালা-মসিবত ইহজগতের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। এসব মেনে নেওয়ার ভেতরেই জীবনের সচলতা নিহিত। তাই বিপদে নিরাশ না হয়ে সবরের পরিচয় দেওয়াই সুবুদ্ধির কাজ।

গ. অতিরিক্ত আশা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। তাই তার পেছনে ছোটা সম্পূর্ণই নির্বুদ্ধিতা।

ঘ. মৃত্যু যে-কোনও সময়ই এসে যেতে পারে। তাই সর্বদা তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৫২৬৮ | মুসলিম বাংলা