মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়

হাদীস নং: ৫২৫৩
- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - গরীবদের ফযীলত ও নবী (সা.) -এর জীবন-যাপন
৫২৫৩। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেনঃ আল্লাহর রাস্তায় (তাহার দ্বীন প্রচারে) আমাকে যে পরিমাণ ভয় দেখান হইয়াছে, আর কাহাকেও সে পরিমাণ ভয় দেখান হয় নাই। আর আল্লাহর রাস্তায় আমাকে (যেইভাবে) কষ্ট দেওয়া হইয়াছে, আর কাহাকেও (এইভাবে) কষ্ট দেওয়া হয় নাই এবং আমার উপর ত্রিশটি দিবারাত্র এই অবস্থায় অতিবাহিত হইয়াছে যে, আমার ও বেলালের জন্য এমন কোন খাদ্যবস্তু ছিল না যাহা কোন প্রাণী খাইতে পারে। শুধু এই পরিমাণ কিছু ছিল যাহা বেলালের বগল লুকাইয়া রাখিত। —তিরমিযী।

ইমাম তিরমিযী হাদীসটির অর্থে বলিয়াছেন যে, যখন নবী (ﷺ) (কাফেরদের অত্যাচারে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে) মক্কা হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেলেন এবং বেলাল তাঁহার সঙ্গে ছিলেন, ইহা সেই সময়ের ঘটনা। বস্তুতঃ এই সময় বেলালের সঙ্গে এই পরিমাণ খাদ্যবস্তু ছিল যাহা তিনি স্বীয় বগলের নীচে দাবাইয়া রাখিতেন।
كتاب الرقاق
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَقَدْ أُخِفْتُ فِي اللَّهِ وَمَا يُخَافُ أَحَدٌ وَلَقَدْ أُوذِيتُ فِي اللَّهِ وَمَا يُؤْذَى أَحَدٌ وَلَقَدْ أَتَتْ عَلَيَّ ثَلَاثُونَ مِنْ بَيْنِ لَيْلَةٍ وَيَوْمٍ وَمَا لِي وَلِبِلَالٍ طَعَامٌ يَأْكُلُهُ ذُو كَبِدٍ إِلَّا شَيْءٌ يُوَارِيهِ إِبْطُ بِلَالٍ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ قَالَ: وَمَعْنَى هَذَا الْحَدِيثِ: حِينَ خَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَارِبًا مِنْ مَكَّةَ وَمَعَهُ بِلَالٌ إِنَّمَا كَانَ مَعَ بِلَالٍ مِنَ الطَّعَامِ مَا يَحْمِلُ تحتَ إبطه

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থবিত্তের আসক্তি থেকে যে কতটা দূরে ছিলেন, এ হাদীছ দ্বারা তা আরও বেশি পরিস্ফুট হয়। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. ছিলেন তাঁর সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় স্ত্রী। সবচে' বেশি ভালোবাসতেন তাঁকেই। সে হিসেবে পার্থিব সুযোগ-সুবিধা সবচে' বেশি তাঁরই পাওয়ার কথা। আল্লাহ তাআলা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমগ্র দুনিয়ার রাজত্ব দিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি চাইলে স্ত্রীদের রাজকীয় আয়েশের ভেতর রাখতে পারতেন। অথচ অন্যসব সুবিধা দূরের কথা, সবচে' বেশি মৌলিক প্রয়োজন যে খাদ্য তাতেও কেমন কৃচ্ছ্রতার চর্চা তিনি চালু রেখেছিলেন! দুনিয়া থেকে চির বিদায়কালে আমাদের আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে পর্যন্ত এ অবস্থায় রেখে যান যে, তাঁর ঘরে সামান্য কিছু যব ছাড়া খাওয়ার মতো আর কিছু ছিল না।

এ কথা ঠিক যে, খায়বার যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক স্ত্রীকে সারা বছরের খাদ্য একসঙ্গে দিয়ে দিতেন। কিন্তু সে খাদ্য যে বছরের শেষ পর্যন্ত থাকত এমন নয়। অতিথি আসলে তা থেকেই খাওয়ানো হতো। অন্য কোনও প্রয়োজন দেখা দিলেও তিনি তাদেরকে সেই খাবার থেকে দান করতে বলতেন। এভাবে দেখা যেত বছর শেষ হওয়ার আগেই সে খাবার শেষ হয়ে গেছে।

হাদীছটির পরের অংশে রয়েছে সেই সামান্য খাদ্যবস্তুতে বরকতের বর্ণনা। আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন, আমি সেই যব থেকে খেতে থাকলাম। অনেক দিন খেলাম। কিন্তু তা ফুরাচ্ছিল না। সামান্য যব এতদিন খাওয়ার পরও শেষ হচ্ছে না! তাঁর কৌতূহল লাগল। কেন শেষ হচ্ছে না? তিনি বলেন فكلته ففني (পরিশেষে একদিন আমি তা মাপলাম, অমনি তা (দ্রুত) নিঃশেষ হয়ে গেল)। অর্থাৎ যতদিন মাপা হয়নি ততদিন তার বরকত চালু ছিল। মাপামাত্র বরকতের ধারা বন্ধ হয়ে গেল। ফলে সে যব দ্রুত শেষ হয়ে গেল। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, খাদ্যদ্রব্য মাপলে বরকত শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অন্য বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় মাপলেই বরকত হয়। যেমন এক হাদীছে আছে
كيلوا طعامكم يبارك لكم
তোমরা তোমাদের খাদ্যদ্রব্য মাপবে। তাহলে তোমাদের জন্য তাতে বরকত হবে।

বাহ্যত উভয় হাদীছের মধ্যে বিরোধ লক্ষ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই। কেননা মাপার হুকুম দেওয়া হয়েছে বেঁচাকেনার ক্ষেত্রে, আর মাপতে না করা হয়েছে খাওয়া ও খরচ করার ক্ষেত্রে। কেননা খরচ করার ক্ষেত্রে মাপামাপি দ্বারা একরকম কার্পণ্য প্রকাশ পায়। যে সম্পদে কৃপণতা করা হয় তাতে বরকত হয় না। বরকত না হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে বাহ্যিক আসবাবের প্রতি মনোযোগী হওয়া। বরকত সম্পূর্ণই গায়েবী বিষয়। আল্লাহ তা'আলা নিজ অনুগ্রহে অদৃশ্যভাবে তা দিয়ে থাকেন। এরূপ ক্ষেত্রে পুরোপুরি মনোযোগ আল্লাহ তা'আলার দিকেই থাকা চাই। আরও কর্তব্য অব্যাহতভাবে তাঁর শোকর আদায় করতে থাকা এবং বিলকুল বাহ্যিক আসবাবের দিকে লক্ষ না করা।

মাপতে যে নিষেধ করা হয়েছে খাওয়া বা খরচ করার বেলায়, অপর এক বর্ণনা দ্বারাও তা বোঝা যায়। যেমন হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে খাবার চাইলে তিনি তাকে এক ওয়াসক যব দিলেন। লোকটি সেই যব থেকে নিজ স্ত্রীসহ খেতে থাকল। মেহমান আসলে তাকেও তা থেকে খাওয়াত। তা সত্ত্বেও সে খাবার ফুরাচ্ছিল না। পরিশেষে একদিন সে তা মাপল (ফলে তা ফুরিয়ে গেল)। তারপর সে এসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানাল। তিনি বললেন
لو لم تكله لأكلتم منه، ولقام لكم
“তুমি যদি তা না মাপতে, তবে তোমরা তা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে খেতে পারতে এবং তা তোমাদের প্রয়োজন মেটাত।"

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসেবে আমাদেরকে ক্ষুধাসহ অন্য যে-কোনও কষ্টে সহিষ্ণুতায় অভ্যস্ত হতে হবে।

খ. আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে কোনওকিছুতে বিশেষ বরকত দান করলে আমাদের কর্তব্য হবে তাতে কোনওরকম পরিবর্তন না ঘটানো এবং অব্যাহতভাবে আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করতে থাকা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৫২৫৩ | মুসলিম বাংলা