মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৬- আদাব - শিষ্টাচার অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৯১২
১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯১২। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন তাহার নাসিকা ধূলিসাৎ হউক। তাহার নাসিকা ধূলিসাৎ হউক। তাহার নাসিকা ধূলিসাৎ হউক। জিজ্ঞাসা করা হইল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। কে সে? তিনি বলিলেনঃ যে ব্যক্তি নিজের মাতা-পিতার কোন একজনকে অথবা উভয় জনকে তাহাদের বার্ধক্য অবস্থায় পাইল, অথচ সে বেহেশতে প্রবেশ করিল না। মুসলিম
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «رَغِمَ أَنْفُهُ رَغِمَ أَنْفُهُ رَغِمَ أَنْفُهُ» . قِيلَ: مَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «مَنْ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ عِنْدَ الْكِبَرِ أَحَدَهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا ثمَّ لم يدْخل الْجنَّة» . وَرَاه مُسلم

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. 'তাহার নাসিকা ধূলিসাৎ হউক, ইহা আরবদের একটি প্রচলিত পরিভাষা। বাক্যটি কোন কোন সময় আদর-সোহাগের স্থলে ব্যবহার করা হইলেও সাধারণতঃ অসন্তুষ্টি ও ধ্বংসের তথা অভিশাপের অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর এখানেও এই অর্থে ব্যবহার করা হইয়াছে। ‘জান্নাতে প্রবেশ করিল না', ইহার অর্থে আল্লামা নববী বলেনঃ সে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পাইয়াও যোগ্যতা হারাইয়াছে।

২. رغم ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি رغام থেকে। رغام অর্থ ধুলো, মাটি। رغم অর্থ ধুলোমলিন হওয়া বা মাটিতে লেগে যাওয়া। তার নাক ধুলোমলিন হোক' বা ‘তার নাক মাটিতে লাগুক' এ কথা দ্বারা লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হওয়া বুঝানো হয়ে থাকে। এটি একটি বদদুআ ও অভিশাপ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে জানাচ্ছেন পিতা-মাতার দু'জনকেই বা তাদের কোনও একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পাওয়া জান্নাতলাভের একটি উপায়। এ অবস্থায় তাদের সেবাযত্ন করলে জান্নাত লাভ হয়। কাজেই কেউ যদি তার পিতা-মাতাকে বা তাদের কোনও একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পায়, তবে তার কর্তব্য তাদের সেবাযত্নে লিপ্ত থাকা। এটা করলে তা তার জন্য জান্নাতলাভের একটি বড় উপায় হবে। কিন্তু কেউ যদি এতে অবহেলা করে এবং বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবাযত্ন করা হতে বিরত থাকে, তবে সে বড় হতভাগা। সে সুযোগ পেয়েও জান্নাতলাভ থেকে বঞ্চিত থাকল এবং নিজের জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে নিল।

বস্তুত পিতা-মাতার সেবাযত্নে অবহেলা করে এমন লোকই, যে নিজের খেয়াল-খুশিমত চলে এবং আল্লাহকে খুশি করার পরিবর্তে মনের চাহিদা পূরণে ব্যস্ত থাকে। নিজ খেয়াল-খুশিমত চলা ও মনের চাহিদা পূরণে ব্যস্ত থাকার দ্বারা যা হয় তা আল্লাহ তাআলার নাফরমানি ও পাপকর্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। পাপকর্মের পরিণাম কেবলই জাহান্নাম। এ ব্যক্তি যেন জান্নাতের পরিবর্তে জাহান্নামের পথই বেছে নেয়। জান্নাতের পরিবর্তে জাহান্নাম বেছে নেওয়া মনুষ্যত্বের পরম লাঞ্ছনা। এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহান্নামভোগের সে লাঞ্ছনার কথাই বুঝিয়েছেন। তিনি যেন সাবধান করছেন যে, সাবধান! পিতা-মাতার সেবাযত্ন ছেড়ে নিজ মনুষ্যত্বকে লাঞ্ছিত করো না। নিজেকে জাহান্নামের খোরাক বানিও না। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ، وَرَغمَ أَنْفُ رَجُلٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ ثُمَّ انْسَلَخَ قَبْلَ أَنْ يُغْفَرَ لَهُ ، وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ أَدْرَكَ عِنْدَهُ أَبَوَاهُ الْكِبَرَ فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنَّةَ

‘ওই ব্যক্তি লাঞ্ছিত হোক, যার সামনে আমার কথা উল্লেখ করা হলো অথচ সে আমার প্রতি সালাত পাঠ করল না। ওই ব্যক্তি লাঞ্ছিত হোক, যে রমযান মাস পেল, তারপর রমযান মাস শেষও হয়ে গেল অথচ তার গুনাহ মাফ করা হলো না। এবং ওই ব্যক্তি লাঞ্ছিত হোক, যে তার পিতা-মাতাকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল, অথচ তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাল না।,৭২

লক্ষ করার বিষয় যে, এ হাদীছে জান্নাতে প্রবেশ করানোকে পিতা-মাতার কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা তো আল্লাহ তাআলার কাজ। সৎকর্ম এর অছিলা। বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবাযত্ন তার একটি বড় অছিলা। সেবাযত্ন করে তাদেরকে খুশি রাখলে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন আল্লাহ তাআলাই। তবে যেহেতু এটা পিতা-মাতার খুশির সুফল, তাই যেন তারাই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাল। এর দ্বারা পিতা-মাতার খেদমতের মর্যাদা ও তাদের সন্তুষ্টির মহিমাও পরিস্ফুট হলো।

অপর এক হাদীছে আছে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে উঠছিলেন। এ অবস্থায় পরপর তিনবার আমীন বললেন। পরে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে জানিয়েছিলেন যে, হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উপরে বর্ণিত তিন ব্যক্তির প্রতি লাঞ্ছিত হওয়ার অভিশাপ দিচ্ছিলেন আর তিনি তাতে আমীন বলছিলেন।৭৩

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় এটা কত বড় ভয়ের কথা। সর্বশ্রেষ্ঠ ফিরিশতা হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম বদ্দুআ করছেন আর তার জবাবে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমীন বলছেন! এটা কবুল হওয়ার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ থাকে কি? আল্লাহ, ফিরিশতা, নবী-রাসূল ও আখেরাতের উপর যার ঈমান আছে, তার তো এ বদ্দুআ শুনে ভয়ে কেঁপে উঠার কথা। এ অভিশাপ থেকে বাঁচার লক্ষ্যে প্রত্যেক মুমিনের উচিত অতি সতর্কতার সঙ্গে হাদীছে বর্ণিত এ তিনওটি বিষয়ে মনোযোগী থাকা। অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনলে ভক্তি ও মহব্বতের সঙ্গে দুরূদ পাঠ করবে, রমযান মাস আসলে সবরকম গুনাহ হতে বিরত থেকে একজন খাঁটি বান্দা ও সাচ্চা মুসলিমরূপে এ মাসটি কাটাবে এবং পরম যত্নের সঙ্গে বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবাযত্ন করবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. পিতা-মাতার বার্ধক্য অবস্থায় তাদের সেবাযত্ন করা জান্নাতলাভের একটি বড় উপায় ।

খ. বৃদ্ধ পিতা-মাতার খেদমত করার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাতে অবহেলা করার পরিণাম দুনিয়া ও আখেরাতের চরম লাঞ্ছনা ও অপদস্থতা।

৭২. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৫৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৪৫১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৯০৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৬৯০

৭৩. বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৬৪৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩১৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৪৭১
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৪৯১২ | মুসলিম বাংলা