মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৬- আদাব - শিষ্টাচার অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৭৯৭
৯. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - বক্তৃতা ও কবিতা আবৃত্তি
৪৭৯৭। হযরত আবু সা'লাবা খোশানী (রাঃ) হইতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেনঃ কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সবচাইতে প্রিয়তম এবং আমার সর্বাপেক্ষা নিকটতম সেই ব্যক্তি হইবে, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম চরিত্রের অধিকারী। আর আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত এবং আমার থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী সেই ব্যক্তি হইবে, তোমাদের মধ্যে যাহার চরিত্র খারাপ। অর্থাৎ, অহেতুক বক্‌বক্ করে, ঠাট্টা বিদ্রূপের ছলে গাল পেঁচাইয়া কথা বলে এবং কথাবার্তায় নিজেকে বড় করিয়া জাহির করে। —বায়হাকী।
وَعَن أبي

ثَعلبةَ الخُشنيِّ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِنَّ أَحَبَّكُمْ إِلَيَّ وَأَقْرَبَكُمْ مِنِّي يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنُكُمْ أَخْلَاقًا وَإِنَّ أَبْغَضَكُمْ إِلَيَّ وَأَبْعَدَكُمْ مني مساويكم أَخْلَاقًا الثرثارون المتشدقون المتفيقهون» . رَوَاهُ الْبَيْهَقِيّ فِي «شعب الْإِيمَان»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. অত্র হাদীসে তিন শ্রেণীর লোকের কথা বলা হইয়াছে। যথাক্রমে—
‘সারসারূন’—সত্যকে ঢাকা-চাপা দেওয়ার উদ্দেশে কথাকে লম্বা করে এবং এক কথাকে বার বার বলে।
‘মুতাশাদ্দিকুন’—অসতর্কভাবে অহেতুক কথাবার্তা বর্ণনাকারী। কোন কথাকে হাসি-ঠাট্টার পর্যায়ে নিয়া বিশেষ ভঙ্গিতে গাল বাঁকা করিয়া হাল্কা করার চেষ্টা করা ।
‘মুতাফাইহেকুন’—যাহারা অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশে মুখ ফুলাইয়া, ঘাড় বাঁকা করিয়া অহংকার-অহমিকার সাথে কথাবার্তা বলে।

২. এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় ও আমার সবচে' বেশি নিকটবর্তী অবস্থানে থাকবে ওই ব্যক্তি, যার আখলাক–চরিত্র তোমাদের মধ্যে সবচে' বেশি ভালো। আর কিয়ামতের দিন আমার কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি ঘৃণ্য ও আমার থেকে সবচে' দূরবর্তী থাকবে সেইসব লোক, যারা ছারছার (বাচাল), মুতাশাদ্দিক (কথাবার্তায় কৃত্রিম) ও মুতাফায়হিক। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ছারছার ও মুতাশাদ্দিক কারা তা তো আমরা জানি। কিন্তু মুতাফায়হিক কারা? তিনি বললেন, যারা অহংকারী।

আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলার হাবীব, তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় বান্দা। প্রিয়ের প্রিয় প্রিয়ই হয়ে থাকে। সুতরাং কেউ যদি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় হতে পারে, তবে সে কত বড়ই না ভাগ্যবান। কেননা সে আল্লাহরও প্রিয় হয়ে যাবে। এর বিপরীতটাও এরকমই। যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অপ্রিয় সাব্যস্ত হবে, সে আল্লাহরও অপ্রিয় হয়ে যাবে। একজন মানুষের জন্য এরচে' দুর্ভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না। তাই আমাদের জানা দরকার কী করলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রিয় হওয়া যাবে এবং কি কি কাজ না করলে তাঁর অপ্রিয় হওয়া থেকে বাঁচা যাবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন বড়ই দয়ালু। তিনি নিজের পক্ষ থেকেই এ বিষয়টি আমাদের জানিয়ে গেছেন। সুতরাং তিনি ইরশাদ করেন-
إنَّ مِن أحبِّكم إليَّ وأقربِكُم منِّي مجلسًا يومَ القيامةِ أحاسنَكُم أخلاقًا (কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় ও আমার সবচে' বেশি নিকটবর্তী অবস্থানে থাকবে ওই ব্যক্তি, যার আখলাক-চরিত্র তোমাদের মধ্যে সবচে' বেশি ভালো)। এখানে কিয়ামত বলে জান্নাত বোঝানো উদ্দেশ্য। জান্নাতই আরামের জায়গা ও বসার স্থান। এর দ্বারা হাশরের ময়দান বোঝানো কঠিন। কেননা সেখানে সমস্ত মানুষ আল্লাহ তা'আলার সামনে দাঁড়ানো থাকবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের পক্ষে সুপারিশ করার ও তাদেরকে সেদিনের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করার জন্য ব্যস্ত থাকবেন। অবশ্য জান্নাতে যারা তাঁর বেশি প্রিয় হবে এবং সেখানে তাঁর কাছাকাছি স্থান লাভ করবে, হাশরের ময়দানেও তারা তাঁর সুপারিশ লাভ করবে বৈ কি এবং এ কথা বলাই যায় যে, তখন তাদের প্রতি তাঁর বিশেষ দৃষ্টিও থাকবে। আল্লাহ তা'আলা উত্তম চরিত্র অর্জনের মাধ্যমে আমাদেরকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশলাভ এবং জান্নাতে তাঁর কাছাকাছি থাকার তাওফীক দান করুন।

وإنَّ مِن أبغضِكُم إليَّ وأبعدِكُم منِّي يومَ القيامةِ الثَّرثارونَ والمتشدِّقونَ والمتفَيهِقونَ 'আর কিয়ামতের দিন আমার কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি ঘৃণ্য ও আমার থেকে সবচে দূরবর্তী থাকবে সেইসব লোক, যারা ছারছার (বাচাল), মুতাশাদ্দিক (কথাবার্তায় কৃত্রিম) ও মুতাফায়হিক'। ছারছার বলে এমন লোককে, যে কথায় ভান-ভণিতা করে এবং বেশি বেশি কথা বলে। মুতাশাদ্দিক বলা হয় এমন লোককে, যে কথায় সীমালঙ্ঘন করে ও তা দিয়ে মানুষকে আঘাত করে। সেইসঙ্গে কথায় কৃত্রিমতা আনা এবং নিজ কথার জৌলুস বাড়ানোর জন্য ভরাট মুখে কথা বলে। এ শব্দদু'টি আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তাই সাহাবায়ে কেরাম এর অর্থ বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু এর পরের শব্দটি তাদের পরিচিত ছিল না। তাই তারা বললেন-
يا رسولَ اللَّهِ، قد علِمنا الثَّرثارينَ والمتشدِّقينَ فما المتفَيهقونَ ؟ (ইয়া রাসূলাল্লাহ ছারছার ও মুতাশাদ্দিক কারা তা তো আমরা জানি। কিন্তু মুতাফায়হিক কারা)? এর উত্তরে তিনি বললেন-

الْمُتَكَبِّرُوْنَ (যারা অহংকারী)। মূলত الْمُتَفَيْهِقُ শব্দটির উৎপত্তি الفَهْق থেকে। এর অর্থ পরিপূর্ণ হওয়া, ভরে যাওয়া। যে ব্যক্তি ভরাটমুখে কথা বলে, প্রয়োজনের বেশি বলে নিজ কথা লম্বা-চওড়া করে ফেলে এবং বিরল শব্দ ব্যবহার করে অন্যদের উপর নিজ শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাকে الْمُتَفَيْهِق (মুতাফায়হিক) বলা হয়। মূলত এ সবই করা হয় অহংকারবশে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শব্দটির অর্থ করেছেন অহংকারী।

হাদীছে যে তিনটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সবগুলোর সম্পর্ক কথা বলার সঙ্গে এবং এর প্রত্যেকটিই মন্দ চরিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই এর অর্থ দাঁড়ায়, যার আখলাক-চরিত্র মন্দ, সে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেশি অপ্রিয়। সুতরাং শু'আবুল ঈমান গ্রন্থে এ হাদীছটির বর্ণনায় আছে-
وَإِنَّ أَبْغَضَكُمْ إِلَيَّ وَأَبْعَدَكُمْ مِنِّي فِي الْآخِرَةِ مَسَاوِيكُمْ أَخْلَاقًا : التَّرْثَارُوْنَ الْمُتَشَدِّقُوْنَ الْمُتَفَيْهِقُوْنَ
আর কিয়ামতের দিন আমার কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি ঘৃণ্য ও আমার থেকে সবচে দূরবর্তী থাকবে সেইসব লোক, যারা মন্দ চরিত্রের অধিকারী, যারা ছারছার (বাচাল), মুতাশাদ্দিক (কথাবার্তায় কৃত্রিম) ও মুতাফায়হিক।(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৪৬১৬)

আকূলী (عاقولي) রহ. বলেন, এ হাদীছটির ভিত্তি হল এ নীতির উপর যে, মুমিনগণ ঈমানের কারণে প্রিয়। অতঃপর বিভিন্ন ভালো গুণ এবং ঈমানের শাখা-প্রশাখায় তাদের পরস্পরের মধ্যে স্তরভেদ আছে। সে হিসেবে যার মধ্যে উৎকৃষ্ট গুণ বেশি, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেশি প্রিয় হবে। এমনিভাবে মন্দ গুণের দিক থেকেও তাদের মধ্যে স্তরভেদ আছে। সে হিসেবে তারা অপ্রিয় সাব্যস্ত হবে। কারও তুলনায় কেউ বেশি অপ্রিয় গণ্য হবে। এমনও হতে পারে যে, একই ব্যক্তি একদিক থেকে প্রিয় হবে, অন্যদিক থেকে অপ্রিয়। এ নিয়ম অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত মুমিনকে ঈমানের ভিত্তিতে ভালোবাসেন। আবার তাদের মধ্যে যার চরিত্র বেশি ভালো, তাকে বেশি ভালোবাসেন। অন্যদিকে যারা গুনাহগার, গুনাহের কারণে তারা তাঁর কাছে অপ্রিয়। তাদের মধ্যে আবার যাদের চরিত্র বেশি মন্দ, তারা তাঁর বেশি অপ্রিয়।

ইমাম নাওয়াবী রহ. বলেন, ইমাম তিরমিযী রহ. উত্তম চরিত্রের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দিছ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ.-এর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, "উত্তম চরিত্র হল উদ্ভাসিত ও হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা, ন্যায় বিস্তার করা ও কষ্টদান হতে বিরত থাকা।” ন্যায়বিস্তারের মানে সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা, উত্তম কথা দ্বারা মানুষকে সদুপদেশ দেওয়া, মানুষের প্রতি মহানুভবতা প্রকাশ করা, অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি। অনেকের মতে উত্তম চরিত্রের সবটাই কুরআন মাজীদের এ আয়াতের মধ্যে এসে গেছে যে-
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
‘তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।’(সূরা আ'রাফ, আয়াত ১৯৯)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জান্নাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘনিষ্ঠতালাভের আশাবাদীকে অবশ্যই উত্তম চরিত্র অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

খ. বাচালতা ভালো নয়। এটা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অপ্রিয় হওয়ার কারণ।

গ. কথায় ভান-ভণিতা নিন্দনীয় ও অবশ্য বর্জনীয়।

ঘ. আমাদেরকে অবশ্যই অহংকার করা ছাড়তে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহংকারী ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান