মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২০- জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়

হাদীস নং: ৪০৩৪
৭. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - গনীমাতের সম্পদ বণ্টন এবং তা আত্মসাৎ করা
৪০৩৪। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত ওমর (রাঃ) আমাকে বলিয়াছেন যে, খায়বার যুদ্ধের দিন (অর্থাৎ, যুদ্ধ শেষে) নবী (ﷺ)-এর কয়েকজন সাহাবী আসিয়া বলিলেন, অমুক শহীদ হইয়াছে এবং অমুক শহীদ হইয়াছে। অবশেষে তাঁহারা আরও এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলিলেন, অমুকও শহীদ হইয়াছে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিলেনঃ কস্মিনকালেও না। একখানা চাদর অথবা (বলিয়াছেন) একটি জুব্বা গনীমতের মাল হইতে খেয়ানতের দায়ে তাহাকে আমি দোযখের আগুনে দগ্ধ হইতে) দেখিয়াছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিলেন, হে ইবনুল খাত্তাব। যাও এবং লোকদিগকে তিন তিন বার ঘোষণা শুনাইয়া দাও যে, মু'মিন ব্যতীত কেহই জান্নাতে প্রবেশ করিবে না। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, আমি তখনই বাহির হইলাম এবং তিনবার ঘোষণা করিয়া দিলাম যে, সাবধান! ঈমানদার ব্যতীত কেহই বেহেশতে প্রবেশ করিবে না। —মুসলিম
وَعَن ابْن عَبَّاس قَالَ: حَدثنِي عمر قَالَ: لَمَّا كَانَ يَوْمَ خَيْبَرَ أَقْبَلَ نَفَرٌ مِنْ صَحَابَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالُوا: فُلَانٌ شَهِيدٌ وَفُلَانٌ شَهِيدٌ حَتَّى مَرُّوا عَلَى رَجُلٍ فَقَالُوا: فُلَانٌ شَهِيدٌ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «كَلَّا إِنِّي رَأَيْتُهُ فِي النَّارِ فِي بُرْدَةٍ غَلَّهَا أَوْ عَبَاءَةٍ» ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا ابْنَ الْخَطَّابِ اذْهَبْ فَنَادِ فِي النَّاسِ: أَنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا الْمُؤْمِنُونَ ثَلَاثًا قَالَ: فَخَرَجْتُ فَنَادَيْتُ: أَلَا إِنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا الْمُؤْمِنُونَ ثَلَاثًا. رَوَاهُ مُسلم

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. অর্থাৎ, কামিল মু'মিন ব্যতীত প্রথম বারের মত কেহ বেহেশতে প্রবেশ করিতে পারিবে না। দোযখে কৃত গুনাহের শাস্তি ভোগ করার পর অন্তরে ঈমান থাকিলে পরবর্তীতে ইহারাও বেহেশতে যাইবে।

২. এ হাদীছে খায়বার যুদ্ধকালীন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। খায়বারের যুদ্ধ হয়েছিল হিজরী ৭ম সালে এবং তা হয়েছিল ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে মুসলিম পক্ষের অনেকেই শাহাদাত বরণ করেছিলেন। ইসলামী জিহাদ হয়ে থাকে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে এবং তার উদ্দেশ্য থাকে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করা। ফলে এতে মুসলমানদের যারা নিহত হয়, তারা শহীদ বলে গণ্য হয়। শহীদগণ বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে এবং তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের অতি উচ্চ মর্যাদা। কুরআন মাজীদে তাদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ (169) فَرِحِينَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ

এবং (হে নবী!) যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে কখনওই মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত। তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের কাছে রিযিক দেওয়া হয়। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন, তারা তাতে প্রফুল্ল। সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৬৯-১৭০

বিভিন্ন হাদীছে শহীদদের বিপুল মর্যাদা ও অশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন একটি দীর্ঘ হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

إن أرواح الشهداء في طير خضر لها قناديل بالعرش، تسرح في أي الجنة شاءت ثم تأوي إلى قناديلها

শহীদদের রূহ সবুজ পাখির ভেতর থাকবে। সে পাখির জন্য রয়েছে আরশে ঝুলন্ত ফানুস। সেখান থেকে বের হয়ে তারা যে-কোনও জান্নাতে ইচ্ছা হয় ঘুরে বেড়াবে। তারপর আবার সেই ফানুসে এসে ঠাঁই নেবে। মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৯৫৫৪; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ১২০

সাহাবায়ে কিরাম শাহাদাত লাভের জন্য ব্যাকুল থাকতেন। তাদের প্রত্যেকেরই অন্যের সম্পর্কে সুধারণা থাকত। যে-কেউ জিহাদে অংশগ্রহণ করলে তাকে খাঁটি মুজাহিদ মনে করতেন এবং নিহত হলে তাকে শহীদ গণ্য করতেন। তো খায়বার যুদ্ধে অনেকে নিহত হলে সাহাবায়ে কিরামের একটি দল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে তাদের একেকজনের নাম নিয়ে বলতে থাকলেন- অমুক শহীদ, অমুক শহীদ।

একপর্যায়ে তারা জনৈক ব্যক্তির নাম নিয়ে তাকেও শহীদ বলে আখ্যায়িত করলেন। তাদের এ মন্তব্য শুনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে উঠলেন-

كلا , إني رأيته في النار في بردة غلها أو عباءة

কক্ষণও নয়, আমি তাকে একটি চাদর বা একটি আবার কারণে জাহান্নামে দেখতে পেয়েছি।
অর্থাৎ তোমরা থাম, তার সম্পর্কে এমন মন্তব্য করো না। তার শহীদ হওয়ার অর্থ তো দাঁড়ায় যে, সে বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে এবং অনন্তকাল জান্নাতের উচ্চস্তরে সুখের জীবন কাটাবে। এরকম সৌভাগ্য তার কী করে হতে পারে, যখন সে গনীমতের মাল বণ্টনের আগেই তা থেকে একটি চাদর বা আবা সরিয়ে নিয়েছে? এ অপরাধের কারণে কক্ষণও সে ওই সৌভাগ্য লাভ করতে পারে না এবং বাস্তবে তা লাভ করেওনি। কেননা আমি তাকে এ অপরাধের দরুন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে দেখেছি। অর্থাৎ গনীমতের মাল আত্মসাৎ করার কারণে শহীদের সুউচ্চ মর্যাদা থেকে সে বঞ্চিত হয়ে জাহান্নামের উপযুক্ত হয়ে গেছে। ফলে তার জন্য এ মর্যাদাকর উপাধিটি প্রযোজ্য নয়। তাকে কিছুতেই শহীদ বলা যায় না।

হাদীছে যে ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে যে, গনীমতের মাল থেকে একটি চাদর বা আবা সরিয়ে রেখেছিল, সে ব্যক্তি কে, সুনির্দিষ্টভাবে তা জানা যায় না। সে ব্যক্তি মুনাফিকও হতে পারে। এমনও হতে পারে যে, সে মুসলিমই ছিল, তবে তখনও পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষায় পরিপক্ক হয়ে উঠেনি। হয়তো তার জানাই ছিল না যে, এভাবে গনীমতের মালে হস্তক্ষেপ করতে নেই। সে ক্ষেত্রে তার সম্পর্কে এ সতর্কবাণী দ্বারা উদ্দেশ্য অবধারিতভাবে তার জাহান্নামী হয়ে যাওয়া নয়। বরং এই কাজটির নিন্দা জানানো এবং এ কথা জানানো যে, এরকম অপরাধী জাহান্নামে যাওয়ারই উপযুক্ত। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এরকম অপরাধ করে, তার পরিণাম জাহান্নামের শাস্তিভোগ। এই ব্যক্তির যদি এ কাজের নিষোধাজ্ঞা সম্পর্কে জানা না থাকে, তবে অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তার ক্ষমার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

উল্লেখ্য, 'শহীদ' একটি ইসলামী পরিভাষা। এটি অতি মর্যাদাকর উপাধি। এটা কেবল এমন ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য, যে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর পথে জিহাদ ও সংগ্রাম করে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ইদানীং এ উপাধি ব্যবহারের ক্ষেত্রে চরম বাড়াবাড়ি দেখা যাচ্ছে এবং এ উপাধিটি ব্যবহারের রীতিনীতি ও শর্ত রক্ষায় মারাত্মক অবহেলা ও শিথিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে-কোনও উদ্দেশ্যে নিহত হলেই তাকে শহীদ বলে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে তার ঈমান-আকীদা ঠিক থাকা বা না থাকারও পরওয়া করা হয় না। চরম পথভ্রষ্ট, ভয়ানক ফাসেক, এমনকি বেঈমান ও অমুসলিমকেও 'শহীদ' উপাধিতে ভূষিত করা হচ্ছে। এটা ইসলামী মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনকি এটাকে ইসলামী হিদায়াত ও দিকনির্দেশনার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনেরও নামান্তর বলা যায়। এরকম মনোভাব দীন ও ঈমানের পক্ষে এক মারাত্মক ঝুঁকি। নিজেকে মুমিন ও মুসলিম বলে পরিচয় দিতে আনন্দ বোধ করে- এমন যে-কোনও ব্যক্তির এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, কোনও অবস্থায়ই গনীমতের মাল বা সরকারি সম্পদে হাত দিতে নেই।

খ. গনীমতের মাল আত্মসাৎ করার দ্বারা শাহাদাতের মর্যাদা বাতিল হয়ে যায়।

গ. নির্বিচারে যে-কাউকে শহীদ নামে অভিহিত করা উচিত নয়।

ঘ. দায়িত্বশীল ব্যক্তির সামনে কেউ কাউকে ভুল সনদ দিলে বা কোনও ভুল কথা বললে তার উচিত তাকে সতর্ক করে দেওয়া।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৪০৩৪ | মুসলিম বাংলা