মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

১৯- রাষ্ট্রনীতি ও আদালত-বিচার অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৬৭৩
প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৬৭৩। হযরত ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রাঃ) বলেন, একবার সালামা ইবনে ইয়াযীদ জু'ফী রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে আল্লাহর নবী।আপনি আমাদিগকে এই সম্পর্কে কি আদেশ করেন? যদি আমাদের উপর এমন শাসক চাপিয়া বসে, যে আমাদের নিকট হইতে নিজেদের প্রাপ্য আদায় করিয়া নিতে চায়, কিন্তু তাহারা আমাদের প্রাপ্য আদায় করিতে অস্বীকার করে? উত্তরে তিনি বলিলেন: তাহাদের আদেশ শ্রবণ কর এবং আনুগত্য কর। কেননা, তাহাদের কর্তব্য তাহাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা আর তোমাদের কর্তব্য হইল তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা। —মুসলিম
وَعَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَ: سَأَلَ سَلَمَةُ بْنُ يَزِيدَ الْجُعْفِيُّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا نَبِيَّ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ قَامَتْ عَلَيْنَا أُمَرَاءُ يَسْأَلُونَا حَقَّهُمْ وَيَمْنَعُونَا حَقَّنَا فَمَا تَأْمُرُنَا؟ قَالَ: «اسْمَعُوا وَأَطِيعُوا فَإِنَّمَا عَلَيْهِمْ مَا حُمِّلُوا وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ» . رَوَاهُ مُسلم

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. প্রজাবৃন্দের প্রতিপালন এবং তাহাদের মধ্যে ইন্‌সাফ কায়েম করা ইত্যাদি শাসকের দায়িত্ব, আর প্রজার উপর দায়িত্ব হইল তাঁহাদের আনুগত্য করা এবং কোন অনাচারের সম্মুখীন হইলে ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহর কালামঃ
قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ ۖ فَإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُم مَّا حُمِّلْتُمْ ۖ وَإِن تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا

এই আয়াতের প্রেক্ষিতে ইহাই সুস্পষ্ট যে, যদি শাসকগণ অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায় না করে, তবে উহার পরিণাম তাহারাই ভোগ করিবে, প্রজাবৃন্দকে উহার জবাবদিহি করিতে হইবে না।

২. কোনও শাসক যদি জনগণের হক আদায় না করে, কিন্তু তাদের কাছে নিজের হক দাবি করে, সে ক্ষেত্রে করণীয় কী, সে সম্পর্কেই এ হাদীছ। শাসকের হক ও অধিকার হল জনগণের আনুগত্য, জিহাদ ও ওইসকল কাজ, যা তাদের সহযোগিতা ছাড়া করা সম্ভব নয়, তাতে তাদের সক্রিয় সহযোগিতা। আর জনগণের হক হল শাসকের ন্যায় ও ইনসাফসম্মত শাসন, তাদের জান-মালের নিরাপত্তাবিধান, তাদের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন ও তাদের মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির ব্যবস্থাকরণ, আল্লাহর ভূমিতে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা এবং দীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা।

‘আমীর’ শব্দটির অর্থ ব্যাপক। আঞ্চলিক সর্বনিম্ন শাসনকর্তা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক পর্যন্ত সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত। জনগণের কর্তব্য এদের সকলেরই আনুগত্য করা। এখন কোনও শাসক-প্রশাসক যদি জনগণের হক আদায় না করে, কিন্তু নিজেদের হক পুরোপুরি পেতে চায়, সে ক্ষেত্রে করণীয় কী? সাহাবী হযরত সালামা ইবন ইয়াযীদ রাযি. এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে এর কোনও উত্তর দেননি। হয়তো ওহীর অপেক্ষা করেছিলেন অথবা ইচ্ছাকৃতই প্রশ্নটি উপেক্ষা করেছিলেন। তিনি সে উপেক্ষা দ্বারা সম্ভবত বোঝাতে চাচ্ছিলেন, এটা তো খুবই আপত্তিকর। এমন হবে কেন? কোনও শাসকেরই এমন করা উচিত নয়। তারপরও সাহাবী পুনরায় একই প্রশ্ন করলেন। কেননা অনুচিত হলেও কোনও শাসক তো এরকম করতে পারে। সে ক্ষেত্রে জনগণের করণীয় কী, তা স্পষ্ট হওয়া উচিত। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশনা দিলেন-
اسْمَعُوا وَأَطِيعُوا ، فَإِنَّمَا عَلَيْهِمْ مَا حُمِّلُوْا، وَعَلَيْكُمْ مَا حملْتُمْ (তোমরা শুনবে ও মানবে। কারণ তাদের পাপভার তাদের উপর এবং তোমাদের পাপভার তোমাদের উপর)। অর্থাৎ তারা তোমাদের অধিকার আদায় না করলেও তোমরা অবশ্যই তাদের অধিকার আদায় করবে। তোমরা তাদের আনুগত্য করে যাবে। তাদের কর্তব্য তাদের দায়িত্ব পালন করা। তা পালন না করলে যে গুনাহ হবে, তা কেবল তাদের কাঁধেই চাপবে। তাদের সে দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে তোমরা তোমাদের দায়িত্ব পালন থেকে নিষ্কৃতি পেতে পার না। তোমাদের দায়িত্ব তাদের আনুগত্য করে যাওয়া। তা করলে তোমরা ছাওয়াব পাবে, না করলে তোমরা গুনাহগার হবে। তোমাদের গুনাহের জন্য তারা দায়ী হবে না আর তাদের গুনাহের জন্যও তোমরা দায়ী হবে না। আখিরাতে প্রত্যেককেই আপন আপন কাজের হিসাব দিতে হবে। প্রত্যেককেই আপন আপন গুনাহের খেসারত দিতে হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. শাসকের উপর যেমন জনগণের হক আছে, তেমনি জনগণের উপরও শাসকের হক আছে। প্রত্যেকের উচিত সে হক আদায়ে সচেষ্ট থাকা।

খ. শাসক যদি জনগণের হক আদায় না করে, তবুও জনগণের কর্তব্য শাসকের হক আদায় করা ও তার আনুগত্য করে যাওয়া।

গ. এক পক্ষের দায়িত্বপালনে অবহেলার কারণে অন্য পক্ষ আপন দায়িত্বপালন থেকে নিষ্কৃতি পায় না।

ঘ. প্রত্যেকের উচিত আপন দায়িত্বপালনে সচেতন থাকা। কেননা তাতে অবহেলা করলে যে গুনাহ হয়, তা কেবল তাকেই বহন করতে হবে, অন্য কেউ বহন করবে না, যেমন তাকে বহন করতে হবে না অন্যের অবহেলাজনিত গুনাহের বোঝা।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৩৬৭৩ | মুসলিম বাংলা