মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
১৮- শরীআতের দন্ড বিধি অধ্যায়
হাদীস নং: ৩৬২১
- শরীআতের দন্ড বিধি অধ্যায়
৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - মদ পানের দণ্ডবিধি
৩৬২১। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর নিকট এমন এক লোককে আনা হইল, যে মদ্য পান করিয়াছিল। তখন হুযূর (ﷺ) বলিলেনঃ তোমরা লোকটিকে পিটাও। সুতরাং আমাদের কেহ হাত দ্বারা কেহ চাদর (মোড়াইয়া লাঠির ন্যায় করিয়া) উহার দ্বারা আবার কেহ জুতার দ্বারা তাহাকে মারপিট করিল। অতঃপর তিনি বলিলেন, এই কাজের দরুন তোমরা তাহাকে ভর্ৎসনা ও নিন্দা জ্ঞাপন কর। সুতরাং লোকেরা তাহার সম্মুখে যাইয়া তাহাকে মুখামুখি তিরস্কার করিতে করিতে বলিল, তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না? তোমার কি আল্লাহর আযাবের ভয় নাই? রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হইতেও কি তোমার লজ্জাবোধ হইল না ইত্যাদি দ্বারা তাহাকে নিন্দা করিতে যাইয়া কোন এক ব্যক্তি বলিয়া ফেলিল, 'আল্লাহ্ তোমাকে অপমান ও লাঞ্ছিত করুক'। এই কথা শুনিয়া হুযূর (ﷺ) বাধা দিয়া বলিলেন, তোমরা তাহাকে এইরূপ কথা বা এইরূপে বদ দোআ করিও না। তোমরা এইরূপ বলিয়া তাহার ব্যাপারে শয়তানের মদদ ও সাহায্য করিও না; বরং তোমরা এইভাবে বল, আয় আল্লাহ্! তাহাকে মাফ করিয়া দাও। আয় আল্লাহ্! তাহার প্রতি অনুগ্রহ কর। —আবু দাউদ
كتاب الحدود
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أُتِيَ بِرَجُلٍ قَدْ شربَ الخمرَ فَقَالَ: «اضْرِبُوهُ» فَمِنَّا الضَّارِبُ بِيَدِهِ وَالضَّارِبُ بِثَوْبِهِ وَالضَّارِبُ بِنَعْلِهِ ثُمَّ قَالَ: «بَكِّتُوهُ» فَأَقْبَلُوا عَلَيْهِ يَقُولُونَ: مَا اتَّقَيْتَ اللَّهَ مَا خَشِيتَ اللَّهَ وَمَا اسْتَحْيَيْتَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ بَعْضُ الْقَوْمِ: أَخْزَاكَ اللَّهُ. قَالَ: لَا تَقُولُوا هَكَذَا لَا تُعِينُوا عَلَيْهِ الشَّيْطَانَ وَلَكِنْ قُولُوا: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ اللَّهُمَّ ارْحَمْهُ . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
হাদীসের ব্যাখ্যা:
১. ‘তাহার ব্যাপারে শয়তানের সাহায্য করিও না।' এই কথার অর্থ হইল, যদি সে আল্লাহর রহমত হইতে বঞ্চিত হয়; তবে শয়তান তাহার উপর প্রাধান্য বিস্তার করিবে। ফলে সে আরও অধিক পাপে লিপ্ত হইবে। অথবা যখন সে আল্লাহর রহমত ও দয়া হইতে নিরাশ ও হতাশ হইয়া যাইবে, তখন আরও জঘন্যতম পাপ করিতেও কুণ্ঠাবোধ করিবে না। আর শয়তান ইহাই চায়
২. এ হাদীছে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়।
ক. মদ পান করেছে এমন এক ব্যক্তিকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাজির করা;
খ. তিনি তাকে মারপিট করতে বললে সকলে মিলে তাকে মারধর করা এবং
গ. শাস্তিদানের পর লোকটি যখন চলে যাচ্ছিল তখন কোনও একজন তাকে লক্ষ্য করে অভিশাপ দিলে তাকে অভিশাপ দিতে নিষেধ করা।
যে ব্যক্তি মদপান করেছিল তাকে হাজির করা হয়েছিল একজন অপরাধীরূপে। মদপান করা এক দণ্ডনীয় অপরাধ। ইসলামে এর শাস্তি হল ৪০ দোররা। সে মদপানের অপরাধ করেছিল বলে তাকে এ শাস্তিদানের জন্য হাজির করা হয়।
মদপান প্রথম দিকে নিষেধ ছিল না। এটা নিষেধ করা হয় পর্যায়ক্রমে। প্রথমে এর ক্ষতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় (দ্র: সূরা বাকারা (২), আয়াত নং ২১৯)। তারপর নামাযের সময় মদপান করতে নিষেধ করা হয় (দ্র: সূরা নিসা (৪), আয়াত নং ৪৩)। সবশেষে সুস্পষ্টভাবে এটি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এ মর্মে অবতীর্ণ হয়-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (90) إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ (91)
‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমার বেদী ও জুয়ার তীর অপবিত্র, শয়তানী কাজ। সুতরাং এসব পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন কর। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষের বীজই বপন করতে চায় এবং চায় তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির ও নামায থেকে বিরত রাখতে। সুতরাং, তোমরা কি (ওসব জিনিস থেকে) নিবৃত্ত হবে? ১৮৫
সঙ্গে সঙ্গে সাহাবীগণ বলে উঠলেন, আমরা নিবৃত্ত হলাম, আমরা নিবৃত্ত হলাম। তাঁরা নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেলেন। মদের মটকা ভেঙ্গে ফেললেন। রাস্তাঘাটে পানির মত মদ বইতে লাগল। মদের আসর উঠে গেল। বহুদিনের অভ্যাস খতম হয়ে গেল। তাঁরা মাদকাসক্তি ছেড়ে আল্লাহপ্রেমে নিমজ্জিত হলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইশক ও মহব্বত এবং দীনের অনুসরণকেই আসক্তির বিষয় বানিয়ে নিলেন। মদ ও মাদকাসক্তি নিবারণে অভূতপূর্ব বিপ্লব সূচিত হল। বলা যায় ইসলামী সমাজ থেকে মাদকাসক্তির চূড়ান্ত নির্বাসন ঘটে গেল। মাদকাসক্তি নিবারণে এরকম সফলতা কোনও রাষ্ট্রীয় আইন, কোনও নেতার নির্দেশ বা কোনও সামাজিক আন্দোলন কখনও দেখাতে পারেনি।
এ সফলতার প্রাণশক্তি ছিল আল্লাহ ও রাসূলপ্রেম এবং তাকওয়া ও পরহেযগারীর চর্চা। কাজেই এই যে ব্যক্তিকে মদপানের অপরাধে হাজির করা হল এর দ্বারা এ ধারণা নেওয়া ঠিক হবে না যে, তখনও বুঝি মদপানের ব্যাপক প্রচলন রয়ে গিয়েছিল। বা লুকাছাপা করে হলেও মানুষ ব্যাপকভাবে মদপান করত। ব্যাপারটা সেরকম নয় মোটেই। গোটা নবীজীবন এবং তারপর খেলাফতে রাশেদার চল্লিশ বছরের দীর্ঘ সময়কালে এরকম ঘটনা গোনাগুণতি কয়েকটাই ঘটেছে। এরূপ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটা মূলত না ঘটারই নামান্তর।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, লোকটিকে ধরে নিয়ে আসার দ্বারা বোঝা যায়, ইসলামে এটা একটা দণ্ডনীয় অপরাধ এবং রাষ্ট্রের কর্তব্য এরূপ অপরাধীর উপর দণ্ড কার্যকর করা। হাদীছের বর্ণনা দ্বারা বাহ্যত বোঝা যায় তাকে গণধোলাই দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টা তা নয়। মদপানের অপরাধে জনগণ তাকে নিজেদের ইচ্ছামত মারধর করেনি; বরং তারা তাকে ধরে আদালতে হাজির করেছে। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই ছিলেন বিচারক। তিনিই উপস্থিত লোকজনকে তার উপর শাস্তি কার্যকরের হুকুম দিয়েছেন। সেই হিসেবে ইসলাম মদপানকারীর শাস্তি হিসেবে যে ৪০ দোররার ব্যবস্থা রেখেছে, তারা সেটাই প্রয়োগ করেছে। কোনও কোনও বর্ণনায় স্পষ্টই আছে যে, গুণে দেখা গেছে তাদের সকলের মারের পরিমাণ চল্লিশই হয়েছিল। সকলকে দিয়ে মারানোর উদ্দেশ্য ছিল হয়ত শাস্তিকে দৃষ্টান্তমূলক করা। যাতে ফের কেউ এ জাতীয় অপরাধে লিপ্ত হওয়ার সাহস না করে।
তৃতীয় বিষয় হল, অভিশাপ দিতে নিষেধ করা। এক ব্যক্তি যখন বলল- 'আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুন', তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, لاَ تَقُولُوا هَكَذَا এরকম বলো না'। অর্থাৎ তার উপর বদ্দুআ দিও না, তাকে অভিশাপ করো না। কেননা সে একজন মুমিন। ঈমানের সুবাদে সে আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান। আল্লাহর কাছে যে মর্যাদাবান সে লাঞ্ছিত হবে কেন? মদপান ও তার শাস্তিভোগ করার কারণে যে সম্মানহানি তার হয়েছে, সে যাতে তা ফিরে পেতে পারে সেই চেষ্টা করাই তোমাদের কর্তব্য। ঈমানসূত্রে সে তোমাদের ভাই। তোমাদের উচিত তার জন্য দুআ করা, যাতে আর কখনও সে এরকম অপরাধ না করে এবং আল্লাহ তা'আলা তাকে সেই তাওফীক দান করেন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- لاَ تُعِينُوا عَلَيْهِ الشَّيْطَانَ তার বিরুদ্ধে শয়তানকে সাহায্য করো না'। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে তার লাঞ্ছিত হওয়ার অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহর রহমত থেকে তার বঞ্চিত হয়ে যাওয়া। যার প্রতি আল্লাহর রহমত হবে না সে গুনাহ থেকেও বাঁচতে পারবে না। শয়তান তাকে পাপকর্মে প্ররোচিত করবে এবং সে ব্যক্তি তার সেই প্ররোচনার শিকার হয়ে যাবে। কাউকে অসহায়ভাবে শয়তানের হাতে ছেড়ে দেওয়াটা ভ্রাতৃসুলভ আচরণ নয়। সে যতই পাপ করুক না কেন, সে যেহেতু তোমাদের ভাই তাই তোমাদের কর্তব্য তার প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করা। কল্যাণকামিতার দাবি, তার জন্য নেক দুআ করা, যাতে তার তাওবা কবুল হয় এবং মদপানসহ সর্বপ্রকার পাপকর্ম থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক লাভ হয়।
হাদীছটির শিক্ষা
ক. মদপান একটি শরীআতী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
খ. শরীআতী শাস্তি প্রয়োগ করা আদালতের কাজ। সাধারণ জনগণ নিজেদের পক্ষ থেকে তা প্রয়োগের অধিকার রাখে না।
গ. শরীআতী শাস্তিযোগ্য অপরাধ কেউ করলে শাস্তি আরোপ করা আদালতের অবশ্যকর্তব্য। আদালত তা ক্ষমার এখতিয়ার রাখে না।
ঘ. কেউ পাপকর্ম করে ফেললে বা কারও উপর অপরাধের শাস্তি প্রয়োগ করা হলে তাতে কারও খুশি হওয়া তো উচিতই নয়, তার প্রতি বদ্দুআও করা উচিত নয়। বরং কর্তব্য কল্যাণকামিতাপূর্ণ আচরণ করা এবং যাতে তার তাওবা নসীব হয় ও আত্মসংশোধনের তাওফীক হয় সেই দুআ করা।
১৮৫. সূরা মায়িদা (৫), আয়াত নং ৯০, ৯১
২. এ হাদীছে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়।
ক. মদ পান করেছে এমন এক ব্যক্তিকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাজির করা;
খ. তিনি তাকে মারপিট করতে বললে সকলে মিলে তাকে মারধর করা এবং
গ. শাস্তিদানের পর লোকটি যখন চলে যাচ্ছিল তখন কোনও একজন তাকে লক্ষ্য করে অভিশাপ দিলে তাকে অভিশাপ দিতে নিষেধ করা।
যে ব্যক্তি মদপান করেছিল তাকে হাজির করা হয়েছিল একজন অপরাধীরূপে। মদপান করা এক দণ্ডনীয় অপরাধ। ইসলামে এর শাস্তি হল ৪০ দোররা। সে মদপানের অপরাধ করেছিল বলে তাকে এ শাস্তিদানের জন্য হাজির করা হয়।
মদপান প্রথম দিকে নিষেধ ছিল না। এটা নিষেধ করা হয় পর্যায়ক্রমে। প্রথমে এর ক্ষতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় (দ্র: সূরা বাকারা (২), আয়াত নং ২১৯)। তারপর নামাযের সময় মদপান করতে নিষেধ করা হয় (দ্র: সূরা নিসা (৪), আয়াত নং ৪৩)। সবশেষে সুস্পষ্টভাবে এটি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এ মর্মে অবতীর্ণ হয়-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (90) إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ (91)
‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমার বেদী ও জুয়ার তীর অপবিত্র, শয়তানী কাজ। সুতরাং এসব পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন কর। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষের বীজই বপন করতে চায় এবং চায় তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির ও নামায থেকে বিরত রাখতে। সুতরাং, তোমরা কি (ওসব জিনিস থেকে) নিবৃত্ত হবে? ১৮৫
সঙ্গে সঙ্গে সাহাবীগণ বলে উঠলেন, আমরা নিবৃত্ত হলাম, আমরা নিবৃত্ত হলাম। তাঁরা নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেলেন। মদের মটকা ভেঙ্গে ফেললেন। রাস্তাঘাটে পানির মত মদ বইতে লাগল। মদের আসর উঠে গেল। বহুদিনের অভ্যাস খতম হয়ে গেল। তাঁরা মাদকাসক্তি ছেড়ে আল্লাহপ্রেমে নিমজ্জিত হলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইশক ও মহব্বত এবং দীনের অনুসরণকেই আসক্তির বিষয় বানিয়ে নিলেন। মদ ও মাদকাসক্তি নিবারণে অভূতপূর্ব বিপ্লব সূচিত হল। বলা যায় ইসলামী সমাজ থেকে মাদকাসক্তির চূড়ান্ত নির্বাসন ঘটে গেল। মাদকাসক্তি নিবারণে এরকম সফলতা কোনও রাষ্ট্রীয় আইন, কোনও নেতার নির্দেশ বা কোনও সামাজিক আন্দোলন কখনও দেখাতে পারেনি।
এ সফলতার প্রাণশক্তি ছিল আল্লাহ ও রাসূলপ্রেম এবং তাকওয়া ও পরহেযগারীর চর্চা। কাজেই এই যে ব্যক্তিকে মদপানের অপরাধে হাজির করা হল এর দ্বারা এ ধারণা নেওয়া ঠিক হবে না যে, তখনও বুঝি মদপানের ব্যাপক প্রচলন রয়ে গিয়েছিল। বা লুকাছাপা করে হলেও মানুষ ব্যাপকভাবে মদপান করত। ব্যাপারটা সেরকম নয় মোটেই। গোটা নবীজীবন এবং তারপর খেলাফতে রাশেদার চল্লিশ বছরের দীর্ঘ সময়কালে এরকম ঘটনা গোনাগুণতি কয়েকটাই ঘটেছে। এরূপ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটা মূলত না ঘটারই নামান্তর।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, লোকটিকে ধরে নিয়ে আসার দ্বারা বোঝা যায়, ইসলামে এটা একটা দণ্ডনীয় অপরাধ এবং রাষ্ট্রের কর্তব্য এরূপ অপরাধীর উপর দণ্ড কার্যকর করা। হাদীছের বর্ণনা দ্বারা বাহ্যত বোঝা যায় তাকে গণধোলাই দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টা তা নয়। মদপানের অপরাধে জনগণ তাকে নিজেদের ইচ্ছামত মারধর করেনি; বরং তারা তাকে ধরে আদালতে হাজির করেছে। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই ছিলেন বিচারক। তিনিই উপস্থিত লোকজনকে তার উপর শাস্তি কার্যকরের হুকুম দিয়েছেন। সেই হিসেবে ইসলাম মদপানকারীর শাস্তি হিসেবে যে ৪০ দোররার ব্যবস্থা রেখেছে, তারা সেটাই প্রয়োগ করেছে। কোনও কোনও বর্ণনায় স্পষ্টই আছে যে, গুণে দেখা গেছে তাদের সকলের মারের পরিমাণ চল্লিশই হয়েছিল। সকলকে দিয়ে মারানোর উদ্দেশ্য ছিল হয়ত শাস্তিকে দৃষ্টান্তমূলক করা। যাতে ফের কেউ এ জাতীয় অপরাধে লিপ্ত হওয়ার সাহস না করে।
তৃতীয় বিষয় হল, অভিশাপ দিতে নিষেধ করা। এক ব্যক্তি যখন বলল- 'আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুন', তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, لاَ تَقُولُوا هَكَذَا এরকম বলো না'। অর্থাৎ তার উপর বদ্দুআ দিও না, তাকে অভিশাপ করো না। কেননা সে একজন মুমিন। ঈমানের সুবাদে সে আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান। আল্লাহর কাছে যে মর্যাদাবান সে লাঞ্ছিত হবে কেন? মদপান ও তার শাস্তিভোগ করার কারণে যে সম্মানহানি তার হয়েছে, সে যাতে তা ফিরে পেতে পারে সেই চেষ্টা করাই তোমাদের কর্তব্য। ঈমানসূত্রে সে তোমাদের ভাই। তোমাদের উচিত তার জন্য দুআ করা, যাতে আর কখনও সে এরকম অপরাধ না করে এবং আল্লাহ তা'আলা তাকে সেই তাওফীক দান করেন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- لاَ تُعِينُوا عَلَيْهِ الشَّيْطَانَ তার বিরুদ্ধে শয়তানকে সাহায্য করো না'। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে তার লাঞ্ছিত হওয়ার অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহর রহমত থেকে তার বঞ্চিত হয়ে যাওয়া। যার প্রতি আল্লাহর রহমত হবে না সে গুনাহ থেকেও বাঁচতে পারবে না। শয়তান তাকে পাপকর্মে প্ররোচিত করবে এবং সে ব্যক্তি তার সেই প্ররোচনার শিকার হয়ে যাবে। কাউকে অসহায়ভাবে শয়তানের হাতে ছেড়ে দেওয়াটা ভ্রাতৃসুলভ আচরণ নয়। সে যতই পাপ করুক না কেন, সে যেহেতু তোমাদের ভাই তাই তোমাদের কর্তব্য তার প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করা। কল্যাণকামিতার দাবি, তার জন্য নেক দুআ করা, যাতে তার তাওবা কবুল হয় এবং মদপানসহ সর্বপ্রকার পাপকর্ম থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক লাভ হয়।
হাদীছটির শিক্ষা
ক. মদপান একটি শরীআতী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
খ. শরীআতী শাস্তি প্রয়োগ করা আদালতের কাজ। সাধারণ জনগণ নিজেদের পক্ষ থেকে তা প্রয়োগের অধিকার রাখে না।
গ. শরীআতী শাস্তিযোগ্য অপরাধ কেউ করলে শাস্তি আরোপ করা আদালতের অবশ্যকর্তব্য। আদালত তা ক্ষমার এখতিয়ার রাখে না।
ঘ. কেউ পাপকর্ম করে ফেললে বা কারও উপর অপরাধের শাস্তি প্রয়োগ করা হলে তাতে কারও খুশি হওয়া তো উচিতই নয়, তার প্রতি বদ্দুআও করা উচিত নয়। বরং কর্তব্য কল্যাণকামিতাপূর্ণ আচরণ করা এবং যাতে তার তাওবা নসীব হয় ও আত্মসংশোধনের তাওফীক হয় সেই দুআ করা।
১৮৫. সূরা মায়িদা (৫), আয়াত নং ৯০, ৯১
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)