মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

১৩- উত্তরাধিকার সম্পত্তি ও ওয়াসিয়্যাত অধ্যায়

হাদীস নং: ৩০৪১
- উত্তরাধিকার সম্পত্তি ও ওয়াসিয়্যাত অধ্যায়
১৯. প্রথম অনুচ্ছেদ - ফারায়িয (মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন সম্বন্ধীয়) ও অন্তিম উপদেশ বা আদেশ)
৩০৪১। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলিয়াছেন: আমি মু'মিনদের পক্ষে তাহাদের নিজেদের অপেক্ষাও নিকটতর। সুতরাং যে মরিয়া যায় ও তাহার উপর ঋণের বোঝা থাকে, আর যে উহা পরিশোধ করার পরিমাণ সম্পত্তি রাখিয়া না যায়, উহা পরিশোধ করার ভার আমার উপর। আর যে মাল রাখিয়া যায় উহা তাহার ওয়ারিসগণের।

অপর এক বর্ণনায় আছে—যে ঋণ অথবা অসহায় পোষ্য রাখিয়া যায়, সে যেন আমার নিকট আসে, আমিই তাহার অভিভাবক। অপর বর্ণনায় আছে—যে মাল রাখিয়া যাইবে তাহা তাহার ওয়ারিসগণের হইবে; আর যে কোন বোঝা রাখিয়া যাইবে তাহা আমার প্রতি বর্তাইবে।
كتاب الفرائض والوصايا
كتاب الْفَرَائِض والوصايا: الْفَصْل الأول
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «أَنَا أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ فَمَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ دَيْنٌ وَلَمْ يَتْرُكْ وَفَاءً فَعَلَيَّ قَضَاؤُهُ. وَمَنْ تَرَكَ مَالًا فَلِوَرَثَتِهِ» . وَفِي رِوَايَة: «من ترك دينا أَو ضيَاعًا فَلْيَأْتِنِي فَأَنَا مَوْلَاهُ» . وَفِي رِوَايَةٍ: «مَنْ تَرَكَ مَالًا فَلِوَرَثَتِهِ وَمَنْ تَرَكَ كَلًّا فَإِلَيْنَا»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

দায়ভাগ

দায়ভাগ—মূলে 'ফারায়েয' শব্দ রহিয়াছে। একবচনে 'ফরীযাহ্’— যাহার অর্থ, নির্ধারিত বিষয়, নির্ধারিত অংশ। এখানে ইহার অর্থ, মৃতের সম্পদ হইতে তাহার আত্মীয়দের জন্য শরীঅত নির্ধারিত অংশ।
কোরআনে বলা হইয়াছে, “পুরুষের জন্য তাহার মা-বাপ ও আত্মীয়গণ কম-বেশী যাহা রাখিয়া গিয়াছে তাহাতে অংশ রহিয়াছে এবং নারীদের জন্য তাহার মা-বাপ ও আত্মীয়গণ কম-বেশী যাহা রাখিয়া গিয়াছে তাহাতে অংশ রহিয়াছে আল্লাহর পক্ষ হইতে নির্ধারিতরূপে।" (সূরা নেসাঃ আয়াত ৭) অতঃপর কোরআনে সকলের অংশ নির্ধারিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে। (সূরা নেসা)
দায় বণ্টন সম্পর্কে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিতে বিভিন্ন নিয়ম প্রচলিত রহিয়াছে। কোন কোন জাতিতে মৃতের সম্পূর্ণ সম্পত্তির মালিক প্রথম সন্তান। ইহাতে ছোটদের প্রতি অবিচার করা হয় এবং ব্যক্তিবিশেষের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আবার কোন কোন জাতিতে মৃতের সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার নাই। ইহাতে নারীদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয় এবং অর্থনৈতিক ব্যাপারে তাহাদেরকে অত্যন্ত অসহায় করিয়া রাখা হইয়াছে।
পক্ষান্তরে ইসলামে ছোটদের ও নারীদের অংশীদার করার কারণে একদিকে যেমন তাহাদের প্রতি সুবিচার ও সামাজিক ন্যায়বিচার করা হইয়াছে, অপর দিকে তেমন ইহাতে সম্পদ বহু ভাগে বিভক্ত হওয়ার দরুন সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ার পক্ষে বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করিয়াছে।
মোটকথা, ইসলামের দায়ভাগ বণ্টনের নীতি দ্বারা ব্যক্তির মাল-সম্পদ যত বেশী হউক না কেন, তাহার মৃত্যুর সাথে সাথেই উহা বহু ভাগে বিভক্ত হইয়া বহু ব্যক্তির হাতে পৌঁছিয়া যায় এবং সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্যের সৃষ্টি করে। বৈধ উত্তরাধিকারী না থাকিলে সম্পদ বায়তুল মালে চলিয়া যায়, সরাসরি সাধারণের সম্পদে পরিণত হয়। অথচ কোন কোন জাতিতে উত্তরাধি কারীর অভাবে উহা পোষ্য পুত্রকে দেওয়া হয়। ফলে অনেক বিরাট বিরাট সম্পত্তি ব্যক্তিবিশেষের কুক্ষিগত হয়।
মৃতের সম্পত্তিতে যেসকল কর্তব্য বর্তায়ঃ
মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে যথাক্রমে চারিটি কর্তব্য বর্তায়।
প্রথমত আবশ্যকের কম বা বেশী ব্যয় পরিহারের সাথে তাহার দাফন-কাফন ব্যয়। দ্বিতীয়ত তাহার দেনা পরিশোধ। তৃতীয়ত দেনা পরিশোধের পর যাহা বাকী থাকিবে তাহার এক-তৃতীয়াংশ দ্বারা তাহার ওছিয়ত পূর্ণকরণ। চতুর্থত এসবের পর যাহা বাকী থাকিবে তাহা ওয়ারিসদের মধ্যে বণ্টন ।
ওয়ারিসদের বিভাগঃ
মৃতের ওয়ারিসগণ চারি ভাগে বিভক্তঃ
১। 'যবিল ফরূয' বা আসহাবুল ফারায়েয — যাহাদের অংশ কোরআন ও হাদীসে রহিয়াছে।
২। 'আসাবা’—যাহাদের জন্য কোরআন-হাদীসে অংশ নির্ধারিত করিয়া দেওয়া হয় নাই, তবে আসহাবে ফারায়েযকে দিয়া যাহা বাকী থাকিবে তাহা দিতে বলা হইয়াছে।
৩। 'যবিল আরহাম’– যাহারা আসাবা না থাকিলে সম্পত্তির মালিক হয়।
৪। ‘মাওলাল আতাকা'—ইহা দাস-দাসী সম্পর্কীয় ব্যাপার, যাহা আমাদের দেশে নাই। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, হযরত ওমর, আলী ও ইবনে মাসউদ প্রমুখ অধিকাংশ সাহাবীর। মতে আসহাবুল ফারায়ে বা আসাবা কেহই না থাকিলে সম্পত্তি যবিল আরহাম পাইবে। ইমাম আ'যম আবু হানীফা ইহারই অনুসরণ করেন। পক্ষান্তরে সাহাবী হযরত যায়দ ইবনে সাবেতের মতে তখন সম্পত্তি বায়তুল মালে যাইবে। ইমাম মালেক ও শাফেয়ী (রঃ) ইহাই বলেন।
যবিল ফরয আছে, যবিল আরহাম আছে; আসাবা নাই, যবিল ফরূযকে দিয়া সম্পত্তি বাঁচিয়া গিয়াছে, ইহা যবিল আরহাম পাইবে না; বরং যবিল ফরযদের মধ্যে পুনরায় বণ্টিত হইবে। ইহাকে ‘রদ' বলে। স্বামী-স্ত্রী যবিল ফরয; তবু যবিল আরহাম না থাকা অবস্থায় তাহাদের প্রতি 'রদ' করা যাইবে না। ইহাই ছিল প্রথম দিকের ইমাম ও ওলামাদের মত। কিন্তু পরবর্তীকালের ওলামাগণ বায়তুল মালের অব্যবস্থা দেখিয়া তাহাদের প্রতি ‘রদ' করার অনুমতি দিয়াছেন।
যবিল ফরযের অংশঃ
যবিল ফরয ১৩ ব্যক্তি। চারিজন পুরুষ এবং নয়জন নারী।

পুরুষ

১। বাপঃ বাপের তিন অবস্থা— (১) মৃতের পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র-আদি কোন অধস্তন পুরুষ থাকিলে বাপ যবিল ফরয। তখন তাহার অংশ ছয় ভাগের এক ভাগ। (২) মৃতের কন্যা, কন্যার কন্যা অথবা তাহার কন্যা-আদি কোন অধস্তন নারী থাকিলে বাপ যবিল ফরয ও আসাবা উভয় রকম হয়। তখন বাপ ছয় ভাগের এক ভাগ যবিল ফরয হিসাবে এবং অপর যবিল ফরযকে দিয়া যাহা বাকী থাকিবে তাহা আসাবা হিসাবে পাইবে। এবং (৩) মৃতের সন্তান-সন্ততি কোন অধস্তন না থাকিলে বাপ আসাবারূপে সমস্ত সম্পত্তি পাইবে।
২। দাদাঃ দাদা বাপের অনুরূপ; চারি অবস্থা ব্যতীত। ঐ চারি অবস্থার বিবরণ পরে আসিবে। তবে বাপ বিদ্যমান থাকিলে দাদা পাইবে না।
৩। পেট-ভাইঃ পেট-ভাই (১) একজন হইলে ছয় ভাগের এক ভাগ পাইবে। (২) একাধিক হইলে সকলে মিলিয়া তিন ভাগের এক ভাগ পাইবে। (৩) মৃতের সন্তান-সন্ততি কোন অধস্তন নারী- -পুরুষ অথবা বাপ কিম্বা দাদা থাকিলে পেট-ভাই পাইবে না।
৪। স্বামীঃ স্বামীর দুই অবস্থা – (১) স্ত্রীর সন্তান-সন্ততি কোন অধস্তন না থাকিলে স্বামী অর্ধেক পাইবে। আর (২) কোন অধস্তন থাকিলে চারি ভাগের এক ভাগ পাইবে।

নারী

১। স্ত্রীঃ (১) স্বামীর সন্তান-সন্ততি কোন অধস্তন না থাকিলে স্ত্রী একজন হউক কিম্বা একাধিক, তাহারা চারি ভাগের এক ভাগ পাইবে, আর (২) কোন অধস্তন থাকিলে আট ভাগের এক ভাগ পাইবে।
২। কন্যাঃ কন্যার তিন অবস্থা - ( ১ ) একজন হইলে অর্ধেক, (২) একের অধিক হইলে তিন ভাগের দুই ভাগ পাইবে, আর (৩) পুত্র-কন্যা একসাথে থাকিলে কন্যা আসাবা হইয়া যাইবে এবং পুত্র যাহা পায় তাহার আধা পাইবে।
৩। পৌত্রীঃ পৌত্রীর ছয় অবস্থা- (১) মৃতের পুত্র-কন্যা কেহ নাই। এক পৌত্রী আছে। পৌত্রী অর্ধেক পাইবে। (২) পুত্র-কন্যা কেহ নাই, একাধিক পৌত্রী আছে, তাহারা সকলে মিলিয়া তিন ভাগের দুই ভাগ পাইবে। (৩) মৃতের এক কন্যা আছে। এ সময় পৌত্রী একজন থাকুক বা বেশী, ছয় ভাগের এক ভাগ পাইবে। (৪) মৃতের একাধিক কন্যা আছে। পৌত্রী কিছুই পাইবে না। তবে (৫) যদি মৃতের পৌত্র বা প্রপৌত্র কোন অধস্তন পুরুষ থাকে, তাহা হইলে পৌত্রীগণ তাহাদের সাথে আসাবা হইবে এবং পৌত্র-পৌত্রী ইহারা সকলে মিলিয়া কন্যাদের তিন ভাগের দুই ভাগ দেওয়ার পর যে এক তৃতীয় ভাগ থাকিবে তাহা পাইবে এবং নারী পুরুষের আধা পাইবে। (৬) মৃতের পুত্র থাকিলে পৌত্রীরা কিছুই পাইবে না। তবে কন্যারা পাইবে।
৪। সহোদরাঃ (১) মৃতের পুত্র-কন্যা, পৌত্র, পৌত্রী-আদি কোন অধস্তন নাই। কেবল এক সহোদরা ভগ্নী আছে; অর্ধেক পাইবে। (২) একাধিক সহোদরা আছে; সকলে মিলিয়া দুই তৃতীয়াংশ পাইবে। (৩) মৃতের এক বা একাধিক সহোদর আছে, তখন সহোদরা আসাবা হইবে এবং সহোদরের আধা পাইবে। (৪) মৃতের পৌত্রী, প্রপৌত্রী-আদি কোন অধস্তন নারী থাকিলে তাহাদের দুই-তৃতীয়াংশ দেওয়ার পর যাহা থাকিবে ইহারা তাহাই পাইবে। (৫) মৃতের পুত্র, পৌত্রাদি কোন অধস্তন পুরুষ অথবা বাপ অথবা দাদা থাকিলে সহোদরাগণ অংশীদার হইবে না।
৫। সৎ-বোনঃ মৃতের কন্যা, পৌত্রী, প্রপৌত্রী-আদি কোন অধস্তন নারী নাই। সহোদরাও নাই। সৎ-বোন একজন আছে; অর্ধেক পাইবে। (২) একাধিক সৎ-বোন আছে; দুই-তৃতীয়াংশ পাইবে। (৩) মৃতের কন্যা, পৌত্রী-আদি নাই; এক সহোদরা আছে। সৎ-বোন এক-ষষ্ঠাংশ পাইবে। (৪) মৃতের দুই সহোদরা আছে। সৎ-বোন পাইবে না। (৫) সৎ-বোনের সাথে সৎ-ভাই আছে। সৎ-বোন আসাবা হইয়া যাইবে এবং ভাইয়ের আধা পাইবে। (৬) মৃতের যদি কন্যা অথবা পৌত্রী অথবা প্রপৌত্রী-আদি কোন অধস্তন থাকে, কিন্তু কোন সহোদরা না থাকে, তবে যবিল ফরূযকে দিয়া যাহা থাকিবে তাহা সৎ-বোন আসাবা হিসাবে পাইবে। (৭) মৃতের পুত্র, পৌত্র আদি কোন অধস্তন অথবা বাপ অথবা দাদা থাকিলে সহোদর ভাই-বোন বা সৎ ভাই-বোন কেহই পাইবে না।
৬। পেট-বোনঃ পেট-বোনের অবস্থা পেট ভাইয়ের অনুরূপ। (১) এক বোন হইলে ছয় ভাগের এক ভাগ, (২) একের অধিক হইলে তিন ভাগের দুই ভাগ পাইবে ; আর (৩) মৃতের কোন সন্তান-সন্ততি অধস্তন অথবা বাপ অথবা দাদা থাকিলে পেট-বোন কিছুই পাইবে না।
৭। মাঃ মৃতের পুত্র-কন্যা অথবা পৌত্রী-আদি কোন অধস্তন নারী-পুরুষ অথবা যে কোন প্রকারের একাধিক ভাই-বোন থাকিলে মা ছয় ভাগের এক ভাগ পাইবে। (২) ইহাদের মধ্যে কেহ না থাকিলে এবং মৃত ব্যক্তি পুরুষ হইলে, তাহার স্ত্রী না থাকিলে এবং স্ত্রী হইলে তাহার স্বামী না থাকিলে মা তিন ভাগের এক ভাগ পাইবে এবং (৩) স্ত্রী অথবা স্বামী থাকিলে তাহাদের নির্ধারিত অংশ দেওয়ার পর যাহা বাকী থাকিবে তাহার তিন ভাগের এক ভাগ পাইবে।
৮। দাদীঃ (১) দাদী ছয় ভাগের এক ভাগ পাইবে, যদি মৃতের মা কিম্বা বাপ না থাকে। (২) দাদী কিছু পাইবে না যদি মৃতের মা কিম্বা বাপ থাকে। এইরূপে দাদা থাকিলে দাদার উপরের পর্যায়ের দাদীরা পাইবে না, কিন্তু আপন বাপের মা, দাদী পাইবে।
৯। নানীঃ (১) নানী ছয় ভাগের এক ভাগ পাইবে যদি মৃতের মা না থাকে। নানী ও দাদী উভয় এক সাথে থাকিলে উভয়ে ঐ ছয় ভাগের এক ভাগই পাইবে এবং আপসে ভাগ করিয়া লইবে। (২) মৃতের মা থাকিলে নানী পাইবে না, কিন্তু বাপ কিম্বা দাদা থাকিলে পাইবে। দাদার কারণে বাপের নানীও মাহরূম হইবে না।

আসাবাঃ
'আসাবা' প্রথমত দুই প্রকারের। 'আসাবায়ে নসবিয়া' (বংশীয় আসাবা) ও 'আসাবায়ে সববিয়া।' আসাবায়ে সববিয়া আমাদের দেশে নাই। কারণ, ইহার সম্পর্ক সাধারণত দাস-দাসীদের সাথে; আর দাস-দাসী আমাদের দেশে নাই। আসাবায়ে নসবিয়া আবার তিন প্রকারের। আসাবা বে-নফসিহী, আসাবা বে-গায়রিহী ও আসাবা মা-গায়রিহী।
আসাবা বে-নফসিহীঃ মৃতের সাথে যাহার সম্পর্ক কোন নারীর মধ্যস্থতায় নহে। আসাবা বে-নফসিহী চারি প্রকারের লোক – (১) মৃতের অধস্তন (যথা-পুত্রের কন্যা)। (২) মৃতের ঊর্ধ্বতন (যথা – বাপ, দাদা)। (৩) মৃতের বাপের অধস্তন (যথা—ভাই, বোন) ও (৪) মৃতের দাদার অধস্তন (যথা— চাচা) ।
ইহাদের মধ্যে যাহারা মৃতের যত নিকটতম হইবে, ততই তাহাদের অগ্রাধিকার জন্মিবে। অর্থাৎ, নিজের অধস্তন থাকিতে যে যত নীচেরই হউক না কেন, নিজের ঊর্ধ্বতন পাইবে না। যথা—আপন পুত্র থাকিতে বাপ পাইবে না। এইরূপে বাপ থাকিতে ভাই পাইবে না এবং ভাই থাকিতে চাচা পাইবে না।
এখানে এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে, একই পর্যায়ের দুইজন আসাবা এক সাথে থাকিলে যাহার আত্মীয়তার বন্ধন অধিক দৃঢ়, সে-ই পাইবে। যথা—সহোদর ভাই ও সৎ-ভাই। মীরাস সহোদর ভাই পাইবে। কেননা, মা-বাপ এক হওয়ার কারণে মৃতের সাথে তাহার সম্পর্ক সৎ-ভাই অপেক্ষা অধিকতর দৃঢ়।
আসাবা বে-গায়রিহীঃ অর্থাৎ, যাহারা অন্যের কারণে আসাবা হয়। ইহারা হইল চারি জন নারী, যাহাদের অংশ যবিল ফরূযরূপে অর্ধেক অথবা তিন ভাগের দুই ভাগ নির্ধারিত ছিল। ইহারা হইল— (১) কন্যা, (২) পৌত্রী, (৩) সহোদরা ও (৪) সৎ-বোন। ইহারা এক হইলে ইহাদের অংশ ছিল অর্ধেক, আর একাধিক হইলে অংশ ছিল তিন ভাগের দুই ভাগ। ইহারা অন্যের কারণে আসাবা হইয়া গেল (যথা—তাহাদের ভাই থাকার কারণে।) কিন্তু এখানে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, যে নারী যবিল ফরূযের মধ্যে নহে, তাহার ভাই আসাবা হইলেও সে আসাবা হইবে না। যথা—ফুফু, চাচা আছে, তথাপি ফুফু আসাবা নহে। কেননা, সে যবিল ফরয নহে।
আসাবা মা-গায়রিহীঃ অর্থাৎ, অন্যের সাথে আসাবা। ইহারা হইল সেসকল নারী, যাহারা অন্য নারীর সাথে আসাবা হইয়াছে। যথা—ভগ্নী। কন্যা থাকিলে কন্যার সাথে সে আসাবা ( যবিল ফরয নহে)।
যিবিল আরহামঃ
যবিল ফরূয ও আসাবাদের মধ্যে কেহ না থাকিলে এ সকল দূর-আত্মীয় যবিল আরহাম-গণই সম্পত্তির মালিক হয়— (১) মেয়ের আওলাদ, (২) বোনের আওলাদ, (৩) ভাইঝি, (৪) চাচাতো বোন, (৫) ফুফাতো বোন, (৬) মামু ও খালা, (৭) নানা, (৮) পেট-চাচা। অর্থাৎ, বাপের পেট-ভাই, (৯) ফুফু এবং (১০) পেট-ভাইয়ের আওলাদ। অতঃপর ইহাদের মধ্যস্থতায় যাহারা মৃতের আত্মীয় গণ্য হইবে। নারীদের কেন কম দেওয়া হইয়াছেঃ
ওয়ারিসগণের হিস্যার প্রতি দৃষ্টি করিলে দেখা যায়; নারীদেরকে পুরুষদের আধা দেওয়া হইয়াছে। কারণ, ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর প্রতি কোন সামাজিক দায়িত্ব বর্তায় না। সন্তানের ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব পুরুষের, আত্মীয়-স্বজন, নর-নারীর আত্মীয়-স্বজনের মেহমানদারীর দায়িত্ব পুরুষের, মেহমান-মুসাফিরদের খবরগিরি করার দায়িত্ব পুরুষের, এমন কি নারীর খোরপোষের দায়িত্ব পর্যন্ত পুরুষের। মোটকথা, ইসলাম নারীকে এসকল কাজের দায়িত্ব দিয়া অতঃপর তাহাকে অর্থ উপার্জনে বাধ্য করিয়া তাহার নারিত্ব নষ্ট করিতে চাহে না। তথাপি নারীকে এ পরিমাণ অংশ দেওয়া হইয়াছে, যাহাতে সে দান-খয়রাত বা তাহার ইচ্ছামত ব্যয়ের ব্যাপারে কাহারও মুখাপেক্ষী না হয়। —অনুবাদক

'উহা পরিশোধের ভার আমার উপর'—হুযূর কাহার মাল হইতে উহা পরিশোধ করার ভার লইয়াছিলেন, নিজের মাল হইতে না বায়তুল মাল বা সরকারী মাল হইতে, এ সম্পর্কে ওলামাদের মধ্যে মতানৈক্য রহিয়াছে। কাহারও মতে নিজের মাল হইতে আর কাহারও মতে সরকারী মাল হইতে। কিতাবুল আমওয়াল ও মুসনাদে আহমদের একটি রেওয়ায়ত শেষোক্ত মতেরই সমর্থন করে। উহাতে রহিয়াছে, “যে মরিয়া যায় এবং ঋণ রাখিয়া যায়, তাহার ঋণ আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলের প্রতি বর্তায়।” এখানে রাসুলের নামের পূর্বে আল্লাহর নামের উল্লেখের কারণে সরকারী মালকেই বুঝাইয়াছে। মোটকথা, শেষোক্ত মত অনুসারে যে ব্যক্তি অভাবের কারণে ঋণ করিয়াছে এবং উহা পরিশোধ পরিমাণ মাল না রাখিয়া মরিয়া গিয়াছে, তাহার ঋণ পরিশোধ করার এবং তাহার পোষ্য পালনের ভার সরকারের ।
এ হাদীস হইতে এ কথাও বুঝা যায় যে, ব্যক্তিও সম্পত্তির মালিকই হয়। কেননা, ব্যক্তি যদি সম্পত্তির মালিকই না হইল, তাহার উত্তরাধিকার আসিবে কোথা হইতে ?
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৩০৪১ | মুসলিম বাংলা