মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

১১- হজ্জ্বের অধ্যায়

হাদীস নং: ২৫০৫
প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫০৫। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দান করিলেন এবং বলিলেনঃ হে মানবমণ্ডলী! আল্লাহ্ তা'আলা তোমাদের উপর হজ্জ ফরয করিয়াছেন। সুতরাং তোমরা হজ্জ করিবে। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! ইহা কি প্রত্যেক বৎসরে। হুযূর চুপ রহিলেন, এমন কি সে তিনবার জিজ্ঞাসা করিল। তখন হুযুর বলিলেন, যদি আমি হ্যাঁ বলিতাম ফরয হইয়া যাইত; কিন্তু তখন তোমাদের আদায় করার সাধ্য হইত না। অতঃপর তিনি বলিলেন, দেখ, যে বিষয় আমি তোমাদের কিছু বলি নাই, সে বিষয় সেরূপ থাকিতে দাও। কেননা, তোমাদের পূর্বে যাহারা ছিল তাহারা বেশী প্রশ্ন করার এবং তাহাদের নবীদের সাথে মতবিরোধ করার কারণেই ধ্বংস হইবার যোগ্য ) হইয়াছে। অতএব, আমি যখন তোমাদিগকে কোন বিষয় করার নির্দেশ দিব, উহার যতখানি সাধ্যে কুলায় করিবে এবং যে ব্যাপারে নিষেধ করিব তাহা ত্যাগ করিবে। -মুসলিম
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ:: خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ فُرِضَ عَلَيْكُمُ الْحَجُّ فَحُجُّوا» فَقَالَ رَجُلٌ: أَكُلَّ عَامٍ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ فَسَكَتَ حَتَّى قَالَهَا ثَلَاثًا فَقَالَ: لَوْ قُلْتُ: نَعَمْ لَوَجَبَتْ وَلَمَا اسْتَطَعْتُمْ ثُمَّ قَالَ: ذَرُونِي مَا تَرَكْتُكُمْ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِكَثْرَةِ سُؤَالِهِمْ وَاخْتِلَافِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ فَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْء فدَعُوه . رَوَاهُ مُسلم

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. হজ্জ পর্ব

'হজ্জ'—অর্থ কছ্দ, সংকল্প। শরীঅতে ইহার অর্থ—কতক কার্যক্রম সম্পাদন করার উদ্দেশ্যে এহরামের সাথে বায়তুল্লাহ্ যিয়ারতের সংকল্প। আর এহরাম' অর্থ 'লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা' বলার সাথে হজ্জ বা উমরার নিয়ত করা। লাব্বাইকা দো'আটি পরে হাদীসে আসিতেছে। হজ্জের কার্যক্রম হইল— (ক) বায়তুল্লাহ্ শরীফের 'তওয়াফ' বা প্রদক্ষিণ করা। (খ) সাফা-মারওয়ার মধ্যে দৌড়ান। ইহাকে 'সায়ী' বলে। (গ) আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। ইহাকে 'ওয়াকুফে আরাফাত' বলে। (ঘ) মাথা মুড়ান অথবা ছাঁটান। ইহাকে হলক বা কসর বলে। (ঙ) ১০ ই যিলহজ্জ তারিখের পর দুই কি তিন দিন মিনায় অবস্থান করা এবং (চ) জামরায় কাঁকর মারা। ইহাকে 'রাময়ুল জেমার' বলে।
‘উমরা’—অর্থ যিয়ারত, দর্শন। শরীঅতে ইহার অর্থ কতক কার্যক্রমের সাথে বায়তুল্লাহর যিয়ারত। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান নাই। হজ্জের কার্যক্রম সমাধা করিতে হয় শাওয়াল, যিকা'দা ও যিলহজ্জ মাসে, আর উমরা বৎসরের যে কোন মাসেই করা যায়। তবে মক্কাবাসীরা হজ্জের মাসে করিতে পারে না।
হজ্জ ফরয এবং ইসলামের পাঁচটি রোকন বা স্তম্ভের মধ্যে পঞ্চম স্তম্ভ। কোরআনে রহিয়াছে, وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا “মানুষের পক্ষে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করা ফরয — যাহার পথের সামর্থ্য আছে।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৭) অপর জায়গায় রহিয়াছে, وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ “আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ ও উমরা পূর্ণ কর!” হাদীসে রহিয়াছে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেন, “হে মানবমণ্ডলী, তোমাদের প্রতি হজ্জ ফরয করা হইয়াছে। সুতরাং তোমরা হজ্জ করিবে।” (মুসলিম) অপর হাদীসে রহিয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, যাহাকে পথের সামর্থ্য অথবা অত্যাচারী শাসক অথবা গুরুতর রোগ বাধা দেয় নাই, তথাপি সে হজ্জ না করিয়া মরিতে বসিয়াছে—মরুক সে ইহুদী হইয়া বা নাসারা হইয়া (ইহাতে ইসলামের কিছু আসে যায় না)। (দারেমী)
হজ্জ ফরয—এই কথার উপর মুসলমান সাধারণের ইজমাও রহিয়াছে। তাহারা ইহা হুযুরের যমানা হইতে এ যমানা পর্যন্ত যুগ পরম্পরা পালন করিয়া আসিতেছে। সুতরাং হজ্জকে অস্বীকার করা কোরআন, হাদীস ও ইজমাকে অস্বীকার করারই নামান্তর। শরীআতের ভাষায় কুফরী।
হজ্জ মদীনাতেই ফরয হইয়াছে। হিজরতের পূর্বে মক্কায় হুযূর যে সকল হজ্জ করিয়াছেন, তাহা কোরাইশদের রীতি অনুসারেই করিয়াছেন। হিজরতের পর ৬ষ্ঠ হিজরীতে তিনি উমরার নিয়তেই (হজ্জের নিয়তে নহে) মক্কা রওয়ানা হইয়াছিলেন এবং কুরাইশ কর্তৃক বাধা প্রাপ্ত হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। সপ্তম হিজরীতে উহারই কাযা আদায় করিয়াছেন। ৮ম হিজরীর রমযান মাসে তিনি মক্কা জয় করেন এবং হযরত আত্তাব ইবনে আসীদকে উহার গবর্নর নিযুক্ত করেন। পরে হজ্জের মাস আসিলে তিনি তাহাকেই আমীরুল হজ্জ (হজ্জের আমীর)- রূপে নিয়োগ করেন। নবম হিজরীতে তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দীককে 'আমীরুল হজ্জ' করিয়া পাঠান এবং দশম হিজরীতে তিনি নিজেই হজ্জ করেন। ইহাই তাহার একমাত্র ফরয হজ্জ ও বিদায়ী হজ্জ।
হজ্জ তিন প্রকারের—এফরাদ, তামাত্তু ও কেরান। হজ্জের মাসে উমরা ছাড়া কেবল হজ্জ করাকে ‘হজ্জে এফরাদ' বলে, আর এইরূপ হজ্জকারীকে 'ফরেদ' বলে। হজ্জের মাসের প্রথমে উমরা, তৎপর হজ্জ করাকে ‘হজ্জে তামাত্তু' বলে এবং এইরূপ হজ্জকারীকে 'মুতামাত্তে' বলে। হজ্জ ও উমরা এক সাথে করাকে 'হজ্জে কেরান' বলে। এইরূপ হজ্জকারীকে 'কারেন' বলে। হজ্জে কেরানই উত্তম। কেননা, উহাতে এক এহরামে দীর্ঘ দিন থাকিতে হয় বলিয়া কষ্ট বেশী হয়। হানাফী মতে হুযূরের বিদায় হজ্জ কেরান হজ্জই ছিল।
উমরা ইমাম মালেক ও শাফেয়ীর মতে ফরয। কেননা, কোরআনে উমরা ও হজ্জকে একই পর্যায়ে এক সাথে বর্ণনা করা হইয়াছে, কিন্তু ইমাম আবু হানীফার মতে উহা সুন্নত। তিনি বলেন, কোরআনে উমরা শুরু করার পর উহা পূর্ণ করাকেই ফরয বলা হইয়াছে, আর ঐ অবস্থায় উহা ফরয। তাঁহার এই মতের স্বপক্ষে তিরমিযীর একটি সহীহ হাদীস রহিয়াছে। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করা হইল, হুযূর, উমরা কি ফরয? তিনি বলিলেন, না, তবে তোমাদের পক্ষে উমরা করা উত্তম। (মিরকাত)
হজ্জ একাধারে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক এবাদত। ইহাতে অর্থ ব্যয়, শারীরিক পরিশ্রম ও পরিবার-পরিজনের মায়া ত্যাগ করার বিরাট মানসিক কষ্ট রহিয়াছে। এইরূপ কঠোর ত্যাগ স্বীকার কোন প্রেমাসক্ত ব্যতীত কাহারও পক্ষে সম্ভব নহে। অতএব, তাহাদের যাহেরী বেশ-ভূষণও প্রেমাসক্ত পাগলের ন্যায় হয়। এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাহাদের এক তহবন্দ ও এক চাদরে মাথা খোলা রাখিয়া চুল, গোঁফ ও নখ না কাটিয়া এবং কোন রকমের সুগন্ধি ব্যবহার না করিয়া সত্যই পাগল সাজিতে হয়। মোটকথা, ইহাতে ত্যাগ যেমন কঠোর, প্রেমাসক্তি যেমন অধিক, ইহার পুরস্কারও তেমন বিরাট ও মহান। হুযূর বলিয়াছেন, “কবুল করা হজ্জের পুরস্কার জান্নাত ছাড়া কিছুই নহে। ”
হজ্জের মধ্যে মানুষের আখেরাতের কল্যাণ ছাড়া দুনিয়ারও বহু কল্যাণ নিহিত রহিয়াছে। ইহা বিশ্ব মুসলিমের এক বিশ্ব সম্মেলন। ইহাতে দুনিয়ার দূরদূরান্তের মুসলমানরা একে অন্যকে চিনিতে পারে, জানিতে পারে। একে অন্যের সমস্যা বুঝিতে পারে ও উহার সমাধান চিন্তা করিতে পারে। এ সুযোগকে কাজে লাগাইলে মুসলিম বিশ্ব দুনিয়ার বহু ঝামেলা হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে। খোলাফায়ে রাশেদীন হজ্জের মওসুমে দেশের সাধারণ অবস্থা ও শাসনসংক্রান্ত ব্যাপারে জনসাধারণের সাথে আলোচনা করিতেন এবং তাহাদের কোন অভাব-অভিযোগ থাকিলে উহা শ্রবণ করিতেন। সমগ্র দুনিয়ার এক আদর্শবাদী মুসলমানরা রক্ত, বর্ণ ও ভৌগোলিক সীমারেখার বৈশিষ্ট্য ভুলিয়া এক কেন্দ্রমুখী হউক এবং দুনিয়াতে একটিমাত্র শক্তিশালী খেলাফত রাষ্ট্র কায়েম হউক ইহাই ইসলামের কাম্য। আর হজ্জ হইল ইহার পথনির্দেশক। হজ্জে যেভাবে রাজা-প্রজা, আরবী, আজমী, কাল, গোরা একাকার হইয়া যায় এবং যেভাবে ইহাতে বিশ্ব-সাম্য ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ভাব ফুটিয়া উঠে, তাহার নযীর দুনিয়ার কোন ব্যাপারেই পাওয়া যায় না।

“যদি আমি হ্যাঁ বলিতাম ফরয হইয়া যাইত” – ইহাতে স্পষ্টভাবে বুঝা গেল যে, কোন বিষয়কে ফরয বা ওয়াজিব ইত্যাদি করার অধিকার আল্লাহ্ তাঁহাকে দিয়াছিলেন। সুতরাং কোরআন ব্যতীতও শরীঅত সম্পর্কে তাঁহার নির্দেশ যে শরীআতের একটি উৎস এবং পালনীয় তাহাতে সন্দেহ থাকিতেছে না।



২. ইমাম দারাকুতনীর বর্ণনায় আছে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়ঃ- يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَسْأَلُوا عَنْ أَشْيَاءَ إِنْ تُبْدَ لَكُمْ تَسُؤْكُمْ وَإِنْ تَسْأَلُوا عَنْهَا حِينَ يُنَزَّلُ الْقُرْآنُ تُبْدَ لَكُمْ عَفَا اللَّهُ عَنْهَا وَاللَّهُ غَفُورٌ حَلِيمٌ অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যা প্রকাশ করা হলে তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর মনে হবে। তোমরা যদি এমন সময়ে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, যখন কুরআন নাযিল হয়, তবে তা তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হবে। (অবশ্য) আল্লাহ ইতঃপূর্বে যা হয়েছে তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করার নিন্দা ও তার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্কবাণী
আয়াতের মর্ম এই যে, যেসব বিষয়ের বিশেষ কোনও প্রয়োজন নেই, প্রথমত তার অনুসন্ধানে লিপ্ত হওয়া একটা নিরর্থক কাজ। দ্বিতীয়ত আল্লাহ তাআলা অনেক সময় কোনও কোনও বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আদেশ দান করেন। সেই আদেশ অনুসারে মোটামুটিভাবে কাজ করলেই যথেষ্ট হয়ে যায়। সে বিষয়ে বিস্তারিতভাবে কিছু জানানোর দরকার হলে খোদ কুরআন মাজীদ কিংবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের মাধ্যমে তা জানিয়ে দেওয়া হত। তা যখন করা হয়নি তখন এর চুলচেরা বিশ্লেষণের পেছনে পড়ার কোনও দরকার নেই। সেইসঙ্গে এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, কুরআন নাযিলের সময় তোমাদের প্রশ্নের উত্তরে এ সম্পর্কে কোনও কঠিন বিধান এসে গেলে তোমাদের নিজেদের পক্ষেই সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই এর থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়।

বনী ইসরাঈলের স্বভাব ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনও হুকুম দেওয়া হলে সে সম্পর্কে অহেতুক প্রশ্ন করতে থাকা। ফলে বিষয়টা তাদের জন্য জটিল হয়ে যেত। এ ব্যাপারে গাভী জবাই সংক্রান্ত ঘটনাটি প্রসিদ্ধ। জনৈক নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীকে শনাক্ত করার জন্য তাদেরকে একটি গাভী জবাইয়ের হুকুম দেওয়া হয়েছিল। হুকুমটি স্পষ্ট। ফলে যে-কোনও একটি গাভী জবাই করলেই চলত। কিন্তু তারা বাড়াবাড়ি শুরু করল। গাভীটি কী বয়সী হবে, কী রঙের হবে ইত্যাদি নানা বিষয়ে তারা একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকল। এতে করে শেষপর্যন্ত যে ধরনের গাভী নির্ধারিত হল, তা সংগ্রহ করতে তাদেরকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। এটা ছিল তাদের অহেতুক প্রশ্ন করতে থাকার পরিণাম।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশঙ্কাবোধ করেছিলেন, অহেতুক প্রশ্নের কারণে তাঁর উম্মতও পাছে কোনও জটিলতার সম্মুখীন হয় এবং এমন কোনও বিধান তাদের দিয়ে দেওয়া হয়, যা পালন করতে তাদের হিমশিম খেতে হবে। কাজেই ‘হজ্জ প্রতি বছর করতে হবে কি না? -এ প্রশ্ন যখন তাঁকে করা হল, তখন এর উত্তর না দিয়ে বরং এ জাতীয় প্রশ্ন করতেই নিষেধ করে দিলেন। কেননা প্রশ্নটি করার কোনও দরকার ছিল না। হজ্জ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। ব্যস একবার হজ্জ করলেই তো হুকুম পালন হয়ে গেল। প্রতি বছর করতে হবে কি না, এটা অতিরিক্ত কৌতূহল। বনী ইসরাঈলের মত এ কৌতূহল যদি মিটিয়ে দেওয়া হত আর প্রতি বছর হজ্জ ফরয করা হত, তবে তা কতই না কঠিন হয়ে যেত! তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট বলে দেন- دعوني ما تركتكم “আমি যতক্ষণ তোমাদের ছেড়ে দিই (অর্থাৎ কোনও বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না বলি), ততক্ষণ তোমরাও আমাকে ছেড়ে দিও।”

যে বিষয়ে খুঁটিনাটি বিবরণ দেওয়া হয়নি, তার যতটুকু বলা হয়েছে তা পালন করা যদি সম্ভব হয়, তবে তোমরা তার খুঁটিনাটির পেছনে পড়বে না। যতটুকু বলা হয়েছে অতটুকুতেই ক্ষান্ত থাকবে, যদিও বিষয়টি খুঁটিনাটি ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। যেমন এ হজ্জের আদেশ। একবার হজ্জ করলেই আদেশের ওপর আমল হয়ে যায়। যদিও এর মধ্যে এ অবকাশ আছে যে, হয়তো এটা প্রতি বছরই করতে হবে, কিন্তু তা যখন পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া হয়নি, তখন শুধু শুধু তার পেছনে পড়া কেন এবং কেন এই প্রশ্ন করতে যাওয়া যে, প্রতি বছরই হজ্জ করতে হবে কি? অসম্ভব নয় এ প্রশ্নের পরিণামে হুকুম দিয়ে দেওয়া হবে যে, হাঁ, প্রতি বছরই হজ্জ করতে হবে আর এভাবে সহজ বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে। এ কারণেই বাড়তি প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে।

এক হাদীছে ইরশাদ- إن أعظم المسلمين جرما : من سأل عن شيء لم يحرم، فحرم من أجل مسألته
মুসলমানদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুতর অপরাধী সেই ব্যক্তি, যে ব্যক্তি এমন কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করে, যা হারাম করা হয়নি। অতঃপর তার প্রশ্নের কারণে তা হারাম করে দেওয়া হয়েছে।

প্রকাশ থাকে যে, যে প্রশ্নের কারণে কোনও হালাল বস্তু হারাম কিংবা কোনও সহজ বিধান কঠিন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেরকম প্রশ্ন নিষিদ্ধ ছিল কেবল রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলে। কেননা এরকম আশঙ্কা কেবল তাঁর আমলেই হতে পারত। তাঁর ওফাতের পর সেরকম কোনও আশঙ্কা থাকেনি। কেননা বিধান তো তাঁর মাধ্যমেই দেওয়া হত। তাঁর ওফাতের পর নতুন কোনও বিধান আসার সুযোগ নেই। ফলে এরূপ প্রশ্নের নিষেধাজ্ঞাও আর বাকি নেই। এখন কোনও বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত অবগতি লাভের জন্য উলামায়ে কিরামের কাছে এরূপ প্রশ্ন করার অবকাশ আছে।

প্রশ্ন করা বৈধ হয় কেবল তখনই, যখন উদ্দেশ্য হয় নিজ অজ্ঞতা দূর করা। উদ্দেশ্য যদি হয় কাউকে আটকানো, তবে এরূপ প্রশ্ন করা কিছুতেই জায়েয নয়। এমনিভাবে নিজ বাহাদুরী ফলানোর জন্যও প্রশ্ন করা বৈধ হতে পারে না। যেসব বিষয় জানার কোনও প্রয়োজন নেই, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করাও একটি অহেতুক কাজ। ইসলামে অহেতুক কাজ পছন্দনীয় নয়।

অতঃপর তিনি ইরশাদ করেনঃ- إنما أهلك من كان قبلكم كثرة سؤالهم واختلافهم على أنبيائهم “তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে তো ধ্বংস করেছে তাদের অত্যধিক প্রশ্ন এবং তাদের নবীদের সঙ্গে বিরোধতায় লিপ্ত হওয়া। অর্থাৎ যে সকল বিষয় জানার দরকার ছিল না বা কোনও বিষয়ের যে খুঁটিনাটি জানানো হয়নি, তারা তাদের নবীগণের কাছে সে সম্পর্কে খুব বেশি বেশি প্রশ্ন করত আর সে কারণে সহজ সহজ বিধানের সাথে নানারকম খুঁটিনাটি যোগ হয়ে তা অত্যন্ত কঠিন ও জটিল হয়ে যেত। সে সকল জটিল বিধান পালন করতে তাদের অত্যন্ত বেগ পেতে হত। অনেক সময় নানা ছলছুতায় তা পালন করা হতে বিরত থাকত। এভাবে কালক্রমে তারা তাদের শরী'আতের বিধি-বিধান থেকে বিমুখ হয়ে পড়ত। একটা জাতির শরী‘আতবিমুখ হয়ে পড়াটা তাদের ধ্বংস হওয়াই তো বটে। কেননা সে ক্ষেত্রে তাদের সামগ্রিক জীবন শর'ঈ জীবনকাঠামো থেকে আলাদা হয়ে যায়। তাদের দীনী জাতিসত্তা বিলুপ্ত হয়ে নতুন এক জাতিতে পরিণত হয়, যা সম্পূর্ণ বিকৃত ও নষ্টভ্রষ্ট এক জাতি।

অনেক সময় আসমানী আযাব দ্বারা তাদেরকে ভূপৃষ্ঠ থেকেই সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হত। কুরআন মাজীদে এমন বহু জাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা যাদেরকে বিভিন্ন রকম আযাব দিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছেন।

নবীর আদেশের বিপরীতে নিজস্ব মত খাটানো
তাদের ধ্বংসের দ্বিতীয় কারণ বলা হয়েছে নবীদের সঙ্গে ইখতিলাফ করা ও বিরোধিতায় লিপ্ত হওয়া। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য নবীগণ কোনও হুকুম দিলে সেই হুকুম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা ও তার বিপরীতে নিজেদের মতামত উত্থাপন করা। উম্মতের কাজ হলো নবী যে হুকুম দেন তা বিনাবাক্যে মেনে নেওয়া। হুকুমের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা তার বিপরীতে নিজেদের মতামত দিতে যাওয়া—একরকম স্পর্ধা ও অবাধ্যতা। বনী ইসরাঈল তাদের নবীদের সঙ্গে এরকম অবাধ্যতা বার বার করেছে আর এ কারণে তাদেরকে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে বিভিন্ন শাস্তিও ভোগ করতে হয়েছে। তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ উম্মতকে সতর্ক করছেন, তারা যেন নবীর হুকুমের বিপরীত নিজেদের মতামত খাটানোর চেষ্টা না করে বা সে হুকুমের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন না তোলে। কেননা তাহলে আগের উম্মতের মত তাদেরকেও শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- فإذا نهيتكم عن شيء فاجتنبوه، وإذا أمرتكم بأمر فأتوا منه ما استطعتم ‘সুতরাং আমি যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে নিষেধ করি, তখন তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে। আর যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে আদেশ করি, তখন যথাসাধ্য তা পালন করবে।'
এর দ্বারা শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলার প্রতি তাগিদ করা হয়েছে।

আদেশ পালনের ক্ষেত্রে ‘যথাসাধ্য' কথাটি যোগ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা পালনের ক্ষেত্রে এ কথা যোগ করা হয়নি। অথচ শরী'আত তার যাবতীয় বিধানেই মানুষের সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে। কুরআন মাজীদ সুস্পষ্টই বলেছেঃ- وما جعل عليكم في الدين من حرج অর্থ : তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। অর্থাৎ শরী'আতের বিধান পালনের ব্যাপারে কোনওরকম ওযর গ্রহণযোগ্য নয় ব্যাপারটা এরকম নয়। বরং ওযর অনুপাতে ছাড়ও দেওয়া হয়েছে। যেমন মরা জন্তু খাওয়া নিষেধ। কিন্তু কারও যদি কোনও হালাল খাদ্য না থাকে আর এ অবস্থায় ক্ষুধায় মারা যাওয়ার উপক্রম হয়, সে ক্ষেত্রে তার জন্য মরা জন্তু খেয়ে প্রাণ রক্ষা করা জায়েয। দেখা যাচ্ছে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেও সাধ্য ও সক্ষমতার বিষয়টা বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

সক্ষমতা অনুযায়ী আদেশ পালন
সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, এ হাদীছে কেবল আদেশের ক্ষেত্রে 'যথাসাধ্য শব্দ কেন ব্যবহৃত হল? এর উত্তর হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আদেশ পালন করা কঠিন। কেননা নিষেধাজ্ঞার অর্থ হচ্ছে কোনও কাজ করা হতে বিরত থাকা। অপরদিকে আদেশ পালন করতে গেলে কাজটি করতে হয়। বলাবাহুল্য, বিরত থাকা অপেক্ষা কাজ সম্পাদন করা কঠিন। তাই তুলনামূলকভাবে নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আদেশ পালনের ক্ষেত্রেই অক্ষমতা বেশি দেখা দিয়ে থাকে। আর সে কারণেই বলা হয়েছে- তোমাদেরকে যা আদেশ করা হয়েছে তা যথাসাধ্য অর্থাৎ সক্ষমতা অনুযায়ী পালন করবে।

উদাহরণ দেওয়া যায় নামায দ্বারা। নামায দাঁড়িয়ে পড়া ফরয। কিন্তু কারও যদি এমন ওযর থাকে, যদ্দরুন দাঁড়িয়ে নামায পড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে সে বসে বসে পড়বে। যদি বসতেও না পারে তবে শুয়ে শুয়ে পড়বে। নামায কিবলার দিকে ফিরে পড়া ফরয। কেউ যদি এমন কোনও জায়গায় থাকে, যেখানে তার পক্ষে নিশ্চিত কিবলা ঠিক করা সম্ভব নয়, তবে সে অনুমানের ওপর নির্ভর করবে এবং যেদিকে কিবলা বলে তার অনুমান ও প্রবল ধারণা হয়, সেদিকে ফিরে নামায পড়বে। এমনিভাবে মাটিতে মাথা রেখে সিজদা করা ফরয। কিন্তু কারও যদি ওযরের কারণে এভাবে সিজদা করা সম্ভব না হয়, তবে সে ইশারা দ্বারা সিজদা আদায় করবে। আর যদি কোনওভাবেই তার পক্ষে নামায পড়া সম্ভব না হয়, তবে তার জন্য পুরোপুরি মাফ। নামায পড়ার দায়িত্ব থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

এভাবে শরী'আতের সবগুলো বিধান পালনের ক্ষেত্রেই সাধ্য ও সক্ষমতার প্রতি দৃষ্টি রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতা থাকলেই পালন করতে হবে। যার যতটুকু ক্ষমতা থাকে, সে ততটুকু পালন করবে। যার বিলকুল ক্ষমতা থাকে না, সে পুরোপুরি মুক্ত। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের কর্তব্য ‘উলামায়ে কিরামের শরণাপন্ন হওয়া। নিজে নিজে কোনও একটা বিষয়কে ওযর ধরে হুকুম পালনে কাটছাট করা কিছুতেই উচিত হবে না।

এ হাদীছে মূলত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাবতীয় আদেশ নিষেধ পালনে যত্নবান থাকা ও বাড়তি প্রশ্ন করা হতে বিরত থাকা সম্পর্কে তাগিদ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বোঝাচ্ছেন, তোমাদের কাজ কেবল আমার যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালন করে যাওয়া। তাঁর আদেশ-নিষেধের সমষ্টিকেই শরী'আত বলে এবং তা তাঁর সুন্নত ও তরিকাও বটে। ব্যস উম্মতের কাজ হচ্ছে সেই তরিকার ওপর চলতে থাকা। বাড়তি প্রশ্নের পেছনে পড়ার কোনও ফায়দা নেই; বরং তাতে ক্ষতিরই আশঙ্কা থাকে, যেমনটা পূর্বে বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য : হাদীছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রশ্ন করতে বারণ করা হয়েছে। বোঝা গেল দরকারি প্রশ্ন করা নিষেধ নয়; বরং যে বিষয়ে জানার প্রয়োজন আছে এবং যার সাথে ঈমান ও আমলের সম্পর্ক আছে, সে সম্পর্কে তো জিজ্ঞেস করাই জরুরি। এরকম বিষয়ে প্রশ্ন করতে কুরআন ও হাদীছে হুকুমও করা হয়েছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ অর্থ : তোমরা নিজেরা যদি না জান, তবে জ্ঞানীজনকে জিজ্ঞেস কর।

এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- إنما شفاء العي السؤال ‘অজ্ঞতার উপশম তো জিজ্ঞেস করাই।


হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আমাদের কর্তব্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাবতীয় আদেশ নিষেধ পালন তথা তাঁর তরিকার ওপর চলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।

খ. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকার ওপর চলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার দাবি এটাও যে, তাঁর তরিকা কী, আমরা তা ভালোভাবে জেনে নেব।

গ. জানার একটি পন্থা হচ্ছে খাঁটি 'উলামায়ে কিরামের কাছে জিজ্ঞেস করা। সুতরাং আমরা দীনের জ্ঞাতব্য বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য তাঁদের শরণাপন্ন হব।

ঘ. ‘উলামায়ে কিরামের কাছে কেবল এমন বিষয়ই জানতে চাব, যার সাথে ঈমান ও আমলের সম্পর্ক আছে। এর বাইরে ফযূল প্রশ্নের (অহেতুক) পেছনে পড়ব না। ফযূল প্রশ্ন করা একটি নিন্দনীয় কাজ।

ঙ. শরী'আতের আদেশ-নিষেধের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা একটি ধ্বংসাত্মক কাজ।

চ. কুরআন-হাদীছের বিপরীতে নিজেদের মতামত খাটানো সুস্পষ্ট গোমরাহী। এতে ব্যাপকভাবে লিপ্ত হওয়ার পরিণাম জাতীয় অস্তিত্বের বিলুপ্তি।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান