মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৯- কুরআনের ফাযাঈল অধ্যায়

হাদীস নং: ২১২৯
প্রথম অনুচ্ছেদ
২১২৯। হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে, একবার নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে এক সেনাদলের সেনাপতি করিয়া পাঠাইলেন। সে তাহার সঙ্গীদের নামায পড়াইত এবং 'কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ' দ্বারা (কেরাআত) শেষ করিত। যখন তাহারা মদীনায় ফিরিলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ইহার উল্লেখ করিলেন। তিনি বলিলেন তাহাকে জিজ্ঞাসা কর, সে কি কারণে এরূপ করে। তাহারা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। সে বলিল, কেননা, ইহাতে আল্লাহর গুণাবলী রহিয়াছে, আর আমি আল্লাহর গুণাবলী পাঠ করিতে ভালবাসি। তখন নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন, তাহাকে জানাইয়া দাও যে, আল্লাহ্ তাহাকে ভালবাসেন। মোত্তাঃ
وَعَنْ عَائِشَةَ: أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ رَجُلًا عَلَى سَرِيَّةٍ وَكَانَ يَقْرَأُ لأَصْحَابه فِي صلَاتهم فيختم ب (قل هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ)

فَلَمَّا رَجَعُوا ذَكَرُوا ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: «سَلُوهُ لِأَيِّ شَيْءٍ يَصْنَعُ ذَلِكَ» فَسَأَلُوهُ فَقَالَ لِأَنَّهَا صفة الرَّحْمَن وَأَنا أحب أَن أَقرَأ بِهَا فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَخْبِرُوهُ أَن الله يُحِبهُ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে যে সাহাবীকে সেনাপতি বানিয়ে পাঠানো হয়েছিল তার নাম কুলছুম ইবন যাহ্দাম। কারও মতে কুরয ইবন হাদম। তিনি যখনই নামাযে ইমামত করতেন, তখন সূরা ফাতিহার পর কুরআন মাজীদের যেখান থেকেই পড়তেন, তার পর অবশ্যই সূরা ইখলাসও পড়তেন। প্রতি রাকআতেই তিনি এটা করতেন। অভিযান থেকে ফেরার পর এ বিষয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হয়। তিনি এর কারণ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করতে বললে উত্তর দিয়েছিলেন যে لأنها صفة الرحمن فأنا أحب أن أقرأ بها ‘এই সূরাটি দয়াময় আল্লাহর পরিচয় (সম্বলিত)। তাই আমি এটি পড়তে ভালোবাসি'। বাস্তবিকই এ সূরাটি আল্লাহ তাআলার পরিচয়বাহী।এতে অতি সংক্ষেপে অতি চমৎকারভাবে আল্লাহ তাআলার গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, ইহুদীরা এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছিল, আপনি আমাদের কাছে আপনার প্রতিপালকের পরিচয় তুলে ধরুন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সূরা ইখলাস নাযিল হয়। তিনি এ সূরাটি তাদের সামনে পেশ করে বললেন, এই হচ্ছে আমার রব্বের পরিচয়। হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, মুশরিকগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আল্লাহ তাআলার পরিচয় জানতে চাইলে এ সূরাটি নাযিল হয়। এর চার আয়াত দ্বারা আল্লাহ তাআলার তাওহীদকে অত্যন্ত পূর্ণাঙ্গরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

সূরা ইখলাসের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
প্রথমত জানানো হয়েছে, তিনি احد অর্থাৎ এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর সত্তায় ও গুণাবলীতে তাঁর কোনও শরীক নেই। সুতরাং কেবল তিনিই ইবাদতের উপযুক্ত। তাঁকে ছেড়ে অন্য কারও ইবাদত করা যায় না এবং তাঁর সঙ্গে ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক করার কোনও অবকাশ নেই। এভাবে এ আয়াত দ্বারা বহু-ঈশ্বরবাদী তথা যারা একের বেশি মাবুদে বিশ্বাস করে তাদেরকে রদ করা হয়েছে।

তাঁর দ্বিতীয় গুণ বলা হয়েছে যে, তিনি الصمد অর্থাৎ সকলে তাঁর মুখাপেক্ষী, তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। একক কোনও শব্দ দ্বারা এ নামটির মর্ম প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আরবীতে الصمد বলে সেই সত্তাকে, মানুষ নিজেদের বিপদ-আপদ ও সমস্যাদিতে সাহায্যের জন্য যাঁর শরণাপন্ন হয় এবং সকলে যার মুখাপেক্ষী থাকে, কিন্তু তিনি নিজে কারও মুখাপেক্ষী থাকেন না। এভাবে এর দ্বারা তাদের ধ্যান-ধারণা খণ্ডন করা হয়েছে, যারা আল্লাহ তাআলাকে এক জানা সত্ত্বেও অন্য কাউকে বিপদাপদ থেকে উদ্ধারকারী, প্রয়োজন সমাধাকারী, মনোবাঞ্ছা পূরণকারী ইত্যাদি বলে বিশ্বাস করে।

তাঁর তৃতীয় গুণ বলা হয়েছে- لم يلد ولم يولد (তার কোনও সন্তান নেই এবং তিনিও কারও সন্তান নন)। অর্থাৎ তিনি কারও পিতাও নন, পুত্রও নন। পিতা ও পুত্র মাত্রই মরণশীল। আল্লাহ তাআলা যখন পিতা ও পুত্র নন, তখন তাঁর মৃত্যুও নেই। তিনি চির জীবন্ত সত্তা। এর দ্বারা খ্রীষ্টসম্প্রদায় রদ্ হয়ে যায়। তাদের বিশ্বাস হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার পুত্র। এ কারণে তারা তাঁর পূজাও করে থাকে। এ সূরা দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তাদের সে বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এ বিশ্বাসের কারণে তারা যে তাঁর পূজা করে তাও সুস্পষ্ট শিরক।

চতুর্থ গুণ বলা হয়েছে- ولم يكن له كفوا احد , (এবং তার সমকক্ষ নয় কেউ)। অর্থাৎ এমন কেউ নেই, যে-কোনও ব্যাপারে তাঁর সমকক্ষতা দাবি করতে পারে। এর দ্বারা সেইসব লোকের বিশ্বাস খণ্ডন করা হয়েছে, যারা মনে করে আল্লাহ তাআলার যে-কোনও গুণ একই রকমভাবে অন্য কারও মধ্যেও থাকতে পারে। যেমন মাজুসী সম্প্রদায় বলত,আলোর স্রষ্টা একজন এবং অন্ধকারের অন্যজন। এমনিভাবে মঙ্গল এক খোদা সৃষ্টি করে। এবং অমঙ্গল অন্য খোদা। এভাবে এই সংক্ষিপ্ত সুরাটি সব রকমের শিরককে ভ্রান্ত সাব্যস্তকরত খালেস ও বিশুদ্ধ তাওহীদকে প্রমাণ করেছে। এ কারণেই এ সূরাকে সূরা ইখলাস বলা হয়।

তো সাহাবী যখন জানালেন যে, আল্লাহ তাআলার পরিচয়বাহী হওয়ার কারণে তিনি এ সূরাটি পড়তে ভালোবাসেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে তাঁকে সুসংবাদ জানানো হলো যে

إن الله تعالى يحبه (নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলাও তাকে ভালোবাসেন)। এ ভালোবাসার কারণ কেবল এ সূরাটির প্রতি তাঁর ভালোবাসাও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে, এ সূরাটির প্রতি তাঁর ভালোবাসা দ্বারা প্রমাণ হয় তাঁর আকীদা-বিশ্বাস বিশুদ্ধ। তিনি আল্লাহ তাআলাকে সর্বতোভাবে এক জানেন, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করেন না। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা তাঁকে ভালোবাসেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, কেউ যদি কুরআন মাজীদকে ভালোবাসে কিংবা কুরআন মাজীদের বিশেষ কোনও সূরার প্রতি তার স্বতন্ত্র মহব্বত থাকে, তবে এটা তাঁর প্রতি আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা থাকার পরিচয় বহন করে। এমনিভাবে কারও আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত থাকাটাও তার প্রতি আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা থাকার প্রমাণ।

প্রকাশ থাকে যে, সমগ্র কুরআনই আল্লাহ তাআলার কালাম। তাই কারও মুমিন মুসলিম হওয়ার জন্য সমগ্র কুরআনের প্রতি বিশ্বাস থাকা জরুরি। এমনিভাবে কুরআন আল্লাহ তাআলার কালাম হওয়ার কারণে সমগ্র কুরআনের প্রতিই ভক্তি-ভালোবাসার সম্পর্ক রাখা অবশ্যকর্তব্য। হাঁ, বিশেষ বিশেষ কারণে যেমন আল্লাহ তাআলার রহমত ও দয়ামায়ার বর্ণনা, নিআমতরাজির বিবরণ, হৃদয়গ্রাহী কাহিনীর পরিবেশনা, বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পাঠমাধুর্য ইত্যাদি, এসব কারণে বিশেষ বিশেষ সূরার প্রতি স্বতন্ত্র ভালোবাসা রাখারও অবকাশ আছে, যেমন এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা সূরা ইখলাসের বিশেষ মর্যাদা উপলব্ধি করা যায়।

খ. যিকর, তিলাওয়াত প্রভৃতি নেক আমল দ্বারা আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা লাভ হয়।

গ. হাদীছটি দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, কারও কোনও আমল দ্বারা মনে এই খটকা জাগলে যে, তা সঠিক কি না, বিজ্ঞ কোনও আলেমের কাছে জিজ্ঞেস করে সে খটকা দূর করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ২১২৯ | মুসলিম বাংলা