আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৭- নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৭৬
২৫৮। লাল কাপড় পরে নামায আদায় করা
৩৬৯। মুহাম্মাদ ইবনে আরআরা (রাহঃ) .... আবু জুহায়ফা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে চামড়ার একটা লাল তাঁবুতে দেখলাম এবং তাঁর জন্য উযুর পানি নিয়ে বিলাল (রাযিঃ)-কে উপস্থিত দেখলাম। আর লোকেরা তাঁর উযুর পানির জন্য প্রতিযোগিতা করছে। কেউ সামান্য পানি পাওয়া মাত্র তা দিয়ে শরীর মুছে নিচ্ছে। আর যে পায়নি সে তাঁর সাথীর ভেজা হাত থেকে নিয়ে নিচ্ছে। তারপর বিলাল (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর একটি লৌহফলকযুক্ত ছড়ি নিয়ে এসে তা মাটিতে পুতে দিলেন। নবী (ﷺ) একটা লাল ডোরাযুক্ত পোশাক পরে বের হলেন, তাঁর তহবন্দ কিঞ্চিত উঁচু করে পরা ছিল। সে ছড়িটি সামনে রেখে লোকদের নিয়ে দুরাকআত নামায আদায় করলেন। আর মানুষ ও জন্তু -জানোয়ার ঐ ছড়িটির বাইরে চলাফেরা করছিলো।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

হযরত আবূ জুহায়ফা ওয়াহব ইবন আব্দুল্লাহ রাযি. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কায় দেখেছি। তিনি আবতাহ নামক স্থানে চামড়ার একটি লাল তাঁবুতে ছিলেন। বিলাল তাঁর ওযুর (অবশিষ্ট) পানি নিয়ে আসলেন। কেউ সে পানির একটা অংশ পেলেন এবং কেউ নিজ অংশ থেকে (তার ভাইকে খানিকটা) ঢেলে দিলেন। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি লাল পোশাক পরিহিত অবস্থায় বের হয়ে আসলেন। আমি যেন তাঁর দুই নলার শুভ্রতা দেখতে পাচ্ছি। তিনি ওযু করলেন এবং বিলাল আযান দিলেন। আমি তার মুখ এদিকে–ওদিকে অনুসন্ধান করছিলাম। তিনি ডান ও বাম দিকে ফিরে বলছিলেন– حَيَّ عَلَى الصَّلَاةِ، حَيَّ عَلَى الفَلَاحِ )এসো নামাযের দিকে, এসো সফলতার দিকে)। তারপর তাঁর সামনে একটি বর্শা গেড়ে দেওয়া হল। তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন এবং নামায পড়লেন। তাঁর সম্মুখ দিয়ে কুকুর ও গাধা অতিক্রম করছিল, কিন্তু বাধা দেওয়া হচ্ছিল না।

ব্যাখ্যাঃ
এ হাদীছটির বর্ণনাকারী হযরত আবূ জুহায়ফা রাযি.। তিনি বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যেমনটা দেখেছিলেন, তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ এ হাদীছে প্রদান করেছেন। তাঁর সূত্রে অনেকেই এটি বর্ণনা করেছেন। তাদের পরস্পরের মধ্যে বর্ণনার ধারাবাহিকতায় কিছুটা পার্থক্য আছে। এখানে যে বর্ণনাটি উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে পরের কথা আগে এবং আগের কথা পরে চলে এসেছে। যেমন এখানে প্রথমে হযরত বিলাল রাযি. কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওযুর অবশিষ্ট পানি নিয়ে বের হয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওযু করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে পরে। অথচ ঘটনার ধারাবাহিকতা হবে এর বিপরীত।

যাহোক হযরত আবূ জুহায়ফা রাযি, জানাচ্ছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবতাহ নামক স্থানে লাল চামড়ার একটি তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। আবতাহ'র অপর নাম বাতহা। একে 'মুহাসসাব'-ও বলে। জায়গাটি মিনার কাছাকাছি। হযরত আবূ জুহায়ফা রাযি. একদিন জোহরের সময় এখানে উপস্থিত হন। তখন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাল হুল্লা পরিহিত অবস্থায় তাঁবু থেকে বের হয়ে আসতে দেখেন।

হুল্লা মানে একই কাপড়ের এক জোড়া লুঙ্গি ও চাদর। এটি লাল ছিল মানে লাল ডোরাযুক্ত ছিল, যেমনটা অন্যান্য বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায়। পুরোপুরি লাল রঙের কাপড় পরা পুরুষের জন্য মাকরূহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পরতে নিষেধ করেছেন।

হযরত আবূ জুহায়ফা রাযি, যে সময়টার কথা বলছেন, তখন ছিল যোহরের ওয়াক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁবুর বাইরে এসে ওযু করেন। হযরত বিলাল রাযি. যোহরের আযান দেন। আযানে যখন حَيَّ عَلَى الصَّلَاةِ বলছিলেন, তখন ডানদিকে এবং যখন حَيَّ عَلَى الفَلَاحِ বলছিলেন, তখন বামদিকে মুখ ঘোরাচ্ছিলেন। হযরত আবূ জুহায়ফা রাযি. এটা বিশেষভাবে লক্ষ করলেন। এর দ্বারা প্রমাণ হয় আযানে حَيَّ عَلَى الفَلَاحِ . حَيَّ عَلَى الصَّلَاةِ বলার সময় যথাক্রমে ডানে ও বামে মুখ ঘোরানো নিয়ম। এটা সুন্নত। আযান শেষ হলে হযরত বিলাল রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওযুর অবশিষ্ট পানি নিয়ে আসেন। উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে গেল। কেউ তো সরাসরি সে অবশিষ্ট পানির একটা অংশ পেয়ে গেলেন। আর যারা সরাসরি পেলেন না, তাদেরকে যারা পেয়েছিলেন তারা নিজেদের অংশ থেকে খানিকটা ঢেলে দিলেন। তারা এতটা আগ্রহের সঙ্গে যে সেই অবশিষ্ট পানি নিচ্ছিলেন, তার কারণ ছিল তাবাররুক। অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতের স্পর্শ থাকায় তারা সে পানিকে বরকতপূর্ণ মনে করেছিলেন। এর দ্বারা নবীর স্পর্শে বরকত থাকার প্রমাণ মেলে। যারা নবীর খাঁটি উত্তরসূরী, সে আল্লাহওয়ালাদের স্পর্শেও বরকত লাভ হয়।

তারপর হযরত বিলাল রাযি. তাঁবুর ভেতর গিয়ে একটি 'আনাযা নিয়ে আসেন। 'আনাযা বর্শার মতোই একটা অস্ত্র। তবে তা বর্শার তুলনায় ছোট হয়ে থাকে। 'আনাযাটি এক জায়গায় গেড়ে দেওয়া হল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটিকে সুতরা বানিয়ে নামাযে দাঁড়ালেন। সবাই তাঁর পেছনে কাতার বেঁধে ইকতিদা করলেন। তাদের সামনে কোনও সুতরা ছিল না। সুতরার ওপাশ দিয়ে কুকুর, গাধা ইত্যাদি চলাচল করছিল। কোনও কোনও বর্ণনায় নারীদের অতিক্রম করার কথাও আছে। তাতে তাদের যাওয়াটা হয় মুক্তাদীদের সম্মুখ থেকে। অথচ তাদের সামনে কোনও সুতরা ছিল না। বোঝা গেল ইমামের সুতরাই মুক্তাদীদের জন্য যথেষ্ট। তাদের আলাদা সুতরার প্রয়োজন নেই।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. পুরুষের জন্য লাল ডোরাযুক্ত কাপড় পরা জায়েয। পুরোপুরি লাল বর্ণের পোশাক পুরুষের জন্য পসন্দনীয় নয়।

খ. আযানে حَيَّ عَلَى الفَلَاح ও حَيَّ عَلَى الصَّلَاةِ বলার সময় যথাক্রমে ডান ও বামদিকে মুখ ফেরানো সুন্নত।

গ. আল্লাহওয়ালাদের স্পর্শযুক্ত বস্তুকে তাবাররুক হিসেবে গ্রহণ করা জায়েয।

ঘ. জামাতে নামায পড়লে ইমামের সুতরাই মুক্তাদীর সুতরা হিসেবে যথেষ্ট। তাদের আলাদা সুতরার প্রয়োজন নেই।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন