মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৭- যাকাতের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৯৪৫
৭. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - উত্তম সদাক্বার বর্ণনা
১৯৪৫। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, আবু তালহা আনসারী মদীনাতে খেজুর বাগান ওয়ালা বড় সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁহার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ছিল 'বায়রাহা' কূপ। উহা ছিল মসজিদে নববীর সম্মুখে। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) উহাতে যাইতেন এবং উহার মিঠা পানি পান করিতেন। আনাস বলেন, যখন এই আয়াত নাযিল হইলঃ “তোমরা কখনও নেকী লাভ করিতে পারিবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা দান কর যাহা তোমরা ভালবাস।” আবু তালহা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর নিকট গেলেন এবং বলিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ “তোমরা কখনও নেকী লাভ করিতে পারিবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা দান কর যাহা তোমরা ভালবাস।" আর আমার নিকট আমার সর্বাপেক্ষা ভালবাসার বস্তু হইল এই 'বায়রাহা'। অতএব, আমি উহা আল্লাহর নামে দান করিলাম নেকী লাভ ও (পরকালে) আল্লাহর নিকটে উহাকে সঞ্চিত ধনরূপে পাইবার আশায়। ইয়া রাসূলাল্লাহ্, আপনি উহা যাহাকে ইচ্ছা তাহাকে দিয়া দিন! রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিলেনঃ বেশ, বেশ, ইহা একটি লাভজনক মাল। আমি শুনিলাম যাহা তুমি বলিলে, তবে আমি পছন্দ করি তুমি নিজেই উহা তোমার আত্মীয়দের মধ্যে দান করিয়া দিবে। ইহা শুনিয়া আবু তালহা বলিলেন, আচ্ছা, তবে আমি তাহা করিব। অতঃপর তিনি উহা আপন আত্মীয় ও চাচাত ভাইদের মধ্যে ভাগে দান করিয়া দিলেন। —মোত্তাঃ
عَن أنس بن مَالك قَالَ: كَانَ أَبُو طَلْحَة أَكثر أَنْصَارِي بِالْمَدِينَةِ مَالًا مِنْ نَخْلٍ وَكَانَ أَحَبُّ أَمْوَالِهِ إِلَيْهِ بيرحاء وَكَانَت مُسْتَقْبل الْمَسْجِدَ وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدْخُلُهَا وَيَشْرَبُ مِنْ مَاءٍ فِيهَا طَيِّبٍ قَالَ أنس فَلَمَّا نزلت (لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ)

قَامَ أَبُو طَلْحَة فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَقُول: (لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ)

وَإِنَّ أَحَبَّ مَالِي إِلَيَّ بَيْرَحَاءُ وَإِنَّهَا صَدَقَةٌ لله أَرْجُو بِرَّهَا وَذُخْرَهَا عِنْدَ اللَّهِ فَضَعْهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ حَيْثُ أَرَاكَ اللَّهِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «بَخٍ بَخٍ ذَلِكَ مَالٌ رَابِحٌ وَقَدْ سَمِعْتُ مَا قُلْتَ وَإِنَّى أَرَى أَنْ تَجْعَلَهَا فِي الْأَقْرَبِينَ» . فَقَالَ أَبُو طَلْحَةَ أَفْعَلُ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَقَسَّمَهَا أَبُو طَلْحَة فِي أَقَاربه وَفِي بني عَمه

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে মূলত হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি.-এর একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা যখন আয়াত নাযিল করলেন-لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ “তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে', তখন তিনি তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ বাইরাহা নামক বাগানটি দান করে দিলেন। আয়াতে বলা হয়েছে প্রিয়বস্তু দান করতে। তিনি সবচে' বেশি প্ৰিয়টা দিয়ে দিলেন। আল্লাহু আকবার! আল্লাহর হুকুম মানার কী উৎকৃষ্টতর নমুনা। এমনই ছিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ। এ কেবল তাঁর একার কথা নয়, বহু সাহাবীই এরকম করেছিলেন। হযরত যায়দ ইবন হারিছা রাযি.-এর সবচে' প্রিয় সম্পদ ছিল একটি ঘোড়া। ঘোড়াটির নাম ছিল 'সাবাল'। তিনি ঘোড়াটির কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি জান আমার কাছে এ ঘোড়াটির চেয়ে বেশি প্রিয় আর কোনও সম্পদ নেই। এই বলে তিনি ঘোড়াটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে আসলেন এবং বললেন, এটি আল্লাহর পথে দিয়ে দিলাম। তিনি তাঁর পুত্র উসামা রাযি.-কে বললেন, তুমি এটা নিয়ে নাও। এতে হযরত যায়দ রাযি. যেন কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তা উপলব্ধি করে তিনি তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দিলেন যে, আল্লাহ তাআলা তোমার দান কবুল করেছেন।
হযরত উমর রাযি.-এর খেলাফতকালে যখন পারস্যের রাজধানী মাদাইন বিজিত হল, তখন তিনি হযরত আবূ মূসা আশআরী রাযি.-এর কাছে চিঠি লিখলেন যে, তুমি যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে আমার জন্য একটি দাসী ক্রয় কর। তিনি একটি বাঁদী ক্রয় করলেন। খলিফার সেটি খুব পসন্দ হল। পরক্ষণেই তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন- لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ। সুতরাং আমি একে আযাদ করে দিলাম।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর গোলাম নাফে' ছিলেন তাঁর খুবই প্রিয়। একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জা'ফর রাযি. তার দাম বলেছিলেন এক হাজার দীনার। তাও তিনি বিক্রি করেননি। পরে তিনি তাকে আযাদ করে দেন। তাঁর স্ত্রী সাফিয়্যা রহ. বলেন, আমার খুব ধারণা তিনি এ আয়াতের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই তা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই নাফে' একজন উচ্চস্তরের মুহাদ্দিছ ও ফকীহ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
এ দানের ক্ষেত্রে হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. উচ্চমাত্রার আদব ও বিনয়েরও পরিচয় দেন। যেহেতু বাগানটির তিনিই মালিক, তাই চাইলে তিনি নিজ ইচ্ছামত যে-কোনও দীনী খাতে দিয়ে দিতে পারতেন। তা না করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই অনুরোধ করলেন যেন তিনি যেখানে চান তা ব্যয় করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এ আখলাকের কদর করলেন। তিনি নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ না করে বরং তাঁকেই পরামর্শ দিলেন, যেন তাঁর আত্মীয়বর্গের মধ্যে বাগানটি বণ্টন করে দেন। তিনি তাই করলেন।
এ দানের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবূ তালহা রাযি.-কে এই বলে সাধুবাদ জানালেন যে, بخ ، ذلك مال رابح ذلك مال رابح (বাহ! এটা তো লাভজনক সম্পদ। এটা তো লাভজনক সম্পদ)। অর্থাৎ দুনিয়ায়ও এটির অনেক দাম এবং আল্লাহর পথে দান করে তুমি আখেরাতেও অনেক লাভ কুড়ালে। এটি দান না করে নিজের কাছে রেখে দিলে মৃত্যু পর্যন্ত সীমিত কালের লাভ পেতে। কিন্তু আল্লাহর পথে দান করে দিয়ে অনন্ত জীবনের লাভ অর্জন করে নিলে।
অপর এক বর্ণনায় رابح এর স্থলে رايح আছে। সে হিসেবে অর্থ হয় এটির উপকার অর্থাৎ ছাওয়াব তোমারই হাতে ফিরে আসবে। বোঝানো হচ্ছে যে, দান করার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে এটি তোমার হাতছাড়া হয়নি। কেননা হাতে থাকলে যেমন তুমি এর ফলফলাদি ভোগ করতে পারতে, তেমনি দান করার দ্বারাও তুমি এর সুফল পেতে থাকবে। আর সেটা তো স্থায়ী সুফল। মান ও পরিমাণে দুনিয়ার উপকার অপেক্ষা তা অনেক অনেক শ্রেষ্ঠ।
উল্লেখ্য, হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. এ বাগানটি যাদেরকে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন হযরত কা'ব ইবন উবাঈ রাযি. হযরত হাসসান ইবন ছাবিত রাযি., হযরত শাদ্দাদ ইবন আওস রাযি. হযরত নুবায়ত ইবন জাবির রাযি, প্রমুখ। হযরত হাসান রাযি. তাঁর অংশটি একলক্ষ দিরহামের বিনিময়ে হযরত মুআবিয়া রাযি.-এর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এর দ্বারা অনুমান করা যায় বাগানটি কত দামী ও কত উন্নত মানের ছিল।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এর দ্বারা সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করার কী আগ্রহ উদ্দীপনা ছিল সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের অন্তরেও তার কিছুটা উত্তাপ লাগিয়ে দিন।

খ. আল্লাহর পথে খরচ করতে নিম্নমানের নয়; বরং উৎকৃষ্ট মানের ও প্রিয় সম্পদটাই বেছে নেওয়া চাই।

গ. আল্লাহর পথে দান করার ক্ষেত্রেও আল্লাহওয়ালাদের পরামর্শ নেওয়া চাই।

ঘ. কেউ কোনও ভালো কাজ করলে গুরুজনদের উচিত তাকে সাধুবাদ জানানো।

ঙ. দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া শ্রেয়।

চ. মনোরম স্থানে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা ও শীতল ছায়ায় আরাম গ্রহণ করা দূষণীয় কিছু নয়; বরং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার নিআমত ভোগের নিয়ত থাকলে তা ছাওয়াবের কাজ বলেই গণ্য হবে।

৪০৮. সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৪১
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান