মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৭- যাকাতের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৯১৯
৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - সদাক্বার মর্যাদা
১৯১৯। হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে, তাহারা একটি বকরী জবাই করিলেন (এবং মেহমান মুসাফিরদের খাওয়াইলেন)। অতঃপর নবী করীম (ﷺ) জিজ্ঞাসা করিলেন, উহার কতটুকু আছে ? আয়েশা বলিলেন, উহার একটি বাহু ছাড়া কিছু বাকি নাই। হুযূর বলিলেনঃ উহার সবই বাকি আছে ঐ বাহুটি ছাড়া। – তিরমিযী এবং তিনি ইহাকে সহীহ্ বলিয়াছেন।
وَعَن عَائِشَة إِنَّهُمْ ذَبَحُوا شَاةً فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا بَقِيَ مِنْهَا؟» قَالَتْ: مَا بَقِي مِنْهَا إِلَّا كتفها قَالَ: «بَقِي كلهَا غير كتفها» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَصَححهُ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. অর্থাৎ, যাহা মেহমান মুসাফিরদের খাওয়ান হইয়াছে, তাহা সবই আল্লাহর নিকট জমা আছে। উহার সওয়াব পাওয়া যাইবে এই বাহুটি ছাড়া। কুরআনে রহিয়াছেঃ “যাহা তোমার নিকট আছে, তাহা শেষ হইয়া যাইবে আর যাহা আল্লাহর নিকট আছে তাহা বাকি থাকিবে।”

২. এ হাদীছটিতে দান-খয়রাত করার মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. জানাচ্ছেন যে, নবী-পরিবারে একটি ছাগল জবাই করা হয়েছিল। বর্ণনার ভাষা দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, জবাইয়ের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথাও চলে গিয়েছিলেন। তারপর বাড়িতে ফিরে আসেন। এসে জিজ্ঞেস করেন-
مَا بَقِي مِنْهَا؟ (তা থেকে কী অবশিষ্ট আছে?) অর্থাৎ তাঁর জানা ছিল জবাই করার পর ছাগলটির গোশত গরীবদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছিল। অথবা তিনি নিজেই তা বিতরণের হুকুম দিয়েছিলেন। এবার জানতে চাচ্ছেন কতটুকু গোশত অবশিষ্ট আছে। যেন বিতরণ করাটাই আসল। তারপর কিছু অবশিষ্ট থাকলে তা নিজেরা খাওয়া হবে। জিজ্ঞাসার উত্তরে আম্মাজান আয়েশা রাযি. বললেন-
مَا بَقِيَ مِنْهَا إِلَّا كَتفهَا (সেটির কাঁধ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই)। অর্থাৎ আমরা ছাগলটির সবটা গোশতই অন্যদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছি। কেবল কাঁধের অংশটুকু অবশিষ্ট আছে। এর দ্বারা আয়েশা রাযি.-এর দানশীলতা সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়। মানুষ দান করে অল্প, বেশিটাই নিজের জন্য রেখে দেয়। পক্ষান্তরে তিনি বেশিটাই দান করে দিয়েছেন, নিজের কাছে রেখেছেন সামান্য! কিন্তু তারপরও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বক্তব্যের মধ্যে সংশোধনী প্রদান করলেন। তিনি মন্তব্য করলেন-
بقى كلّهَا غَيْرُ كتفها (বরং সেটির কাঁধ ছাড়া সবই অবশিষ্ট আছে)। অর্থাৎ তুমি বলছ যেটুকু রেখে দিয়েছ সেটুকু অবশিষ্ট আছে, আর যা দান করেছ তা ফুরিয়ে গেছে। প্রকৃত বিষয় তা নয়। বরং নিজের কাছে যেটুকু রেখেছ তাই অচিরে ফুরিয়ে যাবে। আর যা দান করেছ তাই তোমার জন্য স্থায়ী হয়ে থাকবে। কেননা যা দান-খয়রাত করা হয়েছে তা আল্লাহর কাছে চলে গেছে। আল্লাহর কাছে যা যায় তা বান্দার জন্য জমা থাকে। পক্ষান্তরে যা বান্দার নিজের কাছে থাকে, তা ফুরিয়ে যায়। কুরআনে ইরশাদ-
مَا عِنْدَكُمْ يَنْفَدُ وَمَا عِنْدَ اللَّهِ بَاقٍ
‘তোমাদের কাছে যা-কিছু আছে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা স্থায়ী।’(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯৬)

আল্লাহর কাছে জমা হয় দান-খয়রাতের ছাওয়াব। তা মুমিন বান্দার স্থায়ী সম্পদ। তা কখনও ফুরাবে না। বরং তিনি দান-খয়রাতের তুলনায় ছাওয়াব দেন অনেক অনেক বেশি। আবার দুনিয়ায়ও বিভিন্নভাবে তার প্রতিদান দিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে যা নিজের কাছে রাখা হয় তা একসময় ফুরিয়ে যায়। খাদ্যদ্রব্য খেলেই নিঃশেষ হয়ে যায়। তার দ্বারা শরীরের যে পুষ্টি অর্জিত হয় তাও কোনও স্থায়ী বিষয় নয়। শরীর নিজেই তো একসময় জরাজীর্ণ হয়ে যায়। পরিশেষে মৃত্যুতে তার অবসান ঘটে।

হাদীছটিতে দান-খয়রাত করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে এবং এর প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী থাকতে বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কেউ যেন মনে না করে- বিস্তর দান করে ফেললাম আর এ দানের ফলে আমার সম্পদ কমে গেল। কেননা বাহ্যিকভাবে তা কমে বা শেষই হয়ে যায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলার কাছে তা জমা হয়ে থাকে। আখিরাতে সে বহুগুণ বর্ধিতরূপে তার প্রতিদান দেখতে পাবে। তাই নিজের কাছে সঞ্চিত রাখা বা নিজ খাওয়া-পরাকে প্রাধান্য দেওয়ার তুলনায় আল্লাহ তা'আলার উদ্দেশ্যে দান-খয়রাত করাকেই বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের অকুণ্ঠ দানশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।

খ. মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য ভোগে নয়; ত্যাগে ও দান খয়রাতে অভ্যস্ত হওয়া।

গ. মুরুব্বী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির কর্তব্য তার অধীনে যারা থাকে তাদের ভাষা ও চিন্তা-চেতনা বিশুদ্ধরূপে গড়ে তোলার প্রতি মনোযোগী থাকা।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ১৯১৯ | মুসলিম বাংলা