মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
৭- যাকাতের অধ্যায়
হাদীস নং: ১৮১৪
১. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - যেসব জিনিসের যাকাত দিতে হয়
১৮১৪-[২১] ত্বাউস (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার (ইয়ামানের শাসক) মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ)-এর নিকট (যাকাত উসূল করার জন্য) ওয়াক্কাস গাভী আনা হয়েছিল। তিনি (তা দেখে) বললেন, এসবের থেকে (যাকাত উসূলের জন্য) আমাকে আদেশ দেয়া হয়নি। (দারাকুত্বনী, শাফি’ঈ; ইমাম শাফি’ঈ বলেন, ’ওয়াক্কাস’ এসব জানোয়ারকে বলা হয়, যা প্রাথমিকভাবে যাকাতের নিসাবের সীমায় পৌঁছেনি।)[1]
وَعَنْ طَاوُسٍ أَنَّ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ أَتَى بِوَقَصِ الْبَقَرِ فَقَالَ: لَمْ يَأْمُرْنِي فِيهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِشَيْءٍ. رَوَاهُ الدَّارَقُطْنِيُّ وَالشَّافِعِيُّ وَقَالَ: الْوَقَصُ مَا لَمْ يَبْلُغِ الْفَرِيضَةَ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
তাবেয়ী হযরত তাউস হইতে বর্ণিত আছে, একবার (ইয়ামনের শাসনকর্তা) হযরত মুআয ইবনে জাবালের নিকট (যাকাতের পরিমাণে পৌঁছে নাই এমন) একদল গরু আনা হইল। তিনি বলিলেন, নবী করীম (ﷺ) ইহাতে কিছু গ্রহণ করিতে আমাকে আদেশ দেন নাই। —দারা কুতনী ও শাফেয়ী
শাফেয়ী বলেন, ওয়াকস বলা হয় ঐ পরিমাণকে যাহা যাকাতের পরিমাণ পর্যন্ত না পৌঁছে।
পরিশিষ্ট
পশু ও ফলাদির যাকাতের বিস্তারিত বিবরণ হাদীসের মাধ্যমে জানা গিয়াছে। এখানে কেবল সোনা রূপা ও ব্যবসায়ের মালের যাকাত সম্পর্কে কতিপয় অত্যাবশ্যক মাসআলার বিবরণ দেওয়া হইতেছে। বাকী মাসআলার জন্য ফেকাহর কিতাব দ্রষ্টব্য।
১। যাহার নিকট দেনা ও তাহার মৌলিক প্রয়োজনের সামগ্রী ব্যতীত বিশ মিসকাল অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা সোনা অথবা দুইশত দিরহাম অর্থাৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা আছে, তাহার উপর উহার চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাতরূপে দেওয়া ফরয। —কানয
২। সোনা বা রূপা দ্বারা প্রস্তুত জিনিস, গহনা, তৈজসপত্র ফার্নিচার ইত্যাদি—ইহার উপর ঐ পরিমাণে যাকাত ফরয, ব্যবহারে থাকুক বা না থাকুক।— কানয
৩। ব্যবসায়ের মালের উপরও উহার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত ফরয —যদি উহার মূল্য সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার সমান হয়। —কানয
৪। সোনা রূপার মধ্যে যেটি দেশে অধিক প্রচলিত সেটির সাথেই মূল্য নির্ধারণ করিবে। (আমাদের দেশে রূপাই অধিক প্রচলিত।) কিন্তু উহাতে যদি নেসাব পূর্ণ না হয়, তবে অপরটির সাথেই নির্ধারণ করিবে, অন্য কথায় যেটিতেই দরিদ্রের উপকার অধিক হয়, উহার সাথেই করিবে। —দুররে মুখতার
৫। দেশে প্রচলিত মুদ্রা যথা— টাকা, পয়সা, নোট ও হুণ্ডী – যেহেতু বিনিময়ের জন্যই নির্দিষ্ট - এবং সোনা রূপার স্থলেই ব্যবহৃত। অতএব, উহার উপরও উহার চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাত ফরয, যদি উহার মূল্য সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা খালেস রূপার সমান হয়। (শামী ও ১৩৮৫ হিঃ সনে কায়রোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সম্মেলনের সিদ্ধান্ত — বায়্যেনাত—করাচী)
উদাহরণঃ বর্তমানে (১৩৭৪ বাং) আমাদের দেশে রূপার মূল্য চারি টাকা চারি আনা, অতএব, যাহার নিকট ২২৩ দুইশত তেইশ টাকা দুই আনার পয়সা, নোট বা হুণ্ডী অথবা অর্ধেকের কম রূপাওয়ালা টাকা আছে তাহার উপর উহার চল্লিশ ভাগের একভাগ অর্থাৎ, ৫।।/ পাঁচ টাকা নয় আনা যাকাত ফরয। এখানে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, বর্তমানে টাকার মূল্য রূপার মূল্য অপেক্ষা কম বলিয়াই এইরূপ হইয়াছে। যখন টাকার মূল্য রূপার মূল্যের সমান হইবে, তখন সাড়ে বায়ান্ন টাকাতেই নেসাব পূর্ণ হইবে যেমন এক কালে ছিল এবং উহার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ১।/ এক টাকা পাঁচ আনাতেই যাকাত আদায় হইয়া যাইবে, আবার কখনও যদি রূপার মূল্য টাকার মূল্য অপেক্ষা কমিয়া যায়, যথা রূপার মূল্য বার আনা হয়, তখন চল্লিশ টাকাতেই নেসাব পূর্ণ হইয়া যাইবে এবং উহার চল্লিশ ভাগের একভাগ ১ এক টাকাতেই যাকাত আদায় হইয়া যাইবে।
৬। মুদ্রা ও গহনা ইত্যাদি যে সকল জিনিসে সোনা বা রূপার পরিমাণই অধিক, সে সকল জিনিস সোনা বা রূপা বলিয়াই গণ্য। সুতরাং উহাতে সোনা রূপার যাকাতই ফরয। সোনা রূপা ও খাদের পরিমাণ সমান হইলে উহাতেও সাবধানতা (এহতিয়াৎ) হিসাবে যাকাত দেওয়া কর্তব্য।— দুররে মুখতার ও শামী
৭। কাহারও নিকট পাওনা টাকার উপর যাকাত ফরয — যদি দেনাদার উহা স্বীকার করে এবং আদায়ের অঙ্গীকার করে অথবা নিজের নিকট উহা উসূলের উপযুক্ত দলীল-প্রমাণ থাকে। কিন্তু পাওনা তিন প্রকারেরঃ
(ক) নগদ টাকা পয়সা অথবা সোনা রূপা ধার দেওয়া বাবত পাওনা অথবা ব্যবসায়ের মাল বিক্ৰি বাবত পাওনা। ইহাকে ফেকাহ্ শাস্ত্রে 'দাইনে কভী' বা সবল পাওনা বলে। এইরূপ পাওনা যদি নেসাব পরিমাণ এক কিস্তিতে উসূল হয়, তবে উহার অতীত বৎসরসমূহেরও যাকাত দিতে হইবে। বিভিন্ন কিস্তিতে উসূল হইলে যখন নেসাবের এক পঞ্চমাংশ পরিমাণ উসূল হইবে, তখন এক পঞ্চমাংশ যাকাত দিতে হইবে এবং ঐ পরিমাণের অতীত বৎসরেরও দিতে হইবে।
(খ) উপরিউক্ত রকমের পাওনা ব্যতীত অপর কোন স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি বাবত পাওনা যথা—ঘর বাড়ী জায়গা জমি বা ঘরের কোন ফার্নিচার বিক্রি বাবত পাওনা। ইহাকে ‘দাইনে মুতাওয়াসেত' বা মধ্যম পাওনা বলে। ইহা কিস্তিতে উসূল হইলে যাবৎ না নেসাব পরিমাণ উসূল হইবে তাবৎ যাকাত দেওয়া লাগিবে না।
(গ) উপরের দুই প্রকারের পাওনা ব্যতীত অপর কোন প্রকারের পাওনা যথা চাকরীর মজুরী পাওনা, স্বামীর নিকট মহরের পাওনা। ইহাকে 'দাইনে যঈফ' বা দুর্বল পাওনা বলে। ইহা যখন উসূল হইবে, তখন হইতেই ইহার যাকাত দিতে হইবে। পূর্ব সময়ের যাকাত দেওয়া লাগিবে না। — শামী
ইমাম আ'যম আবু হানীফাই পাওনার এইরূপ প্রকারভেদ করেন; কিন্তু তাঁহার শাগরিদ ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ (রঃ) সকল রকম পাওনাকেই সমান মনে করেন। অতএব, তাহাদের মতে তৃতীয় প্রকারের পাওনাতেও অতীত সময়ের যাকাত দিতে হইবে, যখন উহা পাওয়া যাইবে।
৮। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা যখন উসূল হইবে কেবল তখন হইতেই উহার যাকাত দিতে হইবে। ইমাম সাহেবের বিভাগ মতে ইহা ‘দাইনে যঈফ' ভুক্ত। তবে পূর্ব সময়ের যাকাত দেওয়া উত্তম। — এমদাদুল ফতওয়া ২য় খঃ, পূঃ ৬৪৫
৯। কোন কারখানা বা কোম্পানীতে দেওয়া শেয়ার মূল্যের যাকাত দেওয়া ফরয। তবে উহার যত অংশ ইত্যাদি উপকরণ বাবত খরচ হইয়াছে উহার যাকাত দেওয়া লাগিবে না। — নেয়ামে যাকাত
১০। যাকাতযোগ্য বিভিন্ন প্রকারের মাল আছে, যথা— সোনা রূপা, সোনা রূপার গহনা, নগদ টাকা, পণ্যদ্রব্য বা শেয়ার, কিন্তু একা কোনটিই নেসাব পরিমাণ নহে— যদি সকল প্রকার মিলাইয়াও নেসাব পরিমাণ হয়, উহাতে যাকাত ফরয।
১১। বৎসর পূর্ণ হইবার পূর্বে অগ্রীম যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইয়া যাইবে। ইত্যবসরে মাল ফওত হইয়া বা খরচ হইয়া গেলে উহার নফল সওয়াব মিলিবে।
১২। যাকাত দেওয়াকালে যাকাত আদায় করিতেছে বলিয়া মনে মনে নিয়ত করা ফরয। দেওয়াকালে নিয়ত না করা হইলে অন্ততঃ গ্রহীতা উহা খরচ করিয়া ফেলার পূর্বে নিয়ত করিলেও চলে। কিন্তু নিয়তের সাথে যাকাতের টাকা প্রথমে পৃথক করিয়া রাখা হইলে পরে উহা দেওয়া কালে নিয়ত না করিলেও যাকাত আদায় হইয়া যাইবে।
১৩। যাকাতদাতা কোন ব্যক্তির হাতে যাকাতের টাকা দিয়া বলিল, তুমি ইহা গরীবদের মধ্যে বিতরণ করিয়া দিও। সে উহা যে পর্যন্ত বিতরণ না করিবে, সে পর্যন্ত যাকাত আদায় হইবে না। এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে দিলেও হইবে না অথবা নিজে উহা খরচ করিয়া পরে নিজের টাকা হইতে আদায় করিলেও হইবে না।
১৪। সম্যক যাকাত এক ব্যক্তিকেও দেওয়া যাইতে পারে এবং অনেকের মধ্যে ভাগ করিয়াও দেওয়া যাইতে পারে; কিন্তু এক ব্যক্তিকে অন্ততঃ ঐ পরিমাণ দেওয়া উত্তম, যে পরিমাণ দ্বারা সে ঐ দিনের জন্য কাহারও মুখাপেক্ষী না হয়। এইরূপে এক ব্যক্তিকে ঐ পরিমাণ দেওয়াও মাকরূহ্ যে পরিমাণের উপর যাকাত ফরয। কিন্তু দেওয়া হইলে যাকাত আদায় হইয়া যাইবে। —নেয়ামে যাকাত, মুফতী শফী।
১৫। যাহাকে যাকাত দেওয়া হয়, তাহাকে একথা বলার প্রয়োজন নাই যে, ইহা যাকাত ; বরং না বলাই উত্তম। মনে মনে নিয়ত করাই যথেষ্ট।
১৬। বৎসর পূর্ণ হওয়ার সাথেই যাকাত আদায় করা ওয়াজিব। দেরী করা গোনাহ্। হঠাৎ মউত আসিয়া গেলে উহা ঘাড়ে থাকিয়া যাইবে, আর মাল অপরে খাইবে। — দুররে মুখতার
১৭। যে ব্যক্তি মানুষের হক দেনা রহিয়াছে অথবা আল্লাহর হকের মধ্যে অতীত অনাদায়ী যাকাত দেনা রহিয়াছে তাহার উপর যাকাত ফরয নহে— দেনা আদায় করাই ফরয — যদি তাহার যাকাতযোগ্য সম্পদ দেনার অধিক না হয়। সম্পদ অধিক হইলে এবং নেসাব পরিমাণ হইলে উহাতে যাকাত ফরয। যমীনের খাজনা ও যমীনের টাকা দেনার অন্তর্গত। —দুররে মুখতার, পৃঃ ৫
১৮। কাহারও নিকট কাফ্ফারা বা মানস আদায় অথবা হজ্জ আদায় করার টাকা আছে, যদি উহা নেসাব পরিমাণ হয় উহাতে যাকাত ফরয। এইগুলি আল্লাহর দেনা। এইরূপ দেনা যাকাতের প্রতিবন্ধক নহে। —দুররে মুখতার, পৃঃ ৬
১৯। নাবালেগের মালে যাকাত ফরয নহে। তাহার পক্ষ হইতে তাহার ওলীর উপর তাহার মাল হইতে ইহা আদায় করা জরূরী নহে। — হেদায়া
২০। থাকার ঘর, পরনের কাপড়, আরোহণের এবং ব্যবহারের ফার্নিচার ও তৈজসপত্র, কারিগরির হাতিয়ার, ব্যবসায় ও চাষের সরঞ্জাম এবং অপর পেশাদারের উপকরণ— যত অধিক হউক না কেন উহাতে যাকাত ফরয নহে। উহা মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্গত। — শামী
২১। কারবার করার উদ্দেশ্যে অথবা ভাড়া দেওয়ার জন্য নির্মিত দালান কোঠা, মিল কারখানা ও সামুদ্রিক জাহাজ প্রভৃতির উপর যাকাত ফরয নহে; বরং উহার নিট্ আয়ের উপরই যাকাত ফরয যদি উহা নেসাব পরিমাণ হয় এবং বছরকাল নিজ অধিকারে থাকে। – ১৩৮৫ হিঃ কায়রোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ওলামা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত।
২২। গৃহস্থালী বা পেশার মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিস বাদে যাহার নিকট সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা উহার মূল্য পরিমাণ অন্য দ্রব্য অথবা মুদ্রা আছে, তাহাকে 'সাহেবে নেসাব' বা মালদার বলে। মালদারের উপর যাকাত ফরয। সুতরাং তাহাকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইবে না। —নেযামে যাকাত
২৩। যে ব্যক্তি ঐরূপ মালদার তো নহে; কিন্তু তাহার নিকট গৃহস্থালী বা পেশার পক্ষে আবশ্যক সামগ্রীর অতিরিক্ত কিছু মাল আছে, যথা—বড় ডেগ ও সামিয়ানা, তাহাকে যাকাত দিলেও যাকাত আদায় হইবে না, যদিও তাহার উপর যাকাত ফরয নহে। —নেযামে যাকাত
২৪। নাবালেগ ছেলের পিতা যদি মালদার হয় তাহাকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইবে না। হাঁ, ছেলে যদি বালেগ হয় এবং নিজে মালদার না হয়, তাহাকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইয়া যাইবে। নাবালেগ ছেলের মা মালদার হইলে তাহাকে যাকাত দেওয়া জায়েয।—নেযামে যাকাত
২৫। মা বাপ, দাদা দাদী, নানা প্রমুখ ঊর্ধ্বতন পুরুষ এবং ছেলে মেয়ে, পোতা পোতী, নাতি নাতনী প্রমুখ অধস্থন এবং স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইবে না। ইহাতে পক্ষান্তরে যাকাতদাতা নিজেই উপকৃত হইতেছে। কারণ, ইহাদের তত্বাবধান এমনিই তাহার কর্তব্য। ইহাদের ছাড়া অপর গরীব আত্মীয়কে যাকাত দিলে অধিক সওয়াব হইবে।—শরহে কানয, আইনী
২৬। কাফেরকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইবে না; কিন্তু নফল দান করিলে তাহার সওয়াব পাওয়া যাইবে।
২৭। কেহ কোন গরীবের নিকট কিছু পাইবে। গরীব উহা আদায় করিতে পারিতেছে না। সে যাকাতের নিয়ত করিয়া গরীবকে উহা মাফ করিয়া দিল। ইহাতে তাহার যাকাত আদায় হইবে না। এইরূপ ক্ষেত্রে তাহাকে যাকাত দিয়া পরে উহা নিজের পাওনারূপে উসূল করিয়া লওয়াই সমীচীন। — দুররে মুখতার ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩
২৮। সরকার সরকারী কাজের ব্যয়ভার বহনের জন্য যে টেক্স বা আয়কর উসূল করে উহা দেওয়াকালে যাকাতের নিয়ত করিলে যাকাত আদায় হইবে না। কেননা, সরকার উহা যাকাত হিসাবে উসূল করে না এবং শরীঅত নির্ধারিত খাতে ব্যয়ও করে না। —কায়রো ওলামা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত
২৯। অনেক লোক আছে, যাহাদের আয় অপেক্ষা ব্যয় অধিক, বহু কষ্টে দিন গুযরান করে অথচ লজ্জায় কাহারও নিকট কিছু চাহে না। এইরূপ ব্যক্তিকে তালাশ করিয়া যাকাত এবং অন্যান্য দান খয়রাত দেওয়া অধিক সওয়াবের কারণ।
৩০। যাকাতে ‘তমলীক' অর্থাৎ গরীবকে উহার পূর্ণ স্বত্বাধিকার দান করা শর্ত। সুতরাং যাকাতের টাকা দ্বারা খানা তৈয়ার করিয়া গরীবকে বাড়ী ডাকিয়া খাওয়াইয়া দিলে অথবা পুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, ডাক্তারখানা, মুসাফিরখানা প্রভৃতি জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করিয়া দিলে যাকাত আদায় হইবে না। এইরূপ কাজে ব্যয় করিতে হইলে, উহা এমন গরীবকে দিবে যে উহা যাকাতরূপে গ্রহণ করিয়া পরে নিজ ইচ্ছায় সে সকল কাজে ব্যয় করে। ইহাতে তাহারও সওয়াব হইবে। — নেযামে যাকাত
৩১। যে পরিমাণ মাল হইলে যাকাত ফরয হয়, তাহাকে 'নেসাব' বলে এবং নেসাবের অধিকারীকে ‘সাহেবে নেসাব' বা 'মালদার' বলে। পূর্ণবৎসরের খোরপোষ ও গৃহস্থালীর প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং দেনার বাহিরে সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা ঐ পরিমাণ মূল্যের মুদ্রা বা ব্যবসায়ের মাল হইলে উহা নেসাবে পরিণত হয়। নেসাব পরিমাণ মাল প্রয়োজনে ব্যয় না হইয়া পূর্ণ বছর নিজের অধিকারে থাকিলে, তবে যাকাত আদায় করিতে হয়। কিন্তু খুমুস ওশরের জন্য বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত নহে। যখনই 'গনীমত' বা রেকায় লাভ হইবে, তখনই যাকাতরূপে উহার খুমুস দিবে। যখনই ফসল কাটিবে তখনই উহার ওশর আদায় করিবে।
শাফেয়ী বলেন, ওয়াকস বলা হয় ঐ পরিমাণকে যাহা যাকাতের পরিমাণ পর্যন্ত না পৌঁছে।
পরিশিষ্ট
পশু ও ফলাদির যাকাতের বিস্তারিত বিবরণ হাদীসের মাধ্যমে জানা গিয়াছে। এখানে কেবল সোনা রূপা ও ব্যবসায়ের মালের যাকাত সম্পর্কে কতিপয় অত্যাবশ্যক মাসআলার বিবরণ দেওয়া হইতেছে। বাকী মাসআলার জন্য ফেকাহর কিতাব দ্রষ্টব্য।
১। যাহার নিকট দেনা ও তাহার মৌলিক প্রয়োজনের সামগ্রী ব্যতীত বিশ মিসকাল অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা সোনা অথবা দুইশত দিরহাম অর্থাৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা আছে, তাহার উপর উহার চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাতরূপে দেওয়া ফরয। —কানয
২। সোনা বা রূপা দ্বারা প্রস্তুত জিনিস, গহনা, তৈজসপত্র ফার্নিচার ইত্যাদি—ইহার উপর ঐ পরিমাণে যাকাত ফরয, ব্যবহারে থাকুক বা না থাকুক।— কানয
৩। ব্যবসায়ের মালের উপরও উহার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত ফরয —যদি উহার মূল্য সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার সমান হয়। —কানয
৪। সোনা রূপার মধ্যে যেটি দেশে অধিক প্রচলিত সেটির সাথেই মূল্য নির্ধারণ করিবে। (আমাদের দেশে রূপাই অধিক প্রচলিত।) কিন্তু উহাতে যদি নেসাব পূর্ণ না হয়, তবে অপরটির সাথেই নির্ধারণ করিবে, অন্য কথায় যেটিতেই দরিদ্রের উপকার অধিক হয়, উহার সাথেই করিবে। —দুররে মুখতার
৫। দেশে প্রচলিত মুদ্রা যথা— টাকা, পয়সা, নোট ও হুণ্ডী – যেহেতু বিনিময়ের জন্যই নির্দিষ্ট - এবং সোনা রূপার স্থলেই ব্যবহৃত। অতএব, উহার উপরও উহার চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাত ফরয, যদি উহার মূল্য সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা খালেস রূপার সমান হয়। (শামী ও ১৩৮৫ হিঃ সনে কায়রোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সম্মেলনের সিদ্ধান্ত — বায়্যেনাত—করাচী)
উদাহরণঃ বর্তমানে (১৩৭৪ বাং) আমাদের দেশে রূপার মূল্য চারি টাকা চারি আনা, অতএব, যাহার নিকট ২২৩ দুইশত তেইশ টাকা দুই আনার পয়সা, নোট বা হুণ্ডী অথবা অর্ধেকের কম রূপাওয়ালা টাকা আছে তাহার উপর উহার চল্লিশ ভাগের একভাগ অর্থাৎ, ৫।।/ পাঁচ টাকা নয় আনা যাকাত ফরয। এখানে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, বর্তমানে টাকার মূল্য রূপার মূল্য অপেক্ষা কম বলিয়াই এইরূপ হইয়াছে। যখন টাকার মূল্য রূপার মূল্যের সমান হইবে, তখন সাড়ে বায়ান্ন টাকাতেই নেসাব পূর্ণ হইবে যেমন এক কালে ছিল এবং উহার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ১।/ এক টাকা পাঁচ আনাতেই যাকাত আদায় হইয়া যাইবে, আবার কখনও যদি রূপার মূল্য টাকার মূল্য অপেক্ষা কমিয়া যায়, যথা রূপার মূল্য বার আনা হয়, তখন চল্লিশ টাকাতেই নেসাব পূর্ণ হইয়া যাইবে এবং উহার চল্লিশ ভাগের একভাগ ১ এক টাকাতেই যাকাত আদায় হইয়া যাইবে।
৬। মুদ্রা ও গহনা ইত্যাদি যে সকল জিনিসে সোনা বা রূপার পরিমাণই অধিক, সে সকল জিনিস সোনা বা রূপা বলিয়াই গণ্য। সুতরাং উহাতে সোনা রূপার যাকাতই ফরয। সোনা রূপা ও খাদের পরিমাণ সমান হইলে উহাতেও সাবধানতা (এহতিয়াৎ) হিসাবে যাকাত দেওয়া কর্তব্য।— দুররে মুখতার ও শামী
৭। কাহারও নিকট পাওনা টাকার উপর যাকাত ফরয — যদি দেনাদার উহা স্বীকার করে এবং আদায়ের অঙ্গীকার করে অথবা নিজের নিকট উহা উসূলের উপযুক্ত দলীল-প্রমাণ থাকে। কিন্তু পাওনা তিন প্রকারেরঃ
(ক) নগদ টাকা পয়সা অথবা সোনা রূপা ধার দেওয়া বাবত পাওনা অথবা ব্যবসায়ের মাল বিক্ৰি বাবত পাওনা। ইহাকে ফেকাহ্ শাস্ত্রে 'দাইনে কভী' বা সবল পাওনা বলে। এইরূপ পাওনা যদি নেসাব পরিমাণ এক কিস্তিতে উসূল হয়, তবে উহার অতীত বৎসরসমূহেরও যাকাত দিতে হইবে। বিভিন্ন কিস্তিতে উসূল হইলে যখন নেসাবের এক পঞ্চমাংশ পরিমাণ উসূল হইবে, তখন এক পঞ্চমাংশ যাকাত দিতে হইবে এবং ঐ পরিমাণের অতীত বৎসরেরও দিতে হইবে।
(খ) উপরিউক্ত রকমের পাওনা ব্যতীত অপর কোন স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি বাবত পাওনা যথা—ঘর বাড়ী জায়গা জমি বা ঘরের কোন ফার্নিচার বিক্রি বাবত পাওনা। ইহাকে ‘দাইনে মুতাওয়াসেত' বা মধ্যম পাওনা বলে। ইহা কিস্তিতে উসূল হইলে যাবৎ না নেসাব পরিমাণ উসূল হইবে তাবৎ যাকাত দেওয়া লাগিবে না।
(গ) উপরের দুই প্রকারের পাওনা ব্যতীত অপর কোন প্রকারের পাওনা যথা চাকরীর মজুরী পাওনা, স্বামীর নিকট মহরের পাওনা। ইহাকে 'দাইনে যঈফ' বা দুর্বল পাওনা বলে। ইহা যখন উসূল হইবে, তখন হইতেই ইহার যাকাত দিতে হইবে। পূর্ব সময়ের যাকাত দেওয়া লাগিবে না। — শামী
ইমাম আ'যম আবু হানীফাই পাওনার এইরূপ প্রকারভেদ করেন; কিন্তু তাঁহার শাগরিদ ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ (রঃ) সকল রকম পাওনাকেই সমান মনে করেন। অতএব, তাহাদের মতে তৃতীয় প্রকারের পাওনাতেও অতীত সময়ের যাকাত দিতে হইবে, যখন উহা পাওয়া যাইবে।
৮। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা যখন উসূল হইবে কেবল তখন হইতেই উহার যাকাত দিতে হইবে। ইমাম সাহেবের বিভাগ মতে ইহা ‘দাইনে যঈফ' ভুক্ত। তবে পূর্ব সময়ের যাকাত দেওয়া উত্তম। — এমদাদুল ফতওয়া ২য় খঃ, পূঃ ৬৪৫
৯। কোন কারখানা বা কোম্পানীতে দেওয়া শেয়ার মূল্যের যাকাত দেওয়া ফরয। তবে উহার যত অংশ ইত্যাদি উপকরণ বাবত খরচ হইয়াছে উহার যাকাত দেওয়া লাগিবে না। — নেয়ামে যাকাত
১০। যাকাতযোগ্য বিভিন্ন প্রকারের মাল আছে, যথা— সোনা রূপা, সোনা রূপার গহনা, নগদ টাকা, পণ্যদ্রব্য বা শেয়ার, কিন্তু একা কোনটিই নেসাব পরিমাণ নহে— যদি সকল প্রকার মিলাইয়াও নেসাব পরিমাণ হয়, উহাতে যাকাত ফরয।
১১। বৎসর পূর্ণ হইবার পূর্বে অগ্রীম যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইয়া যাইবে। ইত্যবসরে মাল ফওত হইয়া বা খরচ হইয়া গেলে উহার নফল সওয়াব মিলিবে।
১২। যাকাত দেওয়াকালে যাকাত আদায় করিতেছে বলিয়া মনে মনে নিয়ত করা ফরয। দেওয়াকালে নিয়ত না করা হইলে অন্ততঃ গ্রহীতা উহা খরচ করিয়া ফেলার পূর্বে নিয়ত করিলেও চলে। কিন্তু নিয়তের সাথে যাকাতের টাকা প্রথমে পৃথক করিয়া রাখা হইলে পরে উহা দেওয়া কালে নিয়ত না করিলেও যাকাত আদায় হইয়া যাইবে।
১৩। যাকাতদাতা কোন ব্যক্তির হাতে যাকাতের টাকা দিয়া বলিল, তুমি ইহা গরীবদের মধ্যে বিতরণ করিয়া দিও। সে উহা যে পর্যন্ত বিতরণ না করিবে, সে পর্যন্ত যাকাত আদায় হইবে না। এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে দিলেও হইবে না অথবা নিজে উহা খরচ করিয়া পরে নিজের টাকা হইতে আদায় করিলেও হইবে না।
১৪। সম্যক যাকাত এক ব্যক্তিকেও দেওয়া যাইতে পারে এবং অনেকের মধ্যে ভাগ করিয়াও দেওয়া যাইতে পারে; কিন্তু এক ব্যক্তিকে অন্ততঃ ঐ পরিমাণ দেওয়া উত্তম, যে পরিমাণ দ্বারা সে ঐ দিনের জন্য কাহারও মুখাপেক্ষী না হয়। এইরূপে এক ব্যক্তিকে ঐ পরিমাণ দেওয়াও মাকরূহ্ যে পরিমাণের উপর যাকাত ফরয। কিন্তু দেওয়া হইলে যাকাত আদায় হইয়া যাইবে। —নেয়ামে যাকাত, মুফতী শফী।
১৫। যাহাকে যাকাত দেওয়া হয়, তাহাকে একথা বলার প্রয়োজন নাই যে, ইহা যাকাত ; বরং না বলাই উত্তম। মনে মনে নিয়ত করাই যথেষ্ট।
১৬। বৎসর পূর্ণ হওয়ার সাথেই যাকাত আদায় করা ওয়াজিব। দেরী করা গোনাহ্। হঠাৎ মউত আসিয়া গেলে উহা ঘাড়ে থাকিয়া যাইবে, আর মাল অপরে খাইবে। — দুররে মুখতার
১৭। যে ব্যক্তি মানুষের হক দেনা রহিয়াছে অথবা আল্লাহর হকের মধ্যে অতীত অনাদায়ী যাকাত দেনা রহিয়াছে তাহার উপর যাকাত ফরয নহে— দেনা আদায় করাই ফরয — যদি তাহার যাকাতযোগ্য সম্পদ দেনার অধিক না হয়। সম্পদ অধিক হইলে এবং নেসাব পরিমাণ হইলে উহাতে যাকাত ফরয। যমীনের খাজনা ও যমীনের টাকা দেনার অন্তর্গত। —দুররে মুখতার, পৃঃ ৫
১৮। কাহারও নিকট কাফ্ফারা বা মানস আদায় অথবা হজ্জ আদায় করার টাকা আছে, যদি উহা নেসাব পরিমাণ হয় উহাতে যাকাত ফরয। এইগুলি আল্লাহর দেনা। এইরূপ দেনা যাকাতের প্রতিবন্ধক নহে। —দুররে মুখতার, পৃঃ ৬
১৯। নাবালেগের মালে যাকাত ফরয নহে। তাহার পক্ষ হইতে তাহার ওলীর উপর তাহার মাল হইতে ইহা আদায় করা জরূরী নহে। — হেদায়া
২০। থাকার ঘর, পরনের কাপড়, আরোহণের এবং ব্যবহারের ফার্নিচার ও তৈজসপত্র, কারিগরির হাতিয়ার, ব্যবসায় ও চাষের সরঞ্জাম এবং অপর পেশাদারের উপকরণ— যত অধিক হউক না কেন উহাতে যাকাত ফরয নহে। উহা মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্গত। — শামী
২১। কারবার করার উদ্দেশ্যে অথবা ভাড়া দেওয়ার জন্য নির্মিত দালান কোঠা, মিল কারখানা ও সামুদ্রিক জাহাজ প্রভৃতির উপর যাকাত ফরয নহে; বরং উহার নিট্ আয়ের উপরই যাকাত ফরয যদি উহা নেসাব পরিমাণ হয় এবং বছরকাল নিজ অধিকারে থাকে। – ১৩৮৫ হিঃ কায়রোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ওলামা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত।
২২। গৃহস্থালী বা পেশার মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিস বাদে যাহার নিকট সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা উহার মূল্য পরিমাণ অন্য দ্রব্য অথবা মুদ্রা আছে, তাহাকে 'সাহেবে নেসাব' বা মালদার বলে। মালদারের উপর যাকাত ফরয। সুতরাং তাহাকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইবে না। —নেযামে যাকাত
২৩। যে ব্যক্তি ঐরূপ মালদার তো নহে; কিন্তু তাহার নিকট গৃহস্থালী বা পেশার পক্ষে আবশ্যক সামগ্রীর অতিরিক্ত কিছু মাল আছে, যথা—বড় ডেগ ও সামিয়ানা, তাহাকে যাকাত দিলেও যাকাত আদায় হইবে না, যদিও তাহার উপর যাকাত ফরয নহে। —নেযামে যাকাত
২৪। নাবালেগ ছেলের পিতা যদি মালদার হয় তাহাকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইবে না। হাঁ, ছেলে যদি বালেগ হয় এবং নিজে মালদার না হয়, তাহাকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইয়া যাইবে। নাবালেগ ছেলের মা মালদার হইলে তাহাকে যাকাত দেওয়া জায়েয।—নেযামে যাকাত
২৫। মা বাপ, দাদা দাদী, নানা প্রমুখ ঊর্ধ্বতন পুরুষ এবং ছেলে মেয়ে, পোতা পোতী, নাতি নাতনী প্রমুখ অধস্থন এবং স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইবে না। ইহাতে পক্ষান্তরে যাকাতদাতা নিজেই উপকৃত হইতেছে। কারণ, ইহাদের তত্বাবধান এমনিই তাহার কর্তব্য। ইহাদের ছাড়া অপর গরীব আত্মীয়কে যাকাত দিলে অধিক সওয়াব হইবে।—শরহে কানয, আইনী
২৬। কাফেরকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হইবে না; কিন্তু নফল দান করিলে তাহার সওয়াব পাওয়া যাইবে।
২৭। কেহ কোন গরীবের নিকট কিছু পাইবে। গরীব উহা আদায় করিতে পারিতেছে না। সে যাকাতের নিয়ত করিয়া গরীবকে উহা মাফ করিয়া দিল। ইহাতে তাহার যাকাত আদায় হইবে না। এইরূপ ক্ষেত্রে তাহাকে যাকাত দিয়া পরে উহা নিজের পাওনারূপে উসূল করিয়া লওয়াই সমীচীন। — দুররে মুখতার ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩
২৮। সরকার সরকারী কাজের ব্যয়ভার বহনের জন্য যে টেক্স বা আয়কর উসূল করে উহা দেওয়াকালে যাকাতের নিয়ত করিলে যাকাত আদায় হইবে না। কেননা, সরকার উহা যাকাত হিসাবে উসূল করে না এবং শরীঅত নির্ধারিত খাতে ব্যয়ও করে না। —কায়রো ওলামা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত
২৯। অনেক লোক আছে, যাহাদের আয় অপেক্ষা ব্যয় অধিক, বহু কষ্টে দিন গুযরান করে অথচ লজ্জায় কাহারও নিকট কিছু চাহে না। এইরূপ ব্যক্তিকে তালাশ করিয়া যাকাত এবং অন্যান্য দান খয়রাত দেওয়া অধিক সওয়াবের কারণ।
৩০। যাকাতে ‘তমলীক' অর্থাৎ গরীবকে উহার পূর্ণ স্বত্বাধিকার দান করা শর্ত। সুতরাং যাকাতের টাকা দ্বারা খানা তৈয়ার করিয়া গরীবকে বাড়ী ডাকিয়া খাওয়াইয়া দিলে অথবা পুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, ডাক্তারখানা, মুসাফিরখানা প্রভৃতি জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করিয়া দিলে যাকাত আদায় হইবে না। এইরূপ কাজে ব্যয় করিতে হইলে, উহা এমন গরীবকে দিবে যে উহা যাকাতরূপে গ্রহণ করিয়া পরে নিজ ইচ্ছায় সে সকল কাজে ব্যয় করে। ইহাতে তাহারও সওয়াব হইবে। — নেযামে যাকাত
৩১। যে পরিমাণ মাল হইলে যাকাত ফরয হয়, তাহাকে 'নেসাব' বলে এবং নেসাবের অধিকারীকে ‘সাহেবে নেসাব' বা 'মালদার' বলে। পূর্ণবৎসরের খোরপোষ ও গৃহস্থালীর প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং দেনার বাহিরে সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা ঐ পরিমাণ মূল্যের মুদ্রা বা ব্যবসায়ের মাল হইলে উহা নেসাবে পরিণত হয়। নেসাব পরিমাণ মাল প্রয়োজনে ব্যয় না হইয়া পূর্ণ বছর নিজের অধিকারে থাকিলে, তবে যাকাত আদায় করিতে হয়। কিন্তু খুমুস ওশরের জন্য বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত নহে। যখনই 'গনীমত' বা রেকায় লাভ হইবে, তখনই যাকাতরূপে উহার খুমুস দিবে। যখনই ফসল কাটিবে তখনই উহার ওশর আদায় করিবে।
