মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৬- জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৬৪৬
৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - জানাযার সাথে চলা ও সালাতের বর্ণনা।

জানাযার নামায ফরযে কেফায়া। কেহ সম্পাদন করিলে সকলের দায়িত্ব শেষ হইয়া যাইবে। কেহই সম্পাদন না করিলে সকলেই গোনাগার হইবে। মৃতকে গোসল দান ব্যতীত জানাযা পড়া জায়েয নহে। গোসল দান ব্যতীত কবরে রাখা হইলে উঠাইয়া গোসল দান করিবে; কিন্তু মাটি দেওয়া হইয়া গেলে উঠাইবে না এবং কবরের উপর তাহার জানাযাও পড়িবে না।
অনুপস্থিত মৃতের গায়েবী জানাযা হানাফী মাযহাব মতে জায়েয নহে। শাফেয়ী মাযহাব মতে জায়েয। জানাযার নামাযে রুকূ সজদা বা বসিয়া তাশাহহুদ পড়া নাই। হানাফী মাযহাব মতে জানাযার নামায নিম্নরূপঃ
নিয়ত করিয়া প্রথম তকবীর বলিবে। অতঃপর নামাযে যে সানা (সুবহানাকা) পড়া হয়, তাহা পড়িয়া দ্বিতীয় তকবীর বলিবে। তৎপর নামাযে যে দরূদ শরীফ পড়া হয়, তাহা পড়িয়া তৃতীয় তকবীর বলিবে। অতঃপর নিম্নলিখিত দো'আ পড়িয়া চতুর্থ তকবীর বলিবে। তৎপর ডানে বামে সালাম ফিরাইবে। দো'আ এইঃ

اللهم اغفر لحينا وميتنا وشاهدنا وغائبنا وصغيرنا وكبيرنا وذكرنا وأنثانا اللهم من
أحييته منا فأحيـه على الإسلام ومن توفيته منا فتوفه على الإيمان

(ইহার অর্থ সম্মুখের ২৯ নং হাদীসে আসিবে।)

নাবালেগ ছেলে হইলে ইহার স্থলে নিম্নরূপ দো'আ পড়িবেঃ

اللهم اجعله لنا فرطا واجعله لنا أجرا وذخرا واجعله لنا شافعا ومشفعا

মেয়ের জন্য এইরূপ পড়িবেঃ

اللهم اجعلها لنا فرطا واجعلها لنا أجرا وذخرا واجعلها لنا شافعة ومشفعة

জানাযার নামাযের অপরাপর মাসআলা ফেকাহর কিতাবে দেখিয়া লইবে। —অনুবাদক
১৬৪৬। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেনঃ মুর্দার (দাফন) ব্যাপারে ত্বরান্বিত করিবে। কেননা, সে যদি নেককার হয়, তবে তো ভাল। ভালকে তোমরা তাড়াতাড়ি তাহার ভাল ফলের দিকে পৌঁছাইয়া দিলে। আর যদি ইহার অন্যথা হয়, তাহা হইলে সে খারাব খারাবকে তোমরা তোমাদের ঘাড় হইতে রাখিয়া দিলে। --মোত্তাঃ
الْمَشْيُ بِالْجَنَازَةِ وَالصَّلَاةُ عَلَيْهَا
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَسْرِعُوا بِالْجَنَازَةِ فَإِنْ تَكُ صَالِحَةً فَخَيْرٌ تُقَدِّمُونَهَا إِلَيْهِ وَإِنْ تَكُ سِوَى ذَلِكَ فشر تضعونه عَن رقابك»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটির মূল আলোচনা মায়্যিতের দাফন-কাফনের কাজ যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করা সম্পর্কে। প্রসঙ্গত এর দ্বারা আরও কয়েকটি বিষয় জানা যায়। নিচে বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে।

দাফন-কাফনের কাজ তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করা
হাদীছটিতে মায়্যিতের দাফন-কাফনের কাজ যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি করতে বলা হয়েছে। হুকুম দেওয়া হয়েছে- أَسْرِعُوْا بِالْجَنَازَةِ (তোমরা মায়্যিতকে দ্রুত নিয়ে যাও)। আরবীতে الْجَنَازَةِ শব্দটি দ্বারা মায়্যিত, মায়্যিতকে বহনকারী খাট উভয়ই বোঝানো হয়ে থাকে। আলোচ্য হাদীছে এর দ্বারা মায়্যিত বা মৃতব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়ার অর্থ তাকে গোসল করানো, কাফন পরানো, তার জানাযার নামায আদায় ও তাকে দাফন করা এ সবগুলো কাজই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সম্পাদন করা। বোঝা গেল এসব কাজে অহেতুক দেরি করা শরী'আতপরিপন্থি। অনেকে তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে এসব কাজে এত বিলম্ব করে যে, মায়্যিতকে দাফন করতে দু'-চারদিন পর্যন্ত দেরি করে ফেলে, যা কিছুতেই সমীচীন নয়।

মায়্যিতের দাফন-কাফনের কাজ কেন দ্রুত সম্পাদন করতে হবে, সে সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- فَإِنْ تَكُ صَالِحَةٌ، فَخَيْرٌ تُقَدِّمُوْنَهَا إِلَيْهِ (যদি সে নেককার হয়, তবে তোমরা তাকে কল্যাণের দিকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছ)। কেননা তার কবর জান্নাতের একটি উদ্যান। সেখানে তার জন্য রয়েছে অকল্পনীয় নি'আমত। দুনিয়ার সুখ-শান্তি অপেক্ষা তার জন্য সেখানকার আরাম-আয়েশ অনেক বেশি উৎকৃষ্ট। তাই, সে দ্রুত সেখানেই যেতে চায়। সে বলে- قدموني قدموني (আমাকে এগিয়ে নিয়ে চলো, আমাকে এগিয়ে নিয়ে চলো)। এটা বলার কারণ পরকালে যাওয়ার আগ্রহ। দুনিয়া তো তার জন্য ছিল কারাগারস্বরূপ। মৃত্যু দ্বারা সে এককালে যাওয়ার মুক্তি পেয়েছে। এখন সে আরাম-আয়েশপূর্ণ কবরে যাওয়ার জন্য কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি বাড়ি যাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকে।

পক্ষান্তরে মৃতব্যক্তি যদি হয় পাপী, তবে তার বেলায় দাফন-কাফনের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার কী হিকমত, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে- وَإِن تَكُ سِوى ذَلِكَ، فَشَرٌّ تَضَعُوْنَهُ عَنْ رِقَابِكُمْ (আর যদি তার বিপরীত হয়, তবে তোমরা নিজেদের কাঁধ থেকে মন্দকেই নামাচ্ছ)। অর্থাৎ সে তোমাদের জন্য একটা বোঝা হয়ে আছে। তাকে নিয়ে তোমরা পেরেশান। গোসল করানো থেকে শুরু করে দাফন করা পর্যন্ত কাজ তো অনেক। প্রতিটি কাজই তোমাদের জন্য অবশ্যকর্তব্য। আবার তোমরা শোকার্তও বটে। কাজেই যত তাড়াতাড়ি তোমরা এসব কাজ শেষ করতে পারবে, ততো তাড়াতাড়ি তোমরা দায়িত্বমুক্ত হতে পারবে এবং এক মন্দের বোঝা বয়ে বেড়ানোর ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে। বলাবাহুল্য, কোনও মন্দের সঙ্গ ও সাহচর্য থেকে যত দ্রুত বাঁচা যায় ততোই মঙ্গল। মোটকথা মৃতব্যক্তি পুণ্যবান হোক বা পাপী, উভয় অবস্থায় তার দাফন-কাফনের কাজ দ্রুত সম্পাদন করা উচিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا يَنْبَغِي لِجِيفَةِ مُسْلِمٍ أَنْ تُحْبَسَ بَيْنَ ظَهْرَانِي أَهْلِهِ
'মুসলিম ব্যক্তির লাশ তার পরিবারবর্গের মাঝখানে আটকে রাখা উচিত নয়’। (সুনানে আবু দাউদ : ৩১৫৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৬৬২০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩৫৫৪)

অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
إِذَا مَاتَ أَحَدُكُمْ فَلَا تَحْبِسُوْهُ وَأَسْرِعُوْا بِه إِلَى قَبرِهِ
'তোমাদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তাকে আটকে রেখো না। তাকে দ্রুত তার কবরে নিয়ে যাও’। (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮৮৫৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ১৩৬১৩)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মায়্যিতের দাফন-কাফনের কাজ যথাসম্ভব দ্রুত সম্পাদন করা উচিত।

খ. নেককার ব্যক্তির জন্য কবরে অভাবনীয় আরামের ব্যবস্থা থাকায় মৃত্যুর পর সে দ্রুত সেখানে পৌঁছার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এরকম শুভ পরিণাম লাভের আশায় নিজেদের নেককাররূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য।

গ. বদকার ব্যক্তির পরিণাম অতিমন্দ। তাই সে কবরে যেতে চায় না। আমাদের যাতে এ অবস্থার সম্মুখীন হতে না হয়, তাই অন্তরে আযাব ও গযবের ভয় জাগ্রত রেখে অসৎকর্ম হতে দূরে থাকতে হবে।

ঘ. কুরআন ও হাদীছে অদৃশ্যজগতের যেসকল বিষয় জানানো হয়েছে, তা বুঝে না আসলেও সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে।

ঙ. যে-কোনও মন্দের সঙ্গ ও সাহচর্য থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা থাকা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ১৬৪৬ | মুসলিম বাংলা