মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৬- জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৬২১
৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট যা বলতে হয়
১৬২১। হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেনঃ যাহার শেষ বাক্য হইবেঃ 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্' সে বেহেশতে যাইবে। —আবু দাউদ
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ كَانَ آخِرُ كَلَامِهِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ» رَوَاهُ أَبُو دَاوُد

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. অর্থাৎ, যে এই বিশ্বাসের উপর মরিবে। সুতরাং মৃত্যুকালে তাহাকে ইহা স্মরণ করাইয়া দেওয়া উচিত।

২. এ হাদীছটিতে কালেমা তায়্যিবার ফযীলত বলা হয়েছে যে, মৃত্যুর সময় সর্বশেষ কথা হিসেবে এটি বলতে পারলে জান্নাত লাভ হবে। কালেমা তায়্যিবা ইসলামের মূলমন্ত্র। 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' এর অর্থ আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই। এটা তাওহীদের ঘোষণা। তাওহীদের বিশ্বাস ইসলামী আকীদার মূল স্তম্ভ। অন্যসব আকীদা এ স্তম্ভের উপরই প্রতিষ্ঠিত। তাই এর গুরুত্ব সবকিছুর উপরে। এর ফযীলতও সবচে' বেশি। এরই উপর জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা।

উল্লেখ্য, কালেমার দ্বিতীয় অংশ 'মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ' প্রথম অংশের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। তাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বললে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ আপনা-আপনিই এসে যায়। একজন লোক ঈমানের অন্তর্ভুক্ত কেবল তখনই হতে পারে, যখন সে আল্লাহ যায় মা'বুদ নেই ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আল্লাহর রাসূল এ কথাও স্বীকার করবে। উভয়টি অবিচ্ছেদ্য হওয়ায় কালেমা সম্পর্কিত কোনও কথা বলার সময় পূর্ণ কালেমার উল্লেখ দরকার হয় না। তাই কেবল প্রথম আধ বলেই ক্ষান্ত করা হয়। কিন্তু শ্রোতাকে বুঝতে হবে বক্তার উদ্দেশ্য কেবল প্রথম অংশই নয়; বরং পূর্ণাঙ্গ কালেমা।

সুতরাং মৃত্যুকালে যার শেষকথা হয় لا اله الا الله সে জান্নাতে যাবে এর দ্বারা পূর্ণাঙ্গ কালেমা বোঝানোই উদ্দেশ্য। তবে হাঁ, মুমিন ব্যক্তি যেহেতু বিশ্বাস রাখে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, তাই মৃত্যুকালে তার কেবল লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ বলাকেই পূর্ণাঙ্গ কালেমাপাঠ বলে ধরে নেওয়া হয়, যদিও স্পষ্টভাবে পূর্ণ কালেমা উচ্চারণ করাই শ্রেয়। কিন্তু কোনও অমুসলিম ব্যক্তি যদি ইসলাম গ্রহণ করে। তবে তাকে অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ কালেমা উচ্চারণ করতে হবে। অমুসলিম ব্যক্তি যদি মৃত্যুকালেও ইসলাম গ্রহণ করে, তাকেও সাক্ষ্য দিতে হবে যে আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলার রাসূল।

যে ব্যক্তি কালেমাপাঠের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করে, তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
أَنَّ الْإِسْلَامَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ
'ইসলাম তার পূর্ববর্তী সবকিছু মিটিয়ে দেয়’। (সহীহ মুসলিম: ১২১; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১৫৫৬; সহীহ ইবনে খুযায়মা: ২৫১৫: বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৮১৯০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৪৭)

সুতরাং কোনও অমুসলিম মৃত্যুর আগে আগে যদি আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে এ কালেমা পাঠ করে মারা যায়, তবে সে নিষ্পাপ অবস্থায়ই মারা যায়। ফলে সে সরাসরি জান্নাত লাভ করবে। সে আদৌ জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ كَانَ آخِرُ كَلَامِهِ : لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، لَمْ يَدْخُلِ النَّارَ
'যার শেষকথা হয় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না’। (তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৫৭৪)

যদি কোনও মুসলিম ব্যক্তির কবীরা গুনাহ না থাকে, তার দ্বারা কোনও বান্দার কোনও হকও নষ্ট না হয়ে থাকে, সেও যদি মৃত্যুকালে এ কালেমা পাঠ করে মারা যেতে পারে, তবে তার ক্ষেত্রেও এ হাদীছটি প্রযোজ্য হয়। কেননা তার কোনও সগীরা গুনাহ থাকলে এ কালেমাপাঠের মাধ্যমে তা মাফ হয়ে যায়। কেননা কালেমাপাঠ সর্বশ্রেষ্ঠ পুণ্যের কাজ। আর কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেলা
إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ذَلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ
'নিশ্চয়ই পুণ্যরাজি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ মানে তাদের জন্য এটা এক উপদেশ’। (সূরা হূদ, আয়াত ১১৪)

কোনও মুসলিম ব্যক্তির যদি কবীরা গুনাহও থাকে, তার ক্ষেত্রেও আশা রয়েছে যে, মৃত্যুকালে এ কালেমা নসীব হলে এ হাদীছের বক্তব্যমতে সে সরাসরি জান্নাত লাভ করবে। কেননা মৃত্যুকালে সে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, সবচে' ওজনদার ও সবচে' ফযীলতপূর্ণ বাক্যটি উচ্চারণ করেছে। এটা এমন এক সময়, যখন পার্থিব কোনও লোভ-লালসা থাকার কথা নয়। সবরকম খাহেশাত ও মন্দ চাহিদাও এ সময় লোপ পেয়ে যায়। সে সম্পূর্ণরূপে আখিরাতমুখী হয়ে পড়ে। সে মনেপ্রাণে আল্লাহর কাছে আশাবাদী হয়ে ওঠে। অতীত গুনাহের জন্য তার লজ্জা ও অনুতাপ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। লজ্জা ও অনুতাপই প্রকৃত তাওবা। এ সময় এ মহান কালেমার উচ্চারণ খাঁটি তাওবার সঙ্গেই হয় বলে ধরে নেওয়া যায়। তাওবা দ্বারা আল্লাহ তা'আলা কবীরা গুনাহও মাফ করে দেন। আশা করা যায় খাঁটি তাওবার বদৌলতে আল্লাহ তা'আলা ওই ব্যক্তি দ্বারা কোনও বান্দার কোনও হক নষ্ট হয়ে থাকলে তাও মাফ করানোর ব্যবস্থা করে দেবেন। হয়তো তার ওয়ারিছগণকে তাওফীক দেবেন যাতে তারা সেই হকসমূহ আদায় করে দেয়। কিংবা এমনও হতে পারে যে, পাওনাদারগণই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে ক্ষমা করে দেবে। আল্লাহ তা'আলা তাদের মনে সেই আবেগ ও অনুভূতি সৃষ্টি করে দেবেন। যদি বাস্তবে তাই হয়ে থাকে, তবে তার এ কালেমাপাঠ পূর্ণাঙ্গ তাওবাও বটে। ফলে সে সবরকম গুনাহ থেকে মাফ পেয়ে যাবে এবং আখিরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্ত থেকে সরাসরি জান্নাত লাভ করবে।

মৃত্যুকালে যাতে সর্বশেষ কথারূপে কালেমা পাঠ করা যায়, সেই আশায় আগে থেকেই কালেমাওয়ালা যিন্দেগী গঠন করা উচিত। জান্নাত অতিউচ্চ বিনিময়। এ বিনিময় লাভ করার জন্য বান্দার কেবল আশাই যথেষ্ট নয়; আন্তরিক চেষ্টাও থাকা চাই। তাই জীবনগঠনে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। কালেমাওয়ালা যিন্দেগী হল শরী'আতসম্মত কালেমাপাঠের যিন্দেগী। জীবনের সকল ক্ষেত্রে শরী'আতের অনুসরণ করা কালেমার দাবি। এ দাবি যে পূরণ করতে সচেষ্ট থাকবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে মৃত্যুকালে দেবেন বলেও আশা থাকে। সেইসঙ্গে কালেমার উচ্চারণ যেহেতু মুখে হয়, তাই কেবল তাওফীক মৃত্যুকালে নয়, আগে থেকেই মুখে এ কালেমার জারি রাখা দরকার। কালেমার যিকিরে যবান সজীব রাখলে, এ যিকিরে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুললে মৃত্যুকালে সে অভ্যাস সুফল দেবে। আল্লাহ তা'আলার রহমতে তখনও মুখে কালেমা উচ্চারিত হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আমাদের সকলেরই আশা থাকা উচিত যাতে মৃত্যুকালে কালেমা নসীব হয়।

খ. মৃত্যুকালে যাতে কালেমা নসীব হয়, সেজন্য আগে থেকেই বেশি বেশি কালেমা পাঠ করা ও কালেমার দাবি অনুযায়ী জীবন গঠন করার চেষ্টা থাকা উচিত।

গ. মৃত্যুপথযাত্রী যাতে কালেমা পাঠ করতে পারে, সেজন্য উপস্থিত ব্যক্তিদের উচিত তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে কালেমা পাঠ করা।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ১৬২১ | মুসলিম বাংলা