মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৫- নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৪৮২
৫০. প্রথম অনুচ্ছেদ - সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সালাত
১৪৮২। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় একবার সূর্যগ্রহণ হইল। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়িলেন, আর লোকেরাও তাহার সহিত নামায পড়িল। (কেরাআতে তিনি প্রায় সূরা বাকারা পড়ার পরিমাণ দীর্ঘ সময় দাড়াইলেন, অতঃপর দীর্ঘ রুকু করিলেন (প্রথম রুকু)। তৎপর মাথা উঠাইলেন, অতঃপর দাড়াইলেন দীর্ঘ দাড়ান, তবে প্রথম দাড়ান অপেক্ষা কম। অতঃপর রুকু করিলেন দীর্ঘ রুকূ, তবে প্রথম রুকূ অপেক্ষা কম তৎপর মাথা উঠাইলেন অতঃপর সিজদা করিলেন। অতঃপর দাঁড়াইলেন——দীর্ঘ সময় দাড়াইলেন, তবে প্রথম দাড়ান অপেক্ষা কম। তৎপর দীর্ঘ রুকু করিলেন, তবে প্রথম রুকু অপেক্ষা কম। অতঃপর রুকু হইতে মাথা উঠাইলেন এবং দাঁড়াইয়া রহিলেন দীর্ঘ দাড়ান, তবে উহা ছিল প্রথম দাড়ান অপেক্ষা কম কাছাকাছি। অতঃপর রুকু করিলেন দীর্ঘ রুকু, তবে ইহা ছিল প্রথম রুকু অপেক্ষা কম। তৎপর মাথা উঠাইলেন, অতঃপর সিজদায় গেলেন এবং নামায হইতে অবসর গ্রহণ করিলেন, আর ততক্ষণে সূর্য দীপ্তিমান হইয়া গিয়াছে।

তখন হুযূর (ছাঃ) বলিলেন: সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর (কুদরতের) নিদর্শনসমূহের মধ্যে দুইটি নিদর্শন। উহারা কাহারও মৃত্যুর কারণে বা জন্মের কারণে গ্রহণগ্রস্ত হয় না। যখন তোমরা উহা দেখিবে, আল্লাহর স্মরণ করিবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। আপনাকে দেখিলাম আপনি যেন আপনার এই স্থানে কিছু গ্রহণ করিতেছেন, অতঃপর দেখিলাম পিছনে সরিয়া গেলেন। তিনি বলিলেন, তখন আমি বেহেশতকে দেখিতে পাইলাম এবং তথা হইতে একটি আঙ্গুরের ছড়া গ্রহণ করিতে উদ্যত হইলাম। যদি আমি উহা গ্রহণ করিতাম তাহা হইলে দুনিয়া বাকী থাকা পর্যন্ত তোমরা উহা খাইতে পারিতে। আর তখন আমি দোযখকেও দেখিতে পাইলাম, যাহার ন্যায় বীভৎস দৃশ্য আমি আর কখনও দেখি নাই। আর আমি ইহাও দেখিলাম যে, দোযখের অধিকাংশ অধিবাসীই নারী। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, কি কারণে ইয়া রাসূলাল্লাহ্। হুযুর (ছাঃ) বলিলেন, তাহাদের কুফরীর কারণে পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তাহারা কি আল্লাহর সহিত কুফরী করিয়া থাকে। হুযুর (ছাঃ) বলিলেন, না, বরং স্বামীর সহিত কুফরী করিয়া থাকে এবং তাহারা এহ্সান ভুলিয়া যায়। যদি তুমি তাহাদের কাহারও সাথে আজীবন এহসান কর, অতঃপর সে যদি তোমার পক্ষ হইতে সামান্য মন্দ দেখে, বলিয়া উঠে, আমি কখনও তোমার নিকট হইতে সদ্ব্যবহার পাইলাম না। মোত্তাঃ
بَابُ صَلَاةِ الْخُسُوْفِ
عَن عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: انْخَسَفَتِ الشَّمْسُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَصَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَامَ قِيَامًا طَوِيلًا نَحْوًا مِنْ قِرَاءَةِ سُورَةِ الْبَقَرَةِ ثُمَّ رَكَعَ رُكُوعًا طَوِيلًا ثُمَّ رَفَعَ فَقَامَ قِيَامًا طَوِيلًا وَهُوَ دُونَ الْقِيَامِ الْأَوَّلِ ثُمَّ رَكَعَ رُكُوعًا طَوِيلًا وَهُوَ دُونَ الرُّكُوعِ الْأَوَّلِ ثُمَّ رَفَعَ ثُمَّ سَجَدَ ثُمَّ قَامَ قِيَامًا طَوِيلًا وَهُوَ دُونَ الْقِيَامِ الْأَوَّلِ ثُمَّ رَكَعَ رُكُوعًا طَوِيلًا وَهُوَ دُونَ الرُّكُوعِ الْأَوَّلِ ثُمَّ رَفَعَ فَقَامَ قِيَامًا طَوِيلًا وَهُوَ دُونَ الْقِيَامِ الْأَوَّلِ ثُمَّ رَكَعَ رُكُوعًا طَوِيلًا وَهُوَ دُونَ الرُّكُوعِ الْأَوَّلِ ثُمَّ رَفَعَ ثُمَّ سَجَدَ ثمَّ انْصَرف وَقد تجلت الشَّمْس فَقَالَ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم: «إِنَّ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ آيَتَانِ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لَا يَخْسِفَانِ لِمَوْتِ أَحَدٍ وَلَا لِحَيَاتِهِ فَإِذَا رَأَيْتُمْ ذَلِكَ فَاذْكُرُوا اللَّهَ» . قَالُوا: يَا رَسُولَ الله رَأَيْنَاك تناولت شَيْئا فِي مقامك ثمَّ رَأَيْنَاك تكعكعت؟ قَالَ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم: «إِنِّي أريت الْجنَّة فتناولت عُنْقُودًا وَلَوْ أَخَذْتُهُ لَأَكَلْتُمْ مِنْهُ مَا بَقِيَتِ الدُّنْيَا وأريت النَّار فَلم أر منْظرًا كَالْيَوْمِ قَطُّ أَفْظَعَ وَرَأَيْتُ أَكْثَرَ أَهْلِهَا النِّسَاءَ» . قَالُوا: بِمَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «بِكُفْرِهِنَّ» . قِيلَ: يَكْفُرْنَ بِاللَّهِ؟ . قَالَ: يَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ وَيَكْفُرْنَ الْإِحْسَانَ لَو أَحْسَنت إِلَى أحداهن الدَّهْر كُله ثُمَّ رَأَتْ مِنْكَ شَيْئًا قَالَتْ: مَا رَأَيْتُ مِنْك خيرا قطّ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. কুফরীর দুইটি অর্থ রহিয়াছে, আল্লাহতে অস্বীকার করা এবং কাহারও এহ্সান অস্বীকার করা। স্বামীর সহিত কুফরী অর্থে তাহার এহ্সান-অনুগ্রহকে অস্বীকার করাই বুঝায়। জাহেলিয়াত যুগের আরবদের ধারণা ছিল, দুনিয়ার কোন মহান ব্যক্তির মৃত্যুর কারণেই গ্রহণ হইয়া থাকে। ১০ম হিজরীতে নবী করীম (ﷺ)-এর পুত্র ইব্রাহীমের মৃত্যু-দিবসে এই সূর্যগ্রহণ হইলে তাহারা ভাবিল, আল্লাহর নবীর পুত্রের মৃত্যুতেই এই মহাকাণ্ড ঘটিয়াছে। নবী করীম (ﷺ) ইহার প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, গ্রহণ কাহারও জীবন-মরণের কারণে হয় না।
এখানে স্মরণ রাখা উচিত যে, তিনি কোন সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি হইলে ইহা দ্বারা বিরাট সুযোগ গ্রহণ করিতে এবং মিথ্যা বুযুর্গী ঝাড়িতে পারিতেন।

২. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- (জাহান্নামের অধিকাংশ বাসিন্দা নারী)। এটা বলা হয়েছে জাহান্নামের একটা বিশেষ সময় সম্পর্কে। এটা সাধারণভাবে জাহান্নামের সব সময়কার কথা নয়। মূলত প্রথমদিকে জাহান্নামে নারীদের সংখ্যা বেশি থাকবে। পরে যারা ঈমান নিয়ে মারা যাবে, ঈমানের বদৌলতে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। ফলে তারা জান্নাতে চলে যাবে। তখন জান্নাতে পুরুষ ও নারী উভয়ের সংখ্যাই সমান হয়ে যাবে।

প্রথমদিকে জাহান্নামে নারীদের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ অনেক মুমিন নারী প্রথমে জাহান্নামে যাবে, তারপর সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করবে। তাদের প্রথমদিকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ তাদের এমনকিছু দোষ, যা সাধারণত নারীদের মধ্যেই বেশি পাওয়া যায়। হাদীসে আছে,
تكثرن اللعن، وتكفرن العشير
“তোমরা বেশি বেশি লানত কর এবং স্বামীর অকৃতজ্ঞতা কর।"

অন্যান্য পাপ নারী-পুরুষ উভয়ই সাধারণত সমানই করে। কিন্তু লানত করার পাপ তুলনামূলক নারীদের মধ্যে বেশি। আর স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞতা তো তাদেরই মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ কারণেই প্রথমদিকে জাহান্নামে তাদের সংখ্যা বেশি হবে।

হাদীছটির এরকম ব্যাখ্যাও করা যায় যে, জাহান্নামে তাদের সংখ্যা বেশি হওয়ার অর্থ পুরুষদের তুলনায় বেশি হওয়া নয়; বরং নারীদের মধ্যেই যারা জাহান্নামে যাবে তাদের একদলের তুলনায় অন্যদলের সংখ্যা বেশি বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তাদের অনেককেই বিভিন্ন কারণে জাহান্নামে যেতে হবে বটে, কিন্তু লা'নত করা ও স্বামীর অবাধ্যতা করার অপরাধে যারা জাহান্নামে যাবে তাদের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় বেশি হবে।

উল্লেখ্য : স্বামীর অবাধ্যতা করা যেমন পাপ, তেমনি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর প্রতি জুলুম-নির্যাতন করাও পাপ বৈকি। অনেক স্বামীই এ পাপ করে থাকে। এর থেকে তাদের বিরত হওয়া উচিত। অন্যথায় এ কারণে তাদেরকেও আখিরাতে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকেই জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি হয়ে আছে।

খ. এমন কিছু পাপ আছে, যা সাধারণত মহিলারাই বেশি করে থাকে। তাদের উচিত সেগুলো ছেড়ে দেওয়া, যাতে সেসব পাপের কারণে জাহান্নামে যেতে না হয়। তারা যাতে সেসব পাপ ছাড়তে পারে, পুরুষের উচিত সে ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা করা।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ১৪৮২ | মুসলিম বাংলা