মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৫- নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৪৭৯
৪৯. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - রজব মাসে কুরবানী
১৪৭৯। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেনঃ আমি ওহী প্রাপ্ত হইয়াছি, আল্লাহ্ তা'আলা কোরবানীর দিনকে এই উম্মতের জন্য ঈদরূপে পরিণত করিয়াছেন। এক ব্যক্তি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি যদি মাদী ‘মানীহা’ ব্যতীত অপর কোন পশু না পাই, তবে কি উহা দ্বারা কোরবানী করিব? হুযূর (ﷺ) বলিলেন, না; কিন্তু তুমি (কোরবানীর দিনে) তোমার চুল ও নখ কাটিবে, তোমার গোঁফ খাট করিবে এবং নাভির নীচেকার কেশ ক্ষৌরী করিবে—ইহাই আল্লাহর নিকট তোমার পূর্ণ কোরবানী। –আবু দাউদ ও নাসায়ী
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللَّهُ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ» . قَالَ لَهُ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا مَنِيحَةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا؟ قَالَ: «لَا وَلَكِنْ خُذْ مِنْ شَعْرِكَ وَأَظْفَارِكَ وَتَقُصُّ مِنْ شَارِبِكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللَّهِ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِيُّ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আরবেরা দুধালী গাভী বা ছাগল-ভেড়া কাহাকেও এই শর্তে দান করিত যে, আবশ্যক সময় পর্যন্ত দুধ পান করিয়া পরে উহা ফেরত দিবে। ইহাকে 'মানীহা' বলে।


কোরবানীর মাসায়েলঃ
কোরবানী সম্পর্কীয় কোরআন ও হাদীস আলোচনা করিয়া ইমাম আ'যম আবু হানীফা (রঃ) ও তাঁহার অনুসারী ফকীহগণ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছেনঃ
(১) যাহার নিকট দেনার বাহিরে পূর্ণ বৎসরের খোরপোষ ও গৃহস্থালীর প্রয়োজন অতিরিক্ত সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সোনা-রূপার গহনা বা ঐ পরিমাণ মূল্যের টাকাকড়ি বা ব্যবসায়ের মাল আছে এবং পূর্ণ এক বৎসর হাতে রহিয়াছে, তাহাকে ‘মালদার' বলে। মালদারের উপর যাকাত ফরয এবং ফেতরা ও কোরবানী ওয়াজিব। যে ব্যক্তি মালদার তো নহে; কিন্তু তাহার নিকট গৃহস্থালীর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত যাকাত পরিমাণ মূল্যের কোন দ্রব্যসামগ্রী আছে— যথা—বড় ডেগ ও শামিয়ানা—তাহার উপর যাকাত ফরয না হইলেও ফেতরা ও কোরবানী ওয়াজিব। (২) ফেতরা ও কোরবানীর জন্য মালের এক বৎসর পূর্ণ হওয়া শর্ত নহে। কোরবানীর শেষ তারিখ অর্থাৎ, বার তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্তও মাল হাতে আসিলে কোরবানী ওয়াজিব। (৩) নাবালেগ সন্তানদের পক্ষ হইতে কোরবানী করা মুরব্বীদের উপর ওয়াজিব নহে; বরং মোস্তাহাব। সেই সন্তান মালদার হইলেও তাহাদের মালে কোরবানী ওয়াজিব নহে। (৪) মৃত ব্যক্তির পক্ষ হইতে কোরবানী জায়েয। (৫) কাহারও বিনা অনুমতিতে তাহার কোরবানী করা হইলে কোরবানী হইবে না এবং গরুতে শরীক করা হইলে শরীকদের কোরবানীও হইবে না। (৬) যিলহজ্জ মাসের দশ তারিখ নামাযের পর হইতে বার তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত কোরবানী করা জায়েয, কিন্তু দশ তারিখে করাই উত্তম। রাতে কোরবানী করা মাকরূহ। (৭) মালদার ব্যক্তি বার তারিখ পর্যন্ত কোরবানী করিতে না পারিলে, তবে পশু খরিদ করিলে উহা দান করিয়া দিবে, অন্যথায় কোরবানী পরিমাণ টাকা দান করিবে। (৮) গরু, মহিষ, উট, ছাগল ও ভেড়া ভিন্ন অন্য পশু দ্বারা কোরবানী জায়েয নহে। (৯) ছাগল ভেড়া এক বৎসর এবং গরু-মহিষ দুই বৎসর এবং উট পাঁচ বৎসরের হওয়া শর্ত। কিন্তু ভেড়া মোটা-তাজা হইলে ছয় মাসের হইলেও চলে। (১০) গরু-মহিষ ও উটে সাত জন পর্যন্ত শরীক হইতে পারে। (১১) শরীকদের মধ্যে কেহ গোশত খাইবার গরজে শরীক হইলে কাহারও কোরবানী হইবে না। (১২) কোরবানীর গরু-মহিষে আকীকার শরীক করা জায়েয। (১৩) মালদার ব্যক্তির পক্ষে পশু খরিদ করার পর উহাতে অন্যকে শরীক করা জায়েয। কিন্তু গরীব ব্যক্তি পশু খরিদ করার সময়ে পরে শরীক পাইলে শরীক করিবে নিয়ত করিলে শরীক করা জায়েয, অন্যথায় নহে। (১৪) যেসকল পশুর হাড়ের মজ্জা শুকাইয়া গিয়াছে বা যেসকল পশু দুর্বলতার কারণে বা পা নষ্ট হওয়ার কারণে কোরবানীর স্থান পর্যন্ত যাইতে অক্ষম, উহাদের দ্বারা কোরবানী জায়েয নহে। (১৫) যে পশুর দৃষ্টিশক্তির তিন ভাগের এক ভাগ নষ্ট হইয়া গিয়াছে অথবা কান বা লেজের এক তৃতীয়াংশ কাটা গিয়াছে, তাহা দ্বারা কোরবানী হইবে না। (১৬) শিংয়ের গোড়া দিয়া ভাঙ্গিয়া গেলে এবং মগজে ক্ষতি পৌঁছিলে অথবা দাঁত মোটেই না উঠিলে বা আধাআধি দাঁত পড়িয়া গেলে উহা দ্বারা কোরবানী জায়েয নহে। (১৭) কান একেবারে না জন্মাইলে কোরবানী হইবে না, কিন্তু শিং না জন্মাইলেও কোরবানী হইবে। (১৮) গাভীন বলিয়া পরিচিত হইলেও উহার কোরবানী জায়েয। অবশ্য বাচ্চাটি জীবিত পাওয়া গেলে উহাকেও আল্লাহর নামে যবাহ্ করিয়া দিবে। (১৯) খরিদ করার পর পশুতে এমন কোন দোষ জন্মিলে, যাহাতে কোরবানী হয় না, মালদারের পক্ষে উহা দ্বারা কোরবানী জায়েয নহে, গরীবের পক্ষে জায়েয। (২০) কোরবানীর পশু হারাইয়া যাওয়ায় এবং অন্যটি দ্বারা কোরবানী করার পর উহা পাওয়া গেলে গরীব উহা অবশ্যই কোরবানী করিবে। মালদার অপর কাজে লাগাইতে পারিবে। (২১) কোরবানীর পশুকে খুব যত্নে রাখিবে এবং ঘাস-পানি খাওয়াইয়া কৌরবানী করিবে। (২২) ঠিক যেখানে যবাহ্ করিবে সেখানেই শোয়াইবে এবং তখনই যবাহ্ করিবে, কষ্ট দিবে না। (২৩) খুব ধারাল অস্ত্র দ্বারা যবাহ্ করিবে। ভোঁতা অস্ত্রে যবাহ করা নিষেধ। (২৪) কোরবানীর পশু নিজ হাতে যবাহ্ করা অথবা যবাহ্ করিতে নিজে সামনে থাকা মোস্তাহাব। (২৫) কোরবানীর গোশত তিন ভাগ করিয়া এক ভাগ নিজেরা খাওয়া, এক ভাগ আত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করা এবং এক ভাগ গরীবদিগকে দান করা মোস্তাহাব। (২৬) মৃত ব্যক্তির পক্ষে কোরবানী করিলে ঐ গোশত নিজেরা খাইতে পারে। কিন্তু মৃত ব্যক্তি কোরবানীর জন্য ওসিয়ত করিয়া গেলে ঐ গোশত দান করা ওয়াজিব। (২৭) ঈদের সকালে কিছু না খাইয়া কোরবানীর গোশত দ্বারা প্রথমে খাওয়া আরম্ভ করা মোস্তাহাব। (২৮) চামড়া বিক্রির পর উহার পয়সা গরীবকে দেওয়া ওয়াজিব। যে পয়সা পাওয়া যায় হুবহু তাহাই দেওয়া উচিত, বদলান ভাল নহে। (২৯) কোরাবানীর চামড়ার পয়সা মালদারকে দেওয়া বা সরাসরি উহা মসজিদ বা মাদ্রাসায় খরচ করা জায়েয নহে। (৩০) কোর বানীর গোশত বা চামড়া অথবা চামড়ার পয়সা যবাহ্ করানের বা গোশত কাটানের উজরতরূপে দেওয়া জায়েয নহে। (হেদায়া, আলমগীরী ও শামী হইতে গৃহীত।) — অনুবাদক
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান