আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৯- নবীজী সাঃ ও সাহাবা রাঃ ; মর্যাদা ও বিবিধ ফাযায়েল

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৯১৩
২১৫৪. নবী কারীম (ﷺ) এবং সাহাবীদের মদীনা হিজরত।
৩৬৩২। মুহাম্মাদ ইবনে কাসীর ও মুসাদ্দাদ (রাহঃ) .... খাব্বাব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর সাথে হিজরত করেছি একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। আমাদের প্রতিদান আল্লাহর নিকটই নির্ধারিত। আমাদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের ত্যাগ ও কুরবানীর ফল কিছুই ইহজগতে ভোগ না করে আখিরাতে চলে গিয়েছেন; তন্মধ্যে মুসহাব ইবনে উমায়ের (রাযিঃ) অন্যতম। তিনি ওহুদ যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁকে কাফন দেয়ার জন্য তার একটি চাঁদর ব্যতীত আর অন্য কিছুই আমরা পাচ্ছিলাম না। আমরা চাঁদরটি দিয়ে তাঁর মাথা আবৃত করলাম তাঁর পা বের হয়ে গেল আর যখন আমরা তাঁর পা ঢাকতে গেলাম তখন তাঁর মাথা বের হয়ে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের আদেশ করলেন, চাঁদরটি দিয়ে তাঁর মাথা ঢেকে দাও এবং পা দু’টির উপর ইযখির ঘাস রেখে দাও। আর আমাদের মধ্যে রয়েছেন যাদের ফল পেকে গেছে এবং এখন তাঁরা তা আহরণ করছেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছের বর্ণনায় হযরত খাব্বাব রাযি. তাঁর ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের ইহজীবন যাপনের একটা চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে যেমন নিজ অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তেমনি তাঁর দৃষ্টিতে যারা দুনিয়া বিমুখতায় তারচে' এগিয়ে ছিলেন তাদের কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন
هاجرنا مع رسول الله ﷺ (আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে হিজরত করেছি)। এর অর্থ একইসঙ্গে হিজরত করা নয়। কেননা খাব্বাব রাযি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সফরসঙ্গী হয়ে হিজরত করেননি। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, ও আমির ইবন ফুহায়রা রাযি। বরং এর অর্থ তাঁর হুকুমে ও তাঁর অনুমতিক্রমে হিজরত করেছি। অথবা হিজরতের হুকুম পালনে আমরা তাঁর সঙ্গে ছিলাম। তিনি যেমন হিজরত করেছিলেন, তেমনি আমরাও হিজরত করেছি।

نلتمس وجه الله تعالى (আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে)। অর্থাৎ তাঁর কাছে প্রতিদান পাওয়ার উদ্দেশ্যে হিজরত করেছি। পার্থিব কোনও স্বার্থে নয়।

فوقع أجرنا على الله (এর জন্য আল্লাহর কাছে আমাদের প্রতিদান সাব্যস্ত হয়েছে)। على الله -এর অর্থ আল্লাহর জন্য ওয়াজিব ও আবশ্যিক হয়ে গেছে। এক বর্ণনায় স্পষ্টভাবেই ‘ওয়াজিব' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এ দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য — সাব্যস্ত হওয়া এবং নিশ্চিতভাবেই যে প্রতিদান পাওয়া যাবে সে কথা বোঝানো। কেননা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে প্রতিদান দেওয়ার ওয়াদা আছে। তিনি তাঁর ওয়াদার বরখেলাফ করেন না। সেই হিসেবে এটা অবশ্যই ঘটবে। নয়তো সাধারণভাবে ওয়াজিব বলতে যা বোঝায় যে, তা পালন না করা অন্যায় এবং পালন না করলে জবাবদিহিতা থাকে, আল্লাহ তা'আলার ক্ষেত্রে সেরকম ওয়াজিব বলতে কিছু নেই।

فمنا من مات ولم يأكل من أجره شيئا (তারপর আমাদের মধ্যে কেউ এ অবস্থায় মারা গেছেন যে, তিনি এর প্রতিদান থেকে কিছুমাত্র ভোগ করেননি)। প্রশ্ন হয়, তারা হিজরত যেহেতু আখিরাতের প্রতিদান পাওয়ার উদ্দেশ্যে করেছিলেন, তাই দুনিয়ায় প্রতিদান পাওয়ার তো কোনও প্রশ্নই আসে না, তা সত্ত্বেও এ কথা কেন বলছেন যে, প্রতিদান থেকে (দুনিয়ায়) কিছু ভোগ করেননি? ইমাম ইবনে হাজার রহ. এর উত্তর দিয়েছেন এভাবে যে, পার্থিব প্রতিদানের কথাটি আখিরাতের প্রতিদানের বিপরীতে রূপকার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বস্তুত তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আখিরাতের প্রতিদানই। তারপরও পার্থিব সুফল পাওয়া ও না পাওয়া হিসেবে মুহাজির সাহাবীদের অবস্থা ছিল চার রকম।

এক. তাদের মধ্যে কেউ কেউ পার্থিব সচ্ছলতা শুরুর আগেই ইন্তিকাল করেছেন, যেমন হযরত মুস'আব ইবন উমায়র রাযি.।

দুই. যারা সচ্ছলতা শুরুর পরও জীবিত ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ তো এমন ছিলেন, যারা অর্থ-সম্পদ পাশ কাটিয়ে চলেছেন এবং আগের অভাব-অনটনের অবস্থায়ই থেকে গিয়েছিলেন, যেমন হযরত আবু যার রাযি।

তিন. তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুবাহ ও বৈধ বিষয়াবলী থেকে কিছু কিছু গ্রহণ করে নিয়েছিলেন, যেমন একাধিক বিবাহ, দাস-দাসী, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি। তবে এসব যে তারা খুব বেশি পরিমাণ ভোগ করেছিলেন তা নয়। হাঁ, তাদের পূর্বাবস্থা অপেক্ষা পরবর্তী অবস্থা কিছুটা সচ্ছল ও ভালো হয়েছিল। এরকম মুহাজির সাহাবীদের সংখ্যা ছিল অনেক। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. তাদের একজন।

চার. অনেক মুহাজির সাহাবী গনিমতের মাল বা ব্যবসা-বাণিজ্যসূত্রে প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য তারা সে অর্থ-সম্পদের হকসমূহও আদায় করতেন (যাকাত দিতেন এবং প্রচুর দান-খয়রাত করতেন)।

হযরত খাব্বাব রাযি. শেষোক্ত দুই শ্রেণীর প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ আখিরাতে তাদের প্রতিদান পুরোপুরিই পাবেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী সম্পর্কে বলা যায় যে, দুনিয়ায় তারা যা-কিছু পেয়েছিলেন তা তাদের আখিরাতের প্রতিদান থেকে হিসাব করে নেওয়া হবে। অর্থাৎ আখিরাতে তারা সে পরিমাণ কম পাবেন। কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা এর প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন এক হাদীছে আছে
ما من غازية تغزو في سبيل الله فيصيبون الغنيمة، إلا تعجلوا ثلثي أجرهم من الآخرة، ويبقى لهم الثلث، وإن لم يصيبوا غنيمة، تم لهم أجرهم
যেসকল মুজাহিদ আল্লাহর পথে অভিযান চালায় এবং তাতে তারা গনিমত লাভ করে, তারা তাদের আখিরাতের প্রতিদান থেকে দুই-তৃতীয়াংশ নগদ পেয়ে যায়। তাদের এক-তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে। আর যদি কোনও গনিমত না পায়, তবে তাদের প্রতিদান পরিপূর্ণরূপে থেকে যায়।

এ কারণেই সাহাবা-তাবি'ঈনের মধ্যে অনেকেই অল্প মালকে প্রাধান্য দিতেন ও তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন, যাতে তারা আখিরাতে তাদের ছাওয়ার পরিপূর্ণরূপে পান অথবা আখিরাতে তাদের হিসাব-নিকাশ আসান হয়।

منهم : مصعب بن عمير رضي الله عنه (তাদের মধ্যে একজন হলেন মুস'আব ইবন উমায়র)। হযরত মুসআব ইবন উমায়র রাযি. ছিলেন শুরুর দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন। মদীনা মুনাউওয়ারায় তিনি সবার আগে হিজরত করেন। প্রথম আকাবার বায়'আতে যে সকল আনসার সাহাবী অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদেরকে কুরআন ও দীন শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুস'আব রাযি.-কে তাদের সঙ্গে মদীনায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

হযরত মুস'আব রাযি, ছিলেন কুরায়শদের একজন বিত্তবান যুবক। বিলাসবহুল জীবন তিনি যাপন করতেন। কিন্তু হিজরতের পর তিনি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতে থাকেন। হযরত আলী রাযি. বলেন, একদিন আমরা মসজিদে নববীতে বসা। এ অবস্থায় মুস'আব ইবন উমায়র রাযি. মসজিদে প্রবেশ করেন। তখন তাঁর শরীরে একটা মাত্র কাপড়। তাও চামড়া দিয়ে তালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখেই কেঁদে দেন। কেমন ছিল তাঁর বিগত জীবনের প্রাচুর্য, আর আজ তার কী অবস্থা!

قتل يوم أحد (তিনি উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন)। এ যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পতাকাবাহী ছিলেন। হাদীছে এর পর জানানো হয়েছে যে, তিনি একটি পশমের চাদর রেখে যান। তাঁর আর কোনও কাপড় ছিল না। সে চাদরটি দ্বারাই তাঁর কাফন দেওয়া হয়। কিন্তু চাদরটি এত ছোট ছিল যে, সেটি দ্বারা তার মাথা ঢাকা হলে তার পা দু'টি বের হয়ে যেত। আর তার পা ঢাকা হলে মাথা বের হয়ে যেত। শেষপর্যন্ত সেটি দ্বারা তার মাথা ঢেকে দেওয়া হয় আর পায়ের উপর কিছু ইযখির ঘাস রেখে দেওয়া হয়।

ومنا من اينعت له ثمرته فهو يهدبها (আমাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন, যার ফল পেকে গেছে এবং তিনি তা ভোগ করছেন)। অর্থাৎ দুনিয়ার প্রাচুর্য তাদের সামনে পুরোপুরি খুলে গেছে এবং তারা ভালোভাবে তা ভোগ করতে পারছেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা নিজেদের অবস্থা বর্ণনায় সাহাবায়ে কেরামের সততা ও সরলতার পরিচয় পাওয়া যায়।

খ. দারিদ্র্য ও অন্যান্য কষ্ট-ক্লেশে ধৈর্যধারণ করে যাওয়া এ উম্মতের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিশেষত্ব।

গ. সাহাবায়ে কেরামের হিজরত ও অন্যান্য সব আমলই ছিল কেবলই আল্লাহ তা'আলার জন্য, পার্থিব কোনও উদ্দেশ্যে নয়।

ঘ. এ হাদীছ দ্বারা এ মাসআলাও জানা যায় যে, মৃত ব্যক্তির গোটা শরীর সতর। কাফন দ্বারা সমস্ত শরীরই ঢাকতে হয়।

ঙ. যেসকল মুমিন পার্থিব কোনও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতে পায় না এবং তাতে ধৈর্যধারণ করে, আখিরাতে তাদের ছাওয়াব ও প্রতিদান পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে যেসকল মুমিন দুনিয়ায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে থাকে, তাদেরকে তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অনুপাতে আখিরাতের প্রতিদান কমও দেওয়া হতে পারে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন