মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৫- নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ৯৬৫
১৮. প্রথম অনুচ্ছেদ - সালাতের পর যিকর-আযকার
৯৬৫। হযরত আবু হুরায়রাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একদা নিঃস্ব মুহাজিরগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ) ! সম্পদশালীরাই বেশী বেশী সওয়াব এবং স্থায়ী নিয়ামতসমূহের অধিকারী হল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, এ কি কথা বললে? তাঁরা বললেন, সম্পদশালী লোকগণও নামায পড়ে। যেমন আমরাও পড়ি। আমাদের রোযার ন্যায় তারাও রোযা রাখে কিন্তু তারা দান খয়রাত করে আর আমরা তা করতে পারি না। তারা দাস-দাসী মুক্ত করে কিন্তু আমরা তা করতে পারি না। তাদের কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এরূপ একটি বিষয় শিখিয়ে দিব না, যার মাধ্যমে তোমরা তোমাদের চেয়ে অগ্রবর্তীদের মর্যাদা লাভ করতে পারবে? আর তোমাদের তুলনায় কেউ শ্রেষ্ঠ হতে পারবে না? অবশ্য তোমাদের মত যদি তারাও তা করে সেকথা স্বতন্ত্র। তারা বললেন, হ্যাঁ। আমাদেরকে শিখিয়ে দিন ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমরা প্রত্যেক নামাযের পর তেত্রিশবার করে সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ পাঠ করবে।
বর্ণনাকারী আবু ছালেহ বলেন, অতঃপর আবার নিঃস্ব মুহাজিরগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ) ! (আপনি আমাদেরকে যে কথা শিখিয়ে দিয়েছেন) তা আমাদের ভাইগণও শুনে তদ্রূপ আমল করছে। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, এটা হল আল্লাহর দান। (এতে কারো কিছু করবার নেই।) —বুখারী, মুসলিম
কিন্তু আবু ছালেহ হতে পরবর্তী কথাগুলো শুধু মুসলিমই রেওয়ায়াত করেছেন, আর বুখারীর অপর বর্ণনায় তেত্রিশবারের স্থলে দশবার সুবহানাল্লাহ, দশবার আলহামদুলিল্লাহ এবং দশবার আল্লাহু আকবার বলার কথা রয়েছে।
بَابُ الذِّكْرِ بَعْدَ الصَّلَاةِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: (إِنَّ فُقَرَاءَ الْمُهَاجِرِينَ أَتَوْا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالُوا: قَدْ ذَهَبَ أَهْلُ الدُّثُورِ بِالدَّرَجَاتِ الْعُلَى وَالنَّعِيمِ الْمُقِيمِ فَقَالَ وَمَا ذَاكَ قَالُوا يُصَلُّونَ كَمَا نُصَلِّي وَيَصُومُونَ كَمَا نَصُومُ وَيَتَصَدَّقُونَ وَلَا نَتَصَدَّقُ وَيُعْتِقُونَ وَلَا نُعْتِقُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَفَلَا أُعَلِّمُكُمْ شَيْئًا تُدْرِكُونَ بِهِ مَنْ سَبَقَكُمْ وَتَسْبِقُونَ بِهِ مَنْ بَعْدَكُمْ وَلَا يَكُونُ أَحَدٌ أَفْضَلَ مِنْكُمْ إِلَّا مَنْ صَنَعَ مِثْلَ مَا صَنَعْتُمْ» قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ: «تُسَبِّحُونَ وَتُكَبِّرُونَ وَتَحْمَدُونَ دُبُرَ كُلِّ صَلَاةٍ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ مَرَّةً» . قَالَ أَبُو صَالِحٍ: فَرَجَعَ فُقَرَاءُ الْمُهَاجِرِينَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالُوا سَمِعَ إِخْوَانُنَا أَهْلُ الْأَمْوَالِ بِمَا فَعَلْنَا فَفَعَلُوا مِثْلَهُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «ذَلِك فضل الله يؤته من يَشَاء» . وَلَيْسَ قَوْلُ أَبِي صَالِحٍ إِلَى آخِرِهِ إِلَّا عِنْدَ مُسْلِمٍ وَفِي رِوَايَةٍ لِلْبُخَارِيِّ: «تُسَبِّحُونَ فِي دُبُرَ كُلِّ صَلَاةٍ عَشْرًا وَتَحْمَدُونَ عَشْرًا وَتُكَبِّرُونَ عشرا» . بدل ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

সাহাবায়ে কেরামের জীবনদৃষ্টি ছিল আখিরাতমুখী। আখিরাতের নাজাত লাভই ছিল তাদের মূল লক্ষ্যবস্তু। তাই বেশি বেশি ছাওয়াব হাসিল করার প্রতি তাদের আগ্রহ ছিল অদম্য। যেসব কাজে বেশি বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়, পূর্ণ আগ্রহের সঙ্গে তারা তা করতেন। করতে না পারলে তাদের খুব আক্ষেপ হতো।

দান-খয়রাত করলে খুব বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়। অনেক সাহাবী ছিলেন খুব গরীব। তাদের পক্ষে ধনীদের মতো দান-খয়রাত করা সম্ভব হতো না। তাই এ উপায়ে ছাওয়াব হাসিলের ক্ষেত্রে তারা পেছনে ছিলেন। এজন্য তাদের আক্ষেপ ছিল। একদল গরীব মুহাজির সে আক্ষেপ নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন। তারা বললেন-
ذَهَبَ أَهْلُ الدُّثُوْرِ بِالدَّرَجَاتِ الْعُلَى، وَالنَّعِيمِ الْمُقِيمِ (সম্পদশালীগণ উচ্চমর্যাদা ও স্থায়ী নি‘আমত নিয়ে গেল)। এটা আক্ষেপের ভাষা। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যলাভের যে উচ্চতর স্থান এবং জান্নাতের যে অনন্ত ও অফুরন্ত নি'আমত, তা তো ধনীরা নিয়ে গেল; আমরা নিতে পারলাম না! তাদের দৃষ্টি আখিরাতের দিকে। ধনীগণ তাদের ধন-দৌলত দ্বারা দুনিয়ায় মানুষের কাছে যে ইজ্জত-সম্মান পায় সেদিকে তাদের কোনও দৃষ্টি নেই। তারা যে আরাম-আয়েশে থাকে, সহজে সুখের সামগ্রী অর্জন করতে পারে, সেজন্যও তারা লালায়িত নন। তারা ধন-সম্পদ সঞ্চয় করতে পারে কিন্তু আমরা পারি না, এ কারণে ধনীদের প্রতি তাদের কোনও হিংসা নেই। তাদের লক্ষ্যবস্তু কেবল আখিরাত। দৃষ্টি কেবলই আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও জান্নাতের অফুরন্ত নি'আমতের দিকে। সে ক্ষেত্রে তারা যে ধনীদের থেকে পেছনে পড়ে গেল! তাদের সে আক্ষেপের ছবি অপর এক আয়াতে এভাবে আঁকা হয়েছে-
وَلَا عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُوا مَا يُنْفِقُونَ (92)
‘সেইসকল লোকেরও (কোনও গুনাহ) নেই, যাদের অবস্থা এই যে, তুমি তাদের (যুদ্ধে যাওয়ার) জন্য কোনও বাহনের ব্যবস্থা করবে, যখন এই আশায় তারা তোমার কাছে আসল আর তুমি বললে, আমার কাছে তো তোমাদেরকে দেওয়ার মতো কোনও বাহন নেই, তখন তাদের কাছে খরচ করার মতো কিছু না থাকার দুঃখে তারা এভাবে ফিরে গেল যে, তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৯২)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বললেন- يُصَلُّوْنَ كَمَا نُصَلِّي، وَيَصُوْمُوْنَ كَمَا نَصُوْمُ ، وَيَتَصَدَّقُوْنَ وَلَا نَتَصَدَّقُ، وَيَعْتِقُوْنَ وَلَا نَعْتِقُ (তারা নামায পড়ে, যেমন আমরা নামায পড়ি। তারা রোযা রাখে, যেমন আমরা রোযা রাখি। তারা দান-খয়রাত করে, অথচ আমরা দান-খয়রাত করতে পারি না। তারা গোলাম আযাদ করে, অথচ আমরা আযাদ করতে পারি না)। অর্থাৎ ছাওয়াবের কাজ দু'রকম। কিছু আছে সকলের জন্য সাধারণ, যা ধনী-গরীব সকলেই করতে পারে। যেমন নামায ও রোযা। আবার কিছু আছে এমন, যা কেবল ধনীরাই করতে পারে। যেমন দান-খয়রাত করা, গোলাম আযাদ করা ইত্যাদি। আমরা গরীব হওয়ায় এসব করতে পারি না। ফলে এসব করার মাধ্যমে ধনীগণ আল্লাহ তা'আলার যে নৈকট্য অর্জন করতে পারে এবং জান্নাতের স্থায়ী যেসকল নি'আমত তাদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব, আমাদের পক্ষে তা কীভাবে সম্ভব? সুতরাং আমরা তো এ ক্ষেত্রে তাদের থেকে পেছনে থেকে যাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
أَفَلا أعَلِّمُكُمْ شَيْئًا تُدْرِكُوْنَ بِهِ مَنْ سَبَقَكُمْ، وَتَسْبِقُوْنَ بِهِ مَنْ بَعْدَكُمْ؟ (তোমাদের এমন একটা বিষয় শেখাব না, যা দ্বারা তোমরা তাদের ধরতে পারবে, যারা তোমাদের অগ্রগামী হয়ে গেছে এবং যারা তোমাদের পরের, তোমরা তাদের অগ্রগামী থাকতে পারবে)? অর্থাৎ ধনীগণ আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ খরচ করার দ্বারা তোমাদের পেছনে ফেলে সামনে চলে গেছে বলে তোমরা আক্ষেপ করো না। এমন মর্যাদাপূর্ণ কাজও আছে, যা করলে তোমরা তাদের ধরে ফেলতে পারবে। আবার তা দ্বারা তোমরা এতদূর পৌঁছে যেতে পারবে যে, যারা তোমাদের পেছনে আছে তারা তোমাদের ধরতে পারবে না। ফলে আল্লাহর কাছে মর্যাদায় তোমাদের উপরে কেউ থাকবে না। হাঁ, এটা ভিন্ন কথা যে, সে কাজ যদি তোমাদের মতো অন্য কেউও করে, তবে তারা তোমাদের সমমর্যাদার অধিকারী হবে।

এ কথা শুনে সেই গরীব মুহাজিরগণ খুব আশান্বিত হলেন। তারা সে আমল সম্পর্কে জানার আগ্রহ ব্যক্ত করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
تُسَبِّحُونَ، وَتُكَبِّرُونَ، وَتَحْمَدُونَ، دُبُرَ كُلِّ صَلَاةٍ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ مَرَّةً (তোমরা প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার করে সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ বলবে)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার এ যিকির এত মর্যাদাপূর্ণ আমল যে, এর মাধ্যমে তোমরা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যলাভের ক্ষেত্রে বিত্তবান দানশীলদেরও ছাড়িয়ে যেতে পারবে। অর্থাৎ এটা আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করার উত্তম বিকল্প। কোনও কোনও হাদীছে এসব যিকিরকে সরাসরি দান-খয়রাত (সদাকা) নামেও অভিহিত করা হয়েছে। এক হাদীছে আছে-
يُصْبِحُ عَلَى كُلِّ سُلَامَى مِنْ أَحَدِكُمْ صَدَقَةٌ: فَكُلُّ تَسْبِيحَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ تَحْمِيدَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ تَهْلِيلَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ تَكْبِيرَةٍ صَدَقَةٌ، وَأَمْرٌ بِالْمَعْرُوْفِ صَدَقَةٌ وَنَهْيٌ عَنِ الْمُنكَرِ صَدَقَةٌ، وَيُجْزِي مِنْ ذَلِكَ رَكْعَتَانِ يَرْكَعُهُمَا مِنَ الضُّحَى
‘প্রতিদিন ভোরে তোমাদের শরীরের প্রতিটি জোড়ার বিনিময়ে সদাকা আবশ্যিক হয়ে যায়। তো প্রতিটি তাসবীহ একটি সদাকা; প্রতিটি তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ বলা) একটি সদাকা; প্রতিটি তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা) একটি সদাকা; প্রতিটি তাকবীর একটি সদাকা; একবার সৎকাজের আদেশ করা একটি সদাকা; একবার অসৎকাজে নিষেধ করা একটি সদাকা। আর এ সমুদয়ের পরিবর্তে চাশতের দু' রাক'আত নামায পড়াই যথেষ্ট হয়ে যায়।(সহীহ মুসলিম: ৭২০: সুনানে আবূ দাউদ: ১২৮৫; মুসনাদে আহমাদ: ২১৪৭৪; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৪৮৯৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১০০৭)

এর দ্বারা বোঝা যায়, দান-খয়রাত অপেক্ষা আল্লাহ তা'আলার যিকিরের ফযীলত বেশি এবং যিকিরই শ্রেষ্ঠতম আমল। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ
‘আর আল্লাহর যিকিরই তো সর্বাপেক্ষা বড় জিনিস।(সূরা আনকাবুত (২৯), আয়াত ৪৫)

হযরত আবুদ দারদা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرِ أَعْمَالِكُمْ، وَأَزْكَاهَا عِنْدَ مَلِيْكِكُمْ، وَأَرْفَعِهَا فِي دَرَجَاتِكُمْ وَخَيْرٌ لَكُمْ مِنْ إِنْفَاقِ الذَّهَبِ وَالْوَرِقِ، وَخَيْرٌ لَكُمْ مِنْ أَنْ تَلْقَوْا عَدُوَّكُمْ فَتَضْرِبُوا أَعْنَاقَهُمْ وَيَضْرِبُوا أَعْنَاقَكُمْ؟ قَالُوْا : بَلَى قَالَ: ذِكْرُ اللَّهِ تَعَالَى
আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব না এমন আমল সম্পর্কে, যা তোমাদের যাবতীয় আমলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তোমাদের মালিক আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি পবিত্র, তোমাদের মর্যাদার পক্ষে সর্বাপেক্ষা বেশি উঁচু, (আল্লাহর পথে) সোনা-রুপা খরচ করার চেয়েও উত্তম এবং তোমাদের পক্ষে এরচে'ও বেশি কল্যাণকর যে, তোমরা তোমাদের শত্রুর মুখোমুখি হবে আর তোমরা তাদের হত্যা করবে, তারাও তোমাদের হত্যা করবে? সাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই বলে দিন ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আল্লাহ তা'আলার যিকির।(জামে' তিরমিযী: ৩৩৭৭: সুনানে ইবন মাজাহ ৩৭৯০; মুআত্তা মালিক: ৭১৬; হাকিম, আল-মুসতাদরাক: ১৮২৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১২৪৪)

সাহাবীগণ এ শিক্ষা নিয়ে খুশিমনে ফিরে গেলেন। তাঁরা আমল করতে শুরু করে দিলেন। প্রত্যেক ফরয নামাযের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার ও ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ পড়তে থাকলেন। প্রতি ফরয নামাযের পর বসে বসে এসব যিকির করতে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চোখে পড়ার কথা। তা পড়লও। যেসকল সাহাবী সচ্ছল ছিলেন তাঁরাও জানতে পারলেন যে, গরীব সাহাবীগণ প্রত্যেক ফরয নামাযের পর এসব যিকির করে বিপুল ছাওয়াব অর্জন করে নিচ্ছে। তাঁরাও তো ছাওয়াবের জন্য লালায়িত ছিলেন। সুতরাং তাঁরাও একই আমল শুরু করে দিলেন। তাদের দান-খয়রাত করার আলাদা ছাওয়াব তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে যিকির করার ছাওয়াবও অর্জন করে নিচ্ছে। ফলে আগের মতোই তাঁরা এ ক্ষেত্রে অগ্রগামীই থাকলেন। এ অবস্থা দেখে সেই গরীব সাহাবীগণের আবারও দুঃখ লাগল। কারণ ছাওয়াব অর্জনে তারা তো পেছনেই রয়ে গেলেন। সুতরাং তারা ফের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে আসলেন এবং আগের মতো সেই একই অভিযোগ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
ذلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيْهِ مَنْ يَشَاءُ (এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে চান তাকে দান করেন)। অর্থাৎ উচ্চমর্যাদার বিষয়টা আল্লাহ তা'আলার অনুগ্রহ। এটা আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে দান করেছেন। তারা দৈহিক ইবাদত-বন্দেগী করার মাধ্যমে যেমন সকলের সমান ছাওয়াব অর্জন করতে পারছেন, তেমনি আর্থিক ইবাদতের মাধ্যমেও তা হাসিল করতে সক্ষম হচ্ছেন। উভয় প্রকার ছাওয়াব অর্জনের মাধ্যমে তারা অন্যদের তুলনায় অর্থাৎ যারা কেবল দৈহিক ইবাদত করতে পারছে, আর্থিক ইবাদত নয়, তাদের তুলনায় অধিকতর উচ্চতায় পৌছাতে পারছেন। এটা তাদের প্রতি আল্লাহ তা'আলার বিশেষ অনুগ্রহ। আল্লাহ তা'আলা নিজ অনুগ্রহ কারও প্রতি অন্যদের তুলনায় বেশি করতেই পারেন। এতে কারও আপত্তির কোনও সুযোগ নেই। মানুষের বেলায়ও এটাই নিয়ম। অধিকার মেটানোতে সমতা রক্ষা জরুরি। দয়া ও অনুগ্রহের ক্ষেত্রে তা জরুরি নয়।

হাদীছটি দ্বারা কৃতজ্ঞ বিত্তবানদের বিশেষ ফযীলত জানা গেল। অর্থাৎ যেসকল সম্পদশালী ব্যক্তি দৈহিক ইবাদত-বন্দেগীর পাশাপাশি নিজেদের ধন-সম্পদ থেকে আল্লাহ ও বান্দার হক আদায় করে এবং অকৃপণভাবে মানবকল্যাণ ও দীনের পথে খরচ করে, অন্যদের তুলনায় তাদের মর্যাদা উপরে। তবে এদের সংখ্যা বড় কম। ধন-সম্পদ বড় লোভের জিনিস। সে লোভ কাটিয়ে আল্লাহর পথে খরচ করা সহজ নয়। বেশিরভাগ লোকই তাতে ব্যর্থ হয়। বাড়তি দান-খয়রাত দূরের কথা, হয়তো সঠিকভাবে যাকাতও আদায় করে না। তাছাড়া মালের আরও যত হক আছে, তা আদায়েও গড়িমসি করে। ফলে সম্পদ তাদের পক্ষে মসিবতের কারণ হয়ে যায়। তাই আমাদের পক্ষে উত্তম হল আল্লাহ তা'আলা যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থেকে যতদূর সম্ভব তার সদ্ব্যবহার করা। সদ্ব্যবহার হল বৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ বৈধ খাতে খরচ করা এবং আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতা পরিহার করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ করা। আল্লাহ তা'আলা বান্দার অন্তর ও নিয়ত দেখেন। অল্প সম্পদ থেকে খাঁটি নিয়তে অল্প খরচ করেও বিপুল ছাওয়াব অর্জন করা সম্ভব। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ ও সঠিক আমলের তাওফীক দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আখিরাতের নি'আমত ও মর্যাদালাভের প্রতি সাহাবীদের বিপুল আগ্রহ ছিল।

খ. আখিরাতের নি'আমত ও মর্যাদাই মানুষের জন্য আসল কাম্যবস্তু।

গ. আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ খরচ করার দ্বারা আখিরাতের উচ্চমর্যাদা লাভ হয়।

ঘ. উদ্বৃত্ত সম্পদ বিলাসিতায় খরচ না করে নেককাজে খরচ করা উচিত।

ঙ. প্রত্যেক ফরয নামাযের পর ৩৩ বার করে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ও আল্লাহ আকবার পড়া চাই।

চ. আল্লাহ তা'আলার যিকির সর্বশ্রেষ্ঠ আমল।

ছ. দান-খয়রাত করার কাজে সন্তুষ্ট থেকে আল্লাহ তা'আলার যিকিরের প্রতি উদাসীনতা দেখাতে নেই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)