আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪৯- নবীজী সাঃ ও সাহাবা রাঃ ; মর্যাদা ও বিবিধ ফাযায়েল
৩৫৬৪। ইসমাঈল (রাহঃ) .... আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু বকর (রাযিঃ)- এর একজন ক্রীতদাস ছিল। সে প্রত্যহ তার উপর নির্ধারিত কর আদায় করত। আর আাবূ বকর (রাযিঃ) তার দেওয়া কর থেকে আহার করতেন। একদিন সে কিছু খাবার জিনিস এনে দিল। তা থেকে তিনি আহার করলেন। তারপর গোলাম বলল, আপনি জানেন কি উহা কিভাবে উপার্জন করা হয়েছে যা আপনি খেয়েছেন? তিনি বললেন, বলত ইহা কি? গোলাম উত্তরে বলল, আমি জাহিলী যুগে এক ব্যক্তির ভবিষ্যৎ গণনা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ভবিষ্যৎ গণনা করা আমার উত্তমরূপে জানাছিল না। তথাপি প্রতারণামূলকভাবে ইহা করেছিলাম। (কিন্তু ভাগ্যচক্রে আমার গণনা সঠিক হল।) আমার সাথে তার সাক্ষাত হলে গণনার বিনিময়ে এ দ্রব্যাদি সে আমাকে হাদীয়া দিল যা থেকে আপনি আহার করলেন। আবু বকর (রাযিঃ) ইহা শোনামাত্র মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বমি করে দিলেন এবং পাকস্থলীর মধ্যে যা কিছু ছিল সবই বের করে দিলেন।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এ হাদীছটিতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর যে গোলামের কথা বলা হয়েছে, ইবন হাজার আসকালানী রহ. তার সম্পর্কে বলেন যে, আমি তার নাম জানতে পারিনি। এখানে যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে, অনুরূপ এক ঘটনা নু‘আইমান ইবন আমরের সঙ্গেও হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর ঘটেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন স্বাধীন ব্যক্তি। তিনিও সাহাবী ছিলেন। ইমাম আব্দুর রাযযাক রহ. বর্ণনা করেন যে, একবার সাহাবীগণ একটি জলাশয়ের কাছে যাত্রাবিরতি দেন। তখন নু'আইমান রাযি. সেখানকার লোকজনকে বলছিলেন যে, এরূপ এরূপ ঘটবে। এর বিনিময়ে তারা তার কাছে খাদ্যশস্য নিয়ে আসত। তিনি তা সাহাবীদের দিতেন। বিষয়টা জানতে পেরে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. বললেন, আজ তো দেখছি আমি নু'আইমানের ওই উপার্জন থেকে খাচ্ছি, যা কিনা সে ভাগ্যগণনার বিনিময়ে অর্জন করছে। এই বলে তিনি গলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে বমি করে দেন। ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. ইবন সীরীন রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, আমার মতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ছাড়া আর কেউ খেয়ে ফেলা খাবার বমি করে ফেলে দেননি। একবার তাঁকে কিছু খাদ্য দেওয়া হলে তিনি তা খেয়ে ফেলেন। তারপর তাঁকে বলা হল, এ খাদ্য ইবনুন নু'আইমান নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে ইবনুন নু'আইমানের ভাগ্যগণনার উপার্জন খাওয়ালে! এই বলে তিনি বমি করে দিলেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর এ জাতীয় আরও ঘটনা বর্ণিত আছে। يُخْرِجُ لَهُ الْخَرَاجَ (সে তাঁকে নিজ উপার্জন থেকে নির্ধারিত পরিমাণ প্রদান করত)। الْخَرَاج অর্থ কর, নির্ধারিত প্রদেয়। এমনিভাবে গোলামের ওই প্রাত্যহিক প্রদেয়কেও الخراج বলা হয়, যা মনিবের পক্ষ থেকে তার উপর ধার্য করা হয়। নিজ আয় থেকে সে পরিমাণ মনিবকে প্রদান করার পর যা বেঁচে থাকে, তা গোলামের হয়ে যায়। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর গোলাম প্রতিদিন নিজ আয় থেকে সেই নির্ধারিত পরিমাণ তাঁকে প্রদান করত। তিনি তা ভোগ করতেন। এটা করা জায়েয। প্রকৃতপক্ষে গোলামের উপার্জনের সবটাই মনিবের হয়ে যায়। গোলামের নিজস্ব মালিকানা বলতে কিছু থাকে না। তার পানাহার ও পোশাক দেওয়া মনিবের দায়িত্ব। যাহোক, হাদীছে বর্ণিত এ গোলাম একদিন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে কিছু খাবার দিলে তিনি তা খেয়ে ফেলেন। তারপর গোলামটি জানায় যে, এ খাবার সে পেয়েছে ভাগ্যগণনার বিনিময়ে। জাহিলী যুগে সে এটা করত। কিন্তু নিজে এ কাজ ভালো জানত না। প্রকৃতপক্ষে সে ভাগ্যগণনার ছলে মানুষকে ধোঁকা দিত। এভাবে সে কোনও এক ব্যক্তির ভাগ্যগণনা করেছিল। সে ব্যক্তি কে ছিল, হাদীছটিতে তা উল্লেখ করা হয়নি। তা যেই হোক, ভাগ্যগণনার 'দর্শনি' বাকি রয়েছিল। এতদিনে সে এসে তা পরিশোধ করেছে। গোলাম সেটাই হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-কে খেতে দিয়েছে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সঙ্গে সঙ্গে তা বমি করে ফেলে দেন। তিনি তা ফেলে দেন এ কারণে যে, শরী'আতে ভাগ্যগণনা সম্পূর্ণ হারাম কাজ। এ কাজের কোনও বিনিময়গ্রহণ আদৌ জায়েয নয়। আবার এখানে সে এক নাজায়েযের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধোঁকা দেওয়ার অবৈধতা। কাজেই এরূপ অবৈধ উপায়ে উপার্জিত খাবার খাওয়ার কোনও বৈধতা থাকতে পারে না। তবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তা জেনেশুনে খাননি। খাওয়ার পর জেনেছেন। তাই প্রকৃতপক্ষে তাঁর দ্বারা কোনও নাজায়েয কাজ হয়নি। সুতরাং তাঁর গলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে এত কষ্ট করে বমি করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি তা করেছেন অধিকতর সতর্কতাবশত। এটা ছিল তাঁর উচ্চতর তাকওয়া-পরহেযগারী। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. ভাগ্যগণনার কোনও বাস্তবতা নেই। এটা করা সম্পূর্ণ নাজায়েয। এর মাধ্যমে উপার্জন করাও হারাম। খ. কাউকে ধোঁকা দেওয়া হারাম। ধোঁকা দিয়ে যা উপার্জন করা হয় তা ভোগ করা জায়েয নয়। গ. অজ্ঞতাবশত কোনও হারাম খাদ্য খেয়ে ফেললে অধিকতর সতর্কতাবশত তা বমি করে ফেলে দেওয়া উত্তম। ঘ. কষ্ট-ক্লেশের সঙ্গে হলেও নিজেকে হারাম বস্তুর স্পর্শ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা প্রকৃত তাকওয়া-পরহেযগারীর পরিচায়ক। ঙ. এ হাদীছটি দ্বারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর উচ্চতর তাকওয়ার পরিচয় পাওয়া যায়।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন