আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪৯- নবীজী সাঃ ও সাহাবা রাঃ ; মর্যাদা ও বিবিধ ফাযায়েল
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৮৪১
২১৩৬. জাহিলিয়্যাতের (ইসলাম পূর্ব) যুগ
৩৫৬৩। আবু নু‘য়াঈম (রাহঃ) .... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম (ﷺ) বলেছেন, সর্বাধিক সঠিক বাক্য যা কোন কবি বলেছেন তা হল লাবীদ এর এ পংক্তিটি- সাবধান, আল্লাহ্ ব্যতীত সকল জিনিসই বাতিল ও অসার। এবং কবি উমাইয়্যা ইবনে আবু সালত (তার কথাবার্তার মধ্য দিয়ে) ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছিল।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
কবিগণ সাধারণত কাল্পনিক কথাই বলে থাকে। তাদের অধিকাংশ কথাই বাস্তবসম্মত হয় না। তবে যাদের অন্তর ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত থাকে, এমন কবিগণ যা বলেন তা বাস্তবসম্মত হয়। তা থেকে ঈমানের আলো বিচ্ছুরিত হয়। যেসকল কবি ঈমান ও ইসলামের দাওয়াত পায়নি, তাদের মধ্যেও যারা অবিরত মিথ্যা ও ভ্রষ্টতার অনুগমন করে বুদ্ধি-বিবেচনা সম্পূর্ণ বিকৃত করে ফেলেনি। বরং কিছু না কিছু সত্যনিষ্ঠা তারা লালন করে, এমন অনেক কবিও সত্য ও সুন্দরের বন্দনা করে থাকে। তাদের বহু কবিতা সত্যানুসন্ধানীর অন্তর ছুঁয়ে যায়। তাই কবিতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হল ভালো কবিতা ভালো, মন্দ কবিতা মন্দ। অর্থাৎ যে কবিতার বিষয়বস্তু ইসলামী আকীদা বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা ও আখলাক চরিত্রের পরিপন্থী নয়, তা রচনা ও আবৃত্তি করা জায়েয। এর বিপরীত হলে তা জায়েয নয়।
জাহিলী যুগে যারা ভালো কবিতাও রচনা করেছেন, কবি লাবীদ রাযি.-ও তাদের একজন। এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর যে কবিতাংশের প্রশংসা করেছেন তা তাঁর ইসলামী জীবনের রচনা নয়। তিনি এটি রচনা করেছিলেন ইসলামগ্রহণের আগে। এটি তাঁর একটি মর্সিয়ার অংশ। হিরার বাদশা নু'মান ইবনুল মুনযিরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি এটি রচনা করেছিলেন। এটি দীর্ঘ সে শোকগাঁথার একটি পঙক্তি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পদ্ধতিটির প্রশংসায় বলেন-
أصدق كلمة قالها شاعر كلمة لبيد (কোনও কবি যা বলেছে তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা সত্য কথা হল লাবীদের কথা)। কোনও বর্ণনায় বহুবচনের সঙ্গে আছে ‘কবিগণ যা বলেছে'। কোনও বর্ণনায় আছে 'আরবগণ যা বলেছে। এক বর্ণনায় আছে, এতটুকু বললে সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, লাবীদ কী বলেছেন? উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পঙ্ক্তিটি উচ্চারণ করলেন-
الا كل شيء ما خلا الله باطل (জেনে রেখ, আল্লাহ ছাড়া সবকিছুই মিথ্যা)। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া যা-কিছু আছে তার কোনও স্থায়িত্ব নেই। সব মরণশীল ও ধ্বংসশীল। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে—
كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ
সবকিছুই ধ্বংসশীল, কেবল আল্লাহর সত্তাই ব্যতিক্রম।
হযরত লাবীদ রাযি.-এর কথাটি বাস্তবসম্মত। কুরআন মাজীদের এ আয়াতের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। তাই এটি সর্বাপেক্ষা সত্য কথা। তবে এর উপর প্রশ্ন আসে যে, তিনি আল্লাহ ছাড়া যে সবকিছুকে বাতিল সাব্যস্ত করেছেন তার মধ্যে তো ইবাদত বন্দেগী, জান্নাত-জাহান্নাম সবই এসে যায়, অথচ তা বাতিল নয়; বরং হক ও সত্য? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক দু'আয় আছে—
انت الحق ووعدك الحق، ولقاؤك حق، وقولك حق، والجنة حق، والنار حق والنبيون حق، ومحمد صلى الله عليه وسلم حق، والساعة حق،
'আপনি সত্য, আপনার ওয়াদা সত্য, আপনার সঙ্গে সাক্ষাত হওয়ার বিষয়টি সত্য, আপনার কথা সত্য, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, নবীগণ সত্য, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য এবং কিয়ামত সত্য।'
এর উত্তর হল, কবি 'আল্লাহ ছাড়া' বলতে আল্লাহ সম্পর্কিত বিষয়াবলী ছাড়া বুঝিয়েছেন। কাজেই আল্লাহর গুণাবলী, তাঁর রহমত ও আযাব, তাঁর ইবাদত-বন্দেগী, জান্নাত-জাহান্নাম প্রভৃতি বাতিলের আওতায় আসবে না। তা সবই হক ও সত্য। কবির মূল উদ্দেশ্য দুনিয়া ও দুনিয়াসংশ্লিষ্ট বিষয়াবলীর অস্থায়িত্ব ও নশ্বরতা বোঝানো।
এ শ্লোকটির দ্বিতীয় পঙক্তি হল- وكل نعيم لا محالة زائل (এবং সমস্ত নি'আমত অনিবার্যভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে)। এর দ্বারাও মূলত পার্থিব নি'আমত বোঝানো উদ্দেশ্য। দীনী ও পরকালীন নি'আমত বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। বাহ্যিকভাবে কথাটি যেহেতু ব্যাপক, তাই পরকালীন নি'আমতও এর মধ্যে এসে যায়। এ কারণেই কেউ কেউ এ কথাটির উপর আপত্তি তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত উছমান ইবন মাযঊন রাযি.-এর ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
হযরত উছমান ইবন মাযউন রাযি. হাবশায় হিজরত করেছিলেন। তিনি হারশায় থাকা অবস্থায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল যে, মক্কার সকলে ইসলাম গ্রহণ করেছে। তখন অনেকেই হাবশা থেকে মক্কায় ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল সংবাদটি সঠিক নয়। তখন আবার তাদের অনেকে হারশায় ফিরে গেলেন। যারা ফিরে যাননি তারা প্রভাবশালী কারও কারও আশ্রয়ে মক্কায় নিরাপদ দিন কাটাচ্ছিলেন।
হযরত উছমান ইবন মায‘ঊন রাযি. ওয়ালীদ ইবন মুগীরার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। কিছুদিন পর তিনি যখন দেখলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য সাহাবীগণ মুশরিকদের হাতে জুলুম-নির্যাতন ভোগ করছেন আর তিনি নিজে ওয়ালীদের আশ্রয়ে নিরাপদে চলাফেরা করছেন, তখন তাঁর আত্মগ্লানি বোধ হল। তিনি মনে মনে বললেন, আমার সঙ্গী-সাথী ও ভাইয়েরা আল্লাহর পথে উৎপীড়ন ভোগ করবে আর আমি একজন মুশরিকের আশ্রয়ে তাদের সামনে নিরাপদে চলাফেরা করব, এটা বড়ই লজ্জার কথা। আমার পক্ষে এটা অনেক বড় ত্রুটি।
সুতরাং তিনি ওয়ালীদের কাছে চলে গেলেন এবং তাকে বললেন, হে আব্দ শামসের পিতা! আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এখন আর আমি আপনার আশ্রয়ে থাকতে চাচ্ছি না। আমি আপনার দেওয়া নিরাপত্তা ফিরিয়ে দিলাম।
ওয়ালীদ বলল, কেন ভাতিজা? আমার গোত্রের কেউ তোমাকে কষ্ট দিয়েছে কি?
তিনি বললেন, না; বরং আমি আল্লাহর আশ্রয় বেছে নিয়েছি। তাঁর আশ্রয় ছাড়া অন্য কারও আশ্রয়ে আমি থাকতে চাই না।
ওয়ালীদ বলল, তাহলে তুমি মসজিদুল হারামে চলো। সেখানে তুমি প্রকাশ্যে আমার আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করো, যেমন আমি প্রকাশ্যে তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম।
তারা উভয়ে মসজিদুল হারামে চলে গেলেন। ওয়ালীদ সকলকে লক্ষ্য করে বলল, এই যে উছমান ইবন মাযাউন। আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। এখন সে আমার আশ্রয় ফিরিয়ে দিতে এসেছে।
উছমান রাযি. বললেন, হাঁ, তিনি সত্য বলেছেন। আমি তাকে ওয়াদা রক্ষাকারী এবং একজন উত্তম আশ্রয়দাতা পেয়েছি। তবে আমি আল্লাহ ছাড়া আর কারও আশ্রয়ে থাকতে চাই না। তাই তার আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করছি।
তারপর হযরত উছমান রাযি. সেখান থেকে চলে আসলেন। এ সময় কুরায়শদের একটি মজলিসে কবি লাবীদ নিজ কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলেন। তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। হযরত উছমান রাযি. তাদের সে মজলিসে বসে পড়লেন। লাবীদ আবৃত্তি করছিলেন- الا كل شيء ما خلا الله باطل (জেনে রেখ, আল্লাহ ছাড়া সবকিছুই মিথ্যা)। হযরত উছমান রাযি. বলে উঠলেন, তুমি সত্য বলেছ। তারপর লাবীদ রাযি. বললেন- وكل نعيم لا محالة زائل, (এবং সমস্ত নি'আমত অনিবার্যভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে)। অমনি হযরত উছমান রাযি. বলে উঠলেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। জান্নাতের নি'আমত কখনওই বিলুপ্ত হবে না।
লাবীদ স্তম্ভিত! এভাবে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে তাকে মিথ্যুক ঠাওরানো! তার কবিতার প্রতিবাদ! জীবনে কখনও এরূপ আচরণের সম্মুখীন তিনি হননি। তিনি নিজেকে খুব অপমানিত বোধ করলেন। তিনি উপস্থিত লোকদের সম্বোধন করে বললেন, হে কুরায়শ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম, তোমাদের মজলিসে কেউ কখনও অপমানিত হতো না। তা এই অনাসৃষ্টি তোমাদের মধ্যে কবে থেকে শুরু হল?
এক ব্যক্তি উত্তর দিল, ও একটা আহাম্মক। ওর দলে এরূপ আহাম্মক আরও আছে। ওরা আমাদের ধর্ম পরিত্যাগ করেছে। আপনি ওর কথায় কষ্ট পাবেন না।
লাবীদ আবারও কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন। এবারও হযরত উছমান রাযি. তার প্রথম কথার সমর্থন করলেন এবং দ্বিতীয় কথার প্রতিবাদ করলেন। এ অবস্থায় ওই হতভাগা ওঠে হযরত উছমান রাযি.-এর মুখে এমন জোরে এক চড় মারল যে, তাতে তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেল।
ওয়ালীদও সেখানে উপস্থিত ছিল। সে তাঁর এ অবস্থা লক্ষ করছিল। হযরত উছমান রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলল, ভাতিজা, আল্লাহর কসম, তোমার চোখের এ অবস্থা আজ নাও হতে পারত। তুমি তো এক সুরক্ষিত আশ্রয়ে ছিলে।
তিনি বললেন, আপনি ভুল বলেছেন। বরং আমার দ্বিতীয় চোখটিরও আল্লাহর পথে ওই একই অবস্থা হওয়ার প্রয়োজন ছিল। হে আব্দ শামসের পিতা! আমি আপনার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এক সত্তার আশ্রয়ে আছি।
ওয়ালীদ বলল, ভাতিজা! ইচ্ছা হলে ফের আমার আশ্রয় গ্রহণ করো।
তিনি বললেন, আমার কোনও প্রয়োজন নেই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছুই ধ্বংসশীল। এতে আসক্ত না হয়ে অবিনশ্বর আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে তাঁর নৈকট্যলাভের মেহনতকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
খ. কোনও কবির ভালো কবিতার প্রশংসা করা ও তার উদ্ধৃতি দেওয়া জায়েয।
জাহিলী যুগে যারা ভালো কবিতাও রচনা করেছেন, কবি লাবীদ রাযি.-ও তাদের একজন। এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর যে কবিতাংশের প্রশংসা করেছেন তা তাঁর ইসলামী জীবনের রচনা নয়। তিনি এটি রচনা করেছিলেন ইসলামগ্রহণের আগে। এটি তাঁর একটি মর্সিয়ার অংশ। হিরার বাদশা নু'মান ইবনুল মুনযিরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি এটি রচনা করেছিলেন। এটি দীর্ঘ সে শোকগাঁথার একটি পঙক্তি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পদ্ধতিটির প্রশংসায় বলেন-
أصدق كلمة قالها شاعر كلمة لبيد (কোনও কবি যা বলেছে তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা সত্য কথা হল লাবীদের কথা)। কোনও বর্ণনায় বহুবচনের সঙ্গে আছে ‘কবিগণ যা বলেছে'। কোনও বর্ণনায় আছে 'আরবগণ যা বলেছে। এক বর্ণনায় আছে, এতটুকু বললে সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, লাবীদ কী বলেছেন? উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পঙ্ক্তিটি উচ্চারণ করলেন-
الا كل شيء ما خلا الله باطل (জেনে রেখ, আল্লাহ ছাড়া সবকিছুই মিথ্যা)। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া যা-কিছু আছে তার কোনও স্থায়িত্ব নেই। সব মরণশীল ও ধ্বংসশীল। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে—
كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ
সবকিছুই ধ্বংসশীল, কেবল আল্লাহর সত্তাই ব্যতিক্রম।
হযরত লাবীদ রাযি.-এর কথাটি বাস্তবসম্মত। কুরআন মাজীদের এ আয়াতের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। তাই এটি সর্বাপেক্ষা সত্য কথা। তবে এর উপর প্রশ্ন আসে যে, তিনি আল্লাহ ছাড়া যে সবকিছুকে বাতিল সাব্যস্ত করেছেন তার মধ্যে তো ইবাদত বন্দেগী, জান্নাত-জাহান্নাম সবই এসে যায়, অথচ তা বাতিল নয়; বরং হক ও সত্য? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক দু'আয় আছে—
انت الحق ووعدك الحق، ولقاؤك حق، وقولك حق، والجنة حق، والنار حق والنبيون حق، ومحمد صلى الله عليه وسلم حق، والساعة حق،
'আপনি সত্য, আপনার ওয়াদা সত্য, আপনার সঙ্গে সাক্ষাত হওয়ার বিষয়টি সত্য, আপনার কথা সত্য, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, নবীগণ সত্য, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য এবং কিয়ামত সত্য।'
এর উত্তর হল, কবি 'আল্লাহ ছাড়া' বলতে আল্লাহ সম্পর্কিত বিষয়াবলী ছাড়া বুঝিয়েছেন। কাজেই আল্লাহর গুণাবলী, তাঁর রহমত ও আযাব, তাঁর ইবাদত-বন্দেগী, জান্নাত-জাহান্নাম প্রভৃতি বাতিলের আওতায় আসবে না। তা সবই হক ও সত্য। কবির মূল উদ্দেশ্য দুনিয়া ও দুনিয়াসংশ্লিষ্ট বিষয়াবলীর অস্থায়িত্ব ও নশ্বরতা বোঝানো।
এ শ্লোকটির দ্বিতীয় পঙক্তি হল- وكل نعيم لا محالة زائل (এবং সমস্ত নি'আমত অনিবার্যভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে)। এর দ্বারাও মূলত পার্থিব নি'আমত বোঝানো উদ্দেশ্য। দীনী ও পরকালীন নি'আমত বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। বাহ্যিকভাবে কথাটি যেহেতু ব্যাপক, তাই পরকালীন নি'আমতও এর মধ্যে এসে যায়। এ কারণেই কেউ কেউ এ কথাটির উপর আপত্তি তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত উছমান ইবন মাযঊন রাযি.-এর ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
হযরত উছমান ইবন মাযউন রাযি. হাবশায় হিজরত করেছিলেন। তিনি হারশায় থাকা অবস্থায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল যে, মক্কার সকলে ইসলাম গ্রহণ করেছে। তখন অনেকেই হাবশা থেকে মক্কায় ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল সংবাদটি সঠিক নয়। তখন আবার তাদের অনেকে হারশায় ফিরে গেলেন। যারা ফিরে যাননি তারা প্রভাবশালী কারও কারও আশ্রয়ে মক্কায় নিরাপদ দিন কাটাচ্ছিলেন।
হযরত উছমান ইবন মায‘ঊন রাযি. ওয়ালীদ ইবন মুগীরার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। কিছুদিন পর তিনি যখন দেখলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য সাহাবীগণ মুশরিকদের হাতে জুলুম-নির্যাতন ভোগ করছেন আর তিনি নিজে ওয়ালীদের আশ্রয়ে নিরাপদে চলাফেরা করছেন, তখন তাঁর আত্মগ্লানি বোধ হল। তিনি মনে মনে বললেন, আমার সঙ্গী-সাথী ও ভাইয়েরা আল্লাহর পথে উৎপীড়ন ভোগ করবে আর আমি একজন মুশরিকের আশ্রয়ে তাদের সামনে নিরাপদে চলাফেরা করব, এটা বড়ই লজ্জার কথা। আমার পক্ষে এটা অনেক বড় ত্রুটি।
সুতরাং তিনি ওয়ালীদের কাছে চলে গেলেন এবং তাকে বললেন, হে আব্দ শামসের পিতা! আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এখন আর আমি আপনার আশ্রয়ে থাকতে চাচ্ছি না। আমি আপনার দেওয়া নিরাপত্তা ফিরিয়ে দিলাম।
ওয়ালীদ বলল, কেন ভাতিজা? আমার গোত্রের কেউ তোমাকে কষ্ট দিয়েছে কি?
তিনি বললেন, না; বরং আমি আল্লাহর আশ্রয় বেছে নিয়েছি। তাঁর আশ্রয় ছাড়া অন্য কারও আশ্রয়ে আমি থাকতে চাই না।
ওয়ালীদ বলল, তাহলে তুমি মসজিদুল হারামে চলো। সেখানে তুমি প্রকাশ্যে আমার আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করো, যেমন আমি প্রকাশ্যে তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম।
তারা উভয়ে মসজিদুল হারামে চলে গেলেন। ওয়ালীদ সকলকে লক্ষ্য করে বলল, এই যে উছমান ইবন মাযাউন। আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। এখন সে আমার আশ্রয় ফিরিয়ে দিতে এসেছে।
উছমান রাযি. বললেন, হাঁ, তিনি সত্য বলেছেন। আমি তাকে ওয়াদা রক্ষাকারী এবং একজন উত্তম আশ্রয়দাতা পেয়েছি। তবে আমি আল্লাহ ছাড়া আর কারও আশ্রয়ে থাকতে চাই না। তাই তার আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করছি।
তারপর হযরত উছমান রাযি. সেখান থেকে চলে আসলেন। এ সময় কুরায়শদের একটি মজলিসে কবি লাবীদ নিজ কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলেন। তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। হযরত উছমান রাযি. তাদের সে মজলিসে বসে পড়লেন। লাবীদ আবৃত্তি করছিলেন- الا كل شيء ما خلا الله باطل (জেনে রেখ, আল্লাহ ছাড়া সবকিছুই মিথ্যা)। হযরত উছমান রাযি. বলে উঠলেন, তুমি সত্য বলেছ। তারপর লাবীদ রাযি. বললেন- وكل نعيم لا محالة زائل, (এবং সমস্ত নি'আমত অনিবার্যভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে)। অমনি হযরত উছমান রাযি. বলে উঠলেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। জান্নাতের নি'আমত কখনওই বিলুপ্ত হবে না।
লাবীদ স্তম্ভিত! এভাবে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে তাকে মিথ্যুক ঠাওরানো! তার কবিতার প্রতিবাদ! জীবনে কখনও এরূপ আচরণের সম্মুখীন তিনি হননি। তিনি নিজেকে খুব অপমানিত বোধ করলেন। তিনি উপস্থিত লোকদের সম্বোধন করে বললেন, হে কুরায়শ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম, তোমাদের মজলিসে কেউ কখনও অপমানিত হতো না। তা এই অনাসৃষ্টি তোমাদের মধ্যে কবে থেকে শুরু হল?
এক ব্যক্তি উত্তর দিল, ও একটা আহাম্মক। ওর দলে এরূপ আহাম্মক আরও আছে। ওরা আমাদের ধর্ম পরিত্যাগ করেছে। আপনি ওর কথায় কষ্ট পাবেন না।
লাবীদ আবারও কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন। এবারও হযরত উছমান রাযি. তার প্রথম কথার সমর্থন করলেন এবং দ্বিতীয় কথার প্রতিবাদ করলেন। এ অবস্থায় ওই হতভাগা ওঠে হযরত উছমান রাযি.-এর মুখে এমন জোরে এক চড় মারল যে, তাতে তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেল।
ওয়ালীদও সেখানে উপস্থিত ছিল। সে তাঁর এ অবস্থা লক্ষ করছিল। হযরত উছমান রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলল, ভাতিজা, আল্লাহর কসম, তোমার চোখের এ অবস্থা আজ নাও হতে পারত। তুমি তো এক সুরক্ষিত আশ্রয়ে ছিলে।
তিনি বললেন, আপনি ভুল বলেছেন। বরং আমার দ্বিতীয় চোখটিরও আল্লাহর পথে ওই একই অবস্থা হওয়ার প্রয়োজন ছিল। হে আব্দ শামসের পিতা! আমি আপনার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এক সত্তার আশ্রয়ে আছি।
ওয়ালীদ বলল, ভাতিজা! ইচ্ছা হলে ফের আমার আশ্রয় গ্রহণ করো।
তিনি বললেন, আমার কোনও প্রয়োজন নেই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছুই ধ্বংসশীল। এতে আসক্ত না হয়ে অবিনশ্বর আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে তাঁর নৈকট্যলাভের মেহনতকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
খ. কোনও কবির ভালো কবিতার প্রশংসা করা ও তার উদ্ধৃতি দেওয়া জায়েয।
