আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৯- নবীজী সাঃ ও সাহাবা রাঃ ; মর্যাদা ও বিবিধ ফাযায়েল

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৭৯৪
২১১৮. আনসারদের সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ)- এর উক্তিঃ তোমরা ধৈর্যধারণ করবে অবশেষে আমার সঙ্গে হাওযে কাউসারের নিকট সাক্ষাত করবে।
৩৫২২। আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ (রাহঃ) .... ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি যখন আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ)- এর সঙ্গে ওয়ালীদ (ইবনে আব্দুল মালিক)- এর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বসরা থেকে দামেস্ক সফর করতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি আনাস (রাযিঃ)- কে বলতে শুনেছেন, নবী কারীম (ﷺ) বাহরাইনের জমি তাদের জন্য (জায়গীর হিসাবে) বরাদ্দ করার উদ্দেশ্যে আনসারদিগকে আহবান করলে তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মুহাজির ভাইদের জন্য এরূপ জায়গীর বরাদ্দ না করা পর্যন্ত আমরা তা গ্রহণ করব না। নবী কারীম (ﷺ) বললেন, তোমরা যদি তা গ্রহণ করতে না চাও, তবে (কিয়ামতের ময়দানে) হাউযে কাউসারের নিকটে আমার সাথে সাক্ষাত না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করতে থাক। কেননা অচিরেই তোমরা দেখতে পাবে, আমার পরে তোমাদের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

একটা সময় আসবে, হকদার হওয়া সত্ত্বেও তোমাদেরকে হক থেকে বঞ্চিত করা হবে। বঞ্চিত করা হলেও তোমরা আমীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না। সবর অবলম্বন করবে এবং যথারীতি আমীরের আনুগত্য করে যাবে। তা করতে পারলে আমার সংগে হাউযে কাউসারে সাক্ষাত লাভ করতে পারবে।
বোঝা গেল, সরকারের পক্ষ থেকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে ধৈর্যধারণ করতে পারলে তার পুরস্কার হচ্ছে আখিরাতে হাওযে কাউসারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাতলাভ এবং তাঁর হাতে হাওযে কাউসারের পানি পান করতে পারা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সেই সৌভাগ্য দান করুন।

হাওযে কাউসার
‘হাওযে কাউসার’ আখিরাতের একটি বিশাল জলাশয়ের নাম। তার দৈর্ঘ্য উদয়াচল থেকে অস্তাচলের দূরত্ব পরিমাণ। তার পানি দুধের চেয়ে সাদা, মধুর চেয়ে মিষ্ট। বিভিন্ন হাদীছে হাওযে কাউসারের বিভিন্ন অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। নিচে কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করা গেল।

ইমাম মুসলিম রহ. হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ তাঁর কিছুটা তন্দ্রাভাব দেখা দেয়। তারপর তিনি মুচকি হাসি দিয়ে মাথা তুললেন। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি হাসছেন কেন? তিনি বললেন, এইমাত্র আমার প্রতি একটি সূরা নাযিল হয়েছে। তারপর তিনি বিসমিল্লাহর সাথে সূরা কাউসার পাঠ করলেন। তারপর বললেন, তোমরা কি জান কাউসার কী? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, এটা একটা নহর। আমার প্রতিপালক আমাকে দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন। এর কল্যাণ প্রভূত।কিয়ামতের দিন এ হাওযের তীরে আমার উম্মত উপস্থিত হবে। এর পানপাত্র আকাশের তারকারাজির মত (অসংখ্য হবে)। কোনও কোনও বান্দাকে এর কাছে আসতে বাধা দেওয়া হবে। আমি বলব, হে আমার রব্ব্! এরা তো আমার উম্মত। তিনি বলবেন, আপনি জানেন না। আপনার পর এরা কী সব কাণ্ড করেছে।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আনাস রাযি. সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

دَخَلْتُ الْجَنَّةَ ، فَإِذَا أَنَا بِنَهْرٍ حَافَتَاهُ خِيَامُ اللُّؤْلُؤِ ، فَضَرَبْتُ بِيَدِي إِلَى مَا يَجْرِي فِيهِ الْمَاءُ ، فَإِذَا مِسْكٌ أَذْفَرُ ، قُلْتُ مَا هَذَا يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَذَا الْكَوْثَرُ الَّذِي أَعْطَاكَهُ اللَّهُ

‘আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম। সেখানে একটি নহর দেখতে পেলাম, যার দু'তীরে মণিমুক্তার ছাউনী। আমি তার প্রবাহে হাত রাখলাম। দেখলাম তা খাঁটি মিস্ক। আমি বললাম, হে জিবরাঈল এটা কী? তিনি বললেন, এটাই কাউসার, যা আল্লাহ আপনাকে দান করেছেন।”
তিরমিযী শরীফে হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

هُوَ أَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ اللَّبَنِ، وَأَحْلَى مِنَ العَسَلِ، فِيهِ طُيُورٌ أَعْنَاقُهَا كَأَعْنَاقِ الجُزُرِ، قَالَ عُمَرُ رَضِيَ اللهُ عَنهُ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّهَا لَنَاعِمَةٌ، قَالَ: آكِلُهَا أَنْعَمُ مِنْهَا

‘তা দুধের চেয়েও সাদা, মধুর চেয়েও মিষ্টি। তাতে উটের গলার মত গলাবিশিষ্ট পাখি আছে। একথা শুনে হযরত উমর রাযি. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা তো ভারী উপভোগের হবে। তিনি বললেন, যারা তা খাবে, তারা অনেক বেশি সুখী হবে।
হাওযে কাউসার সংক্রান্ত হাদীছ প্রচুর। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি., হযরত ‘উমর ফারূক রাযি. হযরত উছমান গনী রাযি. ও হযরত আলী রাযি.-সহ পঞ্চাশেরও বেশি সংখ্যক সাহাবী থেকে হাওযে কাউসারের কথা বর্ণিত আছে। ইমাম সুয়ূতী রহ ‘বুদুরুস-সাফিরা' গ্রন্থে এ সম্পর্কিত প্রায় সত্তরটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
এ বরকতময় হাওয থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে যারা পানি পান করবে, আল্লাহ তা'আলা নিজ মেহেরবানীতে আমাদেরকেও তাদের মধ্যে শামিল রাখুন- আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নিজ স্বার্থহানিতে ধৈর্যধারণ হাওযে কাউসারের পানি পানের সৌভাগ্য লাভ হওয়ার একটি বড় উপায়।

খ. হাওযে কাউসার সত্য। তাতে বিশ্বাস রাখা উচিত। আখিরাতে তার পানি পান করতে পারা অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। সেই সৌভাগ্য তারই নসিব হবে, যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত অনুযায়ী জীবনযাপন করবে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন