আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ

আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ

হাদীস নং: ১০১৪
৪৬২. সালাম আদান প্রদানের জন্য বাহির হওয়া
১০১৪. ইসহাক ইব্‌ন আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন আবু তালহা (রাহঃ) বলেনঃ তুফায়ল ইব্‌ন উবাই ইব্‌ন কা’ব হযরত আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন উমরের কাছে যাইতেন এবং তাঁহার সাথে তিনি বাজারে যাইতেন। রাবী বলেন, আমরা যখন বাজারে যাইতাম তখন আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন উমর (রাযিঃ) এমন কোন মামুলী লোক, দোকানদার, ফকীর, মিস্‌কীন বা অন্য কোন ধরনের লোকের কাছ দিয়া অতিক্রম করিতেন না, যাহাকে তিনি সালাম না করিতেন।
তুফায়ল বলেনঃ একদা আমি হযরত আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন উমরের খেদমতে উপস্থিত হইলাম তখন তিনি আমাকে লইয়া বাজারে যাইতে চাহিলেন।
আমি বলিলাম, আপনি বাজারে গিয়া কি করিবেন ? না আপনি কোন কেনাকাটা করেন, না কোন সওদাপাতির দামদর জিজ্ঞাসা করেন, না দরদস্তুর করেন, আর না বাজারের কোন মজলিসে কোন দিন বসেন। বরং এখানেই আমাদিগকে নিয়া বসুন, আপনার সাথে কিছু আলাপ-আলোচনা করি। তখন হযরত আব্দুল্লাহ্ (রাযিঃ) আমাকে বলিলেন, আরে পেটমোটা। (তুফায়লের পেট প্রকৃতই মোটা ছিল) আমি তো বাজারে যাই কেবল যাহাকে সামনে পাই তাহাকেই সালাম দেওয়ার জন্য।
بَابُ مَنْ خَرَجَ يُسَلِّمُ وَيُسَلَّمُ عَلَيْهِ
حَدَّثَنَا حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ , قَالَ : حَدَّثَنِي مَالِكٌ ، عَنْ إِسْحَاقَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي طَلْحَةَ ، أَنَّ الطُّفَيْلَ بْنَ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ أَخْبَرَهُ ، أَنَّهُ كَانَ يَأْتِي عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ , فَيَغْدُو مَعَهُ إِلَى السُّوقِ ، قَالَ : فَإِذَا غَدَوْنَا إِلَى السُّوقِ لَمْ يَمُرَّ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ عَلَى سَقَّاطٍ ، وَلا صَاحِبِ بَيْعَةٍ ، وَلا مِسْكِينٍ ، وَلا أَحَدٍ إِلا يُسَلِّمُ عَلَيْهِ ، قَالَ الطُّفَيْلُ : فَجِئْتُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ يَوْمًا ، فَاسْتَتْبَعَنِي إِلَى السُّوقِ ، فَقُلْتُ : مَا تَصْنَعُ بِالسُّوقِ وَأَنْتَ لا تَقِفُ عَلَى الْبَيْعِ ، وَلا تَسْأَلُ عَنِ السِّلَعِ ، وَلا تَسُومُ بِهَا ، وَلا تَجْلِسُ فِي مَجَالِسِ السُّوقِ ؟ فَاجْلِسْ بِنَا هَاهُنَا نَتَحَدَّثُ ، فَقَالَ لِي عَبْدُ اللَّهِ : " يَا أَبَا بَطْنٍ ، وَكَانَ الطُّفَيْلُ ذَا بَطْنٍ ، إِنَّمَا نَغْدُو مِنْ أَجْلِ السَّلامِ ، نُسَلِّمُ عَلَى مَنْ لَقِيَنَا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

তুফায়ল একজন তাবি'ঈ। তিনি বিখ্যাত সাহাবী হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি.- এর পুত্র। হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি. হযরত উছমান রাযি.-এর খেলাফতকালে হিজরী ৩২ সনে ইন্তিকাল করেন। তাঁর পুত্র তুফায়লের ইন্তিকাল হয় হিজরী ৮১ সনে। পিতার ইন্তিকালের পর প্রায় ৫০ জীবিত ছিলেন। মহান পিতার সাহচর্যে তিনি দীনের শিক্ষালাভের পাশাপাশি জীবন গড়ারও সুযোগ পেয়েছিলেন। পিতা ছিলেন একজন বড় আলেম সাহাবী। সেই সূত্রে তাঁর নিজেরও ইলমের প্রতি বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। কাজেই পিতার মৃত্যুর পর তিনি পিতার সতীর্থ অন্যান্য সাহাবীর কাছে আসা-যাওয়া করতেন। তাদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. উল্লেখ্যযোগ্য। তিনি হিজরী ৭৩ ইন্তিকাল করেন। কাজেই তুফায়ল তাঁর দীর্ঘ সাহচর্যলাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর কাছে নিয়মিতই আসতেন। তিনি ইবন উমর রাযি.-এর বিশিষ্ট ছাত্রদের একজন। ছিলেন তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ। ফলে হযরত ইবনে উমর রাযি. তার প্রাত্যহিক একটি বিশেষ কাজে তাকে সঙ্গে রাখতেন। তুফায়ল সে কাজটিরই বর্ণনা এখানে দিয়েছেন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর কাজ ছিল প্রতিদিন সকালে বাজারে যাওয়া এবং বাজারে আসা লোকদের সালাম দেওয়া বা তাদের সালামের জবাব দেওয়া। সাধারণত বাজারে গিয়ে তাঁর কোনও কেনাকাটা করা হত না। তিনি বাজারে যাওয়ার সময় তুফায়লকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তিনি যে বাজারে কোনও কেনাকাটা করেন না আর তা সত্ত্বেও তিনি রোজ বাজারে যান, এ বিষয়টা তুফায়ল বিশেষভাবে লক্ষ করলেন। তিনি দেখলেন মানুষ বাজারে যেসব কারণে যায় তার কোনওটিই ইবন উমর রাযি. করেন না। না ছোট-বড় কোনও দোকানের সামনে দাঁড়ান, না কোনও মাল কেনেন, না কোনওটির দাম জিজ্ঞেস করেন, না কোনও গরীব-মিসকীনের কাছে দাঁড়ান আর না বাজারের কোনও বৈঠক ও আড্ডায় বসেন। যা করেন তা হল কেবল সালাম দেওয়া। তো অন্যান্য দিনের মতো একদিন সকালে যখন তুফায়ল এসে হাজির হলেন এবং ইবন উমর রাযি. তাকে বাজারে নিয়ে যেতে চাইলেন, তখন তিনি বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন যে, শুধু শুধু কেন বাজারে যাওয়া? বাজারে যেসব কাজে মানুষ যায় তার কোনওটিই যখন আপনি করেন না, তখন যাওয়ার দরকার কী? তারচে' বসেন কথাবার্তা বলি। বলাবাহুল্য তাঁদের কথাবার্তা তো হত দীন সম্পর্কেই। বেহুদা কথা বলার মানুষ তাঁরা ছিলেন না। যা বলতেন তার মধ্যে অন্যদের জন্য শিক্ষা থাকত। হযরত ইবন উমর রাযি. যা বলবেন তা দ্বারা কুরআন-সুন্নাহ'র ইলম হাসিল হবে। তুফায়ল তো তাই চাইতেন। বাহ্যদৃষ্টিতে তার কাছে মনে হচ্ছিল বাজারে যাওয়ার দ্বারা বৃথা সময় নষ্ট হয়। তারচে' সময়টা ইলম অর্জনের জন্য ব্যয় করাই শ্রেয়।

কিন্তু হযরত ইবনে উমর রাযি. তো সাহাবী। তাঁর যে গভীর দৃষ্টি, তা তো অন্যদের থাকার কথা নয়। সুতরাং তিনি তুফায়লকে যে উত্তর দিলেন তা ছিল তার ভাবনার অতীত। তিনি তাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ওরে পেটুক! আমাদের বাজারে যাওয়া তো সালামের জন্য। অর্থাৎ পুণ্য সংগ্রহের জন্য।

আল্লাহু আকবার! কী উঁচু দৃষ্টিভঙ্গি। সকলে বাজারে যায় দুনিয়ার কাজে। যায় পণ্য কিনতে বা অন্য কোনও কাজে। কিন্তু হযরত ইবন উমর রাযি.-এর যাওয়া সেরকমের যান পুণ্য কিনতে। ছাওয়াব হাসিল করতে। বিনিময়ে তিনি ছাওয়াব অর্জন করেন। সালাম দিলে অন্ততপক্ষে দশ নেকী পাওয়া যায়। পূর্‌ণাঙ্গ সালামে পাওয়া যায় ত্রিশ নেকী। বাজারে বহু লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। বিপুল সংখ্যক সালাম দেওয়া যায়। ফলে ছাওয়াবও অর্জিত হয় রাশি রাশি। এটা ঘরে বসে থাকার দ্বারা পাওয়া যায় না। কারণ ঘরে বসে থাকলে কতজন লোকের সঙ্গেই বা সাক্ষাৎ হবে? তাতে সালাম বিনিময় কতবার হওয়া সম্ভব? কাজেই সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে বেশি ছাওয়াব অর্জন করতে চাইলে বাজারেই তো যেতে হবে। এ কারণেই তিনি রোজ বাজারে যেতেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দীন শিক্ষার সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মাধ্যম মুত্তাকী পরহেযগার আলেমের সাহচর্য।

খ. বড় ব্যক্তির সন্তান হওয়ার কারণে এরকম পরিতুষ্টি বোধ করা উচিত নয় যে, দীনের বুঝ, দীনের ইলম, আমল ও আখলাক শেখার জন্য আমার অন্য কারও কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

গ. সালাম বিনিময়ের দ্বারা বিপুল ছাওয়াব পাওয়া যায়। তাই বেশি বেশি সালাম দেওয়ায় অভ্যস্ত হওয়া উচিত।

ঘ. ঈমানী চেতনা ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে দুনিয়াবী কাজের ক্ষেত্রসমূহ থেকেও ছাওয়াব কুড়ানো যায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আল-আদাবুল মুফরাদ - হাদীস নং ১০১৪ | মুসলিম বাংলা