আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ

আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ

হাদীস নং: ৫২১
২৩৫. রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখিতে গিয়া তাহার জন্য দুআ করা
৫২১। হামীদ ইব্‌ন আব্দুর রহমান বলেন, হযরত সা’দের তিন পুত্রের প্রত্যেকেই তাঁহাদের পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) মক্কায় একদা হযরত সা’দের রুগ্ন অবস্থায় তাঁহাকে দেখিতে যান। হযরত সা’দ (রাযিঃ) তখন কাঁদিয়া ফেলিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমাকে কিসে কাঁদাইতেছে? জবাবে হযরত সা’দ বলিলেনঃ আমার আশংকা হইতেছে, যে ভূমি হইতে আমি হিজরত করিয়া গেলাম (আর) সা’দের মত অবশেষে সেই ভূমিতেই বুঝি আমিও ইন্তিকাল করিব! তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিলেনঃ হে আল্লাহ্! সা’দকে আরোগ্য করুন। তিনি এরূপ তিনবার বলিলেন। হযরত সা’দ (রাযিঃ) তখন বলিলেন, আমার বিপুল সম্পত্তি রহিয়াছে আর উত্তরাধিকারী বলিতে রহিয়াছে একটি কন্যা মাত্র। আমি কি আমার সাকুল্য সম্পত্তি বিলাইয়া দেওয়ার ওসীয়্যত করিয়া যাইব? তিনি বলিলেন, না। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ফরমাইলেনঃ না। হযরত সা’দ (রাযিঃ) বলিলেনঃ তবে কি দুই-তৃতীয়াংশের ব্যাপারে অসীয়্যত করিয়া যাইব ? সা’দ (রাযিঃ) বলিলেনঃ তবে কি এক-তৃতীয়াংশের ব্যাপারে অসীয়্যত করিব? বলিলেনঃ এক-তৃতীয়াংশের ব্যাপারে অসীয়্যত করিতে পার এবং এক-তৃতীয়াংশও তো অনেক বেশী। নিঃসন্দেহে তোমার মালের যাকাতও একটি সাদাকা স্বরূপ। তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য তুমি যে ব্যয় কর উহাও সাদাকা বিশেষ। তোমার সহধর্মিণী তোমার আহার্য হইতে যে আহার করে উহাও তোমার জন্য সাদাকা বিশেষ। আর যদি তুমি তোমার পরিবার-পরিজনকে সচ্ছেল অবস্থায় রাখিয়া যাও তবে উহা তাহাদিগকে এমন অবস্থায় রাখিয়া যাওয়ার চাইতে উত্তম যে, তাহারা মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাতিয়া বেড়াইবে। একথা বলিয়া তিনি হাত দ্বারা (হাত পাতার) ইঙ্গিত করিলেন।
بَابُ دُعَاءِ الْعَائِدِ لِلْمَرِيضِ بِالشِّفَاءِ
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى ، قَالَ : حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَهَّابِ ، قَالَ : حَدَّثَنَا أَيُّوبُ ، عَنْ عَمْرِو بْنِ سَعِيدٍ ، عَنْ حُمَيْدِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ ، قَالَ : حَدَّثَنِي ثَلاثَةٌ مِنْ بَنِي سَعْدٍ ، كُلُّهُمْ يُحَدِّثُ عَنْ أَبِيهِ ، أَنّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، دَخَلَ عَلَى سَعْدٍ يَعُودُهُ بِمَكَّةَ ، فَبَكَى ، فَقَالَ : مَا يُبْكِيكَ ؟ قَالَ : خَشِيتُ أَنْ أَمُوتَ بِالأَرْضِ الَّتِي هَاجَرْتُ مِنْهَا كَمَا مَاتَ سَعْدٌ ، قَالَ : اللَّهُمَّ اشْفِ سَعْدًا ، ثَلاثًا ، فَقَالَ : لِي مَالٌ كَثِيرٌ ، يَرِثُنِي ابْنَتَيْ ، أَفَأُوصِي بِمَالِي كُلِّهِ ؟ قَالَ : لا ، قَالَ : فَبِالثُّلُثَيْنِ ؟ قَالَ : لا ، قَالَ : فَالنِّصْفُ ؟ قَالَ : لا ، قَالَ : فَالثُّلُثُ ؟ قَالَ : الثُّلُثُ ، وَالثُّلُثُ كَثِيرٌ ، إِنَّ صَدَقَتَكَ مِنْ مَالِكَ صَدَقَةٌ ، وَنَفَقَتَكَ عَلَى عِيَالِكَ صَدَقَةٌ ، وَمَا تَأْكُلُ امْرَأَتُكَ مِنْ طَعَامِكَ لَكَ صَدَقَةٌ ، وَإِنَّكَ أَنْ تَدَعَ أَهْلَكَ بِخَيْرٍ ، أَوْ قَالَ : بِعَيْشٍ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَدَعَهُمْ يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ ، وَقَالَ بِيَدِهِ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে হযরত সা'দ রাযি. নিজ ঘটনা বর্ণনা করেন যে, তিনি বিদায় হজ্জের বছর মক্কা মুকার্রামায় কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। সংবাদ পেয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখতে আসেন। কোনও সাহাবী অসুস্থ হলে তাকে দেখতে আসা তাঁর সাধারণ অভ্যাস ছিল। তিনি অন্যদেরকেও রোগী দেখতে যাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। এটা তাঁর সুন্নত এবং এর অনেক ফযীলত।

হযরত সা'দ রাযি. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দেখতে আসলেন। আমি তাঁকে জানালাম যে, আমার ওয়ারিশ তো মাত্র আমার এক কন্যা। অন্যদিকে আমার সম্পদ প্রচুর। এ অবস্থায় আমি কি আমার সম্পদের তিন ভাগের দুইভাগ সদকা করে দিতে পারি? নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করলেন। তারপর তিনি অর্ধেকের কথা বললেন। তাও নিষেধ করলেন। শেষে যখন তিন ভাগের একভাগের কথা বললেন, তখন পরিমাণ হিসেবে এটাকেও বেশিই সাব্যস্ত করলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুমতি দিয়ে দিলেন। সেইসংগে উপদেশ দিলেন যে, ধন–সম্পদ থাকলে তার একটা বড় অংশ সন্তানদের জন্য রেখে যাওয়া চাই। কেননা তা না হলে এ আশংকা আছে যে, তারা মানুষের কাছে হাত পেতে বেড়াবে। আর প্রত্যেক মুসলিমের জন্য এটা অমর্যাদাকর।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীছে অপরের কাছে হাত পেতে বেড়ানোর নিন্দা করেছেন। তিনি ভিক্ষাবৃত্তিকে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। তাঁর শিক্ষায় অপরের কাছে হাত পাতা অপেক্ষা খেটে খাওয়াই শ্রেয়। সেই শিক্ষা হিসেবেই তিনি হযরত সা'দ রাযি.–কে তার সম্পদের বড় অংশ ওয়ারিশদের জন্য রেখে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন।

হযরত সা'দ রাযি.–এর আশংকা হয়েছিল যে, অসুস্থতার কারণে তাঁকে মক্কায় থেকে যেতে হবে। ফলে তাঁর হিজরত বাতিল হয়ে যাবে এবং হিজরত করে তিনি যে ছওয়াবের অধিকারী হয়েছিলেন তা থেকে মাহরুম হয়ে যাবেন। সে আশংকা থেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমার বন্ধুগণ মদীনায় ফিরে যাওয়ার পরও আমাকে কি মক্কায় থেকে যেতে হবে? আমার মৃত্যু কি এখানেই হয়ে যাবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে, না, তোমার এখানে থেকে যেতে হবে না এবং হিজরতও বাতিল হবে না। বরং এই সম্ভাবনা আছে যে, তুমি দীর্ঘায়ু লাভ করবে এবং দাওয়াত ও জিহাদের মহান তৎপরতায় তোমার সময় কাটবে। ফলে একদিকে তোমার দ্বারা বহু মানুষ হেদায়াত পাবে এবং তারা জাহান্নাম থেকে বেঁচে যাবে। বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহে প্রচুর গনীমত লাভ হবে এবং তা দ্বারা মুসলিমগণ উপকৃত হবে। দিকে দিকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়বে এবং চারদিকে ইসলামের রাজ্যবিস্তার ঘটবে। মোটকথা তোমার মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ'র প্রভূত কল্যাণ সাধিত হবে। অপরদিকে যাদের ভাগ্যে দীন ও ঈমান নেই, তোমার হাতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কুফরী শক্তি রাজত্ব হারাবে। কেউ যুদ্ধে নিহত হবে এবং জাহান্নামে চলে যাবে। কেউ বন্দি হবে এবং দাসত্বের জীবনযাপন করবে। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল। তিনি দীর্ঘায়ু লাভ করেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. ও উমর ফারুক রাযি.–এর আমলে বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কাদেসিয়ার যুদ্ধে তো তিনিই সেনাপতি ছিলেন। আঞ্চলিক গভর্ণর হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি ১৭ জন পুত্র ও ১২ জন কন্যাসন্তান রেখে যান। অথচ এ ঘটনার সময় তাঁর ছিল মাত্র এক কন্যাসন্তান।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কেউ অসুস্থ হয়েছে জানলে তাকে দেখতে যাওয়া উচিত। এটা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত।

খ. উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ করতে চাইলে সে ব্যাপারে বিজ্ঞজনের সংগে পরামর্শ করা উচিত, যেমন হযরত সা'দ ইবন আবূ ওয়াক্কাস রাযি. তার সম্পদ দান করে দেওয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে পরামর্শ করেছেন।

গ. মুমূর্ষু ব্যক্তি যদি তার সম্পদ দান করতে চায় বা সে সম্পর্কে অসিয়ত করতে চায়, তবে তা সর্বোচ্চ এক–তৃতীয়াংশের ভেতর করতে পারে, এর বেশি করা জায়েয নয়। উত্তম হল এক–তৃতীয়াংশেরও নিচে রাখা

ঘ. সম্পদ যদি অল্প হয়, তবে মুমূর্ষুকালে তা দান–খয়রাত না করে ওয়ারিশদের জন্য রেখে দেওয়াই ভালো।

ঙ. অন্যের কাছে কিছু চাওয়া ও হাত পেতে বেড়ানো অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। যথাসম্ভব খেটে খাওয়াই ইসলামের শিক্ষা।

চ. দান–খয়রাতে সুনাম–সুখ্যাতি নয়, বরং একমাত্র আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি কামনাই লক্ষ হওয়া উচিত।

ছ. আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় সন্তান–সন্ততি ও আত্মীয়–স্বজনের পেছনে খরচ করলেও ছওয়াব পাওয়া যায়। এমনকি স্ত্রীর মুখে লোকমা তুলে দেওয়াটাও একটি ছওয়াবের কাজ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
আল-আদাবুল মুফরাদ - হাদীস নং ৫২১ | মুসলিম বাংলা