আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ
আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ
হাদীস নং: ৪৯১
২২৫- যুলুম হলো অন্ধকার।
৪৯১। হযরত আবু যার (রাযিঃ) বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ হে আমার বান্দাগণ! আমি আমার নিজের উপর যুল্ম হারাম করিয়া নিয়াছি এবং তোমাদের জন্য পরস্পরের প্রতি যুল্ম করা হারাম করিয়া দিয়াছি। সুতরাং তোমরা পরস্পরের প্রতি যুল্ম করিও না। হে আমার বান্দাগণ! তোমরা তো দিবারাত্রি গুনাহ করিতে থাক, আর আমি গুনাহ রাশি মাফ করিয়া থাকি, উহাতে আমার কিছুই আসে যায় না। সুতরাং তোমরা আমার দরবারে ক্ষমা ভিক্ষা কর, আমি তোমাদিগকে ক্ষমা করিয়া দিব। হে আমার বান্দাগণ ! তোমাদের প্রত্যেকেই ক্ষুধার্ত-অবশ্য আমি যাহাকে ক্ষুধার অন্ন প্রদান করি সে নহে । সুতরাং আমার দরবারে অন্ন ভিক্ষা কর, আমি অন্ন দান করিব। তোমাদের প্রত্যেকেই বস্ত্রহীন তবে আমি যাহাকে বস্ত্র দান করি সে নহে। সুতরাং আমার দরবারে বস্ত্র ভিক্ষা কর, আমি তোমাদিগকে বস্ত্র দান করিব। হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের মধ্যকার প্রথম ব্যক্তি হইতে শুরু করিয়া শেষ ব্যক্তিটি পর্যন্ত প্রত্যেকে, জিন্ ও ইনসান তথা মানব-দানব সকলে যদি মুত্তাকী মনা পরমভক্ত বান্দা হইয়া যায় তবুও আমার রাজত্ব বিন্দুমাত্র বৃদ্ধি পাইবে না। আর যদি সকলেই পাপপ্রবণ হইয়া যায়, তবুও তাহাতে আমার রাজত্বে বিন্দুমাত্র কমতি পাইবে না। সকলেই যদি এক প্রান্তরে সমবেত হইয়া আমার দরবারে প্রার্থনা জানায় আর আমি তাহাদের সকলের প্রার্থনা মঞ্জুরও করি এবং তাহাদের প্রার্থিত সব কিছুই তাহাদিগকে দান করি তবে তাহাতে আমার রাজত্বে শুধু এতটুকুই কম হইবে যতটুকু হয় মহাসমুদ্রে একটি সূচ একটি বার মাত্র ডুবাইলে। হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের উপর আমি যাহা চাপাইয়া দেই তাহা হইল তোমাদের স্বকৃত আমলসমূহ। সুতরাং যে মঙ্গল লাভ করে, তজ্জন্য সে যেন আল্লাহর প্রশংসা করে আর যে অন্য কিছু (অমঙ্গল) লাভ করে সে যেন তাহার নিজেকেই ভর্ৎসনা করে।”
মুহাদ্দিস আবু ইদ্রিস খাওলানী (রাহঃ) এই হাদীস যখনই বর্ণনা করিতেন তখনই তিনি জানুদ্বয় একত্র করিয়া চরম বিনয় প্রকাশ করিতেন।
মুহাদ্দিস আবু ইদ্রিস খাওলানী (রাহঃ) এই হাদীস যখনই বর্ণনা করিতেন তখনই তিনি জানুদ্বয় একত্র করিয়া চরম বিনয় প্রকাশ করিতেন।
حَدَّثَنَا عَبْدُ الأعْلَى بْنُ مُسْهِرٍ، أَوْ بَلَغَنِي عَنْهُ، قَالَ: حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ، عَنْ رَبِيعَةَ بْنِ يَزِيدَ، عَنْ أَبِي إِدْرِيسَ الْخَوْلاَنِيِّ، عَنْ أَبِي ذَرٍّ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، عَنِ اللهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى قَالَ: يَا عِبَادِي، إِنِّي قَدْ حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي، وَجَعَلْتُهُ مُحَرَّمًا بَيْنَكُمْ فَلاَ تَظَالَمُوا. يَا عِبَادِي، إِنَّكُمُ الَّذِينَ تُخْطِئُونَ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَأَنَا أَغْفِرُ الذُّنُوبَ، وَلاَ أُبَالِي، فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ. يَا عِبَادِي، كُلُّكُمْ جَائِعٌ إِلاَّ مَنْ أَطْعَمْتُهُ، فَاسْتَطْعِمُونِي أُطْعِمْكُمْ. يَا عِبَادِي، كُلُّكُمْ عَارٍ إِلاَّ مِنْ كَسَوْتُهُ، فَاسْتَكْسُونِي أَكْسُكُمْ. يَا عِبَادِي، لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ، وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ، كَانُوا عَلَى أَتْقَى قَلْبِ عَبْدٍ مِنْكُمْ، لَمْ يَزِدْ ذَلِكَ فِي مُلْكِي شَيْئًا، وَلَوْ كَانُوا عَلَى أَفْجَرِ قَلْبِ رَجُلٍ، لَمْ يَنْقُصْ ذَلِكَ مِنْ مُلْكِي شَيْئًا، وَلَوِ اجْتَمَعُوا فِي صَعِيدٍ وَاحِدٍ فَسَأَلُونِي فَأَعْطَيْتُ كُلَّ إِنْسَانٍ مِنْهُمْ مَا سَأَلَ، لَمْ يَنْقُصْ ذَلِكَ مِنْ مُلْكِي شَيْئًا، إِلاَّ كَمَا يَنْقُصُ الْبَحْرُ أَنْ يُغْمَسَ فِيهِ الْخَيْطُ غَمْسَةً وَاحِدَةً. يَا عِبَادِي، إِنَّمَا هِيَ أَعْمَالُكُمْ أَجْعَلُهَا عَلَيْكُمْ، فَمَنْ وَجَدَ خَيْرًا فَلْيَحْمَدِ اللَّهَ، وَمَنْ وَجَدَ غَيْرَ ذَلِكَ فَلاَ يَلُومُ إِلاَّ نَفْسَهُ كَانَ أَبُو إِدْرِيسَ إِذَا حَدَّثَ بِهَذَا الْحَدِيثِ جَثَى عَلَى رُكْبَتَيْهِ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি একটি হাদীসে কুদসী। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ পাক থেকে তাঁর যে সুস্পষ্ট বাণী বর্ণনা করেছেন এগুলোকেই পরিভাষায় ‘হাদীসে কুদসী’ বলা হয়। যদিও তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কথা, কিন্তু যেহেতু তা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন, তাই তা হাদীসের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ পাকের কালাম, যা নামাযে তিলাওয়াত করা হয়, নামাযে যার শব্দগুলোই পাঠ করতে হয়, তরজমা পঠের সুযোগ নেই, যা তিলাওয়াত করাই একটি বিশেষ ইবাদত, অর্থ না বুঝলেও যে ইবাদতের ছাওয়াব পাওয়া যায়- এই কালাম হল, আলকুরআনুল কারীম, যা মুসহাফে লিপিবদ্ধ ও সুসংরক্ষিত এবং যে মুসহাফ অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করা বৈধ নয়।
তো কুরআন কারীমও আল্লাহ পাকের কালাম, আল্লাহ পাকের বাণী ও বিধান, হাদীসে কুদসীও আল্লাহ পাকের কালাম, বাণী ও সম্বোধন, কিন্তু এ দুয়ের মাঝে পার্থক্য আছে। কুরআন কারীম আলাদা, হাদীসে কুদসী আলাদা। কুরআন কারীমের এমন কিছু বিধান ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা একান্তই কুরআন কারীমের। শরীয়তের অন্যান্য নসের এই বিধান ও বৈশিষ্ট্য নেই। শরীয়তের অন্যান্য নসের মতো হাদীসে কুদসীও একটি নস।
যারা আরবী বোঝেন এবং আল্লাহর কালামের জালাল ও প্রতাপ উপলব্ধির মত সংবেদন অন্তরে ধারণ করেন তাঁরা এই হাদীসে কুদসীগুলো পাঠ করলে শিহরিত হয়ে ওঠেন।
বিখ্যাত তাবেয়ী আবু ইদ্রিস আলখাওলানী রাহ., যিনি হযরত আবু যর আলগিফারী রা. থেকে এই হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি যখন হাদীসটি বর্ণনা করতেন তখন হাঁটুর উপর দাঁড়িয়ে প্রভুর এই ফরমান বর্ণনা করতেন। এই হাদীসের জালাল ও প্রতাপ এভাবে তাঁকে অভিভ‚ত করেছিল। এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. বলেছেন, ‘শামের অধিবাসীগণ যে সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে অভিজাত ও সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ হাদীস হচ্ছে এই হাদীস।
কালামের সূচনা
এখানে আল্লাহ পাকের কালাম শুরু হয়েছে يا عبادي সম্বোধনের মাধ্যমে। মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে যে, আসমান-যমীনের যিনি স্রষ্টা, জগত-মহাজগতের যিনি সৃষ্টিকর্তা, তিনি তাদের সম্বোধন করছেন يا عبادي (হে আমার বান্দাগণ!) বলে।
আমাদের এক বড় মনীষী কাযী ইয়ায রাহ.। মুহাদ্দিস, মুফাসসির ছিলেন। তাঁর দু’টি পঙতি বর্ণনা করা হয়-
وَمِمَّا زَادَنِي شَرَفًا وَفَخْرًا + وَكِدْتُ بِأَخْمُصِي أَطَأُ الثُّرَيَّا
دُخُولِي تَحْتَ قَوْلِكَ يَا عِبَادِيَ + وَأَنْ أَرْسَلْتَ أَحْمَدَ لِي نَبِيَّا
‘আমার গর্ব ও গৌরব কে পরিমাণ করতে পারে? আমি তো ছুরাইয়া তারকাও ভেদ করে উঠে যেতে চাই। কারণ, হে প্রভু! তুমি যে আমায় সম্বোধন করেছ ‘ইয়া ইবাদী’ বলে, আর আহমদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) বানিয়েছ আমার নবী।’
এরচেয়ে বড় গৌরবের বিষয় আর কী হতে পারে? একজন ক্ষুদ্র মানবের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য তো আর কিছুই হতে পারে না। এই যে আনন্দ এটা ঈমানী আনন্দ। এই আনন্দ যার নসীব হয়েছে তার তো অমূল্য সম্পদ নসীব হয়েছে।
এই হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাকের দশটি সম্বোধন রয়েছে। দশবার তিনি বান্দাদের সম্বোধন করেছেন ‘ইয়া ইবাদী’ বলে আর দশটি কথা তিনি বলেছেন বান্দাদের লক্ষ করে।
প্রথম সম্বোধন
حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي.
হে আমার বান্দাগণ! ‘আমি নিজের উপর যুলুম হারাম করে নিয়েছি’।
আল্লাহ পাক হলেন ঐ মহাপরাক্রমশালী সত্তা যাকে জিজ্ঞাসা করার কেউ নেই। কারো কাছে তাঁর জবাবদিহিতা নেই।
لا يُسْئَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْئَلُونَ.
তিনি তো সর্বশক্তিমান- স্রষ্টা ও প্রভু, সব তাঁর সৃষ্টি ও দাস। কে আছে তাঁকে জিজ্ঞাসা করার? কিন্তু তিনি বলেন, আমি নিজের উপর যুলুমকে হারাম করে নিয়েছি। সুতরাং আমি কারো উপর যুলুম করি না। ফরমানের সূচনাই আল্লাহ পাক করেছেন নিজের এই সিফাতের বর্ণনার মাধ্যমে যে, আমি নিজেই নিজের উপর যুলুমকে হারাম করে নিয়েছি। সুতরাং আল্লাহ তাআলা অন্যায়-অবিচার থেকে পবিত্র। এতে বান্দার জন্য এই নির্দেশনাও আছে যে, আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে বান্দার জন্য যে বিধান ও পথনির্দেশ আসে তা বান্দার জন্য পূর্ণ কল্যাণকর। বান্দার দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণকর। সকল শ্রেণির মানুষের জন্য কল্যাণকর। আল্লাহ পাক তো সকল স্বার্থ-চিন্তার ঊর্ধ্বে, সব রকম অবিচার থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
মানুষ তার চারপাশের জন্য বিভিন্ন নিয়ম-কানুন তৈরি করে। যারা প্রস্তুত করে তারা যেহেতু সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়, স্বার্থ-চিন্তা ও ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়, তাই এই নিয়ম ও বিধানে মানবীয় দুর্বলতার ছায়া ও প্রতিফলন থাকে। কিন্তু আল্লাহ পাক হলেন ঐ সত্তা যিনি সকল স্বার্থ-চিন্তার ঊর্ধ্বে। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন। সুতরাং তার পক্ষ থেকে যে বিধান ও নির্দেশ আসে সেটিই ত্রুটিমুক্ত, ভারসাম্যপূর্ণ।
وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا.
‘তোমাদের মাঝেও যুলুমকে হারাম করেছি’।
আমরা যদি কুরআন-সুন্নাহর নুসূস অধ্যয়ন করি তাহলে যুলুমের দুটি প্রকার দেখতে পাই। যুলুম কুরআন ও সুন্নাহর নুসূসে দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এক. নিজের প্রতি যুলুম। দুই. অন্যের প্রতি যুলুম।
আমাদের সীমাবদ্ধ চিন্তায় আমরা শুধু অন্যের প্রতি যুলুমকেই যুলুম মনে করি। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহর নুসূস আমাদের দৃষ্টিকে পরিচ্ছন্ন করে এবং প্রসারিত করে। কুরআন-সুন্নাহ বলে, যুলুম দুই প্রকার। এক হল নিজের প্রতি যুলুম। আরেক হল অন্যের প্রতি যুলুম। অন্যের প্রতি যুলুমও পরিণামে নিজের প্রতিই যুলুম। চিন্তা করলে দেখা যাবে, এটিই বাস্তবতা। প্রকৃতপক্ষে মানুষ তার অন্যায় ও গর্হিত কর্মের দ্বারা নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। কুরআন মাজীদের আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
وَما ظَلَمْناهُمْ وَلكِنْ كانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ.
আমি তাদের প্রতি কোনো যুলুম করিনি; কিন্তু তারাই নিজেদের প্রতি যুলুম করত। -সূরা নহল (১৬) : ১১৮
আখেরাতে যখন ফায়সালা হবে, জাহান্নামীদের জন্য জাহান্নামের ফায়সালা হয়ে যাবে তখন আল্লাহ পাক বলবেন, আমি তাদের উপর যুলুম করিনি; বরং তারাই নিজেদের উপর যুলুম করেছে। আপন কর্মের ফল তারা আজ ভোগ করছে। কুরআন মাজীদের আরো বহু আয়াতে এই বিষয়টি এসেছে।
একটি সহীহ হাদীসে এসেছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَيُمْلِي لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُ، قَالَ: ثُمَّ قَرَأَ : وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ القُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ.
‘আল্লাহ পাক যালিমকে অবকাশ দিতে থাকেন। ঢিল দিতে থাকেন। কিন্তু এরপর যখন পাকড়াও করেন তখন আর ছাড়েন না। এরপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন- (তরজমা) এমনই হয় তোমার রবের পাকড়াও, যখন তিনি জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন, ওদের যুলুমে লিপ্ত অবস্থায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৮৬
এই হাদীসে যালিম মানে কী? এখানে ‘যালিম’ উভয় অর্থকেই শামিল করছে। অন্যের প্রতি যে যুলুম করে সেও শামিল। আর যে ব্যক্তিগত পাপাচারে লিপ্ত থাকে, সে-ও শামিল।
তো কুরআন ও সুন্নাহর নুসূস আমাদের জানাচ্ছে, কাকে বলে যুলুম আর কাকে বলে যালেম। সব রকমের পাপাচার যুলুম, নিজের উপর যুলুম। অন্যের হক্ব নষ্ট করাও যুলুম। পরিণামের বিচারে এটাও নিজের উপর যুলুম। এই স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি যার আছে সে তো নিজের স্বার্থেই পাপাচার ও অবিচার থেকে বেঁচে থাকবে। এই বিশ্বাস যত দৃঢ় হবে কর্ম ও আচরণ ততই প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে। পক্ষান্তরে পাপাচার যদি হয় ‘ভোগ’ ও ‘উপভোগ’, অন্যের হক্ব নষ্ট করা যদি হয় ‘কর্তৃত্ব’ ও ‘কৃতিত্ব’ তাহলে তো পাপাচার, অবিচার চলতেই থাকবে। এই হচ্ছে দুই দৃষ্টিভঙ্গি, কর্ম ও আচরণ সম্পর্কে দুই মূল্যায়ন। এখন আমাদের চিন্তা করা উচিত কোন্ মূল্যায়ন বাস্তবসম্মত এবং কোন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তি ও সমাজের জন্য কল্যাণকর।
মূল কথায় ফিরে আসি। এই হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, তিনি নিজের উপর যুলুম হারাম করে নিয়েছেন এবং মানুষের উপরও একে অপরের প্রতি যুলুমকে হারাম করেছেন।
সহীহ মুসলিমে একটি হাদীস আছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করেছেন-
أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ؟
তোমরা কি জানো তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিঃস্ব কে?
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ!
الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهُ وَلَا مَتَاعَ.
আমাদের মধ্যে নিঃস্ব ব্যক্তি সে, যার অর্থ-সম্পদ নেই।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বললেন-
إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلَاةٍ، وَصِيَامٍ، وَزَكَاةٍ، وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا، وَقَذَفَ هَذَا، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا، وَضَرَبَ هَذَا، فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ، أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ، ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ.
‘আমার উম্মতের নিঃস্ব ঐ লোক, যে কিয়ামতের দিন সালাত-সিয়াম-যাকাত নিয়ে আগমন করবে কিন্তু কাউকে সে গালি দিয়েছিল, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল, কারো রক্ত ঝরিয়েছিল। তো একে তার নেক আমল দিয়ে দেওয়া হবে, ওকেও তার নেক আমল দিয়ে দেওয়া হবে। যখন নেক আমলগুলো শেষ হবে তখন ঐসকল লোকের গুনাহ এই ব্যক্তির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হবে, এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (এ হচ্ছে আমার উম্মতের সবচেয়ে মিসকীন, সবচেয়ে রিক্তহস্ত।) -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮১
আরেকটি সহীহ হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম জানিয়েছেন, যখন জান্নাত-জাহান্নামের ফায়সালা হবে, জান্নাতীগণ জান্নাতে যাবে আর জাহান্নামীরা জাহান্নামে যাবে এর আগে একটা ব্যাপার ঘটবে। সেই ব্যাপার হল, কোনো জান্নাতী এই অবস্থায় জান্নাতে যেতে পারবে না যে, কোনো একজন জাহান্নামীর তার কাছে কোনো পাওনা আছে। এমন নয় যে, ঐ লোক তো জাহান্নামী, তার প্রতি যদি কোনো জান্নাতী কিছু যুলুম করেও থাকে তা ধরা হবে না, বিবেচনায় আনা হবে না। না, ধরা হবে এবং নিষ্পত্তি করা হবে। একজন জাহান্নামীরও পাওনা থাকা অবস্থায় কোনো জান্নাতী জান্নাতে যেতে পারবে না। আল্লাহ পাক তাদের বিবাদ মিটাবেন। এরপর জান্নাতী জান্নাতে যেতে পারবে।
আল্লাহ পাক এই হাদীসে কুদসীতে খুব জালাল ও প্রতাপের সাথে ইরশাদ করেছেন- আমি তোমাদের মাঝে যুলুমকে হারাম করেছি। সুতরাং সাবধান! কেউ কারো প্রতি যুলুম করো না।
দ্বিতীয় খিতাব
يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ ضَالٌّ إِلَّا مَنْ هَدَيْتُهُ، فَاسْتَهْدُونِي أَهْدِكُمْ.
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা সকলেই পথ-না-জানা। আমি যাকে পথ দেখাই সে-ই শুধু পথ পায়। সুতরাং আমার কাছে পথের দিশা প্রার্থনা কর। আমি তোমাদের পথের দিশা দিব।’
আল্লাহ পাক মানুষকে সত্য গ্রহণের যোগ্যতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষ যখন সত্যের সন্ধান পায় তখন স্বভাবগতভাবেই সত্যের প্রতি প্রলুব্ধ হয়, কিন্তু শয়তানের ধোকায়, প্রবৃত্তির তাড়নায় এবং চারপাশের জগতের হাতছানিতে সে সত্য থেকে বিচ্যুত হয়, তখন মিথ্যা ও অন্যায়ের পথে চলা তার জন্য সহজ হয়ে যায়।
সত্যের পথে চলতে হলে প্রথমে মানুষকে সত্যের সন্ধান পেতে হয়। এরপর মিথ্যার হাতছানি থেকেও আত্মরক্ষা করতে হয়। আর এ দুইয়ের প্রত্যেকটিই শুধু হতে পারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তাওফীকের মাধ্যমে। সুতরাং আল্লাহ পাকের ইরশাদ-
كُلُّكُمْ ضَالٌّ إِلَّا مَنْ هَدَيْتُهُ.
‘তোমাদের সকলেই পথ-নাজানা। আমি যাকে পথ দেখাই শুধু সে-ই পথ পায়। আমি যাকে সুপথে পরিচালিত করি শুধু সে-ই সঠিক পথের পথিক হয়।’
সুতরাং তোমরা আমার কাছে হেদায়েত চাও। আমি তোমাদের হেদায়েত দান করবো। এটা হল আল্লাহ পাকের ওয়াদা। যে বান্দা আল্লাহর কাছে হেদায়েত চায় আল্লাহ পাক অবশ্যই ঐ বান্দাকে হেদায়েত দান করেন। এটা দুনিয়ার জীবনে বান্দার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
তৃতীয় খিতাব
يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ جَائِعٌ، إِلَّا مَنْ أَطْعَمْتُهُ، فَاسْتَطْعِمُونِي أُطْعِمْكُمْ.
‘হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই অন্নহীন, শুধু সে-ই অন্ন পায় যাকে আমি অন্ন দান করি। সুতরাং আমার কাছে অন্ন চাও, আমি তোমাদের অন্ন দান করব।’
আল্লাহ তাআলাই রাযযাক। তিনিই একমাত্র রিযিকদাতা। মানুষ শুধু আল্লাহর রিযিক অন্বেষণ করতে পারে। সূরায়ে ওয়াকিয়ায় এ সত্য তিনি কত সুন্দর করেই না বলেছেন-
أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَحْرُثُونَ، أَأَنْتُمْ تَزْرَعُونَهُ أَمْ نَحْنُ الزَّارِعُونََ.
‘তোমরা যে চাষাবাদ কর বল তো এই চাষবাস থেকে ফল-ফসল তোমরা উৎপন্ন কর, না আমি উৎপন্ন করি?’ -সূরা ওয়াকিআ (৫৬) : ৬৩-৬৪
أَفَرَأَيْتُمُ الْماءَ الَّذِي تَشْرَبُونَ، أَأَنْتُمْ أَنْزَلْتُمُوهُ مِنَ الْمُزْنِ أَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُونَ.
‘বল তো তোমরা যে পানি পান কর, মেঘমালা থেকে তা কি তোমরা বর্ষণ কর না আমি বর্ষণ করি?’ -সূরা ওয়াকিআ (৫৬) : ৬৮-৬৯
তাহলে অন্ন দানকারী কে? আল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের অন্ন দান করেন। আমরা আল্লাহরই কাছে অন্ন চাই।
চতুর্থ খিতাব
يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ عَارٍ، إِلَّا مَنْ كَسَوْتُهُ، فَاسْتَكْسُونِي أَكْسُكُمْ.
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা সকলেই বস্ত্রহীন। আমি যাকে বস্ত্র দেই, শুধু সেই বস্ত্র পায়। সুতরাং আমার কাছে বস্ত্র চাও, আমি তোমাদের বস্ত্র দান করব।’
এককথায় বান্দার যত প্রয়োজন তা পূরণ করেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। কিন্তু আল্লাহ যে পূরণ করেন সেটা আমাদের চিন্তায় থাকে না। প্রাত্যহিকতার কারণে এবং আমাদের কিছু কর্ম-প্রয়াস যুক্ত থাকার কারণে আল্লাহর স্মরণ আমাদের চিন্তা থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায়। আমরা মনে করি এ-ই তো নিয়ম। দেখুন, প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠে, সন্ধ্যায় অস্ত যায়। প্রাত্যহিকতার কারণে এ অতি সাধারণ ব্যাপার। আমাদের চিন্তা ও মস্তিষ্ক রাত-দিনের গমনাগমনে সচকিত হয় না। অথচ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত সৌর জগতের কত বড় ঘটনা! এই ঘটনা যিনি প্রতিনিয়ত ঘটান তিনি কত বড় শক্তিমান!
শস্যের বীজ জমিতে বপন করা হলে গাছ জন্মায়, তা থেকে শস্য পাওয়া যায়। প্রাত্যহিকতার কারণে এ অতি সাধারণ ঘটনা। সুতরাং আমাদের চিন্তা ও মস্তিষ্ক এতে সচকিত হয় না। সে নিয়মটিই শুধু জানে। নিয়মের নিয়ন্তা পর্যন্ত পৌঁছার তাড়না বোধ করে না। অথচ একটি বৃক্ষের অঙ্কুরোদ্গম প্রকৃতির কত বড় ঘটনা। যিনি তা নিপুণভাবে ঘটান তিনি কত নিপুণতার অধিকারী!
সকালে একজন মানুষ কর্মস্থলে যায়, সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। এভাবে সে তার জীবিকা উপার্জন করে। প্রাত্যহিকতার কারণে মনে হয় এ-ই নিয়ম। এভাবেই জীবিকা আসে। তার চিন্তা ও মস্তিষ্ক এর অধিক কিছু চিন্তার প্রেরণা বোধ করে না। অথচ প্রাণীজগতে জীবিকা কত বড় ঘটনা! যিনি তা সৃষ্টি করেছেন ও বণ্টন করেছেন তিনি কত মহান, কত শক্তিমান!
তো মানুষ প্রাত্যহিকতার কারণে এবং আপন চিন্তাশক্তির অক্ষমতার কারণে চারপাশের বাস্তবতা সম্পর্কেও গাফিল থাকে, তাই আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাকে সচেতন করেছেন এবং জানিয়েছেন, তার যা কিছু প্রয়োজন তা তিনিই পূরণ করেন। সুতরাং বান্দার প্রথম কর্তব্য, আপন প্রভুর অনুগ্রহ সম্পর্কে সচেতন হওয়া।
সহীহ মুসলিমে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ পাক বান্দার এই আমলটিকে খুব পছন্দ করেন যে, সে খাবার গ্রহণ করে এবং ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলে। সে পানি পান করে এবং ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলে।
এত ছোট্ট আমল, খাবার খেল এরপর বলল, ‘আলহামদু লিল্লাহ’। পানি পান করল এরপর বলল, ‘আলহামদু লিল্লাহ’, এতেই আল্লাহ তাআলা রাজিখুশি! আপাতদৃষ্টিতে আমলটা ছোট, কিন্তু বাস্তবে অনেক বড়। যে আলহামদু লিল্লাহ বলে এই ছোট্ট কথাটিতে তার এই বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটে যে, আমার একজন প্রভু আছেন, যিনি আমার অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করেন। তিনিই আমার জন্য এই সকল নিআমতের ব্যবস্থা করেছেন। আমি তার শোকরগোযারি করছি। চিন্তা করুন, কত বড় কথা! কত বড় সত্যের উপলব্ধি ও স্বীকৃতি! যদি বিষয়টি হৃদয় দ্বারা উপলব্ধি করে থাকেন, তাহলে নিজেই বিবেচনা করুন, এই সত্যের সাথে যার পরিচয় ঘটেনি সে কত বড় বাস্তবতা থেকে বঞ্চিত! আরো চিন্তা করুন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে কত সহজে কত বড় সৌভাগ্য অর্জন করেছি! আলহামদু লিল্লাহ! ছুম্মা আলহামদু লিল্লাহ। এই একটিমাত্র বাক্যের দ্বারা, যদি তা অন্তর থেকে উৎসারিত হয়, ঈমানের সাথে হয়, কৃতজ্ঞতার সাথে হয়, হতে পারে আল্লাহ পাক কাউকে মাফ করে দেবেন, কারো বেড়া পার করে দেবেন।
হাদীস শরীফে আছে, বান্দা কখনো কখনো একটি কথা বলে, ولم يلق لها بالا ‘সে এটাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথাই মনে করে না।’ কিন্তু আল্লাহ পাক তার এ কথার কারণে তার জন্য জান্নাতের ফায়সালা করে দেন। আবার এমনও হয় যে, বান্দা একটি কথা বলে, ولم يلق لها بالا ‘সে এটাকে কোনো কথাই মনে করে না।’ কিন্তু আল্লাহর কাছে তা এত অপছন্দের, এত ক্রোধের হয় যে, এর কারণে তার জাহান্নামের ফায়সালা হয়ে যায়। সুতরাং যবানকে সংযত রাখা জরুরি। আমরা আমাদের চারপাশের একটি শ্রেণীর মাঝে এই প্রবণতা দেখি। আল্লাহ সম্পর্কে, রাসূল সম্পর্কে, কুরআন সম্পর্কে, সুন্নাহ সম্পর্কে, দ্বীন সম্পর্কে, সৃষ্টিজগতে আল্লাহর নানা কুদরতের নিদর্শন সম্পর্কে নানা কথা বলে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে ফেলে। যা মুখে আসে বলে ফেলে। মনে রাখতে হবে সব বিষয় হাস্য-রসের বিষয় নয়। সব ধরনের হাস্য-রস গ্রহণযোগ্য নয়। হাস্য-রসেরও কিছু সীমা-সরহদ আছে। জীবন ও জগতের কিছু বিষয় থাকে যেগুলো নিয়ে হাস্য-রস চলে না। তো আল্লাহ, রাসূল, কুরআন, সুন্নাহ, দ্বীন ও শরীয়ত এই সকল বিষয়ে একজন মুসলিমকে ধীর-স্থির, সংযত-গম্ভীর হতে হয়।
পঞ্চম খিতাব
يَا عِبَادِي إِنَّكُمْ تُخْطِئُونَ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ، وَأَنَا أَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا، فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ.
হে আমার বান্দাগণ! তোমরা তো রাতদিন ভুল কর। আর আমি সকল অপরাধ ক্ষমা করি। সুতরাং আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৭
এই খিতাবে আল্লাহ পাক বান্দার দুর্বলতা উল্লেখ করেছেন এবং আপন দয়া ও মহত্ব বর্ণনা করেছেন। বান্দার দুর্বলতা এই যে, তার ভুল হয়, সে অন্যায় করে, আর আমাদের যিনি রব তাঁর বৈশিষ্ট্য হল, তিনি ক্ষমা করেন। সবাইকে ক্ষমা করেন। সব গুনাহ ক্ষমা করেন।
সব গুনাহ ক্ষমা করেন
তিনি সব গুনাহ ক্ষমা করেন- এ কথার অর্থ সঠিকভাবে বোঝা দরকার। এর অর্থ হচ্ছে, বান্দা যে গুনাহই করুক সব গুনাহই আল্লাহ পাকের রহমতের বিচারে ক্ষমাযোগ্য, যদি বান্দা ক্ষমার পথ অবলম্বন করে। এর অর্থ কখনো এই নয় যে, বান্দা গুনাহ করতে থাকবে আর নির্ভয়, নির্লিপ্ত থাকবে যে, আমার গুনাহ এমনিতেই মাফ হয়ে যাবে। আল্লাহ পাক ক্ষমা করেই দেবেন। সুতরাং গুনাহ করলেও কোনো অসুবিধা নেই। এ ধরনের মানসিকতা আসলে আল্লাহর দয়া ও রহমতের আশাবাদ নয়, আল্লাহর শাস্তি ও আযাব সম্পর্কে নির্লিপ্ততা। এটা অপরাধ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
نَبِّئْ عِبادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ،وَأَنَّ عَذابِي هُوَ الْعَذابُ الْأَلِيمُ.
আমার বান্দাদেরকে বলে দিন যে, আমি তো পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু এবং আমার শাস্তি- সে অতি মর্মন্তুদ শাস্তি! -সূরা হিজর (১৫) : ৪৯-৫০
আমাদের রবের এক পরিচয় যেমন এই যে, তিনি অতিক্ষমাশীল, তেমনি তাঁর আরেক পরিচয়, তিনি কঠিন শাস্তিদাতা। তো গুনাহ সম্পর্কে নির্ভয় ও নির্লিপ্ত হওয়ার অর্থ আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে নির্লিপ্ত হওয়া।
আল্লাহর রহমতের প্রকৃত আশাবাদী কারা
আল্লাহর রহমতের প্রকৃত আশাবাদী তারা যাদের কর্ম তাদের প্রত্যাশার সত্যায়ন করে। কর্ম ও প্রচেষ্টাহীন প্রত্যাশা কুরআন-হাদীসের দৃষ্টিতে নির্বুদ্ধিতা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের বিখ্যাত হাদীস-
الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ، وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا، وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.
বুদ্ধিমান সে যে নিজের নফসের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কর্ম করে। আর (নির্বোধ) অক্ষম সে যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুগামী করে এবং আল্লাহর প্রতি (অলীক) প্রত্যাশা পোষণ করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪২৬০
সুতরাং আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা তখনই সত্য হয়, যখন আল্লাহ প্রদত্ত ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে প্রবৃত্তির অনুগামিতা ত্যাগ করা হয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কর্ম করা হয়। কুরআন মাজীদে এ বিষয়টি কত পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَةَ اللَّهِ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ.
যারা ঈমান আনে এবং যারা হিজরত করে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে। আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, পরমদয়ালু। -সূরা বাকারা (২) : ২১৮
إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتابَ اللَّهِ وَأَقامُوا الصَّلاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْناهُمْ سِرًّا وَعَلانِيَةً يَرْجُونَ تِجارَةً لَنْ تَبُورَ، لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّهُ غَفُورٌ شَكُورٌ.
যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, সালাত কায়েম করে, আমি তাদের যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই প্রত্যাশা করে এমন ব্যবসার যার ক্ষয় নেই। এই জন্য যে, আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দিবেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদের আরো বেশি দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী। -সুরা ফাতির (৩৫) : ২৯-৩০
কর্মহীন প্রত্যাশা অজ্ঞতা ও অজ্ঞতা-প্রসূত
ইহুদী-সম্প্রদায়ের মাঝে ধর্মীয় দিক থেকে যেসকল বিভ্রান্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, তন্মধ্যে একটি ছিল অলীক প্রত্যাশা। ঐ সম্প্রদায়ের বে-ইলম শ্রেণীর মাঝে এ মানসিকতার বিস্তার ঘটেছিল। কুরআন মাজীদে ওদের এই বিভ্রান্তি চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে-
وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لا يَعْلَمُونَ الْكِتابَ إِلاَّ أَمانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَظُنُّونَ.
তাদের মধ্যে এমন কতক নিরক্ষর লোক আছে, যাদের মিথ্যা আশা ব্যতীত কিতাব সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান নেই। তারা শুধু অমূলক ধারণা পোষণ করে। -সূরা বাকারা (২) : ৭৮
ইমাম আবুল আলিয়া, রবী‘ ও কাতাদা রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন,
إِلا أَمَانِيَّ، يَتَمَنَّوْنَ عَلَى اللَّهِ مَا لَيْسَ لَهُمْ.
অর্থাৎ ওরা আল্লাহর প্রতি এমন সব প্রাপ্তির প্রত্যাশা করে যা তাদের জন্য নেই। -তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/১৭৫
এরপরের আয়াতগুলোতে ইহুদী জাতির আরো কিছু অলীক ও অমূলক ধারণা বর্ণনা করা হয়েছে এবং পরিষ্কার ভাষায় খণ্ডণ করা হয়েছে। সারকথা এই যে, প্রত্যাশা ভালো, অমূলক প্রত্যাশা ভালো নয়। ইসলাম অমূলক প্রত্যাশাকে উৎসাহিত করে না। কেননা এটা মিথ্যারই একটি প্রকার।
মুসলমানদের কোনো কোনো গোমরাহ ফের্কার মাঝেও অনেক আগে থেকেই এ ধরনের বিশ্বাস ছিল, এখনো থাকতে পারে যে, ‘গুনাহ করলে কোনো ক্ষতি নেই। ঈমান আনা হয়েছে তো এখন গুনাহ কোনো ক্ষতি করবে না।’ এটা একটা ভ্রান্ত কথা। গুনাহ অবশ্যই মানুষের ক্ষতি করে। মানুষের ঈমানকে দুর্বল করে। মানুষ যদি গুনাহে লিপ্ত থাকে, কবীরা গুনাহ করতে থাকে, তাহলে মানুষের এমন অবস্থাও হতে পারে যে, তার ঈমান বিনষ্ট হয়ে যাবে। গুনাহ মানুষের দুনিয়া এবং আখেরাতের জন্য ক্ষতিকর। দুনিয়াতেও তার শাস্তির আশঙ্কা আছে। আখেরাতেও শাস্তির আশঙ্কা আছে।
কিন্তু কোনো গুনাহই এমন নয়, যা আল্লাহ পাকের দয়া ও রহমতের বিচারে ক্ষমার অযোগ্য। আমরা অনেক ক্ষেত্রে বলি ‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ’ ‘এমন অপরাধ ক্ষমা করা যায় না’ কিন্তু আল্লাহ পাকের রহম-করম, ক্ষমা ও করুণা, বড়ত্ব ও মহত্ব এত বেশি যে, কোনো গুনাহই, কোনো অপরাধই তার রহম করমের বিচারে ‘ক্ষমার অযোগ্য’ নয়।
শিরক ক্ষমা করা হবে না- একথার অর্থ
কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-
إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذلِكَ لِمَنْ يَشاءُ.
‘আল্লাহ তার সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করবেন না। এছাড়া সকল গুনাহই যার সম্পর্কে ইচ্ছা করবেন ক্ষমা করে দেবেন। -সূরা নিসা (৪) : ৪৮
তো আল্লাহ পাক শিরককে ক্ষমা করবেন না- একথার অর্থ কী? একজন মানুষ শিরক করেছে, কুফর করেছে, এখন সে তওবা করেছে, আল্লাহ পাকের দিকে ফিরে এসেছে, শিরক পরিত্যাগ করে তাওহীদ অবলম্বন করেছে, কুফুর পরিত্যাগ করে ঈমান অবলম্বন করেছে এবং এরপর মৃত্যু পর্যন্ত ঈমানের হালতে, আমলে ছালেহের সাথে তার জীবন অতিবাহিত করেছে, আল্লাহ পাক কি তাকে ক্ষমা করবেন না? অবশ্যই ক্ষমা করবেন। ঈমানের দ্বারা কুফুরের হালতের গুনাহগুলো আল্লাহ পাক মাফ করে দেন।
তো কুরআন মাজীদের এই যে, ঘোষণা- ‘আল্লাহ পাক তার সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না’ এর অর্থ হল, যদি শিরকের অবস্থায় তার মৃত্যু হয়ে যায় তখন আর তার ক্ষমার ও মুক্তির কোনো উপায় থাকে না। আল্লাহ পাক কখনো তাকে ক্ষমা করবেন না। পক্ষান্তরে ঈমানের হালতে মৃত্যু হয়েছে, তাওহীদের উপর মৃত্যু হয়েছে, কিছু গুনাহও হয়েছে এমন লোকদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেবেন।
সারকথা এই দাঁড়াল যে, সব গুনাহই ক্ষমাযোগ্য। আল্লাহ পাকের রহমতের কাছে কোনো গুনাহই এমন নয় যা ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু বান্দার কর্তব্য হল, ক্ষমার পথ অবলম্বন করা। আল্লাহ পাক (আলোচ্য হাদীসে কুদসীতে) এর পরের বাক্যে বলেছেন,
فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ.
‘তোমরা আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দেব।’
গুনাহ যদি এমনি এমনি মাফ হয়ে যায়, তাওবা করতে হয় না, ইস্তেগফার করতে হয় না, নেক আমল করতে হয় না, আল্লাহ পাকের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হয় না, ঈমান আছে তো সকল গুনাহ এমনিই মাফ, কোনো গুনাহই কোনো ক্ষতি করবে না, তাহলে আল্লাহ পাক ইস্তেগফারের আদেশ করলেন কেন? বুঝা গেল, গুনাহ ক্ষমাযোগ্য, যদি মানুষ ক্ষমার পথ অবলম্বন করে। فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ. আমার কাছে ক্ষমা চাও। আমি তোমাদের ক্ষমা করে দেবো।
ইসলাম আশাবাদের ধর্ম, ইসলাম হতাশার ধর্ম নেয়। ইসলাম বলে না, পাপ মানুষের সত্তার ভিতরে ঢুকে পড়েছে। মানুষের সত্তাই পাপী। পাপমুক্ত হওয়ার ক্ষমতা ব্যক্তিমানুষের নেই। এর জন্য ঐশী কোনো ব্যবস্থার প্রয়োজন! এই ধরনের প্রান্তিকতা ইসলামে নেই।
প্রত্যেক মানুষ আল্লাহ পাকের কাছে ইস্তেগফারের মাধ্যমে, তাওবার মাধ্যমে, আমলে ছালেহের মাধ্যমে গুনাহ থেকে পবিত্র হতে পারে, আল্লাহ পাকের নৈকট্য অর্জন করতে পারে। ইসলামের শিক্ষা সহজ, সরল, স্বাভাবিক।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক মানুষকে এই পয়গাম দেওয়ার আদেশ করেছেন-
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ.
অর্থাৎ ‘আমার এই পয়গাম মানুষের কাছে পৌঁছে দিন- হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো গাফুরুর রাহীম। -সূরা যুমার (৪৯) : ৫৩
কিন্তু এর জন্য বান্দাকে ক্ষমা লাভের পথ অবলম্বন করতে হবে। যদি সে নিজেকে পবিত্র করতে চায় তাহলে মৃত্যু পর্যন্ত ক্ষমার দুয়ার তার জন্য খোলা। আল্লাহ পাক মৃত্যু পর্যন্ত এই পথ খোলা রেখেছেন।
এইজন্য একজন মুমিন কখনো হতাশ হতে পারে না। আমি এত পাপ করেছি, এত অন্যায় করেছি, এত অবিচার করেছি, আমার তো মুক্তির কোনো উপায় নেই, আমার তো ভালো হওয়ার সুযোগ নেই- এরকম মনে করা হতাশা। এটা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া।
আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কবীরা গুনাহ
আল্লাহ রহমতের আশাবাদী হওয়া মুমিনের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কবীরা গুনাহ। আমরা তো শুধু কবীরা গুনাহ মনে করি চুরি, ব্যাভিচার, ইত্যাদিকে। অবশ্যই এগুলো কবীরা গুনাহ। তবে কবীরা গুনাহ আরো আছে। এর মধ্যে একটি হল, ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া।’ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার বিভিন্ন পর্যায় আছে। বিভিন্ন প্রকাশ আছে। একটি প্রকাশ হল, আমার তো আর উপায় নেই। আমার তো ভালো হওয়ার সুযোগ নেই। আমি তো একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছি। এ রকম নিরাশ হয়ে যাওয়া কবীরা গুনাহ। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। আমি যদি নিজের দিকে তাকাই তাহলে আমি অক্ষম, দুর্বল। কিন্তু যদি আল্লাহর রহমতের দিকে যদি তাকাই তাহলে তো তা এক মহাসমুদ্র। আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অবকাশ রয়েছে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ দান করবেন।
হযরত ইয়াকুব আ.-এর উপদেশ
হযরত ইয়াকুব আ. সন্তানদের উপদেশ দিয়েছিলেন-
وَلا تَيْأَسُوا مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لا يَيْأَسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكافِرُونَ.
হে আমার সন্তানগণ! তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহর রহমত থেকে তো শুধু তারাই নিরাশ হয় যারা কাফির। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৮৭
কবি বলেন-
‘তাঁর সাথে যোগ নাই যার সে-ই করে নিতি অভিযোগ
তাঁর দেওয়া অমৃত ত্যাগ করে বিষ করে তারা ভোগ।’
বিদ্রোহী কবি আরো বলেছেন-
‘তাঁরই নাম লয়ে বলি বিশ্বের অবিশ্বাসীরা শোনো,
তাঁর সাথে ভাব হয় যার তার অভাব থাকে না কোনো।’
ষষ্ঠ খিতাব
يَا عِبَادِي، إِنَّكُمْ لَنْ تَبْلُغُوا ضَرِّي فَتَضُرُّونِي، وَلَنْ تَبْلُغُوا نَفْعِي فَتَنْفَعُونِي .
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা না আমার অপকার সাধনের পর্যায়েই কখনো পৌঁছুবে যে, আমার কোনো অপকার করবে। আর না উপকার সাধনের পর্যায়ে পৌঁছুবে যে, কোনো উপকার করবে।’
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হলেন সেই সুমহান অমুখাপেক্ষী সত্তা, যিনি সর্বপ্রকারের লাভ-ক্ষতি, উপকার-অপকারের ঊর্ধ্বে। আর বান্দার অবস্থা এই যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপকার বা অপকার সাধনের প্রশ্নই তার ক্ষেত্রে অবান্তর।
‘অবস্থান’ ও ‘সম্বন্ধ’ বোঝা
জ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অবস্থান ও সম্বন্ধ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান। কে না জানে যে, ঐ জ্ঞানই প্রশংসনীয়, যা সঠিক ও বাস্তব। ভুল বা অবাস্তব জ্ঞান প্রকৃত অর্থে জ্ঞান নয়। সেটা অজ্ঞানতা। বাস্তবতার সঠিক উপলব্ধি ঐ কাম্য ও প্রশংসনীয় জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। এরই একটি দিক ‘অবস্থান’ ও ‘সম্বন্ধ’ বোঝা। অর্থাৎ নিজের অবস্থান সম্পর্কে বাস্তব ধারণা এবং অন্যের সাথে সম্বন্ধের স্বরূপ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি। এটি একটি প্রশস্ত বিষয়। এখানে যে অংশটি প্রাসঙ্গিক তা হচ্ছে, মানবের কর্তব্য, নিজের সত্তা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা পোষণ আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে তার সম্বন্ধের নির্ভুল উপলব্ধি।
এই জ্ঞান ও উপলব্ধি মানবের চিন্তা ও কর্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। সে তখন উপলব্ধি করে যে, আল্লাহ হলেন খালিক ও ¯্রষ্টা। আর সে এক মাখলুক ও সৃষ্টি। আল্লাহ হলেন বে-নিয়ায ও অমুখাপেক্ষী। আর সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর মুখাপেক্ষী। এটাই হচ্ছে আল্লাহকে জানা এবং নিজেকে চেনার এক বিশেষ দিক। হারিস ইবনে হাইয়্যান রাহ. বলেছেনÑ
من عرف نفسه وعرف ربه عرف قطعا أنه لا وجود له من ذاته، إنما وجود ذاته ودوام وجوده وكمال وجوده من الله وإلى الله وبالله.
অর্থাৎ যে নিজেকে চিনেছে এবং আপন রবের পরিচয় লাভ করেছে তার এ প্রত্যয় জন্মেছে যে, সে আপন অস্তিত্বে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; বরং তার অস্তিত্ব, তার বেঁচে থাকা ও তার সকল গুণ একমাত্র আল্লাহরই দান। Ñইহইয়াউ উলুমিদ্দীন ৪/৩১৮
এই উপলব্ধিরই ফল আল্লাহর ভয়। তাই সালাফ আল্লাহর ভয়কে ‘ইলম’ বলেছেন আর এর বিপরীত ‘উজ্ব’ বা আত্মগর্বকে ‘জাহ্ল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসরূক ইবনুল আজদা রাহ. বলেনÑ
كفى بالمرء علما أن يخشى الله وكفى بالمرء جهلا أن يعجب بعلمه.
অর্থাৎ, জ্ঞানের প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর ভয় আর অজ্ঞতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে নিজ আমলের কারণে আত্মগর্বী হওয়া। Ñআদ দারেমী ৩৮৩; জামেউ বায়ানিল ইলম ১/১৪৩
ইমাম গাযালী রাহ. বলেনÑ
أخوف الناس لربه أعرفهم بنفسه وبربه، ولذلك قال - صلى الله عليه وسلم: أنا أخوفكم لله ،وكذلك قال الله - تعالى : إنما يخشى الله من عباده العلماء.
আপন রবকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে ঐ ব্যক্তি যে নিজের সম্পর্কে এবং আপন রবের সম্পর্কে বেশি জানে। আর একারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি।’ তেমনি কুরআন মাজীদের ইরশাদÑ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই আল্লাহকে ভয় করে...’ Ñইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৪/১৬৪
এর প্রকাশ ঘটে বিনয়, ন¤্রতা, আল্লাহর যিকির, হামদ-ছানা এবং দুআ ও কান্নাকাটির মধ্য দিয়ে।
ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ায রাহ. বলেনÑ
يخرج العارف من الدنيا ولم يقض وطره من شيئين: بكائه على نفسه، وثنائه على ربه.
আরিফ দুটি বিষয়ে অতৃপ্তি নিয়েই দুনিয়া থেকে যায়; নিজের উপর ক্রন্দন আর আপন রবের প্রশংসা। আর এটি এক শ্রেষ্ঠ উক্তি। কারণ এই হালত প্রমাণ করে যে, ব্যক্তি নিজেকে চেনে (নিজের দুর্বলতা ও অক্ষমতা বোঝে) আর তাঁর রবকে এবং রবের প্রতাপ ও মহিমা জানে। ফলে সে নিজের বিষয়ে লাজ্জিত আর রবের প্রশংসায় মুখরিত। Ñবাসাইরু যাবিদ তাময়ীয ৪/৫৪
তো মানবের কর্তব্য, নিজেকে নির্ভুলভাবে চেনা। নিজের সীমা-সরহদ সঠিকভাবে জানা। আর তার সাথে আল্লাহ তাআলার যে নিসবত, খালিক ও মাখলুকের নিসবত, রব ও মারবূবের নিসবত, মাবুদ ও আবিদের নিসবত, সে সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি অর্জন করা।
খালিক অমুখাপেক্ষী আর মাখলুক মুখাপেক্ষী
গোটা সৃষ্টিজগত আল্লাহর মাখলুক ও সৃষ্টি। আর আল্লাহ তাআলা খালিক ও সৃষ্টিকর্তা। গোটা সৃষ্টিজগত প্রতিপালিত আর আল্লাহ তাআলা পালনকর্তা। গোটা সৃষ্টিজগত আল্লাহর দাস, আর আল্লাহ তাআলা মালিক ও প্রভু। গোটা সৃষ্টিজগত আল্লাহর মুখাপেক্ষী আর আল্লাহ তাআলা বে-নিয়ায ও অমুখাপেক্ষী।
সুতরাং বান্দার অবস্থানই এই নয় যে, সে আল্লাহর কোনো উপকার-অপকার করতে পারে। আল্লাহ তো মহামহিম সত্তা, যিনি সকল লাভ-ক্ষতির উর্ধ্বে। কুরআন মাজীদের ইরশাদÑ
হে মানুষ! তোমরা তো আল্লাহর মুখাপেক্ষী; কিন্তু আল্লাহ, তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসার্হ্য। Ñসূরা ফাতির (৩৫) : ১৫
আল্লাহই একমাত্র সত্তা, যিনি সব দিক থেকে অভাবমুক্ত এবং সব দিক থেকে প্রশংসিত। তাঁর অভাবমুক্ততার এক দিক যা সূরায়ে ইসরার শেষ আয়াতে উল্লেখিত হয়েছেÑ
وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُن لَّهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ وَلَمْ يَكُن لَّهُ وَلِيٌّ مِّنَ الذُّلِّ ۖ وَكَبِّرْهُ تَكْبِيرًا.
বল, প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি। তাঁর রাজত্বে কোনো অংশী নেই। এবং তিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যার কারণে তার কোনো সাহায্যকারীর প্রয়োজন হতে পারে। আর সসম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর। Ñসুরা ইসরা (১৭) : ১১১
আল্লাহর সিফাত ও গুণাবলী সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার সম্বন্ধ সঠিকভাবে ‘নির্ণয়ে ব্যর্থ হওয়ার কারণে যুগে যুগে কত জাতি বিপথগামী হয়েছে! কোনো জাতি আল্লাহর কোনো বান্দাকে তাঁর ‘পুত্র’ সাব্যস্ত করেছে! কোনো জাতি ফিরেশতাদেরকে তাঁর ‘কন্যা’ ঘোষণা করেছে। কোনো জাতি নানা কাল্পনিক দেব-দেবী বা আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর ‘রাজত্বে’ শরীক সাব্যস্ত করেছে। কোনো জাতি তাঁর প্রতি নানাবিধ মানবীয় দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা যুক্ত করেছে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন জায়গায় এই সকল বিভ্রান্তি স্পষ্ট ভাষায় খণ্ডন করা হয়েছে। এই সকল বিভ্রান্তির মূলে রয়েছে আল্লাহ তাআলার সিফাত সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা। এবং আল্লাহ ও বান্দার সম্বন্ধের বিষয়ে ভুল ধারণা ও অজ্ঞতা।
তো হাদীসে কুদসীর এই খিতাব স্পষ্ট বলছে, বান্দার শানই এই নয় যে, সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কোনোরূপ উপকার বা অপকার করতে পারে। সুতরাং যে সকল বিশ্বাস, চিন্তা, উচ্চারণ বা আচরণ এই শিক্ষার পরিপন্থী তা বান্দাকে খুব সচেতনভাবে ত্যাগ করতে হবে।
ইবাদত ও ইতাআতে বান্দার নিজের উপকার
আল্লাহর অমুখাপেক্ষিতার এক দিক এই যে, বান্দার উপাসনা ও আনুগত্যের কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই। এ তো একান্তই বান্দার প্রয়োজন এবং এতে বান্দারই ফায়েদা। বান্দার ইবাদত-ইতাআতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও মহত্বে কোনো প্রকার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না; বরং এর দ্বারা বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে এবং দুনিয়া-আখেরাতের সফলতা হাসিল করে।
সামনের দুই খিতাবে এ বিষয়টি স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয়েছে।
সপ্তম ও অষ্টম খিতাব
يا عبادي لو أن أولكم وآخركم وإنكسم وجنكم كانوا على أتقى قلب رجل واحد منكم ما زاد ذلك في ملكي شيئا.
يا عبادي لو أن أولكم وآخركم وإنسكم وجنكم كانوا على أفجر قلب رجل واحد منكم ما نقص ذلك في ملكي شيئاً.
হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রথম ও শেষ জন, তোমরা মানব ও জিন সকলেই যদি হও তোমাদের সবচেয়ে খোদাভীরু কলবের ব্যক্তিটির মত তাহলে তা আমার রাজত্ব কিছুমাত্রও বৃদ্ধি করবে না।
হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রথম ও শেষজন, তোমরা মানব ও জিন সকলেই যদি হও তোমাদের সবচেয়ে অবাধ্য হৃদয়ের লোকটার মত তাহলে তা আমার রাজত্ব কিছুমাত্রও হ্রাস করবে না।
গোটা মানব ও জিন জাতির মধ্যে সবচেয়ে খোদাভীরু হৃদয়ের অধিকারী হলেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সবাই যদি তাঁর মতো আরিফ ও মুত্তাকী হয়ে যায় এতে আল্লাহর রাজত্বে কোনো কিছু বাড়বে না। গোটা মানব ও জিন জাতির মধ্যে সবচেয়ে অবাধ্য হৃদয়ের লোকটা হচ্ছে ইবলীস। সবাই যদি ইবলীসের মতো অবাধ্য-নাফরমান হয়ে যায় তাহলে আল্লাহর কুদরত, ক্ষমতা, রাজত্ব কিছুমাত্র হ্রাস পাবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা সম্পূর্ণ বে-নিয়ায। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর ক্ষমতা ও রাজত্ব কারো সমর্থনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। তাঁর রাজত্ব ও ক্ষমতায় কারো কোনো অংশীদারত্ব নেই। দেখুন, দুনিয়াতে যারা রাজা-বাদশা, নেতা-নেত্রী তারা সবাই অন্যের মুখাপেক্ষী। অন্যের শক্তি ও সমর্থনে তাদের ক্ষমতা। অন্যের কর্ম ও আনুগত্যে তাদের রাজত্ব। তাই সমর্থন ও আনুগত্য থাকলে ক্ষমতা থাকে, আনুগত্য ও সমর্থন না থাকলে ক্ষমতাও থাকে না। এটা মানব-রাজত্বের বৈশিষ্ট্য। কারণ সে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; সে অন্যের মুখাপেক্ষী। একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই হলেন সবদিক থেকে অমুখাপেক্ষী।
وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ
‘তিনিই তো অভাবমুক্ত, প্রশংসার্হ্য।’
কেউ প্রশংসা করুক বা না করুক তিনি তার সত্তা ও গুণাবলীর কারণেই প্রশংসিত। কেউ ইবাদত করুক বা না করুক তিনিই সত্য মাবুদ। তিনি ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই।
কেউ ‘ইতাআত’ করুক বা না করুক, তিনিই সত্য প্রভু। তিনি ছাড়া চ‚ড়ান্ত আনুগত্যের উপযুক্ত আর কেউ নেই।
তবে তাঁর করুণা ও মেহেরবানী যে, নিজ বান্দাদের তিনি তাঁর ইবাদত ও ইতাআতের পথ দেখিয়েছেন এবং অনেককে তাওফীক দান করেছেন। সুতরাং ঈমান ও ইতাআতের তাওফীক হলে বান্দার কর্তব্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ ও কৃতার্থ হওয়া।
দ্বীন গ্রহণে ও দ্বীনের নুসরতে বান্দার নিজের উপকার
সূরায়ে হুজুরাতের এ সত্য কত স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছেÑ
یَمُنُّوْنَ عَلَیْكَ اَنْ اَسْلَمُوْا ؕ قُلْ لَّا تَمُنُّوْا عَلَیَّ اِسْلَامَكُمْ ۚ بَلِ اللّٰهُ یَمُنُّ عَلَیْكُمْ اَنْ هَدٰىكُمْ لِلْاِیْمَانِ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ
তারা (বেদুইনরা) ইসলাম গ্রহণ করে তোমাকে ধন্য করেছে বলে মনে করে। তাদেরকে বলে দাও, তোমাদের ইসলাম দ্বারা আমাকে ধন্য করেছ বলে মনে করো না; বরং তোমরা যদি বাস্তবিকই (নিজেদের দাবিতে) সত্যবাদী হও তবে (জেনে রেখো) আল্লাহই তোমাদের ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। Ñসূরা হুজুরাত (৪৯) : ১৭
চিন্তা ও দৃষ্টির কী অপূর্ব পরিশুদ্ধি! লক্ষ্যণীয় এই যে, এ আয়াতে শুধু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কথা বলা হয়নি; বরং স্পষ্ট ভাষায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের কথা বলা হয়েছে যে, ইসলাম গ্রহণ করে তোমরা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে ধন্য করেছ এমনটা মনে করো না। এটা এক আসমানী তরবিয়ত। কিছু বেদুঈন যারা তখনও দ্বীনের পূর্ণ প্রজ্ঞা অর্র্জন করেননি তাদের মনে এ ধরনের চিন্তার উদ্রেক ঘটেছিল। এখনও এই শ্রেণির লোকের মধ্যে এই ধরনের চিন্তা থাকতে পারে। তাদের মনে হয়েছিল, তাদের ইসলাম গ্রহণের দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম-এর উপকার হল! তাঁর অনুসারী বৃদ্ধি পেল! তিনি শক্তি পেলেন! তিনি ধন্য হলেন বৈকি! (নাউযুবিল্লাহ)
এ হচ্ছে চিন্তার অস্বচ্ছতা। এর চিকিৎসা কুরআন মাজীদের বহু জায়গায় করা হয়েছে, যার সারকথা হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নুসরত তো করেন আল্লাহ তাআলা। তবে যারা সৌভাগ্যবান তাদের তিনি এই নুসরাতের কাজে যুক্ত করে ‘দ্বীনের নুসরতকারী’র মর্যাদা দান করেন। সূরা তাওবায় আল্লাহ তাআলার ইরশাদÑ
اِلَّا تَنْصُرُوْهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللّٰهُ اِذْ اَخْرَجَهُ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا ثَانِیَ اثْنَیْنِ اِذْ هُمَا فِی الْغَارِ اِذْ یَقُوْلُ لِصَاحِبِهٖ لَا تَحْزَنْ اِنَّ اللّٰهَ مَعَنَا
তোমরা যদি তার (অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের) সাহায্য না কর তবে (তাতে তার কোনো ক্ষতি নেই। কেননা) আল্লাহই তো সেই সময়ও তার সাহায্য করেছিলেন যখন কাফেররা তাকে (মক্কা থেকে) বের করে দিয়েছিল এবং তখন সে ছিল দুইজনের দ্বিতীয়জন, যখন তারা উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল, তখন সে তার সঙ্গীকে বলেছিল, চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। ... Ñসূরা তাওবা (৯) : ৪০
এই কুরআনী তারবিয়তের ফলে সাহাবায়ে কেরামের চিন্তা ও দৃষ্টি যে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধি লাভ করেছিল তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সাহাবায়ে কেরামের তারবিয়াত করেছেন। যার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানে পেশ করছি।
সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের কিতাবগুলোতে হুনাইনের যুদ্ধের ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। ঐ যুদ্ধে গনীমতের যে সম্পদ অর্জিত হয়েছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মক্কার ‘মুআল্লাফাতুল কুলূব’দের (অর্থাৎ ফতহে মক্কা বা কাছাকাছি সময়ে নতুন ইসলাম গ্রহণকারী, যাদেরকে ইসলামের উপর অবিচল রাখা ও ফতহে মক্কার দ্বারা তাদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল তার উপর একটি শীতল প্রলেপ দেয়া তাঁর ইচ্ছা ছিল) মাঝে বণ্টন করে দেন। মদীনার আনসারীদের এ সম্পদ থেকে কিছুই দেননি। এতে আনসারীদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হল এবং কেউ কেউ নানা কথাও বলে ফেললেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানানো হলে তিনি আনসারীদের এক জায়গায় একত্র করে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে যারা ‘ফকীহ’ (অর্থাৎ দ্বীনের প্রজ্ঞা যাদের আছে) তারা তো কিছু বলেননি তবে অন্যরা বলেছে।’ বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবীগণ কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতেন না। বাস্তব অবস্থা অকপটে তুলে ধরতেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনÑ
يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ أَلَمْ أَجِدْكُمْ ضُلاَّلاً فَهَدَاكُمُ اللَّهُ بِي،وَكُنْتُمْ مُتَفَرِّقِينَ فَأَلَّفَكُمُ اللَّهُ بِي، وَعَالَةً فَأَغْنَاكُمُ اللَّهُ بِي.
হে আনসারী সম্প্রদায়! তোমরা কি পথহারা ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের পথ দেখালেন? তোমরা কি বিবাদ-বিভক্তিতে জর্জরিত ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার দ্বারা তোমাদের ঐক্যবদ্ধ করলেন? তোমরা কি নিঃস্ব ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের নিঃস্বতা দূর করলেন?’ আল্লাহর রাসূল যখন এ কথাগুলো বলছিলেন তখন প্রতি প্রশ্নের উত্তরে আনসারী সাহাবীগণের জবাব ছিলÑ
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই (আমাদের প্রতি) অধিক অনুগ্রহকারী।’
(সুবহানাল্লাহ! লক্ষ্য করুন, এখানে আল্লাহর রাসূল সবার আগে হেদায়েতের নিআমত এরপর ঐক্যবদ্ধতার নিআমত এরপর সচ্ছলতার নিআমত উল্লেখ করেছেন) এরপর আল্লাহর রাসূল বললেনÑ
مَا يَمْنَعُكُمْ أَنْ تُجِيبُوا رَسُولَ اللَّهِ - صلى الله عليه وسلم-
‘তোমরাও তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রত্ত্যুত্তরে কিছু বলতে পার। তা বলছ না কেন?’
তোমরা তো বলতে পারÑ যদি বল তবে তা সত্যই হবে এবং তোমাদের সত্যবাদীই বলা হবেÑ যে, আপনি তো আমাদের কাছে ঐ সময় এসেছেন যখন অন্যরা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলেছে। তখন আমরা আপনাকে সত্যবাদী বলেছি।
আপনি ঐ সময় এসেছেন যখন আপনার কোনো সাহায্যকারী ছিল না। তখন আমরা আপনার নুসরত করেছি। আপনি এমন অবস্থায় এসেছেন যে, আপনাকে আশ্রয়হীন করা হয়েছে। ঐ সময় আমরা আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি।
আপনি এমন অবস্থায় এসেছেন যে, আপনি ছিলেন রিক্তহস্ত, ঐ সময় আমরা আপনার সহমর্মী হয়েছি।’
সুবহানাল্লাহ! কীভাবে মানব-মনের এক একটি কাঁটা বের করে আনছেন এবং হৃদয়কে কণ্টকমুক্ত করছেন!
আল্লাহর রাসূলের এই কথাগুলোর জবাবে আনসারীদের জবাব কী ছিল? তাঁদের জবাব ছিলÑ
بل المن علينا لله ولرسوله
বরং আমরাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কৃতার্থ। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪৩৩০ (ফতহুল বারী)
অর্থাৎ সাময়িক বিস্মৃতির পর তারা আবার প্রকৃত অবস্থায়, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় ফিরে এসেছেন। তাঁদের চেয়ে এ উপলব্ধি আর কাদের বেশি হতে পারে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত নুসরতকারী স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। আর যাদের তিনি এ নুসরতের কাজে ব্যবহার করেছেন এ তো তাদের পরম সৌভাগ্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তো কোনোরূপ মাধ্যম ছাড়াও তার দ্বীনের নুসরত করতে পারেন আবার যাদেরকে মাধ্যম বানিয়েছেন তারা ছাড়া অন্যদেরও মাধ্যম বানাতে পারেন। সুতরাং তাদের অনুসরণীয় ও অবিস্মরণীয় জবাবÑ
بل المن علينا لله ولرسوله
‘বরং আমরাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কৃতার্থ।’ এই হচ্ছে দ্বীনের সমঝ, নুসরতে দ্বীন সম্পর্ক সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এতক্ষণ তো ছিল তরবিয়াতের অস্ত্রোপচারপর্ব। এরপর ক্ষতস্থান সিলাই ও ব্যান্ডেজ-পর্ব। তা হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ কথাগুলো। সহীহ বুখারীর বর্ণনায় তা এভাবে আছেÑ
أَتَرْضَوْنَ أَنْ يَذْهَبَ النَّاسُ بِالشَّاةِ وَالْبَعِيرِ، وَتَذْهَبُونَ بِالنَّبِيِّ - صلى الله عليه وسلم - إِلَى رِحَالِكُمْ، لَوْلاَ الْهِجْرَةُ لَكُنْتُ امْرَأً مِنَ الأَنْصَارِ، وَلَوْ سَلَكَ النَّاسُ وَادِيًا وَشِعْبًا لَسَلَكْتُ وَادِيَ الأَنْصَارِ وَشِعْبَهَا، الأَنْصَارُ شِعَارٌ وَالنَّاسُ دِثَارٌ، إِنَّكُمْ سَتَلْقَوْنَ بَعْدِي أَثَرَةً فَاصْبِرُوا حَتَّى تَلْقَوْنِي عَلَى الْحَوْضِ.
তোমরা কি রাজি আছো যে, লোকেরা উট ও ছাগল নিয়ে ঘরে ফিরবে আর তোমরা ঘরে ফিরবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে? যদি হিজরতের প্রসঙ্গ না হত তাহলে আমি আনসারীদেরই একজন হতাম। (কিন্তু যেহেতু হিজরত অনেক বড় মর্যাদার বিষয় এজন্য আনসারী পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছি না। স্মর্তব্য, আনসারীগণ ছিলেন আল্লাহর রাসূলের মাতুল বংশীয়, তাছাড়া আরবে সম্বন্ধের নানা রীতি প্রচলিত ছিল) আর সকল মানুষ যদি এক গিরিপথ ও উপত্যকায় চলে আমি চলব আনসারীদের উপত্যকা ও গিরিপথে। (অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি তাদের সমর্পণ ও দুনিয়ার বিষয়ে নির্মোহতার পথই পছন্দনীয় পথ) আর আনসার হল আমার ভিতরের পোষাক (একান্ত কাছেরজন) আর অন্যরা বাইরের পোষাক। শোনো! আমার পর তোমরা বঞ্চনার শিকার হবে তখন সবর করো, পরিশেষে আমার সাথে তোমাদের সাক্ষাত হবে ‘হাউযে’র পাড়ে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪৩৩০
এই বাক্যগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা অন্য কোনো অবসরে আলোচনা করা যাবে।
তো, কুরআন-সুন্নাহর আলোকিত তারবিয়াতের মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরাম দ্বীনের সহীহ ‘ফিকহ’ অর্জন করেছিলেন যার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক চিন্তার স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতা।
তো ইবাদত, ইতাআত ও নুসরতে দ্বীনের যত কাজ রয়েছে এতে যুক্ত হতে পারা বান্দার সৌভাগ্য। এতে আল্লাহর প্রতি বান্দার কোনো অনুগ্রহ সাব্যস্ত হয় না।
কবি কত সুন্দর বলেছেনÑ
منت منہ کہ خدمت سلطاں ہمی کنی + منت شناس ازو کہ بخدمت بداشتت
মনে করো না সুলতানের ‘সেবা’ করে তাকে ধন্য করেছ। বরং কৃতার্থ হও যে, তিনি তোমাকে ‘সেবা’র সুযোগ দান করেছেন।
যাই হোক, হাদীসে কুদসীর উপরোক্ত দুই খিতাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অমুখাপেক্ষিতার বিবরণ এসেছে। তাঁর অভাবমুক্ততার আরেক দিক পরের খিতাবে উল্লেখিত হয়েছে।
নবম খিতাব-
يا عبادي! لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ، وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ، قَامُوا فِي صَعِيدٍ وَاحِدٍ فَسَأَلُونِي كُلُّ وَاحِدٍ مِنْكُمْ مَسْأَلَتَهُ، فَأَعْطَيْتُهُ، مَا نَقَصَ ذَلِكَ مِمَّا عِنْدِي , إِلا كَمَا يَنْقُصُ الْمِخْيَطُ إِذَا أُدْخِلَ فِي الْبَحْرِ
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রথম ও শেষজন তোমরা মানব ও জিন সকলেই যদি এক সমতল ভ‚মিতে সমবেত হয়ে আমার কাছে প্রার্থনা করতে থাক আর আমি সবাইকে তার প্রার্থিত বস্তু দান করতে থাকি তাহলেও আমার কাছে যা আছে তা থেকে শুধু এটুকু কমবে, যতটুকু সমুদ্রে একটি সুঁই ডোবালে কমে।’
পৃথিবীতে আমরা খালি চোখে যা কিছু দেখি ও উপলব্ধি করি এর মধ্যে ক্ষুদ্রতম হচ্ছে সুঁইয়ের মাথা, আর প্রশস্ততম হচ্ছে, সাগর, মহাসাগর। তাই বলা হয়, অথৈ সাগর, অতলান্ত জলরাশি। আল্লাহ পাকের কাছে যা আছে তা বোঝানোর জন্য বলা হচ্ছে, আল্লাহর সম্পদ যেন এক মহাসমুদ্র। আর তোমাদের সবার প্রার্থিত বস্তু যদি আল্লাহ তোমাদের দান করেন তাহলে সেই সম্পদ কতটুকু কমবে? একটা সুঁই যদি মহাসমুদ্রে ডোবাও এরপর তা তোলো, যদি সুঁইয়ের মাথার দিকে তাকাও তাহলে হয়তো এক বিন্দু পানি তুমি দেখতে পাবে। কিন্তু যদি মহাসমুদ্রের দিকে তাকাও তাহলে মহাসমুদ্রের পানি কতটুকু কমল বলে মনে হবে? এই হচ্ছে আল্লাহর ‘গিনা’ ও অভাবমুক্ততার উপমা। অর্থাৎ আল্লাহ পাক স্রষ্টা। তাঁর কাছে কোনো কিছুরই কমতি নেই। সুতরাং বান্দার কর্তব্য, তাঁরই কাছে প্রার্থনা করা।
কুরআন-সুন্নাহ বোঝার জন্য আরবী ভাষা-জ্ঞান ও সাহিত্যের সাধারণ রুচি অতিপ্রয়োজন
কুরআন মাজীদ কোনো নিষ্প্রাণ ‘আইন-গ্রন্থ’ মাত্র নয়, এ হচ্ছে ‘কিতাবুল হিদায়াহ’ হিদায়াতের কিতাব। এতে যেমন আইন আছে, তেমনি উপদেশও আছে। আসমানী ফরমান যেমন আছে তেমনি পূর্বের জাতিসমূহের কর্ম ও পরিণামের বিবরণও আছে। এ কিতাব যেমন মস্তিষ্ককে সম্বোধন করে তেমনি হৃদয়কেও সম্বোধন করে। এতে যেমন আছে বিধান ও ফরমানের প্রতাপ, তেমনি আছে উপমা-উদাহরণের মাধুর্য। এ কারণে কুরআনকে বোঝার জন্য যেমন প্রয়োজন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তেমনি প্রয়োজন ভাষার রুচি ও সংবেদন। এ জিনিসের অভাব হলে শুধু যে কুরআনের বর্ণনা-মাধুর্য থেকেই বঞ্চিত হতে হয় তা-ই নয়, ছোট-বড় বিভ্রান্তিও ঘটে থাকে এবং ঘটেছে। কারো যদি সহজ-সুন্দর ভাষা-বোধ না থাকে তাহলে তার মনে অহেতুক এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এ আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহর ‘সম্পদে’ও -নাউযুবিল্লাহ- সীমাবদ্ধতা আছে! কারণ যে বস্তু দ্বারা এর উপমা দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ সাগর, তা যত বড়ই হোক, সসীম বটে! অথচ ভাষা-বোধ যার আছে তার কাছে এ প্রশ্ন হাস্যকর। উপমার ক্ষেত্রে উপমান ও উপমিত সবদিক থেকে এক হওয়া জরুরি নয়। বিশেষ কোনো একটি বৈশিষ্ট্য সহজে বোঝানোই উপমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।
আমাদের আলোচ্য বিষয়টি আল্লাহর কুদরতের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহর ইলমের ব্যাপারেও এ ধরনের উপমা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। হযরত খাযির ও হযরত মূসা আ.-এর ঘটনা সবারই জানা আছে। কুরআন মাজীদে সূরা কাহফের শেষ দিকে এ ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। হাদীস শরীফে ঐ ঘটনার বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে আছে। সহীহ বুখারীর এক মওকুফ বর্ণনায় আছে যে, একটি পাখী সমুদ্র থেকে চঞ্চু দ্বারা পানি তুলল তখন খাযির আ. হযরত মূসা আ.-কে লক্ষ্য করে বললেন-
وَاللَّهِ مَا عِلْمِي وَمَا عِلْمُكَ فِي جَنْبِ عِلْمِ اللَّهِ إِلَّا كَمَا أَخَذَ هَذَا الطَّائِرُ بِمِنْقَارِهِ مِنَ البَحْرِ
আল্লাহর কসম! আল্লাহর ইলমের তুলনায় আমার ও তোমার ইলমের (সমষ্টির) উদাহরণ হচ্ছে এই যে পাখিটি, যে তার চঞ্চু দ্বারা সমুদ্র থেকে পানি নিল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭২৬
অথচ কে না জানে সমুদ্র যত বড়ই হোক তা সসীম। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইলম অসীম! তবে উপমার যে উদ্দেশ্য আল্লাহর জ্ঞানের সম্মুখে মানুষের জ্ঞানের অকিঞ্চিতকরতা প্রত্যক্ষ করে তোলা তাতে এ উপমা সফল। এই উপমা থেকে এ বিষয়টি উপলব্ধি না করে কেউ যদি সসীম-অসীমের তর্কে জড়িয়ে পড়ে, তবে তা যেমন হাস্যকর হয় তেমনি মর্মান্তিকও হয় বটে।
ইহুদী জাতির বিভ্রান্তি ও বেআদবী
কোনো কোনো সরলপ্রাণ-মুসলিমের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, পৃথিবীতে এমন দুর্ভাগা কে আছে, যে আল্লাহ তাআলার বিষয়েও অভাবের চিন্তামাত্রও করতে পারে? চারপাশের প্রকৃতিতেই তো আল্লাহ তাআলার গিনা ও অভাবমুক্ততার কত উদাহরণ! কিন্তু বাস্তবতা এই যে, কোনো কোনো জাতি এ বিষয়েও বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে, যার মূলে রয়েছে কুফর ও কিবর। কুরআন মাজীদে ইহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
لَقَدْ سَمِعَ اللّٰهُ قَوْلَ الَّذِیْنَ قَالُوْۤا اِنَّ اللّٰهَ فَقِیْرٌ وَّ نَحْنُ اَغْنِیَآءُ ۘ سَنَكْتُبُ مَا قَالُوْا وَ قَتْلَهُمُ الْاَنْۢبِیَآءَ بِغَیْرِ حَقٍّ ۙ وَّ نَقُوْلُ ذُوْقُوْا عَذَابَ الْحَرِیْقِ
আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন ওদের কথা যারা বলেছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অভাবগ্রস্ত আর আমরা অভাবমুক্ত। ওরা যা বলেছে তা এবং ওরা যে নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে তা আমি লিখে রাখব এবং বলব, ভোগ কর দহন-যন্ত্রণা। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮১
তবারী ও ইবনে আবী হাতিম হাসান সনদে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আবু বকর সিদ্দীক রা. একদিন ‘বাইতুল মিদরাস’-এ গেলেন (এটি ছিল ইহুদীদের একটি ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র) ওখানে অনেক ইহুদী ওদের এক ধর্মগুরু ফিনহাসের কাছে বসে ছিল। আশইয়া‘ নামে আরেক ধর্মগুরুও উপস্থিত ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. ফিনহাসকে লক্ষ করে বললেন, ওহে ফিনহাস! আল্লাহকে ভয় কর এবং ইসলাম কবুল কর। আল্লাহর কসম! তোমার খুব ভালোভাবেই জানা আছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছেন। যার কথা তোমরা তোমাদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পাচ্ছ। ফিনহাস তখন বলল, হে আবু বকর! আল্লাহর কসম! আল্লাহর প্রতি আমাদের কোনো মুখাপেক্ষিতা নেই; বরং সে-ই আমাদের মুখাপেক্ষী। আমরা তার কাছে কাকুতি-মিনতি করি না, সে-ই আমাদের কাছে কাকুতি মিনতি করে। সে যদি আমাদের থেকে অমুখাপেক্ষী হত তাহলে আমাদের কাছে ঋণ চাইত না। যেমনটা তোমার সঙ্গী বলে থাকে! একদিকে সে আমাদের জন্য সুদ নিষিদ্ধ করে অন্যদিকে নিজেই সুদ দান করে। সে যদি অভাবী না হবে তাহলে সুদ দেবে কেন?! (নাউযুবিল্লাহ)
তার এ ধৃষ্টতাপূর্ণ কটূক্তি শুনে আবু বকর রা. ক্ষুব্ধ হলেন এবং ফিনহাসের মুখে সজোরে আঘাত করলেন এবং বললেন, ঐ সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার প্রাণ। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে যদি ঐ চুক্তি না থাকত তাহলে হে আল্লাহর দুশমন! তোমাকে আজ শেষ করে দিতাম। ঠিক আছে তোমরা যদি সত্যবাদীই হয়ে থাক তাহলে যত পার আমাদের অস্বীকার কর। ফিনহাস আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, হে মুহাম্মাদ! দেখ, তোমার সঙ্গী আমার কী হাল করেছে! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কেন এমন করলে হে আবু বকর! আবু বকর রা. বললেন, আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর দুশমন অতি মারাত্মক কথা বলেছে। সে বলেছে, আল্লাহ অভাবী আর ওরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী নয়। সে যখন এহেন উক্তি করল তখন আমি আল্লাহর জন্য ক্ষুব্ধ হয়েছি এবং ওর মুখে আঘাত করেছি। তখন ফিনহাস পরিষ্কার অস্বীকার করে বলল, জ্বী না, আমি এমন কথা বলিনি। তখন কুরআন মাজীদের এ আয়াত নাযিল হল। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৬৫১
দ্বীন-ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ইহুদীদের চরিত্র
এটা এক মর্মান্তিক বাস্তবতা যে, ইহুদীজাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের সাথে এবং আসমানী কিতাব ও আসমানী দ্বীনের সাথে চরম ঔদ্ধত্য ও নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে অভিশপ্ত হয়েছে। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর আনীত দ্বীনের সাথেও তাদের আচরণ একই রকম ছিল। কুরআনের অর্থ-বিকৃতি, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি উপহাস, দ্বীন ও শরীয়ত নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছিল এদের জাতীয় চরিত্র। এ ঘটনাতেই দেখুন, কুরআন মাজীদের একটি বাণীর কী নির্মম বিকৃতি।
আল্লাহ তাআলার ঋণ চাওয়ার অর্থ
সূরা বাকারায় ইরশাদ হয়েছে-
وَ قَاتِلُوْا فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ اعْلَمُوْۤا اَنَّ اللّٰهَ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ مَنْ ذَا الَّذِیْ یُقْرِضُ اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا فَیُضٰعِفَهٗ لَهٗۤ اَضْعَافًا كَثِیْرَةً ؕ وَ اللّٰهُ یَقْبِضُ وَ یَبْصُۜطُ ۪ وَ اِلَیْهِ تُرْجَعُوْنَ
অর্থ: আল্লাহর পথে লড়াই কর এবং জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব কিছু শোনেন, সব কিছু জানেন।
কে আছে যে আল্লাহকে করয দিবে উত্তম করয; অতপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন? আল্লাহই সংকুচিত করেন এবং তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে। -সূরা বাকারা (২) : ২৪৪-২৪৫
কুরআন মাজীদের এ আয়াতেই বলা হচ্ছে যে, ধন-সম্পদ, রিযক সব আল্লাহর হাতে। তিনিই সংকোচন করেন, তিনিই প্রশস্ততা দান করেন। সুতরাং তিনিই যখন বান্দাকে লক্ষ্য করে বলছেন, কে আছে যে আল্লাহকে করয দিবে? তখন সহজেই বোঝা যায়, এর অর্থ তাঁর ‘অভাবী’ হওয়া নয় (নাউযুবিল্লাহ) এ তো বান্দার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ যে, বান্দাকে তিনি এ ভাষায় উৎসাহিত করেছেন। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, বান্দাকে নেক আমলে ও দ্বীনের পথে জান-মাল কুরবানীতে উৎসাহিত করা। এতে বান্দার নিজের উপকার, এই কুরবানীর বিনিময় বান্দা নিজেই লাভ করবে। এক আরিফ তো আরো অগ্রসর হয়ে বলেছেন,
جان دى دى ہوئ اسى كى تھی + حق تو يہ ہے كہ حق ادا نہ ہوا
এই প্রাণ তো তাঁরই দেয়া + সুতরাং হক কথা এই যে, (তাঁর পথে প্রাণ বিসর্জন দ্বারা তাঁর) হক আদায় হয়নি। তাঁর অনুগ্রহের প্রতিদান হয়নি।
আলিমগণ বলেন, এখানে ‘করজ’ শব্দের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেভাবে করজ পরিশোধ করা অপরিহার্য-সেভাবে তোমাদের কর্মের বিনিময়ও আমি আমার উপর অপরিহার্য করে নিচ্ছি। আবার কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহকে করজ দেওয়ার অর্থ তাঁর বান্দাদেরকে করজ দেওয়া এবং তাদের অভাব পূরণ করা। আর এর বিনিময় আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে বহুগুণ বাড়িয়ে দান করবেন।
সহীহ মুসলিমে একটি দীর্ঘ হাদীসে কুদসী আছে, যাতে অন্নহীনকে অন্নদান, পিপাসার্তের তৃষ্ণা নিবারণ এবং অসুস্থের ইয়াদাতকেও এ ধরনের মহিমাপূর্ণ ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। ঐ হাদীসে কুদসীর ভাষা ও উপস্থাপনার পরম মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি আব্দুল কাদির একে কাব্যরূপ দান করেছেন-
হাশরের দিন বলিবেন খোদা- হে আদম সন্তান/তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান।/মানুষ বলিবে - তুমি প্রভু করতার,/আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার?/বলিবেন খোদা- দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে,/তারি শুশ্রƒষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে।/খোদা বলিবেন- হে আদম সন্তান,/ আমি চেয়েছিনু ক্ষুধায় অন্ন, তুমি কর নাই দান।/মানুষ বলিবে- তুমি জগতের প্রভু,/আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে, সে কাজ কি হয় কভু?/বলিবেন খোদা- ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে,/মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে।/পুনরপি খোদা বলিবেন- শোন হে আদম সন্তান,/ পিপাসিত হয়ে গিয়েছিনু আমি, করাও নি জল পান।/মানুষ বলিবে- তুমি জগতের স্বামী,/তোমারে কেমনে পিয়াইব বারি, অধম বান্দা আমি?/বলিবেন খোদা- তৃষ্ণার্ত তোমা ডেকেছিল জল আশে,/তারে যদি জল দিতে তুমি তাহা পাইতে আমায় পাশে।
যাই হোক, আসল কথা হল, কুরআনে বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার যে খিতাব, তার মাধুর্য উপলব্ধি করা ও আপ্লুত হওয়ার জন্যও তো হৃদয়ে কিছু প্রাণ ও স্পন্দন থাকতে হয়। নির্জীব নিষ্প্রাণ হৃদয় কীভাবে উপলব্ধি করবে এই আসমানী খিতাবের মাধুর্য।
সাহাবীগণের জীবনে কুরআনের প্রভাব
একদিকে ইহুদী পণ্ডিত স্রষ্টার এই অনুগ্রহকে ব্যঙ্গ করল অন্যদিকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী হযরত আবুদ দাহদাহ রা.-এর অবস্থা দেখুন : এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক! আল্লাহ তাআলা কি আমাদের নিকট ঋণ চাচ্ছেন? তাঁর তো ঋণের প্রয়োজন নেই। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, আল্লাহ তাআলা এর বদলে তোমাদেরকে বেহেশতে প্রবেশ করাতে চাচ্ছেন। আবুদ দাহদাহ রা. একথা শুনে বললেন, আল্লাহর রাসূল! হাত বাড়ান। তিনি হাত বাড়ালেন। আবুদ দাহদাহ বলতে লাগলেন, ‘আমি আমার দুটি বাগানই আল্লাহকে ঋণ দিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, একটি আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দাও এবং অন্যটি নিজের পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য রেখে দাও। আবুদ দাহদা বললেন, আপনি সাক্ষী থাকুন, এ দুটি বাগানের মধ্যে যেটি উত্তম- যাতে খেজুরের ছয় শ’ ফলন্ত বৃক্ষ রয়েছে, সেটা আমি আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করলাম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর বদলে আল্লাহ তোমাকে বেহেশত দান করবেন।
আবুদ দাহদা রা. বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বিষয়টি জানালেন। স্ত্রীও তাঁর এ সৎকর্মের কথা শুনে খুশী হলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘খেজুরে পরিপূর্ণ অসংখ্য বৃক্ষ এবং প্রশস্ত অট্টালিকা আবুদ দাহদাহের জন্য তৈরি হয়েছে’। -আবু ইয়ালা, তবারানী-মাজমাউয যাওয়াইদ ৯/৩২৪, হাদীস ১৫৭৯২
দেখুন, কুরআন মাজীদের এক আয়াতে দুই শ্রেণির মানুষের মাঝে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া হল। যারা কাফির তাদের কুফর বৃদ্ধি পেল আর যারা মুমিন, যাদের অন্তরে রয়েছে ঈমানের আলো, তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেল।
আমাদের যাদেরকে আল্লাহ ঈমান নসীব করেছেন তাদের কর্তব্য, নিজের পথ চিনে নেওয়া এবং কারা আমাদের পূর্বসূরী তা স্মরণ করা। নতুবা গাফলত ও উদাসীনতা অনেক মুসলিমকেও ইহুদি-নাসারার পথে নিয়ে যেতে পারে। আল্লাহ হেফাযত করুন। এরপরের খিতাব-
দশম খিতাব-
يَا عِبَادِي إِنَّمَا هِيَ أَعْمَالُكُمْ أُحْصِيهَا لَكُمْ، ثُمَّ أُوَفِّيكُمْ إِيَّاهَا
হে আমার বান্দাগণ! আমি তোমাদের জন্য তোমাদের কর্মগুলো গুণে গুণে সংরক্ষণ করছি। এরপর তোমাদের তা বুঝিয়ে দেবো’।
فَمَنْ وَجَدَ خَيْرًا، فَلْيَحْمَدِ اللهَ وَمَنْ وَجَدَ غَيْرَ ذَلِكَ، فَلَا يَلُومَنَّ إِلَّا نَفْسَهُ
‘ঐ সময় যে উত্তম পরিণাম লাভ করবে সে যেন আল্লাহর শোকরগোযারি করে (আল্লাহই তাকে তাওফীক দিয়েছেন)। আর যে এর বিপরীত কিছু লাভ করে সে যেন নিজেকেই ভর্ৎসনা করে (কারণ এটা তার কর্মফল)।
দেখুন হাদীস শরীফের শব্দগত সৌন্দর্য। এখানে বলা হচ্ছে ‘غير ذلك ’(-এর বিপরীত কিছু) উত্তম পরিণামের বিপরীত হচ্ছে মন্দপরিণাম, অশুভ পরিণাম। কিন্তু মন্দ ও অশুভ কথাটা উচ্চারণ করাও পছন্দ করা হয়নি। তাই তো বলা হচ্ছে, ‘যে এর বিপরীত কিছু লাভ করে’।
এই হল এই হাদীসে কুদসীর সরল তরজমা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা। এখান থেকে আমরা আল্লাহ পাকের কিছু ছিফাত ও বৈশিষ্ট্য জানতে পেরেছি এবং আমাদের কিছু করণীয় সম্পর্কেও জানতে পেরেছি। আমাদের কর্তব্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে জানা, তাঁর সিফাত ও গুণাবলীর পরিচয় লাভ করা এবং আমাদের তিনি যে হায়াতটুকু দান করেছেন তা ঈমান ও আমলে ছালেহের সাথে অতিবাহিত করা। তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের জন্য শুভ পরিণাম অপেক্ষা করছে।
আল্লাহ পাকের কালাম, যা নামাযে তিলাওয়াত করা হয়, নামাযে যার শব্দগুলোই পাঠ করতে হয়, তরজমা পঠের সুযোগ নেই, যা তিলাওয়াত করাই একটি বিশেষ ইবাদত, অর্থ না বুঝলেও যে ইবাদতের ছাওয়াব পাওয়া যায়- এই কালাম হল, আলকুরআনুল কারীম, যা মুসহাফে লিপিবদ্ধ ও সুসংরক্ষিত এবং যে মুসহাফ অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করা বৈধ নয়।
তো কুরআন কারীমও আল্লাহ পাকের কালাম, আল্লাহ পাকের বাণী ও বিধান, হাদীসে কুদসীও আল্লাহ পাকের কালাম, বাণী ও সম্বোধন, কিন্তু এ দুয়ের মাঝে পার্থক্য আছে। কুরআন কারীম আলাদা, হাদীসে কুদসী আলাদা। কুরআন কারীমের এমন কিছু বিধান ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা একান্তই কুরআন কারীমের। শরীয়তের অন্যান্য নসের এই বিধান ও বৈশিষ্ট্য নেই। শরীয়তের অন্যান্য নসের মতো হাদীসে কুদসীও একটি নস।
যারা আরবী বোঝেন এবং আল্লাহর কালামের জালাল ও প্রতাপ উপলব্ধির মত সংবেদন অন্তরে ধারণ করেন তাঁরা এই হাদীসে কুদসীগুলো পাঠ করলে শিহরিত হয়ে ওঠেন।
বিখ্যাত তাবেয়ী আবু ইদ্রিস আলখাওলানী রাহ., যিনি হযরত আবু যর আলগিফারী রা. থেকে এই হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি যখন হাদীসটি বর্ণনা করতেন তখন হাঁটুর উপর দাঁড়িয়ে প্রভুর এই ফরমান বর্ণনা করতেন। এই হাদীসের জালাল ও প্রতাপ এভাবে তাঁকে অভিভ‚ত করেছিল। এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. বলেছেন, ‘শামের অধিবাসীগণ যে সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে অভিজাত ও সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ হাদীস হচ্ছে এই হাদীস।
কালামের সূচনা
এখানে আল্লাহ পাকের কালাম শুরু হয়েছে يا عبادي সম্বোধনের মাধ্যমে। মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে যে, আসমান-যমীনের যিনি স্রষ্টা, জগত-মহাজগতের যিনি সৃষ্টিকর্তা, তিনি তাদের সম্বোধন করছেন يا عبادي (হে আমার বান্দাগণ!) বলে।
আমাদের এক বড় মনীষী কাযী ইয়ায রাহ.। মুহাদ্দিস, মুফাসসির ছিলেন। তাঁর দু’টি পঙতি বর্ণনা করা হয়-
وَمِمَّا زَادَنِي شَرَفًا وَفَخْرًا + وَكِدْتُ بِأَخْمُصِي أَطَأُ الثُّرَيَّا
دُخُولِي تَحْتَ قَوْلِكَ يَا عِبَادِيَ + وَأَنْ أَرْسَلْتَ أَحْمَدَ لِي نَبِيَّا
‘আমার গর্ব ও গৌরব কে পরিমাণ করতে পারে? আমি তো ছুরাইয়া তারকাও ভেদ করে উঠে যেতে চাই। কারণ, হে প্রভু! তুমি যে আমায় সম্বোধন করেছ ‘ইয়া ইবাদী’ বলে, আর আহমদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) বানিয়েছ আমার নবী।’
এরচেয়ে বড় গৌরবের বিষয় আর কী হতে পারে? একজন ক্ষুদ্র মানবের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য তো আর কিছুই হতে পারে না। এই যে আনন্দ এটা ঈমানী আনন্দ। এই আনন্দ যার নসীব হয়েছে তার তো অমূল্য সম্পদ নসীব হয়েছে।
এই হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাকের দশটি সম্বোধন রয়েছে। দশবার তিনি বান্দাদের সম্বোধন করেছেন ‘ইয়া ইবাদী’ বলে আর দশটি কথা তিনি বলেছেন বান্দাদের লক্ষ করে।
প্রথম সম্বোধন
حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي.
হে আমার বান্দাগণ! ‘আমি নিজের উপর যুলুম হারাম করে নিয়েছি’।
আল্লাহ পাক হলেন ঐ মহাপরাক্রমশালী সত্তা যাকে জিজ্ঞাসা করার কেউ নেই। কারো কাছে তাঁর জবাবদিহিতা নেই।
لا يُسْئَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْئَلُونَ.
তিনি তো সর্বশক্তিমান- স্রষ্টা ও প্রভু, সব তাঁর সৃষ্টি ও দাস। কে আছে তাঁকে জিজ্ঞাসা করার? কিন্তু তিনি বলেন, আমি নিজের উপর যুলুমকে হারাম করে নিয়েছি। সুতরাং আমি কারো উপর যুলুম করি না। ফরমানের সূচনাই আল্লাহ পাক করেছেন নিজের এই সিফাতের বর্ণনার মাধ্যমে যে, আমি নিজেই নিজের উপর যুলুমকে হারাম করে নিয়েছি। সুতরাং আল্লাহ তাআলা অন্যায়-অবিচার থেকে পবিত্র। এতে বান্দার জন্য এই নির্দেশনাও আছে যে, আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে বান্দার জন্য যে বিধান ও পথনির্দেশ আসে তা বান্দার জন্য পূর্ণ কল্যাণকর। বান্দার দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণকর। সকল শ্রেণির মানুষের জন্য কল্যাণকর। আল্লাহ পাক তো সকল স্বার্থ-চিন্তার ঊর্ধ্বে, সব রকম অবিচার থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
মানুষ তার চারপাশের জন্য বিভিন্ন নিয়ম-কানুন তৈরি করে। যারা প্রস্তুত করে তারা যেহেতু সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়, স্বার্থ-চিন্তা ও ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়, তাই এই নিয়ম ও বিধানে মানবীয় দুর্বলতার ছায়া ও প্রতিফলন থাকে। কিন্তু আল্লাহ পাক হলেন ঐ সত্তা যিনি সকল স্বার্থ-চিন্তার ঊর্ধ্বে। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন। সুতরাং তার পক্ষ থেকে যে বিধান ও নির্দেশ আসে সেটিই ত্রুটিমুক্ত, ভারসাম্যপূর্ণ।
وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا.
‘তোমাদের মাঝেও যুলুমকে হারাম করেছি’।
আমরা যদি কুরআন-সুন্নাহর নুসূস অধ্যয়ন করি তাহলে যুলুমের দুটি প্রকার দেখতে পাই। যুলুম কুরআন ও সুন্নাহর নুসূসে দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এক. নিজের প্রতি যুলুম। দুই. অন্যের প্রতি যুলুম।
আমাদের সীমাবদ্ধ চিন্তায় আমরা শুধু অন্যের প্রতি যুলুমকেই যুলুম মনে করি। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহর নুসূস আমাদের দৃষ্টিকে পরিচ্ছন্ন করে এবং প্রসারিত করে। কুরআন-সুন্নাহ বলে, যুলুম দুই প্রকার। এক হল নিজের প্রতি যুলুম। আরেক হল অন্যের প্রতি যুলুম। অন্যের প্রতি যুলুমও পরিণামে নিজের প্রতিই যুলুম। চিন্তা করলে দেখা যাবে, এটিই বাস্তবতা। প্রকৃতপক্ষে মানুষ তার অন্যায় ও গর্হিত কর্মের দ্বারা নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। কুরআন মাজীদের আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
وَما ظَلَمْناهُمْ وَلكِنْ كانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ.
আমি তাদের প্রতি কোনো যুলুম করিনি; কিন্তু তারাই নিজেদের প্রতি যুলুম করত। -সূরা নহল (১৬) : ১১৮
আখেরাতে যখন ফায়সালা হবে, জাহান্নামীদের জন্য জাহান্নামের ফায়সালা হয়ে যাবে তখন আল্লাহ পাক বলবেন, আমি তাদের উপর যুলুম করিনি; বরং তারাই নিজেদের উপর যুলুম করেছে। আপন কর্মের ফল তারা আজ ভোগ করছে। কুরআন মাজীদের আরো বহু আয়াতে এই বিষয়টি এসেছে।
একটি সহীহ হাদীসে এসেছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَيُمْلِي لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُ، قَالَ: ثُمَّ قَرَأَ : وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ القُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ.
‘আল্লাহ পাক যালিমকে অবকাশ দিতে থাকেন। ঢিল দিতে থাকেন। কিন্তু এরপর যখন পাকড়াও করেন তখন আর ছাড়েন না। এরপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন- (তরজমা) এমনই হয় তোমার রবের পাকড়াও, যখন তিনি জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন, ওদের যুলুমে লিপ্ত অবস্থায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৮৬
এই হাদীসে যালিম মানে কী? এখানে ‘যালিম’ উভয় অর্থকেই শামিল করছে। অন্যের প্রতি যে যুলুম করে সেও শামিল। আর যে ব্যক্তিগত পাপাচারে লিপ্ত থাকে, সে-ও শামিল।
তো কুরআন ও সুন্নাহর নুসূস আমাদের জানাচ্ছে, কাকে বলে যুলুম আর কাকে বলে যালেম। সব রকমের পাপাচার যুলুম, নিজের উপর যুলুম। অন্যের হক্ব নষ্ট করাও যুলুম। পরিণামের বিচারে এটাও নিজের উপর যুলুম। এই স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি যার আছে সে তো নিজের স্বার্থেই পাপাচার ও অবিচার থেকে বেঁচে থাকবে। এই বিশ্বাস যত দৃঢ় হবে কর্ম ও আচরণ ততই প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে। পক্ষান্তরে পাপাচার যদি হয় ‘ভোগ’ ও ‘উপভোগ’, অন্যের হক্ব নষ্ট করা যদি হয় ‘কর্তৃত্ব’ ও ‘কৃতিত্ব’ তাহলে তো পাপাচার, অবিচার চলতেই থাকবে। এই হচ্ছে দুই দৃষ্টিভঙ্গি, কর্ম ও আচরণ সম্পর্কে দুই মূল্যায়ন। এখন আমাদের চিন্তা করা উচিত কোন্ মূল্যায়ন বাস্তবসম্মত এবং কোন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তি ও সমাজের জন্য কল্যাণকর।
মূল কথায় ফিরে আসি। এই হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, তিনি নিজের উপর যুলুম হারাম করে নিয়েছেন এবং মানুষের উপরও একে অপরের প্রতি যুলুমকে হারাম করেছেন।
সহীহ মুসলিমে একটি হাদীস আছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করেছেন-
أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ؟
তোমরা কি জানো তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিঃস্ব কে?
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ!
الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهُ وَلَا مَتَاعَ.
আমাদের মধ্যে নিঃস্ব ব্যক্তি সে, যার অর্থ-সম্পদ নেই।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বললেন-
إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلَاةٍ، وَصِيَامٍ، وَزَكَاةٍ، وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا، وَقَذَفَ هَذَا، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا، وَضَرَبَ هَذَا، فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ، أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ، ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ.
‘আমার উম্মতের নিঃস্ব ঐ লোক, যে কিয়ামতের দিন সালাত-সিয়াম-যাকাত নিয়ে আগমন করবে কিন্তু কাউকে সে গালি দিয়েছিল, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল, কারো রক্ত ঝরিয়েছিল। তো একে তার নেক আমল দিয়ে দেওয়া হবে, ওকেও তার নেক আমল দিয়ে দেওয়া হবে। যখন নেক আমলগুলো শেষ হবে তখন ঐসকল লোকের গুনাহ এই ব্যক্তির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হবে, এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (এ হচ্ছে আমার উম্মতের সবচেয়ে মিসকীন, সবচেয়ে রিক্তহস্ত।) -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮১
আরেকটি সহীহ হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম জানিয়েছেন, যখন জান্নাত-জাহান্নামের ফায়সালা হবে, জান্নাতীগণ জান্নাতে যাবে আর জাহান্নামীরা জাহান্নামে যাবে এর আগে একটা ব্যাপার ঘটবে। সেই ব্যাপার হল, কোনো জান্নাতী এই অবস্থায় জান্নাতে যেতে পারবে না যে, কোনো একজন জাহান্নামীর তার কাছে কোনো পাওনা আছে। এমন নয় যে, ঐ লোক তো জাহান্নামী, তার প্রতি যদি কোনো জান্নাতী কিছু যুলুম করেও থাকে তা ধরা হবে না, বিবেচনায় আনা হবে না। না, ধরা হবে এবং নিষ্পত্তি করা হবে। একজন জাহান্নামীরও পাওনা থাকা অবস্থায় কোনো জান্নাতী জান্নাতে যেতে পারবে না। আল্লাহ পাক তাদের বিবাদ মিটাবেন। এরপর জান্নাতী জান্নাতে যেতে পারবে।
আল্লাহ পাক এই হাদীসে কুদসীতে খুব জালাল ও প্রতাপের সাথে ইরশাদ করেছেন- আমি তোমাদের মাঝে যুলুমকে হারাম করেছি। সুতরাং সাবধান! কেউ কারো প্রতি যুলুম করো না।
দ্বিতীয় খিতাব
يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ ضَالٌّ إِلَّا مَنْ هَدَيْتُهُ، فَاسْتَهْدُونِي أَهْدِكُمْ.
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা সকলেই পথ-না-জানা। আমি যাকে পথ দেখাই সে-ই শুধু পথ পায়। সুতরাং আমার কাছে পথের দিশা প্রার্থনা কর। আমি তোমাদের পথের দিশা দিব।’
আল্লাহ পাক মানুষকে সত্য গ্রহণের যোগ্যতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষ যখন সত্যের সন্ধান পায় তখন স্বভাবগতভাবেই সত্যের প্রতি প্রলুব্ধ হয়, কিন্তু শয়তানের ধোকায়, প্রবৃত্তির তাড়নায় এবং চারপাশের জগতের হাতছানিতে সে সত্য থেকে বিচ্যুত হয়, তখন মিথ্যা ও অন্যায়ের পথে চলা তার জন্য সহজ হয়ে যায়।
সত্যের পথে চলতে হলে প্রথমে মানুষকে সত্যের সন্ধান পেতে হয়। এরপর মিথ্যার হাতছানি থেকেও আত্মরক্ষা করতে হয়। আর এ দুইয়ের প্রত্যেকটিই শুধু হতে পারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তাওফীকের মাধ্যমে। সুতরাং আল্লাহ পাকের ইরশাদ-
كُلُّكُمْ ضَالٌّ إِلَّا مَنْ هَدَيْتُهُ.
‘তোমাদের সকলেই পথ-নাজানা। আমি যাকে পথ দেখাই শুধু সে-ই পথ পায়। আমি যাকে সুপথে পরিচালিত করি শুধু সে-ই সঠিক পথের পথিক হয়।’
সুতরাং তোমরা আমার কাছে হেদায়েত চাও। আমি তোমাদের হেদায়েত দান করবো। এটা হল আল্লাহ পাকের ওয়াদা। যে বান্দা আল্লাহর কাছে হেদায়েত চায় আল্লাহ পাক অবশ্যই ঐ বান্দাকে হেদায়েত দান করেন। এটা দুনিয়ার জীবনে বান্দার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
তৃতীয় খিতাব
يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ جَائِعٌ، إِلَّا مَنْ أَطْعَمْتُهُ، فَاسْتَطْعِمُونِي أُطْعِمْكُمْ.
‘হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই অন্নহীন, শুধু সে-ই অন্ন পায় যাকে আমি অন্ন দান করি। সুতরাং আমার কাছে অন্ন চাও, আমি তোমাদের অন্ন দান করব।’
আল্লাহ তাআলাই রাযযাক। তিনিই একমাত্র রিযিকদাতা। মানুষ শুধু আল্লাহর রিযিক অন্বেষণ করতে পারে। সূরায়ে ওয়াকিয়ায় এ সত্য তিনি কত সুন্দর করেই না বলেছেন-
أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَحْرُثُونَ، أَأَنْتُمْ تَزْرَعُونَهُ أَمْ نَحْنُ الزَّارِعُونََ.
‘তোমরা যে চাষাবাদ কর বল তো এই চাষবাস থেকে ফল-ফসল তোমরা উৎপন্ন কর, না আমি উৎপন্ন করি?’ -সূরা ওয়াকিআ (৫৬) : ৬৩-৬৪
أَفَرَأَيْتُمُ الْماءَ الَّذِي تَشْرَبُونَ، أَأَنْتُمْ أَنْزَلْتُمُوهُ مِنَ الْمُزْنِ أَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُونَ.
‘বল তো তোমরা যে পানি পান কর, মেঘমালা থেকে তা কি তোমরা বর্ষণ কর না আমি বর্ষণ করি?’ -সূরা ওয়াকিআ (৫৬) : ৬৮-৬৯
তাহলে অন্ন দানকারী কে? আল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের অন্ন দান করেন। আমরা আল্লাহরই কাছে অন্ন চাই।
চতুর্থ খিতাব
يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ عَارٍ، إِلَّا مَنْ كَسَوْتُهُ، فَاسْتَكْسُونِي أَكْسُكُمْ.
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা সকলেই বস্ত্রহীন। আমি যাকে বস্ত্র দেই, শুধু সেই বস্ত্র পায়। সুতরাং আমার কাছে বস্ত্র চাও, আমি তোমাদের বস্ত্র দান করব।’
এককথায় বান্দার যত প্রয়োজন তা পূরণ করেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। কিন্তু আল্লাহ যে পূরণ করেন সেটা আমাদের চিন্তায় থাকে না। প্রাত্যহিকতার কারণে এবং আমাদের কিছু কর্ম-প্রয়াস যুক্ত থাকার কারণে আল্লাহর স্মরণ আমাদের চিন্তা থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায়। আমরা মনে করি এ-ই তো নিয়ম। দেখুন, প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠে, সন্ধ্যায় অস্ত যায়। প্রাত্যহিকতার কারণে এ অতি সাধারণ ব্যাপার। আমাদের চিন্তা ও মস্তিষ্ক রাত-দিনের গমনাগমনে সচকিত হয় না। অথচ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত সৌর জগতের কত বড় ঘটনা! এই ঘটনা যিনি প্রতিনিয়ত ঘটান তিনি কত বড় শক্তিমান!
শস্যের বীজ জমিতে বপন করা হলে গাছ জন্মায়, তা থেকে শস্য পাওয়া যায়। প্রাত্যহিকতার কারণে এ অতি সাধারণ ঘটনা। সুতরাং আমাদের চিন্তা ও মস্তিষ্ক এতে সচকিত হয় না। সে নিয়মটিই শুধু জানে। নিয়মের নিয়ন্তা পর্যন্ত পৌঁছার তাড়না বোধ করে না। অথচ একটি বৃক্ষের অঙ্কুরোদ্গম প্রকৃতির কত বড় ঘটনা। যিনি তা নিপুণভাবে ঘটান তিনি কত নিপুণতার অধিকারী!
সকালে একজন মানুষ কর্মস্থলে যায়, সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। এভাবে সে তার জীবিকা উপার্জন করে। প্রাত্যহিকতার কারণে মনে হয় এ-ই নিয়ম। এভাবেই জীবিকা আসে। তার চিন্তা ও মস্তিষ্ক এর অধিক কিছু চিন্তার প্রেরণা বোধ করে না। অথচ প্রাণীজগতে জীবিকা কত বড় ঘটনা! যিনি তা সৃষ্টি করেছেন ও বণ্টন করেছেন তিনি কত মহান, কত শক্তিমান!
তো মানুষ প্রাত্যহিকতার কারণে এবং আপন চিন্তাশক্তির অক্ষমতার কারণে চারপাশের বাস্তবতা সম্পর্কেও গাফিল থাকে, তাই আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাকে সচেতন করেছেন এবং জানিয়েছেন, তার যা কিছু প্রয়োজন তা তিনিই পূরণ করেন। সুতরাং বান্দার প্রথম কর্তব্য, আপন প্রভুর অনুগ্রহ সম্পর্কে সচেতন হওয়া।
সহীহ মুসলিমে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ পাক বান্দার এই আমলটিকে খুব পছন্দ করেন যে, সে খাবার গ্রহণ করে এবং ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলে। সে পানি পান করে এবং ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলে।
এত ছোট্ট আমল, খাবার খেল এরপর বলল, ‘আলহামদু লিল্লাহ’। পানি পান করল এরপর বলল, ‘আলহামদু লিল্লাহ’, এতেই আল্লাহ তাআলা রাজিখুশি! আপাতদৃষ্টিতে আমলটা ছোট, কিন্তু বাস্তবে অনেক বড়। যে আলহামদু লিল্লাহ বলে এই ছোট্ট কথাটিতে তার এই বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটে যে, আমার একজন প্রভু আছেন, যিনি আমার অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করেন। তিনিই আমার জন্য এই সকল নিআমতের ব্যবস্থা করেছেন। আমি তার শোকরগোযারি করছি। চিন্তা করুন, কত বড় কথা! কত বড় সত্যের উপলব্ধি ও স্বীকৃতি! যদি বিষয়টি হৃদয় দ্বারা উপলব্ধি করে থাকেন, তাহলে নিজেই বিবেচনা করুন, এই সত্যের সাথে যার পরিচয় ঘটেনি সে কত বড় বাস্তবতা থেকে বঞ্চিত! আরো চিন্তা করুন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে কত সহজে কত বড় সৌভাগ্য অর্জন করেছি! আলহামদু লিল্লাহ! ছুম্মা আলহামদু লিল্লাহ। এই একটিমাত্র বাক্যের দ্বারা, যদি তা অন্তর থেকে উৎসারিত হয়, ঈমানের সাথে হয়, কৃতজ্ঞতার সাথে হয়, হতে পারে আল্লাহ পাক কাউকে মাফ করে দেবেন, কারো বেড়া পার করে দেবেন।
হাদীস শরীফে আছে, বান্দা কখনো কখনো একটি কথা বলে, ولم يلق لها بالا ‘সে এটাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথাই মনে করে না।’ কিন্তু আল্লাহ পাক তার এ কথার কারণে তার জন্য জান্নাতের ফায়সালা করে দেন। আবার এমনও হয় যে, বান্দা একটি কথা বলে, ولم يلق لها بالا ‘সে এটাকে কোনো কথাই মনে করে না।’ কিন্তু আল্লাহর কাছে তা এত অপছন্দের, এত ক্রোধের হয় যে, এর কারণে তার জাহান্নামের ফায়সালা হয়ে যায়। সুতরাং যবানকে সংযত রাখা জরুরি। আমরা আমাদের চারপাশের একটি শ্রেণীর মাঝে এই প্রবণতা দেখি। আল্লাহ সম্পর্কে, রাসূল সম্পর্কে, কুরআন সম্পর্কে, সুন্নাহ সম্পর্কে, দ্বীন সম্পর্কে, সৃষ্টিজগতে আল্লাহর নানা কুদরতের নিদর্শন সম্পর্কে নানা কথা বলে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে ফেলে। যা মুখে আসে বলে ফেলে। মনে রাখতে হবে সব বিষয় হাস্য-রসের বিষয় নয়। সব ধরনের হাস্য-রস গ্রহণযোগ্য নয়। হাস্য-রসেরও কিছু সীমা-সরহদ আছে। জীবন ও জগতের কিছু বিষয় থাকে যেগুলো নিয়ে হাস্য-রস চলে না। তো আল্লাহ, রাসূল, কুরআন, সুন্নাহ, দ্বীন ও শরীয়ত এই সকল বিষয়ে একজন মুসলিমকে ধীর-স্থির, সংযত-গম্ভীর হতে হয়।
পঞ্চম খিতাব
يَا عِبَادِي إِنَّكُمْ تُخْطِئُونَ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ، وَأَنَا أَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا، فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ.
হে আমার বান্দাগণ! তোমরা তো রাতদিন ভুল কর। আর আমি সকল অপরাধ ক্ষমা করি। সুতরাং আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৭
এই খিতাবে আল্লাহ পাক বান্দার দুর্বলতা উল্লেখ করেছেন এবং আপন দয়া ও মহত্ব বর্ণনা করেছেন। বান্দার দুর্বলতা এই যে, তার ভুল হয়, সে অন্যায় করে, আর আমাদের যিনি রব তাঁর বৈশিষ্ট্য হল, তিনি ক্ষমা করেন। সবাইকে ক্ষমা করেন। সব গুনাহ ক্ষমা করেন।
সব গুনাহ ক্ষমা করেন
তিনি সব গুনাহ ক্ষমা করেন- এ কথার অর্থ সঠিকভাবে বোঝা দরকার। এর অর্থ হচ্ছে, বান্দা যে গুনাহই করুক সব গুনাহই আল্লাহ পাকের রহমতের বিচারে ক্ষমাযোগ্য, যদি বান্দা ক্ষমার পথ অবলম্বন করে। এর অর্থ কখনো এই নয় যে, বান্দা গুনাহ করতে থাকবে আর নির্ভয়, নির্লিপ্ত থাকবে যে, আমার গুনাহ এমনিতেই মাফ হয়ে যাবে। আল্লাহ পাক ক্ষমা করেই দেবেন। সুতরাং গুনাহ করলেও কোনো অসুবিধা নেই। এ ধরনের মানসিকতা আসলে আল্লাহর দয়া ও রহমতের আশাবাদ নয়, আল্লাহর শাস্তি ও আযাব সম্পর্কে নির্লিপ্ততা। এটা অপরাধ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
نَبِّئْ عِبادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ،وَأَنَّ عَذابِي هُوَ الْعَذابُ الْأَلِيمُ.
আমার বান্দাদেরকে বলে দিন যে, আমি তো পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু এবং আমার শাস্তি- সে অতি মর্মন্তুদ শাস্তি! -সূরা হিজর (১৫) : ৪৯-৫০
আমাদের রবের এক পরিচয় যেমন এই যে, তিনি অতিক্ষমাশীল, তেমনি তাঁর আরেক পরিচয়, তিনি কঠিন শাস্তিদাতা। তো গুনাহ সম্পর্কে নির্ভয় ও নির্লিপ্ত হওয়ার অর্থ আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে নির্লিপ্ত হওয়া।
আল্লাহর রহমতের প্রকৃত আশাবাদী কারা
আল্লাহর রহমতের প্রকৃত আশাবাদী তারা যাদের কর্ম তাদের প্রত্যাশার সত্যায়ন করে। কর্ম ও প্রচেষ্টাহীন প্রত্যাশা কুরআন-হাদীসের দৃষ্টিতে নির্বুদ্ধিতা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের বিখ্যাত হাদীস-
الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ، وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا، وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.
বুদ্ধিমান সে যে নিজের নফসের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কর্ম করে। আর (নির্বোধ) অক্ষম সে যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুগামী করে এবং আল্লাহর প্রতি (অলীক) প্রত্যাশা পোষণ করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪২৬০
সুতরাং আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা তখনই সত্য হয়, যখন আল্লাহ প্রদত্ত ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে প্রবৃত্তির অনুগামিতা ত্যাগ করা হয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কর্ম করা হয়। কুরআন মাজীদে এ বিষয়টি কত পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَةَ اللَّهِ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ.
যারা ঈমান আনে এবং যারা হিজরত করে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে। আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, পরমদয়ালু। -সূরা বাকারা (২) : ২১৮
إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتابَ اللَّهِ وَأَقامُوا الصَّلاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْناهُمْ سِرًّا وَعَلانِيَةً يَرْجُونَ تِجارَةً لَنْ تَبُورَ، لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّهُ غَفُورٌ شَكُورٌ.
যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, সালাত কায়েম করে, আমি তাদের যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই প্রত্যাশা করে এমন ব্যবসার যার ক্ষয় নেই। এই জন্য যে, আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দিবেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদের আরো বেশি দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী। -সুরা ফাতির (৩৫) : ২৯-৩০
কর্মহীন প্রত্যাশা অজ্ঞতা ও অজ্ঞতা-প্রসূত
ইহুদী-সম্প্রদায়ের মাঝে ধর্মীয় দিক থেকে যেসকল বিভ্রান্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, তন্মধ্যে একটি ছিল অলীক প্রত্যাশা। ঐ সম্প্রদায়ের বে-ইলম শ্রেণীর মাঝে এ মানসিকতার বিস্তার ঘটেছিল। কুরআন মাজীদে ওদের এই বিভ্রান্তি চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে-
وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لا يَعْلَمُونَ الْكِتابَ إِلاَّ أَمانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَظُنُّونَ.
তাদের মধ্যে এমন কতক নিরক্ষর লোক আছে, যাদের মিথ্যা আশা ব্যতীত কিতাব সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান নেই। তারা শুধু অমূলক ধারণা পোষণ করে। -সূরা বাকারা (২) : ৭৮
ইমাম আবুল আলিয়া, রবী‘ ও কাতাদা রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন,
إِلا أَمَانِيَّ، يَتَمَنَّوْنَ عَلَى اللَّهِ مَا لَيْسَ لَهُمْ.
অর্থাৎ ওরা আল্লাহর প্রতি এমন সব প্রাপ্তির প্রত্যাশা করে যা তাদের জন্য নেই। -তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/১৭৫
এরপরের আয়াতগুলোতে ইহুদী জাতির আরো কিছু অলীক ও অমূলক ধারণা বর্ণনা করা হয়েছে এবং পরিষ্কার ভাষায় খণ্ডণ করা হয়েছে। সারকথা এই যে, প্রত্যাশা ভালো, অমূলক প্রত্যাশা ভালো নয়। ইসলাম অমূলক প্রত্যাশাকে উৎসাহিত করে না। কেননা এটা মিথ্যারই একটি প্রকার।
মুসলমানদের কোনো কোনো গোমরাহ ফের্কার মাঝেও অনেক আগে থেকেই এ ধরনের বিশ্বাস ছিল, এখনো থাকতে পারে যে, ‘গুনাহ করলে কোনো ক্ষতি নেই। ঈমান আনা হয়েছে তো এখন গুনাহ কোনো ক্ষতি করবে না।’ এটা একটা ভ্রান্ত কথা। গুনাহ অবশ্যই মানুষের ক্ষতি করে। মানুষের ঈমানকে দুর্বল করে। মানুষ যদি গুনাহে লিপ্ত থাকে, কবীরা গুনাহ করতে থাকে, তাহলে মানুষের এমন অবস্থাও হতে পারে যে, তার ঈমান বিনষ্ট হয়ে যাবে। গুনাহ মানুষের দুনিয়া এবং আখেরাতের জন্য ক্ষতিকর। দুনিয়াতেও তার শাস্তির আশঙ্কা আছে। আখেরাতেও শাস্তির আশঙ্কা আছে।
কিন্তু কোনো গুনাহই এমন নয়, যা আল্লাহ পাকের দয়া ও রহমতের বিচারে ক্ষমার অযোগ্য। আমরা অনেক ক্ষেত্রে বলি ‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ’ ‘এমন অপরাধ ক্ষমা করা যায় না’ কিন্তু আল্লাহ পাকের রহম-করম, ক্ষমা ও করুণা, বড়ত্ব ও মহত্ব এত বেশি যে, কোনো গুনাহই, কোনো অপরাধই তার রহম করমের বিচারে ‘ক্ষমার অযোগ্য’ নয়।
শিরক ক্ষমা করা হবে না- একথার অর্থ
কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-
إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذلِكَ لِمَنْ يَشاءُ.
‘আল্লাহ তার সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করবেন না। এছাড়া সকল গুনাহই যার সম্পর্কে ইচ্ছা করবেন ক্ষমা করে দেবেন। -সূরা নিসা (৪) : ৪৮
তো আল্লাহ পাক শিরককে ক্ষমা করবেন না- একথার অর্থ কী? একজন মানুষ শিরক করেছে, কুফর করেছে, এখন সে তওবা করেছে, আল্লাহ পাকের দিকে ফিরে এসেছে, শিরক পরিত্যাগ করে তাওহীদ অবলম্বন করেছে, কুফুর পরিত্যাগ করে ঈমান অবলম্বন করেছে এবং এরপর মৃত্যু পর্যন্ত ঈমানের হালতে, আমলে ছালেহের সাথে তার জীবন অতিবাহিত করেছে, আল্লাহ পাক কি তাকে ক্ষমা করবেন না? অবশ্যই ক্ষমা করবেন। ঈমানের দ্বারা কুফুরের হালতের গুনাহগুলো আল্লাহ পাক মাফ করে দেন।
তো কুরআন মাজীদের এই যে, ঘোষণা- ‘আল্লাহ পাক তার সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না’ এর অর্থ হল, যদি শিরকের অবস্থায় তার মৃত্যু হয়ে যায় তখন আর তার ক্ষমার ও মুক্তির কোনো উপায় থাকে না। আল্লাহ পাক কখনো তাকে ক্ষমা করবেন না। পক্ষান্তরে ঈমানের হালতে মৃত্যু হয়েছে, তাওহীদের উপর মৃত্যু হয়েছে, কিছু গুনাহও হয়েছে এমন লোকদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেবেন।
সারকথা এই দাঁড়াল যে, সব গুনাহই ক্ষমাযোগ্য। আল্লাহ পাকের রহমতের কাছে কোনো গুনাহই এমন নয় যা ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু বান্দার কর্তব্য হল, ক্ষমার পথ অবলম্বন করা। আল্লাহ পাক (আলোচ্য হাদীসে কুদসীতে) এর পরের বাক্যে বলেছেন,
فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ.
‘তোমরা আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দেব।’
গুনাহ যদি এমনি এমনি মাফ হয়ে যায়, তাওবা করতে হয় না, ইস্তেগফার করতে হয় না, নেক আমল করতে হয় না, আল্লাহ পাকের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হয় না, ঈমান আছে তো সকল গুনাহ এমনিই মাফ, কোনো গুনাহই কোনো ক্ষতি করবে না, তাহলে আল্লাহ পাক ইস্তেগফারের আদেশ করলেন কেন? বুঝা গেল, গুনাহ ক্ষমাযোগ্য, যদি মানুষ ক্ষমার পথ অবলম্বন করে। فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ. আমার কাছে ক্ষমা চাও। আমি তোমাদের ক্ষমা করে দেবো।
ইসলাম আশাবাদের ধর্ম, ইসলাম হতাশার ধর্ম নেয়। ইসলাম বলে না, পাপ মানুষের সত্তার ভিতরে ঢুকে পড়েছে। মানুষের সত্তাই পাপী। পাপমুক্ত হওয়ার ক্ষমতা ব্যক্তিমানুষের নেই। এর জন্য ঐশী কোনো ব্যবস্থার প্রয়োজন! এই ধরনের প্রান্তিকতা ইসলামে নেই।
প্রত্যেক মানুষ আল্লাহ পাকের কাছে ইস্তেগফারের মাধ্যমে, তাওবার মাধ্যমে, আমলে ছালেহের মাধ্যমে গুনাহ থেকে পবিত্র হতে পারে, আল্লাহ পাকের নৈকট্য অর্জন করতে পারে। ইসলামের শিক্ষা সহজ, সরল, স্বাভাবিক।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক মানুষকে এই পয়গাম দেওয়ার আদেশ করেছেন-
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ.
অর্থাৎ ‘আমার এই পয়গাম মানুষের কাছে পৌঁছে দিন- হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো গাফুরুর রাহীম। -সূরা যুমার (৪৯) : ৫৩
কিন্তু এর জন্য বান্দাকে ক্ষমা লাভের পথ অবলম্বন করতে হবে। যদি সে নিজেকে পবিত্র করতে চায় তাহলে মৃত্যু পর্যন্ত ক্ষমার দুয়ার তার জন্য খোলা। আল্লাহ পাক মৃত্যু পর্যন্ত এই পথ খোলা রেখেছেন।
এইজন্য একজন মুমিন কখনো হতাশ হতে পারে না। আমি এত পাপ করেছি, এত অন্যায় করেছি, এত অবিচার করেছি, আমার তো মুক্তির কোনো উপায় নেই, আমার তো ভালো হওয়ার সুযোগ নেই- এরকম মনে করা হতাশা। এটা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া।
আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কবীরা গুনাহ
আল্লাহ রহমতের আশাবাদী হওয়া মুমিনের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কবীরা গুনাহ। আমরা তো শুধু কবীরা গুনাহ মনে করি চুরি, ব্যাভিচার, ইত্যাদিকে। অবশ্যই এগুলো কবীরা গুনাহ। তবে কবীরা গুনাহ আরো আছে। এর মধ্যে একটি হল, ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া।’ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার বিভিন্ন পর্যায় আছে। বিভিন্ন প্রকাশ আছে। একটি প্রকাশ হল, আমার তো আর উপায় নেই। আমার তো ভালো হওয়ার সুযোগ নেই। আমি তো একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছি। এ রকম নিরাশ হয়ে যাওয়া কবীরা গুনাহ। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। আমি যদি নিজের দিকে তাকাই তাহলে আমি অক্ষম, দুর্বল। কিন্তু যদি আল্লাহর রহমতের দিকে যদি তাকাই তাহলে তো তা এক মহাসমুদ্র। আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অবকাশ রয়েছে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ দান করবেন।
হযরত ইয়াকুব আ.-এর উপদেশ
হযরত ইয়াকুব আ. সন্তানদের উপদেশ দিয়েছিলেন-
وَلا تَيْأَسُوا مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لا يَيْأَسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكافِرُونَ.
হে আমার সন্তানগণ! তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহর রহমত থেকে তো শুধু তারাই নিরাশ হয় যারা কাফির। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৮৭
কবি বলেন-
‘তাঁর সাথে যোগ নাই যার সে-ই করে নিতি অভিযোগ
তাঁর দেওয়া অমৃত ত্যাগ করে বিষ করে তারা ভোগ।’
বিদ্রোহী কবি আরো বলেছেন-
‘তাঁরই নাম লয়ে বলি বিশ্বের অবিশ্বাসীরা শোনো,
তাঁর সাথে ভাব হয় যার তার অভাব থাকে না কোনো।’
ষষ্ঠ খিতাব
يَا عِبَادِي، إِنَّكُمْ لَنْ تَبْلُغُوا ضَرِّي فَتَضُرُّونِي، وَلَنْ تَبْلُغُوا نَفْعِي فَتَنْفَعُونِي .
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা না আমার অপকার সাধনের পর্যায়েই কখনো পৌঁছুবে যে, আমার কোনো অপকার করবে। আর না উপকার সাধনের পর্যায়ে পৌঁছুবে যে, কোনো উপকার করবে।’
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হলেন সেই সুমহান অমুখাপেক্ষী সত্তা, যিনি সর্বপ্রকারের লাভ-ক্ষতি, উপকার-অপকারের ঊর্ধ্বে। আর বান্দার অবস্থা এই যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপকার বা অপকার সাধনের প্রশ্নই তার ক্ষেত্রে অবান্তর।
‘অবস্থান’ ও ‘সম্বন্ধ’ বোঝা
জ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অবস্থান ও সম্বন্ধ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান। কে না জানে যে, ঐ জ্ঞানই প্রশংসনীয়, যা সঠিক ও বাস্তব। ভুল বা অবাস্তব জ্ঞান প্রকৃত অর্থে জ্ঞান নয়। সেটা অজ্ঞানতা। বাস্তবতার সঠিক উপলব্ধি ঐ কাম্য ও প্রশংসনীয় জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। এরই একটি দিক ‘অবস্থান’ ও ‘সম্বন্ধ’ বোঝা। অর্থাৎ নিজের অবস্থান সম্পর্কে বাস্তব ধারণা এবং অন্যের সাথে সম্বন্ধের স্বরূপ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি। এটি একটি প্রশস্ত বিষয়। এখানে যে অংশটি প্রাসঙ্গিক তা হচ্ছে, মানবের কর্তব্য, নিজের সত্তা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা পোষণ আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে তার সম্বন্ধের নির্ভুল উপলব্ধি।
এই জ্ঞান ও উপলব্ধি মানবের চিন্তা ও কর্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। সে তখন উপলব্ধি করে যে, আল্লাহ হলেন খালিক ও ¯্রষ্টা। আর সে এক মাখলুক ও সৃষ্টি। আল্লাহ হলেন বে-নিয়ায ও অমুখাপেক্ষী। আর সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর মুখাপেক্ষী। এটাই হচ্ছে আল্লাহকে জানা এবং নিজেকে চেনার এক বিশেষ দিক। হারিস ইবনে হাইয়্যান রাহ. বলেছেনÑ
من عرف نفسه وعرف ربه عرف قطعا أنه لا وجود له من ذاته، إنما وجود ذاته ودوام وجوده وكمال وجوده من الله وإلى الله وبالله.
অর্থাৎ যে নিজেকে চিনেছে এবং আপন রবের পরিচয় লাভ করেছে তার এ প্রত্যয় জন্মেছে যে, সে আপন অস্তিত্বে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; বরং তার অস্তিত্ব, তার বেঁচে থাকা ও তার সকল গুণ একমাত্র আল্লাহরই দান। Ñইহইয়াউ উলুমিদ্দীন ৪/৩১৮
এই উপলব্ধিরই ফল আল্লাহর ভয়। তাই সালাফ আল্লাহর ভয়কে ‘ইলম’ বলেছেন আর এর বিপরীত ‘উজ্ব’ বা আত্মগর্বকে ‘জাহ্ল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসরূক ইবনুল আজদা রাহ. বলেনÑ
كفى بالمرء علما أن يخشى الله وكفى بالمرء جهلا أن يعجب بعلمه.
অর্থাৎ, জ্ঞানের প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর ভয় আর অজ্ঞতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে নিজ আমলের কারণে আত্মগর্বী হওয়া। Ñআদ দারেমী ৩৮৩; জামেউ বায়ানিল ইলম ১/১৪৩
ইমাম গাযালী রাহ. বলেনÑ
أخوف الناس لربه أعرفهم بنفسه وبربه، ولذلك قال - صلى الله عليه وسلم: أنا أخوفكم لله ،وكذلك قال الله - تعالى : إنما يخشى الله من عباده العلماء.
আপন রবকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে ঐ ব্যক্তি যে নিজের সম্পর্কে এবং আপন রবের সম্পর্কে বেশি জানে। আর একারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি।’ তেমনি কুরআন মাজীদের ইরশাদÑ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই আল্লাহকে ভয় করে...’ Ñইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৪/১৬৪
এর প্রকাশ ঘটে বিনয়, ন¤্রতা, আল্লাহর যিকির, হামদ-ছানা এবং দুআ ও কান্নাকাটির মধ্য দিয়ে।
ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ায রাহ. বলেনÑ
يخرج العارف من الدنيا ولم يقض وطره من شيئين: بكائه على نفسه، وثنائه على ربه.
আরিফ দুটি বিষয়ে অতৃপ্তি নিয়েই দুনিয়া থেকে যায়; নিজের উপর ক্রন্দন আর আপন রবের প্রশংসা। আর এটি এক শ্রেষ্ঠ উক্তি। কারণ এই হালত প্রমাণ করে যে, ব্যক্তি নিজেকে চেনে (নিজের দুর্বলতা ও অক্ষমতা বোঝে) আর তাঁর রবকে এবং রবের প্রতাপ ও মহিমা জানে। ফলে সে নিজের বিষয়ে লাজ্জিত আর রবের প্রশংসায় মুখরিত। Ñবাসাইরু যাবিদ তাময়ীয ৪/৫৪
তো মানবের কর্তব্য, নিজেকে নির্ভুলভাবে চেনা। নিজের সীমা-সরহদ সঠিকভাবে জানা। আর তার সাথে আল্লাহ তাআলার যে নিসবত, খালিক ও মাখলুকের নিসবত, রব ও মারবূবের নিসবত, মাবুদ ও আবিদের নিসবত, সে সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি অর্জন করা।
খালিক অমুখাপেক্ষী আর মাখলুক মুখাপেক্ষী
গোটা সৃষ্টিজগত আল্লাহর মাখলুক ও সৃষ্টি। আর আল্লাহ তাআলা খালিক ও সৃষ্টিকর্তা। গোটা সৃষ্টিজগত প্রতিপালিত আর আল্লাহ তাআলা পালনকর্তা। গোটা সৃষ্টিজগত আল্লাহর দাস, আর আল্লাহ তাআলা মালিক ও প্রভু। গোটা সৃষ্টিজগত আল্লাহর মুখাপেক্ষী আর আল্লাহ তাআলা বে-নিয়ায ও অমুখাপেক্ষী।
সুতরাং বান্দার অবস্থানই এই নয় যে, সে আল্লাহর কোনো উপকার-অপকার করতে পারে। আল্লাহ তো মহামহিম সত্তা, যিনি সকল লাভ-ক্ষতির উর্ধ্বে। কুরআন মাজীদের ইরশাদÑ
হে মানুষ! তোমরা তো আল্লাহর মুখাপেক্ষী; কিন্তু আল্লাহ, তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসার্হ্য। Ñসূরা ফাতির (৩৫) : ১৫
আল্লাহই একমাত্র সত্তা, যিনি সব দিক থেকে অভাবমুক্ত এবং সব দিক থেকে প্রশংসিত। তাঁর অভাবমুক্ততার এক দিক যা সূরায়ে ইসরার শেষ আয়াতে উল্লেখিত হয়েছেÑ
وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُن لَّهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ وَلَمْ يَكُن لَّهُ وَلِيٌّ مِّنَ الذُّلِّ ۖ وَكَبِّرْهُ تَكْبِيرًا.
বল, প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি। তাঁর রাজত্বে কোনো অংশী নেই। এবং তিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যার কারণে তার কোনো সাহায্যকারীর প্রয়োজন হতে পারে। আর সসম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর। Ñসুরা ইসরা (১৭) : ১১১
আল্লাহর সিফাত ও গুণাবলী সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার সম্বন্ধ সঠিকভাবে ‘নির্ণয়ে ব্যর্থ হওয়ার কারণে যুগে যুগে কত জাতি বিপথগামী হয়েছে! কোনো জাতি আল্লাহর কোনো বান্দাকে তাঁর ‘পুত্র’ সাব্যস্ত করেছে! কোনো জাতি ফিরেশতাদেরকে তাঁর ‘কন্যা’ ঘোষণা করেছে। কোনো জাতি নানা কাল্পনিক দেব-দেবী বা আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর ‘রাজত্বে’ শরীক সাব্যস্ত করেছে। কোনো জাতি তাঁর প্রতি নানাবিধ মানবীয় দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা যুক্ত করেছে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন জায়গায় এই সকল বিভ্রান্তি স্পষ্ট ভাষায় খণ্ডন করা হয়েছে। এই সকল বিভ্রান্তির মূলে রয়েছে আল্লাহ তাআলার সিফাত সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা। এবং আল্লাহ ও বান্দার সম্বন্ধের বিষয়ে ভুল ধারণা ও অজ্ঞতা।
তো হাদীসে কুদসীর এই খিতাব স্পষ্ট বলছে, বান্দার শানই এই নয় যে, সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কোনোরূপ উপকার বা অপকার করতে পারে। সুতরাং যে সকল বিশ্বাস, চিন্তা, উচ্চারণ বা আচরণ এই শিক্ষার পরিপন্থী তা বান্দাকে খুব সচেতনভাবে ত্যাগ করতে হবে।
ইবাদত ও ইতাআতে বান্দার নিজের উপকার
আল্লাহর অমুখাপেক্ষিতার এক দিক এই যে, বান্দার উপাসনা ও আনুগত্যের কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই। এ তো একান্তই বান্দার প্রয়োজন এবং এতে বান্দারই ফায়েদা। বান্দার ইবাদত-ইতাআতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও মহত্বে কোনো প্রকার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না; বরং এর দ্বারা বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে এবং দুনিয়া-আখেরাতের সফলতা হাসিল করে।
সামনের দুই খিতাবে এ বিষয়টি স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয়েছে।
সপ্তম ও অষ্টম খিতাব
يا عبادي لو أن أولكم وآخركم وإنكسم وجنكم كانوا على أتقى قلب رجل واحد منكم ما زاد ذلك في ملكي شيئا.
يا عبادي لو أن أولكم وآخركم وإنسكم وجنكم كانوا على أفجر قلب رجل واحد منكم ما نقص ذلك في ملكي شيئاً.
হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রথম ও শেষ জন, তোমরা মানব ও জিন সকলেই যদি হও তোমাদের সবচেয়ে খোদাভীরু কলবের ব্যক্তিটির মত তাহলে তা আমার রাজত্ব কিছুমাত্রও বৃদ্ধি করবে না।
হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রথম ও শেষজন, তোমরা মানব ও জিন সকলেই যদি হও তোমাদের সবচেয়ে অবাধ্য হৃদয়ের লোকটার মত তাহলে তা আমার রাজত্ব কিছুমাত্রও হ্রাস করবে না।
গোটা মানব ও জিন জাতির মধ্যে সবচেয়ে খোদাভীরু হৃদয়ের অধিকারী হলেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সবাই যদি তাঁর মতো আরিফ ও মুত্তাকী হয়ে যায় এতে আল্লাহর রাজত্বে কোনো কিছু বাড়বে না। গোটা মানব ও জিন জাতির মধ্যে সবচেয়ে অবাধ্য হৃদয়ের লোকটা হচ্ছে ইবলীস। সবাই যদি ইবলীসের মতো অবাধ্য-নাফরমান হয়ে যায় তাহলে আল্লাহর কুদরত, ক্ষমতা, রাজত্ব কিছুমাত্র হ্রাস পাবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা সম্পূর্ণ বে-নিয়ায। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর ক্ষমতা ও রাজত্ব কারো সমর্থনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। তাঁর রাজত্ব ও ক্ষমতায় কারো কোনো অংশীদারত্ব নেই। দেখুন, দুনিয়াতে যারা রাজা-বাদশা, নেতা-নেত্রী তারা সবাই অন্যের মুখাপেক্ষী। অন্যের শক্তি ও সমর্থনে তাদের ক্ষমতা। অন্যের কর্ম ও আনুগত্যে তাদের রাজত্ব। তাই সমর্থন ও আনুগত্য থাকলে ক্ষমতা থাকে, আনুগত্য ও সমর্থন না থাকলে ক্ষমতাও থাকে না। এটা মানব-রাজত্বের বৈশিষ্ট্য। কারণ সে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; সে অন্যের মুখাপেক্ষী। একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই হলেন সবদিক থেকে অমুখাপেক্ষী।
وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ
‘তিনিই তো অভাবমুক্ত, প্রশংসার্হ্য।’
কেউ প্রশংসা করুক বা না করুক তিনি তার সত্তা ও গুণাবলীর কারণেই প্রশংসিত। কেউ ইবাদত করুক বা না করুক তিনিই সত্য মাবুদ। তিনি ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই।
কেউ ‘ইতাআত’ করুক বা না করুক, তিনিই সত্য প্রভু। তিনি ছাড়া চ‚ড়ান্ত আনুগত্যের উপযুক্ত আর কেউ নেই।
তবে তাঁর করুণা ও মেহেরবানী যে, নিজ বান্দাদের তিনি তাঁর ইবাদত ও ইতাআতের পথ দেখিয়েছেন এবং অনেককে তাওফীক দান করেছেন। সুতরাং ঈমান ও ইতাআতের তাওফীক হলে বান্দার কর্তব্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ ও কৃতার্থ হওয়া।
দ্বীন গ্রহণে ও দ্বীনের নুসরতে বান্দার নিজের উপকার
সূরায়ে হুজুরাতের এ সত্য কত স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছেÑ
یَمُنُّوْنَ عَلَیْكَ اَنْ اَسْلَمُوْا ؕ قُلْ لَّا تَمُنُّوْا عَلَیَّ اِسْلَامَكُمْ ۚ بَلِ اللّٰهُ یَمُنُّ عَلَیْكُمْ اَنْ هَدٰىكُمْ لِلْاِیْمَانِ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ
তারা (বেদুইনরা) ইসলাম গ্রহণ করে তোমাকে ধন্য করেছে বলে মনে করে। তাদেরকে বলে দাও, তোমাদের ইসলাম দ্বারা আমাকে ধন্য করেছ বলে মনে করো না; বরং তোমরা যদি বাস্তবিকই (নিজেদের দাবিতে) সত্যবাদী হও তবে (জেনে রেখো) আল্লাহই তোমাদের ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। Ñসূরা হুজুরাত (৪৯) : ১৭
চিন্তা ও দৃষ্টির কী অপূর্ব পরিশুদ্ধি! লক্ষ্যণীয় এই যে, এ আয়াতে শুধু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কথা বলা হয়নি; বরং স্পষ্ট ভাষায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের কথা বলা হয়েছে যে, ইসলাম গ্রহণ করে তোমরা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে ধন্য করেছ এমনটা মনে করো না। এটা এক আসমানী তরবিয়ত। কিছু বেদুঈন যারা তখনও দ্বীনের পূর্ণ প্রজ্ঞা অর্র্জন করেননি তাদের মনে এ ধরনের চিন্তার উদ্রেক ঘটেছিল। এখনও এই শ্রেণির লোকের মধ্যে এই ধরনের চিন্তা থাকতে পারে। তাদের মনে হয়েছিল, তাদের ইসলাম গ্রহণের দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম-এর উপকার হল! তাঁর অনুসারী বৃদ্ধি পেল! তিনি শক্তি পেলেন! তিনি ধন্য হলেন বৈকি! (নাউযুবিল্লাহ)
এ হচ্ছে চিন্তার অস্বচ্ছতা। এর চিকিৎসা কুরআন মাজীদের বহু জায়গায় করা হয়েছে, যার সারকথা হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নুসরত তো করেন আল্লাহ তাআলা। তবে যারা সৌভাগ্যবান তাদের তিনি এই নুসরাতের কাজে যুক্ত করে ‘দ্বীনের নুসরতকারী’র মর্যাদা দান করেন। সূরা তাওবায় আল্লাহ তাআলার ইরশাদÑ
اِلَّا تَنْصُرُوْهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللّٰهُ اِذْ اَخْرَجَهُ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا ثَانِیَ اثْنَیْنِ اِذْ هُمَا فِی الْغَارِ اِذْ یَقُوْلُ لِصَاحِبِهٖ لَا تَحْزَنْ اِنَّ اللّٰهَ مَعَنَا
তোমরা যদি তার (অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের) সাহায্য না কর তবে (তাতে তার কোনো ক্ষতি নেই। কেননা) আল্লাহই তো সেই সময়ও তার সাহায্য করেছিলেন যখন কাফেররা তাকে (মক্কা থেকে) বের করে দিয়েছিল এবং তখন সে ছিল দুইজনের দ্বিতীয়জন, যখন তারা উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল, তখন সে তার সঙ্গীকে বলেছিল, চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। ... Ñসূরা তাওবা (৯) : ৪০
এই কুরআনী তারবিয়তের ফলে সাহাবায়ে কেরামের চিন্তা ও দৃষ্টি যে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধি লাভ করেছিল তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সাহাবায়ে কেরামের তারবিয়াত করেছেন। যার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানে পেশ করছি।
সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের কিতাবগুলোতে হুনাইনের যুদ্ধের ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। ঐ যুদ্ধে গনীমতের যে সম্পদ অর্জিত হয়েছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মক্কার ‘মুআল্লাফাতুল কুলূব’দের (অর্থাৎ ফতহে মক্কা বা কাছাকাছি সময়ে নতুন ইসলাম গ্রহণকারী, যাদেরকে ইসলামের উপর অবিচল রাখা ও ফতহে মক্কার দ্বারা তাদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল তার উপর একটি শীতল প্রলেপ দেয়া তাঁর ইচ্ছা ছিল) মাঝে বণ্টন করে দেন। মদীনার আনসারীদের এ সম্পদ থেকে কিছুই দেননি। এতে আনসারীদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হল এবং কেউ কেউ নানা কথাও বলে ফেললেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানানো হলে তিনি আনসারীদের এক জায়গায় একত্র করে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে যারা ‘ফকীহ’ (অর্থাৎ দ্বীনের প্রজ্ঞা যাদের আছে) তারা তো কিছু বলেননি তবে অন্যরা বলেছে।’ বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবীগণ কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতেন না। বাস্তব অবস্থা অকপটে তুলে ধরতেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনÑ
يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ أَلَمْ أَجِدْكُمْ ضُلاَّلاً فَهَدَاكُمُ اللَّهُ بِي،وَكُنْتُمْ مُتَفَرِّقِينَ فَأَلَّفَكُمُ اللَّهُ بِي، وَعَالَةً فَأَغْنَاكُمُ اللَّهُ بِي.
হে আনসারী সম্প্রদায়! তোমরা কি পথহারা ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের পথ দেখালেন? তোমরা কি বিবাদ-বিভক্তিতে জর্জরিত ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার দ্বারা তোমাদের ঐক্যবদ্ধ করলেন? তোমরা কি নিঃস্ব ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের নিঃস্বতা দূর করলেন?’ আল্লাহর রাসূল যখন এ কথাগুলো বলছিলেন তখন প্রতি প্রশ্নের উত্তরে আনসারী সাহাবীগণের জবাব ছিলÑ
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই (আমাদের প্রতি) অধিক অনুগ্রহকারী।’
(সুবহানাল্লাহ! লক্ষ্য করুন, এখানে আল্লাহর রাসূল সবার আগে হেদায়েতের নিআমত এরপর ঐক্যবদ্ধতার নিআমত এরপর সচ্ছলতার নিআমত উল্লেখ করেছেন) এরপর আল্লাহর রাসূল বললেনÑ
مَا يَمْنَعُكُمْ أَنْ تُجِيبُوا رَسُولَ اللَّهِ - صلى الله عليه وسلم-
‘তোমরাও তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রত্ত্যুত্তরে কিছু বলতে পার। তা বলছ না কেন?’
তোমরা তো বলতে পারÑ যদি বল তবে তা সত্যই হবে এবং তোমাদের সত্যবাদীই বলা হবেÑ যে, আপনি তো আমাদের কাছে ঐ সময় এসেছেন যখন অন্যরা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলেছে। তখন আমরা আপনাকে সত্যবাদী বলেছি।
আপনি ঐ সময় এসেছেন যখন আপনার কোনো সাহায্যকারী ছিল না। তখন আমরা আপনার নুসরত করেছি। আপনি এমন অবস্থায় এসেছেন যে, আপনাকে আশ্রয়হীন করা হয়েছে। ঐ সময় আমরা আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি।
আপনি এমন অবস্থায় এসেছেন যে, আপনি ছিলেন রিক্তহস্ত, ঐ সময় আমরা আপনার সহমর্মী হয়েছি।’
সুবহানাল্লাহ! কীভাবে মানব-মনের এক একটি কাঁটা বের করে আনছেন এবং হৃদয়কে কণ্টকমুক্ত করছেন!
আল্লাহর রাসূলের এই কথাগুলোর জবাবে আনসারীদের জবাব কী ছিল? তাঁদের জবাব ছিলÑ
بل المن علينا لله ولرسوله
বরং আমরাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কৃতার্থ। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪৩৩০ (ফতহুল বারী)
অর্থাৎ সাময়িক বিস্মৃতির পর তারা আবার প্রকৃত অবস্থায়, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় ফিরে এসেছেন। তাঁদের চেয়ে এ উপলব্ধি আর কাদের বেশি হতে পারে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত নুসরতকারী স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। আর যাদের তিনি এ নুসরতের কাজে ব্যবহার করেছেন এ তো তাদের পরম সৌভাগ্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তো কোনোরূপ মাধ্যম ছাড়াও তার দ্বীনের নুসরত করতে পারেন আবার যাদেরকে মাধ্যম বানিয়েছেন তারা ছাড়া অন্যদেরও মাধ্যম বানাতে পারেন। সুতরাং তাদের অনুসরণীয় ও অবিস্মরণীয় জবাবÑ
بل المن علينا لله ولرسوله
‘বরং আমরাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কৃতার্থ।’ এই হচ্ছে দ্বীনের সমঝ, নুসরতে দ্বীন সম্পর্ক সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এতক্ষণ তো ছিল তরবিয়াতের অস্ত্রোপচারপর্ব। এরপর ক্ষতস্থান সিলাই ও ব্যান্ডেজ-পর্ব। তা হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ কথাগুলো। সহীহ বুখারীর বর্ণনায় তা এভাবে আছেÑ
أَتَرْضَوْنَ أَنْ يَذْهَبَ النَّاسُ بِالشَّاةِ وَالْبَعِيرِ، وَتَذْهَبُونَ بِالنَّبِيِّ - صلى الله عليه وسلم - إِلَى رِحَالِكُمْ، لَوْلاَ الْهِجْرَةُ لَكُنْتُ امْرَأً مِنَ الأَنْصَارِ، وَلَوْ سَلَكَ النَّاسُ وَادِيًا وَشِعْبًا لَسَلَكْتُ وَادِيَ الأَنْصَارِ وَشِعْبَهَا، الأَنْصَارُ شِعَارٌ وَالنَّاسُ دِثَارٌ، إِنَّكُمْ سَتَلْقَوْنَ بَعْدِي أَثَرَةً فَاصْبِرُوا حَتَّى تَلْقَوْنِي عَلَى الْحَوْضِ.
তোমরা কি রাজি আছো যে, লোকেরা উট ও ছাগল নিয়ে ঘরে ফিরবে আর তোমরা ঘরে ফিরবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে? যদি হিজরতের প্রসঙ্গ না হত তাহলে আমি আনসারীদেরই একজন হতাম। (কিন্তু যেহেতু হিজরত অনেক বড় মর্যাদার বিষয় এজন্য আনসারী পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছি না। স্মর্তব্য, আনসারীগণ ছিলেন আল্লাহর রাসূলের মাতুল বংশীয়, তাছাড়া আরবে সম্বন্ধের নানা রীতি প্রচলিত ছিল) আর সকল মানুষ যদি এক গিরিপথ ও উপত্যকায় চলে আমি চলব আনসারীদের উপত্যকা ও গিরিপথে। (অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি তাদের সমর্পণ ও দুনিয়ার বিষয়ে নির্মোহতার পথই পছন্দনীয় পথ) আর আনসার হল আমার ভিতরের পোষাক (একান্ত কাছেরজন) আর অন্যরা বাইরের পোষাক। শোনো! আমার পর তোমরা বঞ্চনার শিকার হবে তখন সবর করো, পরিশেষে আমার সাথে তোমাদের সাক্ষাত হবে ‘হাউযে’র পাড়ে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪৩৩০
এই বাক্যগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা অন্য কোনো অবসরে আলোচনা করা যাবে।
তো, কুরআন-সুন্নাহর আলোকিত তারবিয়াতের মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরাম দ্বীনের সহীহ ‘ফিকহ’ অর্জন করেছিলেন যার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক চিন্তার স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতা।
তো ইবাদত, ইতাআত ও নুসরতে দ্বীনের যত কাজ রয়েছে এতে যুক্ত হতে পারা বান্দার সৌভাগ্য। এতে আল্লাহর প্রতি বান্দার কোনো অনুগ্রহ সাব্যস্ত হয় না।
কবি কত সুন্দর বলেছেনÑ
منت منہ کہ خدمت سلطاں ہمی کنی + منت شناس ازو کہ بخدمت بداشتت
মনে করো না সুলতানের ‘সেবা’ করে তাকে ধন্য করেছ। বরং কৃতার্থ হও যে, তিনি তোমাকে ‘সেবা’র সুযোগ দান করেছেন।
যাই হোক, হাদীসে কুদসীর উপরোক্ত দুই খিতাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অমুখাপেক্ষিতার বিবরণ এসেছে। তাঁর অভাবমুক্ততার আরেক দিক পরের খিতাবে উল্লেখিত হয়েছে।
নবম খিতাব-
يا عبادي! لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ، وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ، قَامُوا فِي صَعِيدٍ وَاحِدٍ فَسَأَلُونِي كُلُّ وَاحِدٍ مِنْكُمْ مَسْأَلَتَهُ، فَأَعْطَيْتُهُ، مَا نَقَصَ ذَلِكَ مِمَّا عِنْدِي , إِلا كَمَا يَنْقُصُ الْمِخْيَطُ إِذَا أُدْخِلَ فِي الْبَحْرِ
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রথম ও শেষজন তোমরা মানব ও জিন সকলেই যদি এক সমতল ভ‚মিতে সমবেত হয়ে আমার কাছে প্রার্থনা করতে থাক আর আমি সবাইকে তার প্রার্থিত বস্তু দান করতে থাকি তাহলেও আমার কাছে যা আছে তা থেকে শুধু এটুকু কমবে, যতটুকু সমুদ্রে একটি সুঁই ডোবালে কমে।’
পৃথিবীতে আমরা খালি চোখে যা কিছু দেখি ও উপলব্ধি করি এর মধ্যে ক্ষুদ্রতম হচ্ছে সুঁইয়ের মাথা, আর প্রশস্ততম হচ্ছে, সাগর, মহাসাগর। তাই বলা হয়, অথৈ সাগর, অতলান্ত জলরাশি। আল্লাহ পাকের কাছে যা আছে তা বোঝানোর জন্য বলা হচ্ছে, আল্লাহর সম্পদ যেন এক মহাসমুদ্র। আর তোমাদের সবার প্রার্থিত বস্তু যদি আল্লাহ তোমাদের দান করেন তাহলে সেই সম্পদ কতটুকু কমবে? একটা সুঁই যদি মহাসমুদ্রে ডোবাও এরপর তা তোলো, যদি সুঁইয়ের মাথার দিকে তাকাও তাহলে হয়তো এক বিন্দু পানি তুমি দেখতে পাবে। কিন্তু যদি মহাসমুদ্রের দিকে তাকাও তাহলে মহাসমুদ্রের পানি কতটুকু কমল বলে মনে হবে? এই হচ্ছে আল্লাহর ‘গিনা’ ও অভাবমুক্ততার উপমা। অর্থাৎ আল্লাহ পাক স্রষ্টা। তাঁর কাছে কোনো কিছুরই কমতি নেই। সুতরাং বান্দার কর্তব্য, তাঁরই কাছে প্রার্থনা করা।
কুরআন-সুন্নাহ বোঝার জন্য আরবী ভাষা-জ্ঞান ও সাহিত্যের সাধারণ রুচি অতিপ্রয়োজন
কুরআন মাজীদ কোনো নিষ্প্রাণ ‘আইন-গ্রন্থ’ মাত্র নয়, এ হচ্ছে ‘কিতাবুল হিদায়াহ’ হিদায়াতের কিতাব। এতে যেমন আইন আছে, তেমনি উপদেশও আছে। আসমানী ফরমান যেমন আছে তেমনি পূর্বের জাতিসমূহের কর্ম ও পরিণামের বিবরণও আছে। এ কিতাব যেমন মস্তিষ্ককে সম্বোধন করে তেমনি হৃদয়কেও সম্বোধন করে। এতে যেমন আছে বিধান ও ফরমানের প্রতাপ, তেমনি আছে উপমা-উদাহরণের মাধুর্য। এ কারণে কুরআনকে বোঝার জন্য যেমন প্রয়োজন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তেমনি প্রয়োজন ভাষার রুচি ও সংবেদন। এ জিনিসের অভাব হলে শুধু যে কুরআনের বর্ণনা-মাধুর্য থেকেই বঞ্চিত হতে হয় তা-ই নয়, ছোট-বড় বিভ্রান্তিও ঘটে থাকে এবং ঘটেছে। কারো যদি সহজ-সুন্দর ভাষা-বোধ না থাকে তাহলে তার মনে অহেতুক এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এ আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহর ‘সম্পদে’ও -নাউযুবিল্লাহ- সীমাবদ্ধতা আছে! কারণ যে বস্তু দ্বারা এর উপমা দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ সাগর, তা যত বড়ই হোক, সসীম বটে! অথচ ভাষা-বোধ যার আছে তার কাছে এ প্রশ্ন হাস্যকর। উপমার ক্ষেত্রে উপমান ও উপমিত সবদিক থেকে এক হওয়া জরুরি নয়। বিশেষ কোনো একটি বৈশিষ্ট্য সহজে বোঝানোই উপমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।
আমাদের আলোচ্য বিষয়টি আল্লাহর কুদরতের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহর ইলমের ব্যাপারেও এ ধরনের উপমা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। হযরত খাযির ও হযরত মূসা আ.-এর ঘটনা সবারই জানা আছে। কুরআন মাজীদে সূরা কাহফের শেষ দিকে এ ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। হাদীস শরীফে ঐ ঘটনার বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে আছে। সহীহ বুখারীর এক মওকুফ বর্ণনায় আছে যে, একটি পাখী সমুদ্র থেকে চঞ্চু দ্বারা পানি তুলল তখন খাযির আ. হযরত মূসা আ.-কে লক্ষ্য করে বললেন-
وَاللَّهِ مَا عِلْمِي وَمَا عِلْمُكَ فِي جَنْبِ عِلْمِ اللَّهِ إِلَّا كَمَا أَخَذَ هَذَا الطَّائِرُ بِمِنْقَارِهِ مِنَ البَحْرِ
আল্লাহর কসম! আল্লাহর ইলমের তুলনায় আমার ও তোমার ইলমের (সমষ্টির) উদাহরণ হচ্ছে এই যে পাখিটি, যে তার চঞ্চু দ্বারা সমুদ্র থেকে পানি নিল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭২৬
অথচ কে না জানে সমুদ্র যত বড়ই হোক তা সসীম। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইলম অসীম! তবে উপমার যে উদ্দেশ্য আল্লাহর জ্ঞানের সম্মুখে মানুষের জ্ঞানের অকিঞ্চিতকরতা প্রত্যক্ষ করে তোলা তাতে এ উপমা সফল। এই উপমা থেকে এ বিষয়টি উপলব্ধি না করে কেউ যদি সসীম-অসীমের তর্কে জড়িয়ে পড়ে, তবে তা যেমন হাস্যকর হয় তেমনি মর্মান্তিকও হয় বটে।
ইহুদী জাতির বিভ্রান্তি ও বেআদবী
কোনো কোনো সরলপ্রাণ-মুসলিমের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, পৃথিবীতে এমন দুর্ভাগা কে আছে, যে আল্লাহ তাআলার বিষয়েও অভাবের চিন্তামাত্রও করতে পারে? চারপাশের প্রকৃতিতেই তো আল্লাহ তাআলার গিনা ও অভাবমুক্ততার কত উদাহরণ! কিন্তু বাস্তবতা এই যে, কোনো কোনো জাতি এ বিষয়েও বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে, যার মূলে রয়েছে কুফর ও কিবর। কুরআন মাজীদে ইহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
لَقَدْ سَمِعَ اللّٰهُ قَوْلَ الَّذِیْنَ قَالُوْۤا اِنَّ اللّٰهَ فَقِیْرٌ وَّ نَحْنُ اَغْنِیَآءُ ۘ سَنَكْتُبُ مَا قَالُوْا وَ قَتْلَهُمُ الْاَنْۢبِیَآءَ بِغَیْرِ حَقٍّ ۙ وَّ نَقُوْلُ ذُوْقُوْا عَذَابَ الْحَرِیْقِ
আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন ওদের কথা যারা বলেছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অভাবগ্রস্ত আর আমরা অভাবমুক্ত। ওরা যা বলেছে তা এবং ওরা যে নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে তা আমি লিখে রাখব এবং বলব, ভোগ কর দহন-যন্ত্রণা। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮১
তবারী ও ইবনে আবী হাতিম হাসান সনদে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আবু বকর সিদ্দীক রা. একদিন ‘বাইতুল মিদরাস’-এ গেলেন (এটি ছিল ইহুদীদের একটি ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র) ওখানে অনেক ইহুদী ওদের এক ধর্মগুরু ফিনহাসের কাছে বসে ছিল। আশইয়া‘ নামে আরেক ধর্মগুরুও উপস্থিত ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. ফিনহাসকে লক্ষ করে বললেন, ওহে ফিনহাস! আল্লাহকে ভয় কর এবং ইসলাম কবুল কর। আল্লাহর কসম! তোমার খুব ভালোভাবেই জানা আছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছেন। যার কথা তোমরা তোমাদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পাচ্ছ। ফিনহাস তখন বলল, হে আবু বকর! আল্লাহর কসম! আল্লাহর প্রতি আমাদের কোনো মুখাপেক্ষিতা নেই; বরং সে-ই আমাদের মুখাপেক্ষী। আমরা তার কাছে কাকুতি-মিনতি করি না, সে-ই আমাদের কাছে কাকুতি মিনতি করে। সে যদি আমাদের থেকে অমুখাপেক্ষী হত তাহলে আমাদের কাছে ঋণ চাইত না। যেমনটা তোমার সঙ্গী বলে থাকে! একদিকে সে আমাদের জন্য সুদ নিষিদ্ধ করে অন্যদিকে নিজেই সুদ দান করে। সে যদি অভাবী না হবে তাহলে সুদ দেবে কেন?! (নাউযুবিল্লাহ)
তার এ ধৃষ্টতাপূর্ণ কটূক্তি শুনে আবু বকর রা. ক্ষুব্ধ হলেন এবং ফিনহাসের মুখে সজোরে আঘাত করলেন এবং বললেন, ঐ সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার প্রাণ। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে যদি ঐ চুক্তি না থাকত তাহলে হে আল্লাহর দুশমন! তোমাকে আজ শেষ করে দিতাম। ঠিক আছে তোমরা যদি সত্যবাদীই হয়ে থাক তাহলে যত পার আমাদের অস্বীকার কর। ফিনহাস আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, হে মুহাম্মাদ! দেখ, তোমার সঙ্গী আমার কী হাল করেছে! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কেন এমন করলে হে আবু বকর! আবু বকর রা. বললেন, আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর দুশমন অতি মারাত্মক কথা বলেছে। সে বলেছে, আল্লাহ অভাবী আর ওরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী নয়। সে যখন এহেন উক্তি করল তখন আমি আল্লাহর জন্য ক্ষুব্ধ হয়েছি এবং ওর মুখে আঘাত করেছি। তখন ফিনহাস পরিষ্কার অস্বীকার করে বলল, জ্বী না, আমি এমন কথা বলিনি। তখন কুরআন মাজীদের এ আয়াত নাযিল হল। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৬৫১
দ্বীন-ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ইহুদীদের চরিত্র
এটা এক মর্মান্তিক বাস্তবতা যে, ইহুদীজাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের সাথে এবং আসমানী কিতাব ও আসমানী দ্বীনের সাথে চরম ঔদ্ধত্য ও নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে অভিশপ্ত হয়েছে। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর আনীত দ্বীনের সাথেও তাদের আচরণ একই রকম ছিল। কুরআনের অর্থ-বিকৃতি, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি উপহাস, দ্বীন ও শরীয়ত নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছিল এদের জাতীয় চরিত্র। এ ঘটনাতেই দেখুন, কুরআন মাজীদের একটি বাণীর কী নির্মম বিকৃতি।
আল্লাহ তাআলার ঋণ চাওয়ার অর্থ
সূরা বাকারায় ইরশাদ হয়েছে-
وَ قَاتِلُوْا فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ اعْلَمُوْۤا اَنَّ اللّٰهَ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ مَنْ ذَا الَّذِیْ یُقْرِضُ اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا فَیُضٰعِفَهٗ لَهٗۤ اَضْعَافًا كَثِیْرَةً ؕ وَ اللّٰهُ یَقْبِضُ وَ یَبْصُۜطُ ۪ وَ اِلَیْهِ تُرْجَعُوْنَ
অর্থ: আল্লাহর পথে লড়াই কর এবং জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব কিছু শোনেন, সব কিছু জানেন।
কে আছে যে আল্লাহকে করয দিবে উত্তম করয; অতপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন? আল্লাহই সংকুচিত করেন এবং তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে। -সূরা বাকারা (২) : ২৪৪-২৪৫
কুরআন মাজীদের এ আয়াতেই বলা হচ্ছে যে, ধন-সম্পদ, রিযক সব আল্লাহর হাতে। তিনিই সংকোচন করেন, তিনিই প্রশস্ততা দান করেন। সুতরাং তিনিই যখন বান্দাকে লক্ষ্য করে বলছেন, কে আছে যে আল্লাহকে করয দিবে? তখন সহজেই বোঝা যায়, এর অর্থ তাঁর ‘অভাবী’ হওয়া নয় (নাউযুবিল্লাহ) এ তো বান্দার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ যে, বান্দাকে তিনি এ ভাষায় উৎসাহিত করেছেন। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, বান্দাকে নেক আমলে ও দ্বীনের পথে জান-মাল কুরবানীতে উৎসাহিত করা। এতে বান্দার নিজের উপকার, এই কুরবানীর বিনিময় বান্দা নিজেই লাভ করবে। এক আরিফ তো আরো অগ্রসর হয়ে বলেছেন,
جان دى دى ہوئ اسى كى تھی + حق تو يہ ہے كہ حق ادا نہ ہوا
এই প্রাণ তো তাঁরই দেয়া + সুতরাং হক কথা এই যে, (তাঁর পথে প্রাণ বিসর্জন দ্বারা তাঁর) হক আদায় হয়নি। তাঁর অনুগ্রহের প্রতিদান হয়নি।
আলিমগণ বলেন, এখানে ‘করজ’ শব্দের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেভাবে করজ পরিশোধ করা অপরিহার্য-সেভাবে তোমাদের কর্মের বিনিময়ও আমি আমার উপর অপরিহার্য করে নিচ্ছি। আবার কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহকে করজ দেওয়ার অর্থ তাঁর বান্দাদেরকে করজ দেওয়া এবং তাদের অভাব পূরণ করা। আর এর বিনিময় আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে বহুগুণ বাড়িয়ে দান করবেন।
সহীহ মুসলিমে একটি দীর্ঘ হাদীসে কুদসী আছে, যাতে অন্নহীনকে অন্নদান, পিপাসার্তের তৃষ্ণা নিবারণ এবং অসুস্থের ইয়াদাতকেও এ ধরনের মহিমাপূর্ণ ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। ঐ হাদীসে কুদসীর ভাষা ও উপস্থাপনার পরম মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি আব্দুল কাদির একে কাব্যরূপ দান করেছেন-
হাশরের দিন বলিবেন খোদা- হে আদম সন্তান/তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান।/মানুষ বলিবে - তুমি প্রভু করতার,/আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার?/বলিবেন খোদা- দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে,/তারি শুশ্রƒষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে।/খোদা বলিবেন- হে আদম সন্তান,/ আমি চেয়েছিনু ক্ষুধায় অন্ন, তুমি কর নাই দান।/মানুষ বলিবে- তুমি জগতের প্রভু,/আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে, সে কাজ কি হয় কভু?/বলিবেন খোদা- ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে,/মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে।/পুনরপি খোদা বলিবেন- শোন হে আদম সন্তান,/ পিপাসিত হয়ে গিয়েছিনু আমি, করাও নি জল পান।/মানুষ বলিবে- তুমি জগতের স্বামী,/তোমারে কেমনে পিয়াইব বারি, অধম বান্দা আমি?/বলিবেন খোদা- তৃষ্ণার্ত তোমা ডেকেছিল জল আশে,/তারে যদি জল দিতে তুমি তাহা পাইতে আমায় পাশে।
যাই হোক, আসল কথা হল, কুরআনে বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার যে খিতাব, তার মাধুর্য উপলব্ধি করা ও আপ্লুত হওয়ার জন্যও তো হৃদয়ে কিছু প্রাণ ও স্পন্দন থাকতে হয়। নির্জীব নিষ্প্রাণ হৃদয় কীভাবে উপলব্ধি করবে এই আসমানী খিতাবের মাধুর্য।
সাহাবীগণের জীবনে কুরআনের প্রভাব
একদিকে ইহুদী পণ্ডিত স্রষ্টার এই অনুগ্রহকে ব্যঙ্গ করল অন্যদিকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী হযরত আবুদ দাহদাহ রা.-এর অবস্থা দেখুন : এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক! আল্লাহ তাআলা কি আমাদের নিকট ঋণ চাচ্ছেন? তাঁর তো ঋণের প্রয়োজন নেই। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, আল্লাহ তাআলা এর বদলে তোমাদেরকে বেহেশতে প্রবেশ করাতে চাচ্ছেন। আবুদ দাহদাহ রা. একথা শুনে বললেন, আল্লাহর রাসূল! হাত বাড়ান। তিনি হাত বাড়ালেন। আবুদ দাহদাহ বলতে লাগলেন, ‘আমি আমার দুটি বাগানই আল্লাহকে ঋণ দিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, একটি আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দাও এবং অন্যটি নিজের পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য রেখে দাও। আবুদ দাহদা বললেন, আপনি সাক্ষী থাকুন, এ দুটি বাগানের মধ্যে যেটি উত্তম- যাতে খেজুরের ছয় শ’ ফলন্ত বৃক্ষ রয়েছে, সেটা আমি আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করলাম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর বদলে আল্লাহ তোমাকে বেহেশত দান করবেন।
আবুদ দাহদা রা. বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বিষয়টি জানালেন। স্ত্রীও তাঁর এ সৎকর্মের কথা শুনে খুশী হলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘খেজুরে পরিপূর্ণ অসংখ্য বৃক্ষ এবং প্রশস্ত অট্টালিকা আবুদ দাহদাহের জন্য তৈরি হয়েছে’। -আবু ইয়ালা, তবারানী-মাজমাউয যাওয়াইদ ৯/৩২৪, হাদীস ১৫৭৯২
দেখুন, কুরআন মাজীদের এক আয়াতে দুই শ্রেণির মানুষের মাঝে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া হল। যারা কাফির তাদের কুফর বৃদ্ধি পেল আর যারা মুমিন, যাদের অন্তরে রয়েছে ঈমানের আলো, তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেল।
আমাদের যাদেরকে আল্লাহ ঈমান নসীব করেছেন তাদের কর্তব্য, নিজের পথ চিনে নেওয়া এবং কারা আমাদের পূর্বসূরী তা স্মরণ করা। নতুবা গাফলত ও উদাসীনতা অনেক মুসলিমকেও ইহুদি-নাসারার পথে নিয়ে যেতে পারে। আল্লাহ হেফাযত করুন। এরপরের খিতাব-
দশম খিতাব-
يَا عِبَادِي إِنَّمَا هِيَ أَعْمَالُكُمْ أُحْصِيهَا لَكُمْ، ثُمَّ أُوَفِّيكُمْ إِيَّاهَا
হে আমার বান্দাগণ! আমি তোমাদের জন্য তোমাদের কর্মগুলো গুণে গুণে সংরক্ষণ করছি। এরপর তোমাদের তা বুঝিয়ে দেবো’।
فَمَنْ وَجَدَ خَيْرًا، فَلْيَحْمَدِ اللهَ وَمَنْ وَجَدَ غَيْرَ ذَلِكَ، فَلَا يَلُومَنَّ إِلَّا نَفْسَهُ
‘ঐ সময় যে উত্তম পরিণাম লাভ করবে সে যেন আল্লাহর শোকরগোযারি করে (আল্লাহই তাকে তাওফীক দিয়েছেন)। আর যে এর বিপরীত কিছু লাভ করে সে যেন নিজেকেই ভর্ৎসনা করে (কারণ এটা তার কর্মফল)।
দেখুন হাদীস শরীফের শব্দগত সৌন্দর্য। এখানে বলা হচ্ছে ‘غير ذلك ’(-এর বিপরীত কিছু) উত্তম পরিণামের বিপরীত হচ্ছে মন্দপরিণাম, অশুভ পরিণাম। কিন্তু মন্দ ও অশুভ কথাটা উচ্চারণ করাও পছন্দ করা হয়নি। তাই তো বলা হচ্ছে, ‘যে এর বিপরীত কিছু লাভ করে’।
এই হল এই হাদীসে কুদসীর সরল তরজমা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা। এখান থেকে আমরা আল্লাহ পাকের কিছু ছিফাত ও বৈশিষ্ট্য জানতে পেরেছি এবং আমাদের কিছু করণীয় সম্পর্কেও জানতে পেরেছি। আমাদের কর্তব্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে জানা, তাঁর সিফাত ও গুণাবলীর পরিচয় লাভ করা এবং আমাদের তিনি যে হায়াতটুকু দান করেছেন তা ঈমান ও আমলে ছালেহের সাথে অতিবাহিত করা। তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের জন্য শুভ পরিণাম অপেক্ষা করছে।
