আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ

আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ

হাদীস নং: ১১৩
৬২- ঝােলে পানি বেশী করিয়া দিবে এবং প্রতিবেশীকে বিলাইবে
১১৩। হযরত আবু যর (রাযিঃ) বলেন, আমার পরম বন্ধু (রাসূলে করীম (ﷺ) আমাকে তিনটি উপদেশ দিয়াছেন ঃ ১. শুনিবে এবং আনুগত্য করিবে যদিও বা (আনুগত্যের অধিকারী নেতা) নাক-কান কাটা গােলামও হয়। ২. যখন ঝােল পাকাইবে তখন তাহাতে ঝােল একটু বেশী করিয়াই দিবে এবং তৎপর প্রতিবেশীর প্রতি লক্ষ্য করিবে এবং উহা তাহাদিগকে সদিচ্ছা সহকারে বিলাইবে এবং ৩. নামায তাহার নির্ধারিত ওয়াক্তে আদায় করিবে ! যদি দেখিতে পাও যে, ইমাম নামায পড়িয়া ফেলিয়াছেন (আর তুমিও তােমার নামায আদায় করিয়া ফেলিয়াছ) তাহা হইলে (ভাবনার কিছু নাই) তােমার নামায তাে হইয়াই গিয়াছে নতুবা উহা (অর্থাৎ ইমামের সহিত তােমার দ্বিতীয় বারের নামায) নফল হিসাবে গণ্য হইবে।
بَابُ يُكْثِرُ مَاءَ الْمَرَقِ فَيَقْسِمُ فِي الْجِيرَانِ
حَدَّثَنَا بِشْرُ بْنُ مُحَمَّدٍ، قَالَ‏:‏ أَخْبَرَنَا عَبْدُ اللهِ، قَالَ‏:‏ أَخْبَرَنَا شُعْبَةُ، عَنْ أَبِي عِمْرَانَ الْجَوْنِيِّ، عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ الصَّامِتِ، عَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ‏:‏ أَوْصَانِي خَلِيلِي صلى الله عليه وسلم بِثَلاَثٍ‏:‏ أَسْمَعُ وَأُطِيعُ وَلَوْ لِعَبْدٍ مُجَدَّعِ الأَطْرَافِ، وَإِذَا صَنَعْتَ مَرَقَةً فَأَكْثِرْ مَاءَهَا، ثُمَّ انْظُرْ أَهْلَ بَيْتٍ مِنْ جِيرَانِكَ، فَأَصِبْهُمْ مِنْهُ بِمَعْرُوفٍ، وَصَلِّ الصَّلاَةَ لِوَقْتِهَا، فَإِنْ وَجَدْتَ الإِمَامَ قَدْ صَلَّى، فَقَدْ أَحْرَزْتَ صَلاَتَكَ، وَإِلاَّ فَهِيَ نَافِلَةٌ‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে প্রতিবেশীদেরকে নিজ খাবারে শরীক রাখতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী অভাবগ্রস্ত হলে এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَا آمَنَ بِي مَنْ بَاتَ شَبْعَانًا وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلَى جَنْبِهِ وَهُوَ يَعْلَمُ بِهِ

‘ওই ব্যক্তি আমার প্রতি ঈমান আনেনি, যে ভরাপেটে রাত কাটায় অথচ তার পাশেই তার প্রতিবেশী অনাহারে থাকে এবং সে তা জানেও। ২২

لَيْسَ الْمُؤْمِنُ الَّذِي يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلى جَنْبِهِ

‘ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে উদরপূর্তি করে খায় অথচ তার পাশেই তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকে।

আলোচ্য হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি ঝোল দিয়ে গোশত রান্না করতে বলেছেন এ কারণে যে, এতে করে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করা সহজ হয়। দান-দক্ষিণা যতবেশি ব্যাপক করা যায় ততই শ্রেয়। বিশেষ করে আহার্য-সামগ্রীতে প্রতিবেশীদেরকে বেশি বেশি শামিল রাখার দ্বারা যেমন বেশি ছাওয়ার পাওয়া যায়, তেমনি তা পরস্পরে মহব্বত সৃষ্টিতেও বেশি সহায়ক। আহার্যের পরিমাণ অল্প হলে তা বেশি বিতরণ করা সম্ভব হয় না। আবার পরিমাণ বাড়ানোর সামর্থ্যও সকলের থাকে না। এ অবস্থায় তা বেশি বিতরণ করার উপায় কী? কিভাবেই বা তাতে বেশি লোককে শামিল রাখা যাবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টাকে সহজ করে দিয়েছেন। তরকারিতে ঝোল বাড়িয়ে দাও। তারপর সেই ঝোল সম্ভব হলে দু'-এক টুকরো গোশতসহ প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ কর। অপর এক হাদীছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِذَا طَبَخْتُمُ اللَّحْمَ ، فَأَكْثِرُوا الْمَرَقَ - أَوِ الْمَاءَ ، فَإِنَّهُ أَوْسَعُ أَوْ أَبْلَغُ - لِلْجِيْرَانِ

‘যখন তোমরা গোশত রান্না করবে, তাতে ঝোল অথবা (বলেছেন) পানি বাড়িয়ে দেবে। কেননা তা প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করার পক্ষে বেশি সহায়ক।

এর দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায়—যে বস্তুতে ঝোল নেই তাতেও এমন কোনও উপায় বের করে নেওয়া চাই, যাতে প্রতিবেশীদের মধ্যে তা কিছু না কিছু বিতরণ করা যায়। যেমন তরমুজ বা এ জাতীয় বড় কোনও ফল ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নেওয়া।

এ হাদীছে দৃশ্যত গোশতের ঝোল বিতরণের কথা বোঝা যায়। এতে আপত্তির কিছু নেই। কেননা ‘সুবাসে অর্ধেক ভোজন' কথাটি কেবল কথার কথা হলেও ঝোল দ্বারা বাস্তবেও ভোজনের কাজ সমাধা হয়। বলা হয়ে থাকে, ঝোলও একরকম গোশত । কেননা ঝোলের মধ্যে গোশতের কিছু না কিছু পুষ্টি এসে যায় এবং কেবল ঝোল দিয়েও রুটি বা ভাত খাওয়া যায়। কেবল ঝোল বিতরণের ব্যাপারটা তো তখনই দাঁড়ায়, যখন অভাব-অনটন খুব বেশি থাকে। বলাবাহুল্য অভাবকালে গোশতের সামান্য একটু ঝোলও অনেক মূল্যবান হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জমানায় খাদ্যাভাব ছিল প্রচণ্ড। অনেক সময় যুদ্ধাবস্থায় একেকজনকে একটি মাত্র খেজুর খেয়েও দিন কাটাতে হয়েছে। মাত্র একটা খেজুরে কী হত? এর উত্তরে সাহাবীগণ বলতেন, ওই একটার কদরও সেদিন বুঝে এসেছিল, যেদিন ভাগে একটিও জোটেনি। তখন খেজুরের বিচি চুষেছি, তারপর কেবল পানি খেয়ে দিন কাটিয়েছি।

এজন্যই খাদ্যবস্তু যত সামান্যই হোক না কেন তাকে তুচ্ছ মনে করতে নেই। এক প্রতিবেশী যদি অন্য প্রতিবেশীকে সামান্য একটু ঝোলও দেয়, তবে তার সমাদর করা উচিত। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

يَا نِسَاء الْمُسْلِمَاتِ، لَا تَحْقِرَنَّ جَارَةٌ لِجَارَتِهَا، وَلَوْ فِرْسِنَ شَاةٍ

‘হে মুসলিম নারীগণ! কোনও প্রতিবেশিনী যেন তার অপর প্রতিবেশিনীর দানকে তুচ্ছ মনে না করে, তা বকরির একটা পায়া হলেও।২৫

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা প্রতিবেশীদের প্রতি সদ্ব্যবহারের শিক্ষা পাওয়া যায় এবং খাদ্যসামগ্রীতে প্রতিবেশীদেরকে যে-কোনও উপায়ে শামিল রাখার উৎসাহ লাভ হয়।

খ. প্রতিবেশী ও গরীবদের মধ্যে সহজে বিতরণ করার লক্ষ্যে তরকারিতে ঝোল বেশি দেওয়া উত্তম।

গ. বোঝা যায় মাছ-গোশত ভূনা করার চেয়ে ঝোল রান্না উত্তম, যেহেতু এভাবে রান্না করার দ্বারা প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করা সহজ হয়।

২২. তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৫১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩০৩৫৯ . তহারী, শারহু মাআনিল আছার, হাদীছ নং ১১১

২৩. শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩১১৭; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১১২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১২৭৪১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৯৬৬৮; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ২৬৯৯

২৪. মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫০৩০

২৫. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৫৬৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০৩০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৩০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৫৯১; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১২৩; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৬২; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১৩২৮; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২১৬০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৬৪১
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আল-আদাবুল মুফরাদ - হাদীস নং ১১৩ | মুসলিম বাংলা