আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ
৪৭. নবীজী ﷺ থেকে বর্ণিত যাবতীয় দোয়া-জিকির
হাদীস নং: ৩৫১৯
আন্তর্জাতিক নং: ৩৫১৯
শিরোনামবিহীন পরিচ্ছেদ
৩৫১৯. হান্নাদ (রাহঃ) .... বনু সুলায়মের জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার হাত গুণে গুণে (বর্ণনান্তরে) তাঁর নিজ হাতে গুণে গুণে বললেনঃ সুবহানাল্লাহ হল মীযানের অর্ধেক, আলহামদুলিল্লাহ তা পূর্ণ করে দেয়, আল্লাহ আকবার আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থান ভরে দেয়। রোযা হল সবরের অর্ধেক আর পবিত্রতা হল ঈমানের অর্ধেক।
হাদীসটি হাসান। শু’বা ও ছাওরী (রাহঃ)-ও এটি আবু ইসহাক (রাহঃ)-এর বরাতে রিওয়ায়াত করেছেন।
হাদীসটি হাসান। শু’বা ও ছাওরী (রাহঃ)-ও এটি আবু ইসহাক (রাহঃ)-এর বরাতে রিওয়ায়াত করেছেন।
باب
حَدَّثَنَا هَنَّادٌ، حَدَّثَنَا أَبُو الأَحْوَصِ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ، عَنْ جُرَىٍّ النَّهْدِيِّ، عَنْ رَجُلٍ، مِنْ بَنِي سُلَيْمٍ قَالَ عَدَّهُنَّ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي يَدِي أَوْ فِي يَدِهِ " التَّسْبِيحُ نِصْفُ الْمِيزَانِ وَالْحَمْدُ يَمْلَؤُهُ وَالتَّكْبِيرُ يَمْلأُ مَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ وَالصَّوْمُ نِصْفُ الصَّبْرِ وَالطُّهُورُ نِصْفُ الإِيمَانِ " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ وَقَدْ رَوَاهُ شُعْبَةُ وَسُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। সর্বপ্রথম তুলে ধরা হয়েছে ' ত্বহারাত' (পবিত্রতা)-এর গুরুত্ব। বলা হয়েছে ত্বহারাত ঈমানের অর্ধেক। কি হিসেবে ত্বহারাত ঈমানের অর্ধেক, তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন -
পাক-পবিত্রতার ফযীলত
ক. ত্বহারাত ছাড়া ঈমানের আর যত শাখা-প্রশাখা আছে, যেমন নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, যিকর তিলাওয়াত, দান-খয়রাত ইত্যাদি, তা মানুষের আত্মাকে পবিত্র করে। আর ত্বহারাত দ্বারা পবিত্র হয় মানুষের দেহ। দেহ ও আত্মার সমষ্টিই হল মানুষ । তাহলে দেখা যাচ্ছে মানুষের অর্ধাংশ পবিত্র হয় ত্বহারাত দ্বারা আর বাকি অর্ধেক অন্যান্য ইবাদত দ্বারা। এই হিসেবে ঈমান তথা ঈমানের কার্যাবলী দুই ভাগে বিভক্ত হল। একভাগ দ্বারা মানুষের জাহের পবিত্র হয়, অন্যভাগ দ্বারা পবিত্র হয় মানুষের বাতেন। তাই বলা হয়েছে 'ত্বহারাত ঈমানের অর্ধেক'।
খ. ঈমান দ্বারা নামায বোঝানো হয়েছে, যেমন সুরা বাকারার আয়াত-
وَمَا كَانَ اللهُ لِيُضِيعَ إِيْمَانَكُمْ
*আর আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদের ঈমান নিষ্ফল করে দেবেন। - এর ঈমান শব্দ দ্বারা নামায বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ কিবলা পরিবর্তনের আগে তোমর বায়তুল মাকদিসের দিকে ফিরে যেসব নামায পড়েছ, আল্লাহ তা নিষ্ফল করবেন না তদ্রূপ এ হাদীছেও ঈমান দ্বারা নামায বোঝানো হয়েছে। অর্থ দাঁড়ায়- ত্বহারাত নামাযের অর্ধেক, যেহেতু ত্বহারাত ছাড়া নামায হয় না।
গ. এক হাদীছে আছে, যে-কোনও মুসলিম পরিপূর্ণ ত্বহারাতের সাথে পাঁচ ওয়া নামায পড়ে, তার ওইসকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়, যা এর ওয়াক্তসমূহের মাঝখানে হ যায়। দেখা যাচ্ছে গুনাহ মাফ হয় ত্বহারাত ও নামায- এ দুইয়ের সমষ্টি দ্বারা। সুতর গুনাহ হতে ক্ষমাপ্রাপ্তির দিক থেকে ত্বহারাত ঈমানের তথা নামাযের অর্ধেক।
ঘ. নামায বেহেশতের চাবি। আবার ওযু নামাযের চাবি। তাহলে ওষু ও নামায এ দুইয়ের সমষ্টি দ্বারা জান্নাতের দুয়ার খোলা হয়, যা কিনা ঈমানের লক্ষবস্ত্র। সেই হিসেবে ত্বহারাত ঈমানের অর্ধেক হল।
ঙ. ত্বহারাত তথা ওযু, গোসল ও তায়াম্মুম দ্বারা যে ছওয়াব লাভ হয়, সে ছওয়াব বৃদ্ধি পেতে পেতে ঈমান দ্বারা অর্জিত ছওয়াবের অর্ধেক বরাবর হয়ে যায়।
চ. পবিত্রতাকে ব্যাপক অর্থেও ধরা যেতে পারে। তার মানে জাহিরী ও বাহিনী উভয় প্রকার পবিত্রতা। জাহিরী পবিত্রতা অর্জিত হয় ওযু, গোসল ও তায়াম্মুম দ্বারা। আর বাতিনী তথা আত্মিক পবিত্রতা অর্জিত হয় শিরক ও পাপাচার পরিহার দ্বারা। এই উভয়বিধ পবিত্রতা দ্বারা মানুষের পূর্ণাঙ্গ পরিশুদ্ধি লাভ হয়। বাকি থাকল শোভা ও সৌন্দর্যবিধানের ব্যাপার। তা সম্পন্ন হয় নামায, রোযা, যিকর, তিলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা। এভাবে মানব-জীবনে ঈমানের পরিপূর্ণতা সাধিত হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।
ছ. আবার এমনও বলা যায়, মানুষের করণীয় কাজ দু'প্রকার। একটা অর্জনমূলক, আরেকটা বর্জনমূলক। এ দুইয়ের সমন্বিত রূপই ঈমান। আল্লাহ তা'আলা যা করার আদেশ করেছেন সেগুলো করাই হল অর্জনমূলক কাজ। আর আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু করতে নিষেধ করেছেন সেগুলো হতে বিরত থাকা হচ্ছে বর্জনমূলক কাজ। সেই বর্জনমূলক কাজসমূহ দ্বারা মানুষের শরীর ও মন পবিত্র হয়। এই হিসেবেই বলা হয়েছে, পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।
জ. ত্বহারাত দ্বারা ইখলাসও বোঝানো যেতে পারে। অর্থাৎ ঈমানের এক হল। মৌখিক স্বীকৃতি- নিজেকে মু'মিন ও মুসলিমরূপে প্রকাশ করা। এর মাধ্যমে মানুষের কাছে একজন ব্যক্তি মু'মিনরূপে বিবেচিত হয়, তাতে তার অন্তরে বিশ্বাস থাকুক বা নাই থাকুক। কিন্তু আল্লাহর কাছে মু'মিন সাব্যস্ত হওয়ার জন্যে ইখলাস ও মনের বিশ্বাস ও জরুরি। অন্যথায় সে আখিরাতে মুক্তি পাবে না। তাহলে পরিপূর্ণ ঈমান অর্থাৎ যেই ঈমান দ্বারা আখিরাতে মুক্তিলাভ হবে, তার অর্ধেক হচ্ছে ইখলাস, যাকে 'ত্বহারাত' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। ত্বহারাত শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে এ কথা বোঝানোর জন্য যে, তার মুখের স্বীকারোক্তি মুখের কথামাত্র নয়; বরং তার প্রকৃত ঈমান, যা লোকদেখানোর মনোভাব ও মুনাফিকীর আবিলতা থেকে পবিত্র।
‘আলহামদুলিল্লাহ' বলার ফযীলত
হাদীছের দ্বিতীয় বাক্যে বলা হয়েছে, 'আলহামদুলিল্লাহ' মীযান ভরে ফেলে। আলহামদুলিল্লাহ অর্থ 'সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর'। একথা বলে আল্লাহ তা'আলার যাবতীয় গুণাবলীর প্রতি ঈমানের স্বীকারোক্তিদান, তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও তাঁর প্রদত্ত নি'আমতসমূহের জন্যে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়। সমস্ত প্রশংসা বলতে ফিরিশতা, মানুষ ও জিন্নসহ কুল মাখলুকের মুখে আদায়কৃত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমুদয় প্রশংসা বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ সরাসরি আল্লাহর যে প্রশংসা করা হয় তা তো আল্লাহরই, আর যে সকল প্রশংসা কোনও সৃষ্টিকে লক্ষ্য করে করা হয়ে থাকে তাও মূলত আল্লাহরই প্রশংসা। কেননা মানবজগত, জড়জগত ও উদ্ভিতজগত থেকে শুরু করে নভোমণ্ডল, নক্ষত্রমণ্ডল ও ফিরিশতা জগত পর্যন্ত ও প্রতিপালন আল্লাহ তা'আলারই কাজ। সমস্ত মাখলুক আল্লাহরই সৃষ্টি আর তাদের যাবতীয় গুণ তাঁরই প্রদত্ত। কাজেই এর কোনওটির প্রশংসা করলে তাতে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলারই প্রশংসা করা হয়। বস্তুত আল্লাহ তা'আলার যথার্থ প্রশংসা কোনও সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয়, যেহেতু আল্লাহ তাআলার যাবতীয় গুণ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান আয়ত্ত করা আমাদের সাধ্যাতীত এবং তাঁর সৃষ্টির বিপুলতা সম্পর্কেও পূর্ণাঙ্গ ধারণালাভ অসম্ভব। এ জন্যেই নবী কারীম সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
اللهم لا تحصي ثناء عليك أنت كما أثنيت على نفسك
হে আল্লাহ! আমরা তোমার পুরোপুরি প্রশংসা করতে সক্ষম নই। তুমি নিজে নিজের যেমন প্রশংসা করেছ, তুমি তেমনই।
আল্লাহ তা'আলার যে-কোনও নি'আমত ভোগের পর তাঁর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আলহামদুলিল্লাহ বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন হাদীছে এর অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, যেমন এক হাদীছে আছে- “ যে ব্যক্তি এক লোকমা খাবার খায় বা এক ঢোক পানি পান করে, তারপর আলহামদুলিল্লাহ বলে, তার অতীতের সমস্ত (সগীরা) গুনাহ মাফ হয়ে যায়।”
আর এ হাদীছে তো বলাই হয়েছে যে, আলহামদুলিল্লাহ মীযান ভরে ফেলে। মীযান বলতে ওই তুলাদণ্ড বোঝানো হয়েছে, যা দ্বারা বান্দার আমল পরিমাপ করা হবে। সেটি কেমন, কী তার রূপ, ইহজগতে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। কুরআন ও হাদীছে আমাদেরকে মীযান দ্বারা পরিমাপ করার কথা অবগত করা হয়েছে। আমরা তাতে বিশ্বাস রাখি। এর বেশি খোঁড়াখুঁড়ি করার কোনও প্রয়োজন আমাদের নেই।
বান্দার আমল বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কোনও আমল হয় অন্তর দ্বারা, যেমন অন্তরের বিশ্বাস। কোনওটি মুখের দ্বারা, যেমন যিকর ও তিলাওয়াত। কোনওটি অন্যান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা, যেমন পা দিয়ে মসজিদের দিকে চলা, হাত দ্বারা এতিমের মাধ্য হাত বুলানো, কান দ্বারা কুরআন তিলাওয়াত শোনা ইত্যাদি। এসব আমল কিভাবে পরিমাপ করা হবে তা আল্লাহ তা'আলাই জানেন। আমরা এর সত্যতায় বিশ্বাস রাখি বিশেষত বর্তমানকালে যখন বাতাসের ওজন মাপা হচ্ছে, শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা যায় এবং শীত ও তাপ পরিমাপের ব্যাপারটাও আমরা সবাই জানি, তখন বান্দার যাবতীয় আমল পরিমাপ করা যায় এমন কোনও যন্ত্র সৃষ্টি করা আল্লাহর পক্ষে কঠিন হবে কেন? 'আলহামদুলিল্লাহ' কিভাবে মীযান ভরে ফেলবে তার স্বরূপও আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। হতে পারে এর ছওয়াব এত বেশি, যা মীযান ভরে ফেলবে। অথবা আলহামদুলিল্লাহকে বিশেষ কোনও রূপ দান করা হবে, যা দ্বারা মীযান ভরে যাবে।
'সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ' বলার ফযীলত
তৃতীয় বাক্যে বলা হয়েছে- "সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ' আসমান-যমীনের মধ্যবর্তী স্থান ভরে ফেলে। সুবহানাল্লাহ অর্থ 'আমি আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি। অর্থাৎ তিনি যাবতীয় নাম ও গুণাবলী এবং সমস্ত কাজ ও বিধানাবলীতে সর্বপ্রকার দোষ- ত্রুটি থেকে মুক্ত। আর আলহামদুলিল্লাহ দ্বারা জানানো হয় যে, তিনি সমস্ত সৎগুনের অধিকারী। এই উভয়টি দ্বারা আল্লাহ তা'আলার যিকর ও স্মরণ পরিপূর্ণতা লাভ করে। সে কারণেই এর ছওয়াব এত বেশি। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা জানা যায়। আল্লাহ তা'আলার প্রত্যেকটি সৃষ্টি এ যিকর করে থাকে, যেমন ইরশাদ হয়েছে-
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ ۚ وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَٰكِن لَّا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ
‘সাত আসমান ও যমীন এবং এদের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সৃষ্টি তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে, এমন কোনও জিনিস নেই, যা তাঁর সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে না। কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পার না।' বনী ইস্রাইল-৪৪
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. পবিত্রতা যেহেতু ঈমানের অর্ধেক, তাই সর্বদা এ ব্যাপারে যত্নবান থাকা উচিত । উভয় রকমের পবিত্রতা। অর্থাৎ ওযূ-গোসলের মাধ্যমে শারীরিক পবিত্রতা এবং পাপাচার বর্জনের মাধ্যমে আত্মিক পবিত্রতা।
খ. এ হাদীছ দ্বারা হামদ ও তাসবীহের যে ফযীলত জানা গেল, তা অর্জনের লক্ষ্যে অবসর সময়ে এবং কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব যিকরে রত থাকা উচিত।
পাক-পবিত্রতার ফযীলত
ক. ত্বহারাত ছাড়া ঈমানের আর যত শাখা-প্রশাখা আছে, যেমন নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, যিকর তিলাওয়াত, দান-খয়রাত ইত্যাদি, তা মানুষের আত্মাকে পবিত্র করে। আর ত্বহারাত দ্বারা পবিত্র হয় মানুষের দেহ। দেহ ও আত্মার সমষ্টিই হল মানুষ । তাহলে দেখা যাচ্ছে মানুষের অর্ধাংশ পবিত্র হয় ত্বহারাত দ্বারা আর বাকি অর্ধেক অন্যান্য ইবাদত দ্বারা। এই হিসেবে ঈমান তথা ঈমানের কার্যাবলী দুই ভাগে বিভক্ত হল। একভাগ দ্বারা মানুষের জাহের পবিত্র হয়, অন্যভাগ দ্বারা পবিত্র হয় মানুষের বাতেন। তাই বলা হয়েছে 'ত্বহারাত ঈমানের অর্ধেক'।
খ. ঈমান দ্বারা নামায বোঝানো হয়েছে, যেমন সুরা বাকারার আয়াত-
وَمَا كَانَ اللهُ لِيُضِيعَ إِيْمَانَكُمْ
*আর আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদের ঈমান নিষ্ফল করে দেবেন। - এর ঈমান শব্দ দ্বারা নামায বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ কিবলা পরিবর্তনের আগে তোমর বায়তুল মাকদিসের দিকে ফিরে যেসব নামায পড়েছ, আল্লাহ তা নিষ্ফল করবেন না তদ্রূপ এ হাদীছেও ঈমান দ্বারা নামায বোঝানো হয়েছে। অর্থ দাঁড়ায়- ত্বহারাত নামাযের অর্ধেক, যেহেতু ত্বহারাত ছাড়া নামায হয় না।
গ. এক হাদীছে আছে, যে-কোনও মুসলিম পরিপূর্ণ ত্বহারাতের সাথে পাঁচ ওয়া নামায পড়ে, তার ওইসকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়, যা এর ওয়াক্তসমূহের মাঝখানে হ যায়। দেখা যাচ্ছে গুনাহ মাফ হয় ত্বহারাত ও নামায- এ দুইয়ের সমষ্টি দ্বারা। সুতর গুনাহ হতে ক্ষমাপ্রাপ্তির দিক থেকে ত্বহারাত ঈমানের তথা নামাযের অর্ধেক।
ঘ. নামায বেহেশতের চাবি। আবার ওযু নামাযের চাবি। তাহলে ওষু ও নামায এ দুইয়ের সমষ্টি দ্বারা জান্নাতের দুয়ার খোলা হয়, যা কিনা ঈমানের লক্ষবস্ত্র। সেই হিসেবে ত্বহারাত ঈমানের অর্ধেক হল।
ঙ. ত্বহারাত তথা ওযু, গোসল ও তায়াম্মুম দ্বারা যে ছওয়াব লাভ হয়, সে ছওয়াব বৃদ্ধি পেতে পেতে ঈমান দ্বারা অর্জিত ছওয়াবের অর্ধেক বরাবর হয়ে যায়।
চ. পবিত্রতাকে ব্যাপক অর্থেও ধরা যেতে পারে। তার মানে জাহিরী ও বাহিনী উভয় প্রকার পবিত্রতা। জাহিরী পবিত্রতা অর্জিত হয় ওযু, গোসল ও তায়াম্মুম দ্বারা। আর বাতিনী তথা আত্মিক পবিত্রতা অর্জিত হয় শিরক ও পাপাচার পরিহার দ্বারা। এই উভয়বিধ পবিত্রতা দ্বারা মানুষের পূর্ণাঙ্গ পরিশুদ্ধি লাভ হয়। বাকি থাকল শোভা ও সৌন্দর্যবিধানের ব্যাপার। তা সম্পন্ন হয় নামায, রোযা, যিকর, তিলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা। এভাবে মানব-জীবনে ঈমানের পরিপূর্ণতা সাধিত হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।
ছ. আবার এমনও বলা যায়, মানুষের করণীয় কাজ দু'প্রকার। একটা অর্জনমূলক, আরেকটা বর্জনমূলক। এ দুইয়ের সমন্বিত রূপই ঈমান। আল্লাহ তা'আলা যা করার আদেশ করেছেন সেগুলো করাই হল অর্জনমূলক কাজ। আর আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু করতে নিষেধ করেছেন সেগুলো হতে বিরত থাকা হচ্ছে বর্জনমূলক কাজ। সেই বর্জনমূলক কাজসমূহ দ্বারা মানুষের শরীর ও মন পবিত্র হয়। এই হিসেবেই বলা হয়েছে, পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।
জ. ত্বহারাত দ্বারা ইখলাসও বোঝানো যেতে পারে। অর্থাৎ ঈমানের এক হল। মৌখিক স্বীকৃতি- নিজেকে মু'মিন ও মুসলিমরূপে প্রকাশ করা। এর মাধ্যমে মানুষের কাছে একজন ব্যক্তি মু'মিনরূপে বিবেচিত হয়, তাতে তার অন্তরে বিশ্বাস থাকুক বা নাই থাকুক। কিন্তু আল্লাহর কাছে মু'মিন সাব্যস্ত হওয়ার জন্যে ইখলাস ও মনের বিশ্বাস ও জরুরি। অন্যথায় সে আখিরাতে মুক্তি পাবে না। তাহলে পরিপূর্ণ ঈমান অর্থাৎ যেই ঈমান দ্বারা আখিরাতে মুক্তিলাভ হবে, তার অর্ধেক হচ্ছে ইখলাস, যাকে 'ত্বহারাত' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। ত্বহারাত শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে এ কথা বোঝানোর জন্য যে, তার মুখের স্বীকারোক্তি মুখের কথামাত্র নয়; বরং তার প্রকৃত ঈমান, যা লোকদেখানোর মনোভাব ও মুনাফিকীর আবিলতা থেকে পবিত্র।
‘আলহামদুলিল্লাহ' বলার ফযীলত
হাদীছের দ্বিতীয় বাক্যে বলা হয়েছে, 'আলহামদুলিল্লাহ' মীযান ভরে ফেলে। আলহামদুলিল্লাহ অর্থ 'সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর'। একথা বলে আল্লাহ তা'আলার যাবতীয় গুণাবলীর প্রতি ঈমানের স্বীকারোক্তিদান, তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও তাঁর প্রদত্ত নি'আমতসমূহের জন্যে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়। সমস্ত প্রশংসা বলতে ফিরিশতা, মানুষ ও জিন্নসহ কুল মাখলুকের মুখে আদায়কৃত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমুদয় প্রশংসা বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ সরাসরি আল্লাহর যে প্রশংসা করা হয় তা তো আল্লাহরই, আর যে সকল প্রশংসা কোনও সৃষ্টিকে লক্ষ্য করে করা হয়ে থাকে তাও মূলত আল্লাহরই প্রশংসা। কেননা মানবজগত, জড়জগত ও উদ্ভিতজগত থেকে শুরু করে নভোমণ্ডল, নক্ষত্রমণ্ডল ও ফিরিশতা জগত পর্যন্ত ও প্রতিপালন আল্লাহ তা'আলারই কাজ। সমস্ত মাখলুক আল্লাহরই সৃষ্টি আর তাদের যাবতীয় গুণ তাঁরই প্রদত্ত। কাজেই এর কোনওটির প্রশংসা করলে তাতে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলারই প্রশংসা করা হয়। বস্তুত আল্লাহ তা'আলার যথার্থ প্রশংসা কোনও সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয়, যেহেতু আল্লাহ তাআলার যাবতীয় গুণ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান আয়ত্ত করা আমাদের সাধ্যাতীত এবং তাঁর সৃষ্টির বিপুলতা সম্পর্কেও পূর্ণাঙ্গ ধারণালাভ অসম্ভব। এ জন্যেই নবী কারীম সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
اللهم لا تحصي ثناء عليك أنت كما أثنيت على نفسك
হে আল্লাহ! আমরা তোমার পুরোপুরি প্রশংসা করতে সক্ষম নই। তুমি নিজে নিজের যেমন প্রশংসা করেছ, তুমি তেমনই।
আল্লাহ তা'আলার যে-কোনও নি'আমত ভোগের পর তাঁর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আলহামদুলিল্লাহ বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন হাদীছে এর অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, যেমন এক হাদীছে আছে- “ যে ব্যক্তি এক লোকমা খাবার খায় বা এক ঢোক পানি পান করে, তারপর আলহামদুলিল্লাহ বলে, তার অতীতের সমস্ত (সগীরা) গুনাহ মাফ হয়ে যায়।”
আর এ হাদীছে তো বলাই হয়েছে যে, আলহামদুলিল্লাহ মীযান ভরে ফেলে। মীযান বলতে ওই তুলাদণ্ড বোঝানো হয়েছে, যা দ্বারা বান্দার আমল পরিমাপ করা হবে। সেটি কেমন, কী তার রূপ, ইহজগতে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। কুরআন ও হাদীছে আমাদেরকে মীযান দ্বারা পরিমাপ করার কথা অবগত করা হয়েছে। আমরা তাতে বিশ্বাস রাখি। এর বেশি খোঁড়াখুঁড়ি করার কোনও প্রয়োজন আমাদের নেই।
বান্দার আমল বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কোনও আমল হয় অন্তর দ্বারা, যেমন অন্তরের বিশ্বাস। কোনওটি মুখের দ্বারা, যেমন যিকর ও তিলাওয়াত। কোনওটি অন্যান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা, যেমন পা দিয়ে মসজিদের দিকে চলা, হাত দ্বারা এতিমের মাধ্য হাত বুলানো, কান দ্বারা কুরআন তিলাওয়াত শোনা ইত্যাদি। এসব আমল কিভাবে পরিমাপ করা হবে তা আল্লাহ তা'আলাই জানেন। আমরা এর সত্যতায় বিশ্বাস রাখি বিশেষত বর্তমানকালে যখন বাতাসের ওজন মাপা হচ্ছে, শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা যায় এবং শীত ও তাপ পরিমাপের ব্যাপারটাও আমরা সবাই জানি, তখন বান্দার যাবতীয় আমল পরিমাপ করা যায় এমন কোনও যন্ত্র সৃষ্টি করা আল্লাহর পক্ষে কঠিন হবে কেন? 'আলহামদুলিল্লাহ' কিভাবে মীযান ভরে ফেলবে তার স্বরূপও আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। হতে পারে এর ছওয়াব এত বেশি, যা মীযান ভরে ফেলবে। অথবা আলহামদুলিল্লাহকে বিশেষ কোনও রূপ দান করা হবে, যা দ্বারা মীযান ভরে যাবে।
'সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ' বলার ফযীলত
তৃতীয় বাক্যে বলা হয়েছে- "সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ' আসমান-যমীনের মধ্যবর্তী স্থান ভরে ফেলে। সুবহানাল্লাহ অর্থ 'আমি আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি। অর্থাৎ তিনি যাবতীয় নাম ও গুণাবলী এবং সমস্ত কাজ ও বিধানাবলীতে সর্বপ্রকার দোষ- ত্রুটি থেকে মুক্ত। আর আলহামদুলিল্লাহ দ্বারা জানানো হয় যে, তিনি সমস্ত সৎগুনের অধিকারী। এই উভয়টি দ্বারা আল্লাহ তা'আলার যিকর ও স্মরণ পরিপূর্ণতা লাভ করে। সে কারণেই এর ছওয়াব এত বেশি। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা জানা যায়। আল্লাহ তা'আলার প্রত্যেকটি সৃষ্টি এ যিকর করে থাকে, যেমন ইরশাদ হয়েছে-
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ ۚ وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَٰكِن لَّا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ
‘সাত আসমান ও যমীন এবং এদের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সৃষ্টি তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে, এমন কোনও জিনিস নেই, যা তাঁর সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে না। কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পার না।' বনী ইস্রাইল-৪৪
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. পবিত্রতা যেহেতু ঈমানের অর্ধেক, তাই সর্বদা এ ব্যাপারে যত্নবান থাকা উচিত । উভয় রকমের পবিত্রতা। অর্থাৎ ওযূ-গোসলের মাধ্যমে শারীরিক পবিত্রতা এবং পাপাচার বর্জনের মাধ্যমে আত্মিক পবিত্রতা।
খ. এ হাদীছ দ্বারা হামদ ও তাসবীহের যে ফযীলত জানা গেল, তা অর্জনের লক্ষ্যে অবসর সময়ে এবং কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব যিকরে রত থাকা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: