আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ
৪৭. নবীজী ﷺ থেকে বর্ণিত যাবতীয় দোয়া-জিকির
হাদীস নং: ৩৫০২
আন্তর্জাতিক নং: ৩৫০২
শিরোনামবিহীন পরিচ্ছেদ
৩৫০২. আলী ইবনে হুজর (রাহঃ) ...... ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নিম্নের এই কালিমাসমূহে সাহাবীদের জন্য দুআ না করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার মজলিস থেকে খুব কমই উঠেছেন। কালিমা গুলো হলঃ
اللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا يَحُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيكَ وَمِنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغُنَا بِهِ جَنَّتَكَ وَمِنَ الْيَقِينِ مَا تُهَوِّنُ بِهِ عَلَيْنَا مُصِيبَاتِ الدُّنْيَا وَمَتِّعْنَا بِأَسْمَاعِنَا وَأَبْصَارِنَا وَقُوَّتِنَا مَا أَحْيَيْتَنَا وَاجْعَلْهُ الْوَارِثَ مِنَّا وَاجْعَلْ ثَأْرَنَا عَلَى مَنْ ظَلَمَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى مَنْ عَادَانَا وَلاَ تَجْعَلْ مُصِيبَتَنَا فِي دِينِنَا وَلاَ تَجْعَلِ الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا وَلاَ مَبْلَغَ عِلْمِنَا وَلاَ تُسَلِّطْ عَلَيْنَا مَنْ لاَ يَرْحَمُنَا
হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্য বণ্টন কর তোমার ততটুকু ভয় যতটুকু আমাদের মাঝে এবং তোমার নফরমানীর মাঝে যেন আমাদের জন্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়, তোমার ততটুকু ফরমাবরদারী দাও যতটুকু আমাদের পৌছে দেবে তোমার জান্নাতে। ততটুকু ইয়াকীন দাও যতটুকু দ্বারা সহজ হয়ে যায় আমাদের জন্য দুনিয়ার বিপদাপদ। উপভোগর অবকাশ দাও আমাদের শ্রবন শক্তির, আমাদের দৃষ্টির, আমাদের শক্তির। যতদিন তুমি আমাদের জীবিত রাখবে ততদিন এগুলো তুমি বজায় রেখো। যারা আমাদর উপর যুলুমকরেছে তাদের উপর বদলা তুমিই নিও, যারা আমাদের শত্রুতা করে তাদের মুকাবিলায় তুমিই আমাদের সাহায্য করো। আমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে আমাদেরকে বিপদাপন্ন করো না। দুনিয়ার চিন্তাই তুমি আমাদের বড় চিন্তায় পরিণত করো না। এটিকেই তুমি আমাদের জ্ঞনের চূড়ান্ত বানিও না, আর যারা আমাদের দয়া করবে না তাদেরকে তুমি আমাদের উপর আধিপত্য দিও না।
হাদীসটি হাসান-গারীব। কোন কোন রাবী এই হাদীসটি খালিদ ইবনে আবু ইমরান-নাফি-ইবনে উমর (রাযিঃ) সূত্রে রিওয়ায়াত করেছেন।
اللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا يَحُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيكَ وَمِنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغُنَا بِهِ جَنَّتَكَ وَمِنَ الْيَقِينِ مَا تُهَوِّنُ بِهِ عَلَيْنَا مُصِيبَاتِ الدُّنْيَا وَمَتِّعْنَا بِأَسْمَاعِنَا وَأَبْصَارِنَا وَقُوَّتِنَا مَا أَحْيَيْتَنَا وَاجْعَلْهُ الْوَارِثَ مِنَّا وَاجْعَلْ ثَأْرَنَا عَلَى مَنْ ظَلَمَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى مَنْ عَادَانَا وَلاَ تَجْعَلْ مُصِيبَتَنَا فِي دِينِنَا وَلاَ تَجْعَلِ الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا وَلاَ مَبْلَغَ عِلْمِنَا وَلاَ تُسَلِّطْ عَلَيْنَا مَنْ لاَ يَرْحَمُنَا
হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্য বণ্টন কর তোমার ততটুকু ভয় যতটুকু আমাদের মাঝে এবং তোমার নফরমানীর মাঝে যেন আমাদের জন্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়, তোমার ততটুকু ফরমাবরদারী দাও যতটুকু আমাদের পৌছে দেবে তোমার জান্নাতে। ততটুকু ইয়াকীন দাও যতটুকু দ্বারা সহজ হয়ে যায় আমাদের জন্য দুনিয়ার বিপদাপদ। উপভোগর অবকাশ দাও আমাদের শ্রবন শক্তির, আমাদের দৃষ্টির, আমাদের শক্তির। যতদিন তুমি আমাদের জীবিত রাখবে ততদিন এগুলো তুমি বজায় রেখো। যারা আমাদর উপর যুলুমকরেছে তাদের উপর বদলা তুমিই নিও, যারা আমাদের শত্রুতা করে তাদের মুকাবিলায় তুমিই আমাদের সাহায্য করো। আমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে আমাদেরকে বিপদাপন্ন করো না। দুনিয়ার চিন্তাই তুমি আমাদের বড় চিন্তায় পরিণত করো না। এটিকেই তুমি আমাদের জ্ঞনের চূড়ান্ত বানিও না, আর যারা আমাদের দয়া করবে না তাদেরকে তুমি আমাদের উপর আধিপত্য দিও না।
হাদীসটি হাসান-গারীব। কোন কোন রাবী এই হাদীসটি খালিদ ইবনে আবু ইমরান-নাফি-ইবনে উমর (রাযিঃ) সূত্রে রিওয়ায়াত করেছেন।
باب
حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حُجْرٍ، أَخْبَرَنَا ابْنُ الْمُبَارَكِ، أَخْبَرَنَا يَحْيَى بْنُ أَيُّوبَ، عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ زَحْرٍ، عَنْ خَالِدِ بْنِ أَبِي عِمْرَانَ، أَنَّ ابْنَ عُمَرَ، قَالَ قَلَّمَا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُومُ مِنْ مَجْلِسٍ حَتَّى يَدْعُوَ بِهَؤُلاَءِ الْكَلِمَاتِ لأَصْحَابِهِ " اللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا يَحُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيكَ وَمِنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغُنَا بِهِ جَنَّتَكَ وَمِنَ الْيَقِينِ مَا تُهَوِّنُ بِهِ عَلَيْنَا مُصِيبَاتِ الدُّنْيَا وَمَتِّعْنَا بِأَسْمَاعِنَا وَأَبْصَارِنَا وَقُوَّتِنَا مَا أَحْيَيْتَنَا وَاجْعَلْهُ الْوَارِثَ مِنَّا وَاجْعَلْ ثَأْرَنَا عَلَى مَنْ ظَلَمَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى مَنْ عَادَانَا وَلاَ تَجْعَلْ مُصِيبَتَنَا فِي دِينِنَا وَلاَ تَجْعَلِ الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا وَلاَ مَبْلَغَ عِلْمِنَا وَلاَ تُسَلِّطْ عَلَيْنَا مَنْ لاَ يَرْحَمُنَا " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ . وَقَدْ رَوَى بَعْضُهُمْ هَذَا الْحَدِيثَ عَنْ خَالِدِ بْنِ أَبِي عِمْرَانَ عَنْ نَافِعٍ عَنِ ابْنِ عُمَرَ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে মজলিসের শেষে পড়ার জন্য আরেকটি দু'আ শেখানো হয়েছে। অত্যন্ত সারগর্ভ, ব্যাপক অর্থবোধক ও দীন-দুনিয়ার প্রয়োজনীয় বহু বিষয় সম্বলিত এক দু'আ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এ দু'আটি প্রায় প্রতি মজলিসেরই শেষে পড়তেন। দু'আটি এই-
اللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا تَحُولُ بِهِ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيْكَ، وَمِنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغُنَا بِهِ جَنَّتَكَ، وَمِنَ الْيَقِيْنِ مَا تُهَوِّنُ عَلَيْنَا مَصَائِبَ الدُّنْيَا، اللَّهُمَّ مَتِّعْنَا بِأَسْمَاعِنَا، وَأَبْصَارِنَا، وَقُوَّتِنَا مَا أَحْيَيْتَنَا، وَاجْعَلْهُ الْوَارِثَ مِنَّا ، وَاجْعَلْ ثَأْرَنَا عَلَى مَنْ ظَلَمَنَا، وَانْصُرْنَا عَلَى مَنْ عَادَانَا، وَلَا تَجْعَلْ مُصِيبَتَنَا فِي دِينِنَا، وَلَا تَجْعَلِ الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا، وَلَا مَبْلَغَ عِلْمِنَا، وَلَا تُسَلِّطُ عَلَيْنَا مَنْ لَا يَرْحَمُنَا
নিচে আলাদাভাবে দু'আটির প্রতিটি বাক্যের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে।
اَللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا تَحُوْلُ بِهِ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيْكَ
‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে তোমার এ পরিমাণ ভীতি দান করো, যা আমাদের ও তোমার নাফরমানির মাঝখানে প্রতিবন্ধক হবে’। এ বাক্যে আল্লাহ তা'আলার কাছে চাওয়া হয়েছে তাঁর খাশয়াত (ভীতি)। এর দ্বারা পরোক্ষভাবে আল্লাহ তা'আলার পরিচয় সম্পর্কিত জ্ঞানও চাওয়া হয়ে যায়। খাশয়াত বলা হয় অন্তরে সঞ্চারিত ওই ভীতিকে, যা আল্লাহ তা'আলার উচ্চমর্যাদা, তাঁর মহিমা, বড়ত্ব ও গৌরব সম্পর্কে জানার দ্বারা জন্ম নেয়। সুতরাং কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ
'আল্লাহকে তো কেবল তারাই ভয় করে, যারা জ্ঞানের অধিকারী।’ (সূরা ফাতির, আয়াত ২৮)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলাকে চিনতেন সবচে' বেশি। তাই তিনি তাঁকে ভয়ও করতেন সকলের অধিক। সুতরাং তিনি বলেন-
فَأَنَا وَاللَّهِ أَعْلَمُكُمْ بِاللَّهِ ، وَأَتْقَاكُمْ لَهُ
'আল্লাহর কসম! আল্লাহকে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি জানি এবং তাঁকে ভয়ওকরি তোমাদের সকলের চেয়ে বেশি।' (হাকিম, আল-মুস্তাদরাক: ১৭৪২)
ফিরিশতাগণ আল্লাহ তা'আলাকে আমাদের তুলনায় বেশি কাছ থেকে জানেন। তাদের সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ
'তারা তাঁর ভয়ে থাকে ভীত।' (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ২৮)
এ বাক্যটিতে আল্লাহ তা'আলার কাছে তাঁর ভয় কেন চাওয়া হয়েছে তাও বলে দেওয়া হয়েছে। তা হল আল্লাহর ভয় নাফরমানিতে লিপ্ত হওয়ার সবচে' বড় প্রতিবন্ধক। আল্লাহভীতি মানুষকে গুনাহে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখে। গুনাহ হতে বিরত থাকা প্রত্যেক বান্দার অবশ্যকর্তব্য। গুনাহের কারণে মানুষ জাহান্নামে যাবে। আমাদেরকে তো জাহান্নাম থেকে বাঁচতে হবে। আর তা বাঁচা যাবে তখনই, যখন আমরা গুনাহ থেকে বিরত থাকব। সেজন্যই প্রয়োজন আল্লাহভীতির, যা এ বাক্যে চাওয়া হয়েছে।
লক্ষণীয়, এ দু'আয় আল্লাহভীতি চাওয়া হয়েছে বিশেষ এক পরিমাণে। যে পরিমাণ দ্বারা গুনাহ হতে বাঁচা যায়। তার কমও নয়, বেশিও নয়। আল্লাহর ভয় যদি হালকা হয়, তবে মানুষ সে ভয়কে উপেক্ষা করে গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। মনে মনে আশা রাখে আল্লাহ মাফ করে দেবেন। হয়তো ভাবে পরে তাওবা করে নেব। কিংবা কিছুই ভাবে না। তার কুপ্রবৃত্তির তাড়না হালকা আল্লাহভীতিকে ছাপিয়ে যায়। আর এভাবে একের পর এক গুনাহে লিপ্ত হতে থাকে। অপরদিকে আল্লাহর ভয় মাত্রাতিরিক্ত হলে মনে হতাশা জন্ম নেয়। ফলে যে পাপ হয়ে গেছে তা থেকে ক্ষমা পাওয়ার আশা রাখে না। অতীত পাপের জন্য যখন ক্ষমা পাওয়ার আশা রাখে না, তখন অধিকতর পাপে লিপ্ত হতে তার কুণ্ঠাবোধ থাকে না। বরং আগের চেয়ে অধিকতর ঔদ্ধত্যের সঙ্গে পাপকর্ম করতে থাকে। তাই অল্পও নয় বেশিও নয়, আল্লাহভীতি থাকা দরকার মাঝামাঝি পরিমাণে। এতটুকু পরিমাণে, যা গুনাহে লিপ্ত হওয়ার জন্য বাধা হয়।
وَمِنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغْنَا بِهِ جَنَّتَكَ
‘আমাদেরকে তোমার এ পরিমাণ আনুগত্য দান করো, যা দ্বারা তুমি আমাদেরকে তোমার জান্নাতে পৌঁছাবে’।
অর্থাৎ আপনার এ পরিমাণ ইবাদত-বন্দেগী করার তাওফীক আমাদের দান করুন, যা আমাদের জন্য আপনার সমষ্টি লাভ করা ও জান্নাতে পৌছার কারণ হবে। বোঝা গেল জান্নাতলাভের জন্য আল্লাহ তা'আলার ইবাদত-বন্দেগী ও নেক আমল করা জরুরি। কুরআন মাজীদে এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছে আমাদেরকে বেশি বেশি নেক আমল করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। বার বার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, জান্নাতে যেতে হলে অবশ্যই সৎকর্মের পুঁজি প্রয়োজন হবে। কোনও কোনও হাদীছে যে জানাে হয়েছে জান্নাত লাভ হবে কেবল আল্লাহ তা'আলার রহমতে, তার সঙ্গে এ কথার কোনও বিরোধ নেই। কেননা তাঁর যে রহমত দ্বারা জান্নাত লাভ হবে, সে রহমত পাওয়ার জন্যই ইবাদত-বন্দেগী জরুরি। অর্থাৎ ইবাদত-বন্দেগী করার দ্বারা আল্লাহ তা'আলা খুলি হবেন। ফলে তিনি নিজ রহমত ও দয়ায় জান্নাত দান করবেন। কাজেই আল্লাহর রহমতে জান্নাতে যেতে চাইলে অবশ্যই তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে। এজন্যই বিভিন্ন আয়াতে জান্নাতলাভকে ইবাদত-বন্দেগী ও সৎকর্মের পুরস্কার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জান্নাতবাসীগণ জান্নাতে পৌছার পর আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে লক্ষা করে বলবেন-
وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي أُوْرِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
'এটাই সেই জান্নাত, তোমাদেরকে যার অধিকারী করা হয়েছে তোমাদের কর্মের বিনিময়ে।’ (সূরা যুখরুফ, আয়াত ৭২)
وَمِنَ الْيَقِيْنِ مَا تُهَوِّنُ عَلَيْنَا مَصَائِبَ الدُّنْيَا
‘এবং এ পরিমাণ ইয়াকীন দান করো, যা আমাদের জন্য দুনিয়ার বালা-মসিবতকে সহজ করে দেবে’।
ইয়াকীন হল ঈমান ও বিশ্বাসের উচ্চতর স্তর। ঈমান যে পর্যায়ে পৌঁছলে অন্তরে কোনওরূপ খটকা ও সংশয়-সন্দেহ প্রশ্রয় পায় না এবং অদৃশ্য জান্নাত ও জাহান্নাম দৃশ্যমান বিষয়ের মতো হয়ে যায়, তাকে ইয়াকীন বলে। অন্তরে ইয়াকীন এসে গেলে ইবাদত-বন্দেগী সহজ হয়ে যায় এবং বিপদ-আপদে ধৈর্য ধরা সহজ হয়ে যায়। বরং ধৈর্যের পুরস্কারে জান্নাতের যে মহা নি'আমত দান করা হবে, সে বিবেচনায় কঠিন থেকে কঠিন বিপদও তুচ্ছ বলে মনে হয়। মহাবিপদের সম্মুখীন হয়েও ইয়াকীনওয়ালা ব্যক্তি বলে ওঠে-
لَنْ يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلنَا
'আল্লাহ আমাদের জন্য (তাকদীরে) যা লিখে রেখেছেন, তাছাড়া অন্য কোনও কষ্ট আমাদেরকে কিছুতেই স্পর্শ করবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক।’ (সূরা তাওবা, আয়াত ৫১)
اللَّهُمَّ مَتِّعْنَا بِأَسْمَاعِنَا، وَأَبْصَارِنَا، وَقُوَّتِنَا مَا أَحْيَيْتَنَا
‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে যতদিন জীবিত রাখ, ততোদিন আমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্যান্য শক্তি দ্বারা আমাদেরকে উপকৃত করো’।
অর্থাৎ যতদিন জীবিত রাখ, ততোদিন যেন আমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং শরীরের ভেতরে ও বাইরে যতগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে প্রত্যেকটির শক্তি অবশিষ্ট থাকে। যাতে আমরা সেসব শক্তি দ্বারা উপকৃত হতে পারি। এমন যেন না হয় যে, বেঁচে থাকলাম অথচ শেষপর্যন্ত দেখার শক্তি, বলার শক্তি, চলার শক্তি বা অন্য কোনও শক্তি বাকি থাকল না। কেননা এরূপ কোনও শক্তি হারিয়ে গেলে বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে যায়। জীবন অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ইবাদত-বন্দেগী করাও কঠিন হয়ে যায়। সুতরাং হে আল্লাহ! অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজে নিজেই যাতে চলতে পারি এবং মৃত্যু পর্যন্ত সবগুলো অঙ্গ কাজে লাগিয়ে তোমার শোকরগুযার হয়ে থাকতে পারি, সেজন্য আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল ও সক্রিয় রেখো।
وَاجْعَلْهُ الْوَارِثَ مِنَّا
‘এবং এগুলোকে আমাদের ওয়ারিছ বানিয়ে দিয়ো’।
এখানে ওয়ারিছ দ্বারা 'বাকি' বা 'অবশিষ্ট' অর্থ বোঝানো হয়েছে। এর দুই ব্যাখ্যা হতে পারে। এক ব্যাখ্যা এই যে, আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের শক্তি এখনকার মতো ভবিষ্যতেও বাকি রেখো। কোনও ব্যক্তি মারা গেলে তার জায়গায় তার ওয়ারিছ বাকি থাকে। ঠিক তেমনি এখানেও বোঝানো হচ্ছে যে, আমার বর্তমান সময়টা চলে যাওয়ার পরও আমার শক্তিসমূহ যেন অবশিষ্ট থাকে। এ হিসেবে এই বাক্যটির কথা এর আগের বাক্যের অনুরূপ।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হল, আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যেন ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারি সেই তাওফীক আমাকে দান করো। যাতে আমার মৃত্যুর পরও আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ মানুষের মধ্যে টিকে থাকে এবং মানুষ তা দ্বারা উপকৃত হতে পারে। মানুষ মারা গেলে তার কাজও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মৃত্যুর পর তার আমলনামায় কোনও ছাওয়াব যুক্ত হয় না। তবে হাঁ, জীবিত অবস্থায় যদি এমন কোনও কাজ করা যায়, যা তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে যায় না; বরং তার পরেও তার কল্যাণধারা অব্যাহত থাকে, তবে যতদিন মানুষ সে কল্যাণ ভোগ করবে, ততোদিন মৃতব্যক্তির আমলনামায় তার ছাওয়াব লেখা হতে থাকবে। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
إذا مات الإنسان انقطع عنه عمله إلا من ثلاثةٍ: من صدقة جارية، أو علم ينتفع به، أو ولد صالح يدعو له
'মানুষ যখন মারা যায় তার আমল বন্ধ হয়ে যায় (তার আমলনামায় আর কোনও ছাওয়াব লেখা হয় না), তবে তিনটি ছাড়া- সদাকায়ে জারিয়া (-এর ছাওয়াব); ওই ইলম (বিস্তার করার ছাওয়াব), যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং নেক সন্তান, যে তার জন্য দু'আ করবে’।
(সহীহ মুসলিম: ১৬৩১; জামে' তিরমিযী: ১৩৭৬; সুনানে নাসাঈ ৩৬৫১; সুনানে আবু দাউদ : ২৮৮০; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৪২; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৬৪৫৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা। ২৪৯৪; সহীহ ইবনে হিব্বান; ৩০১৬, বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১২৬৩৫; শু'আবুল ঈমান: ৩১৭৩; সুনানে দারিমী: ৫৭৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৩৯)
وَاجْعَلْ ثَأْرَنَا عَلَى مَنْ ظَلَمَنَا
‘যে আমাদের উপর জুলুম করেছে, আমাদের পক্ষে তাঁর থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করো’।
অথবা এর অর্থ- যে আমার উপর জুলুম করেছে, তাঁর থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকে আমার জন্য সহজ করে দাও। এমন যেন না হয় যে, প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে অধিকতর জুলুমের শিকার হই কিংবা উল্টো আমি তাঁর উপর জুলুম করে বসি। এমনিতে তো জুলুমকারীকে ক্ষমা করাই উত্তম। যদি প্রতিশোধ গ্রহণ করার ইচ্ছা হয়, তবে এক তো প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা আছে কি না সেদিয়ে লক্ষ রাখাও জরুরি। দ্বিতীয়ত এ বিষয়েও সতর্ক থাকা দরকার যাতে জুলুমের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে উল্টো জুলুম করা না হয়। অর্থাৎ জালেমের জুলুমের তুলনায় প্রতিশোধের মাত্রা বেশি না হয়ে যায়।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ
'তোমরা যদি (কোনও জুলুমের) প্রতিশোধ নাও, তবে ঠিক ততটুকুই নেবে, যতটুক জুলুম তোমাদের উপর করা হয়েছে আর যদি সবর কর, তবে নিশ্চয়ই সবর অবলম্বনকারীদের পক্ষে তাই শ্রেয়।'
(সূরা নাহল, আয়াত ১২৬)
وَانْصُرْنَا عَلَى مَنْ عَادَانَا
‘যে আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে, তার বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করো’।
অর্থাৎ যারা অন্যায়ভাবে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করে, আমরা যাতে তাদের উপর জয়ী হতে পারি সেজন্য তুমি আমাদের সাহায্য করো। তুমি সাহায্য না করলে আমাদের এমন ক্ষমতা নেই, যা দ্বারা আমরা তাদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারব।
وَلَا تَجْعَلْ مُصِيبَتَنَا فِي دِيْنِنَا
‘আমাদের দীনের কোনও বিষয়ে আমাদেরকে বিপদ দিয়ো না’।
অর্থাৎ আমাদের উপর কাফের-বেঈমানদের আধিপত্য দিয়ো না, নাস্তিক- মুরতাদদের চাপিয়ে দিয়ো না এবং আমাদেরকে এমন কোনও পরীক্ষা ও এমন কোনও মসিবতে ফেলো না, যার কারণে আমাদের আকীদা-বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমাদের আমলে ভাটা পড়ে, আমাদের আখলাক-চরিত্র ক্ষুণ্ণ হয়। কেননা দুনিয়াবী বালা-মসিবত অপেক্ষা দীনী বিপদ-আপদের ক্ষতি অনেক বেশি। দুনিয়াবী বালা-মসিবতের ক্ষতি সাময়িক কালের। পক্ষান্তরে দীনী ক্ষতি তো অনন্তকালের। তাই দুনিয়াবী ক্ষতি অপেক্ষা দীনী ক্ষতি থেকে বাঁচা অনেক বেশি জরুরি। এর জন্য যেমন সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে, তেমনি আল্লাহ তা'আলার কাছে সাহায্যও চাইতে হবে। তাঁর সাহায্য ছাড়া নিজ দীন ও ঈমানের হেফাজত সম্ভব নয়। এ ফিতনা-ফাসাদের যমানায় আরও বেশি কঠিন।
وَلَا تَجْعَلِ الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا
‘দুনিয়াকে বানিয়ো না আমাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু’।
هَمّ এর অর্থ চিন্তা, দুঃখ, অভিপ্রায়, আসক্তি ইত্যাদি। অর্থাৎ এমন যেন না হয় যে, আমরা দুনিয়াকেই লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নিয়েছি। আমাদের শরীর-মনকে দুনিয়ার সঙ্গেই যুক্ত করে দিয়েছি। যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা কেবল দুনিয়ার জন্যই করছি। দীনের ক্ষতি অপেক্ষা দুনিয়ার ক্ষতিতেই বেশি দুঃখ-কষ্ট পাচ্ছি। এমন যদি হয়ে যাই, তবে আখিরাত থেকে গাফেল হয়ে পড়ব। কাজেই আমাদের ধ্যান, চিন্তা, মনোযোগ ও আসক্তিকে আখিরাতমুখী করে দাও, যাতে দুনিয়া অপেক্ষা আমরা আখিরাতকেই বড় করে দেখি।
বাক্যটিতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, দুনিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে নেই। প্রধান লক্ষ্যবস্তু আখিরাত হবে বটে, কিন্তু ইহজীবনে চলার জন্য যা-কিছু প্রয়োজন তা থেকেও বিমুখ হওয়া যাবে না।
وَلا مبلغ علمنا
‘এবং দুনিয়াকে বানিয়ো না আমাদের জ্ঞানের শেষ সীমানা’।
অর্থাৎ আমাদের যাবতীয় জ্ঞানবিদ্যার লক্ষ্যবস্তু যেন দুনিয়াই না হয়। কেবল এরই উদ্দেশ্যে যেন আমরা জ্ঞান আহরণ না করি। আমাদের জ্ঞানবিদ্যার দৌড় যেন দুনিয়া পর্যন্তই না হয়, যেমনটা কাফের ও অবিশ্বাসীদের হয়ে থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَعْلَمُونَ ظَاهِرًا مِنَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ عَنِ الْآخِرَةِ هُمْ غَافِلُونَ
'তারা পার্থিব জীবনের প্রকাশ্য দিকটাই জানে। আর আখিরাত সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ গাফেল’। (সূরা রূম, আয়াত ৭)
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
فَأَعْرِضْ عَنْ مَنْ تَوَلَّى عَنْ ذِكْرِنَا وَلَمْ يُرِدْ إِلَّا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا (29) ذَلِكَ مَبْلَغُهُمْ مِنَ الْعِلْمِ
'সুতরাং (হে রাসূল!) যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং পার্থিব জীবন ছাড়া অন্য কিছু কামনাই করে না, তুমি তাকে অগ্রাহ্য করো। তাদের জ্ঞানের দৌড় এ পর্যন্তই। (সূরা নাজম, আয়াত ২৯, ৩০)
সুতরাং যারা মুমিন-মুত্তাকী, তাদের এরকম হলে চলবে না। তারা যদি তাদের সবটা ধ্যান-জ্ঞান নিজ দুনিয়া গড়ার জন্যই নিয়োজিত করে এবং নিজ আখিরাত নির্মাণ থেকে উদাসীন হয়ে থাকে, তবে তা কত বড়ই না আফসোসের কথা! আমরা যাতে সেরকম না হই, সেজন্যই এ দু'আ আমাদের শেখানো হয়েছে।
وَلَا تُسَلِّطُ عَلَيْنَا مَنْ لَا يَرْحَمُنَا
‘যারা আমাদের প্রতি সদয় নয়, তাদেরকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ো না’।
অর্থাৎ কাফের, জালেম ও পাপিষ্ঠদেরকে আমাদের উপর আধিপত্য দিয়ো না এবং তাদেরকে আমাদের উপর প্রবল করো না। তাহলে তারা আমাদেরকে দাবিয়ে রাখবে, আমাদের নির্যাতন করবে, আমাদের ঈমান-আমলে বাধা দেবে। এভাবে দীন ও দুনিয়া সবদিক থেকে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এর মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মুমিনদের উপর বেঈমান ও পাপিষ্ঠদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠ আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাতেই হয়। মুমিনগণ যখন আপন দায়িত্বে অবহেলা করে, তখনই তারা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। কাজেই জালেম শাসক বা কোনও পাপি প্রভাবশালী ব্যক্তি দ্বারা মুমিন-মুসলিম ব্যক্তি নিপীড়িত হলে তখন তাদেরকে গালমন্দ না করে উচিত হল আল্লাহ তা'আলার শরণাপন্ন হওয়া এবং নিজ আমল-আখলাকের সংশোধনে মনোযোগ দেওয়া। তখন আল্লাহ তা'আলা পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দেবেন। হয় সেই জালেমকে ঈমানদার বানিয়ে দেবেন, নয়তো তার বিপরীতে মুমিনকে সাহায্য করবেন, তাকে শক্তিশালী করে তুলবেন। এরকম দু'আ কুরআন মাজীদেও বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আছে-
رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِلْقَوْمِ الظَّالِمِينَ (85) وَنَجِّنَا بِرَحْمَتِكَ مِنَ الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
'হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ওই জালেম সম্প্রদায়ের পরীক্ষার পাত্র বানিয়ো না। এবং নিজ রহমতে আমাদেরকে কাফের সম্প্রদায় হতে নাজাত দাও’।(সূরা ইয়ূনুস, আয়াত ৮৫, ৮৬)
এ বাক্যে কবরে আযাব দানকারী ও জাহান্নামের ফিরিশতাদেরকেও বোঝানো হতে পারে। ফিরিশতারা যখন পাপী ব্যক্তিকে কবরে ও জাহান্নামে শাস্তি দেবে, তখন কোনও দয়ামায়া করবে না। তাই এ বাক্যে তাদের থেকে পানাহ চাওয়া হয়েছে। যাতে আল্লাহ তা'আলা পূর্ণাঙ্গ ঈমান-আমলের তাওফীক দান করেন আর মুসলিমরূপে মৃত্যু দেন। এর ফলে আযাবের ফিরিশতাদের দেখাই মিলবে না। কবরেও শান্তি লাভ হবে এবং আখিরাতেও জান্নাত নসীব হবে।
এমনও হতে পারে যে, বাক্যে একইসঙ্গে জালেম ও নিপীড়ক এবং আযাবের ফিরিশতা উভয়কেই বোঝানো হয়েছে। বস্তুত মুমিন ব্যক্তির জন্য প্রয়োজন উভয় থেকে মুক্তি লাভ করা এবং উভয় জগতের নিরাপত্তা পাওয়া। তাই এ দু'আ করার সময় উভয়টার নিয়ত থাকাই ভালো।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কোনও বৈঠক ও মজলিসে অনুচিত ও অহেতুক কথা বলা উচিত নয়।
খ. আল্লাহর ভয় পাপকর্ম থেকে বাঁচার শক্তি যোগায়।
গ. ইবাদত-বন্দেগীই জান্নাতলাভের একমাত্র উপায়।
ঘ. ঈমান যত শক্তিশালী হয়, বিপদ-আপদে ধৈর্য ধরা ততো সহজ হয়।
ঙ.চোখ, কান, হাত, পা সহ প্রতিটি অঙ্গের শক্তি আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। নিজ অবহেলায় এ শক্তি নষ্ট করতে নেই। বরং যতদিন আয়ু থাকে ততোদিন এ শক্তির হেফাজত করার জন্য সচেষ্ট থাকা ও দু'আ করা জরুরি।
চ. জুলুমের প্রতিশোধ নেওয়ার বেলায়ও ইনসাফ করা উচিত।
ছ. শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়লাভে কেবল নিজ ক্ষমতা ও কৌশলই যথেষ্ট নয়; আল্লাহ তা'আলার সাহায্যও প্রয়োজন।
জ. নিজ দীনের ক্ষতি সবচে' বড় ক্ষতি। কাজেই কোনও বিপদ-আপদে যাতে এ ক্ষতির শিকার না হতে হয় সেজন্য চেষ্টা ও দু'আ দুই-ই জরুরি।
ঝ. দুনিয়ার অর্থবিত্ত ও বস্তুগত সাফল্যই জীবনের লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত নয়।
ঞ. জীবনরক্ষার জন্য যা-কিছু প্রয়োজন তা উপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয় নয়।
ট. মুমিন ব্যক্তির নিজ জ্ঞানবিদ্যার দৌড় দুনিয়া ও দুনিয়ার বস্তুসামগ্রী পর্যন্তই হওয়া উচিত নয়। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি ও আখিরাতের মুক্তিলাভ যে উপায়ে হয় তা জানাটাই আসল জ্ঞান।
ঠ. মুমিনদের সতর্ক থাকা উচিত এবং ব্যবস্থাও গ্রহণ করা উচিত যাতে কাফের-মুশরিক ও পাপিষ্ঠ সম্প্রদায় তাদের উপর চেপে বসতে না পারে।
ড. মৃত্যুর পর আযাবের ফিরিশতাদের কবলে যাতে পড়তে না হয়, ইহজীবনে সে লক্ষ্যে সৎকর্মের সাধনা করতে হবে।
চ. এ গুরুত্বপূর্ণ দু'আটি প্রত্যেক বৈঠক ও মজলিসের শেষে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
اللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا تَحُولُ بِهِ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيْكَ، وَمِنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغُنَا بِهِ جَنَّتَكَ، وَمِنَ الْيَقِيْنِ مَا تُهَوِّنُ عَلَيْنَا مَصَائِبَ الدُّنْيَا، اللَّهُمَّ مَتِّعْنَا بِأَسْمَاعِنَا، وَأَبْصَارِنَا، وَقُوَّتِنَا مَا أَحْيَيْتَنَا، وَاجْعَلْهُ الْوَارِثَ مِنَّا ، وَاجْعَلْ ثَأْرَنَا عَلَى مَنْ ظَلَمَنَا، وَانْصُرْنَا عَلَى مَنْ عَادَانَا، وَلَا تَجْعَلْ مُصِيبَتَنَا فِي دِينِنَا، وَلَا تَجْعَلِ الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا، وَلَا مَبْلَغَ عِلْمِنَا، وَلَا تُسَلِّطُ عَلَيْنَا مَنْ لَا يَرْحَمُنَا
নিচে আলাদাভাবে দু'আটির প্রতিটি বাক্যের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে।
اَللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا تَحُوْلُ بِهِ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيْكَ
‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে তোমার এ পরিমাণ ভীতি দান করো, যা আমাদের ও তোমার নাফরমানির মাঝখানে প্রতিবন্ধক হবে’। এ বাক্যে আল্লাহ তা'আলার কাছে চাওয়া হয়েছে তাঁর খাশয়াত (ভীতি)। এর দ্বারা পরোক্ষভাবে আল্লাহ তা'আলার পরিচয় সম্পর্কিত জ্ঞানও চাওয়া হয়ে যায়। খাশয়াত বলা হয় অন্তরে সঞ্চারিত ওই ভীতিকে, যা আল্লাহ তা'আলার উচ্চমর্যাদা, তাঁর মহিমা, বড়ত্ব ও গৌরব সম্পর্কে জানার দ্বারা জন্ম নেয়। সুতরাং কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ
'আল্লাহকে তো কেবল তারাই ভয় করে, যারা জ্ঞানের অধিকারী।’ (সূরা ফাতির, আয়াত ২৮)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলাকে চিনতেন সবচে' বেশি। তাই তিনি তাঁকে ভয়ও করতেন সকলের অধিক। সুতরাং তিনি বলেন-
فَأَنَا وَاللَّهِ أَعْلَمُكُمْ بِاللَّهِ ، وَأَتْقَاكُمْ لَهُ
'আল্লাহর কসম! আল্লাহকে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি জানি এবং তাঁকে ভয়ওকরি তোমাদের সকলের চেয়ে বেশি।' (হাকিম, আল-মুস্তাদরাক: ১৭৪২)
ফিরিশতাগণ আল্লাহ তা'আলাকে আমাদের তুলনায় বেশি কাছ থেকে জানেন। তাদের সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ
'তারা তাঁর ভয়ে থাকে ভীত।' (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ২৮)
এ বাক্যটিতে আল্লাহ তা'আলার কাছে তাঁর ভয় কেন চাওয়া হয়েছে তাও বলে দেওয়া হয়েছে। তা হল আল্লাহর ভয় নাফরমানিতে লিপ্ত হওয়ার সবচে' বড় প্রতিবন্ধক। আল্লাহভীতি মানুষকে গুনাহে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখে। গুনাহ হতে বিরত থাকা প্রত্যেক বান্দার অবশ্যকর্তব্য। গুনাহের কারণে মানুষ জাহান্নামে যাবে। আমাদেরকে তো জাহান্নাম থেকে বাঁচতে হবে। আর তা বাঁচা যাবে তখনই, যখন আমরা গুনাহ থেকে বিরত থাকব। সেজন্যই প্রয়োজন আল্লাহভীতির, যা এ বাক্যে চাওয়া হয়েছে।
লক্ষণীয়, এ দু'আয় আল্লাহভীতি চাওয়া হয়েছে বিশেষ এক পরিমাণে। যে পরিমাণ দ্বারা গুনাহ হতে বাঁচা যায়। তার কমও নয়, বেশিও নয়। আল্লাহর ভয় যদি হালকা হয়, তবে মানুষ সে ভয়কে উপেক্ষা করে গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। মনে মনে আশা রাখে আল্লাহ মাফ করে দেবেন। হয়তো ভাবে পরে তাওবা করে নেব। কিংবা কিছুই ভাবে না। তার কুপ্রবৃত্তির তাড়না হালকা আল্লাহভীতিকে ছাপিয়ে যায়। আর এভাবে একের পর এক গুনাহে লিপ্ত হতে থাকে। অপরদিকে আল্লাহর ভয় মাত্রাতিরিক্ত হলে মনে হতাশা জন্ম নেয়। ফলে যে পাপ হয়ে গেছে তা থেকে ক্ষমা পাওয়ার আশা রাখে না। অতীত পাপের জন্য যখন ক্ষমা পাওয়ার আশা রাখে না, তখন অধিকতর পাপে লিপ্ত হতে তার কুণ্ঠাবোধ থাকে না। বরং আগের চেয়ে অধিকতর ঔদ্ধত্যের সঙ্গে পাপকর্ম করতে থাকে। তাই অল্পও নয় বেশিও নয়, আল্লাহভীতি থাকা দরকার মাঝামাঝি পরিমাণে। এতটুকু পরিমাণে, যা গুনাহে লিপ্ত হওয়ার জন্য বাধা হয়।
وَمِنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغْنَا بِهِ جَنَّتَكَ
‘আমাদেরকে তোমার এ পরিমাণ আনুগত্য দান করো, যা দ্বারা তুমি আমাদেরকে তোমার জান্নাতে পৌঁছাবে’।
অর্থাৎ আপনার এ পরিমাণ ইবাদত-বন্দেগী করার তাওফীক আমাদের দান করুন, যা আমাদের জন্য আপনার সমষ্টি লাভ করা ও জান্নাতে পৌছার কারণ হবে। বোঝা গেল জান্নাতলাভের জন্য আল্লাহ তা'আলার ইবাদত-বন্দেগী ও নেক আমল করা জরুরি। কুরআন মাজীদে এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছে আমাদেরকে বেশি বেশি নেক আমল করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। বার বার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, জান্নাতে যেতে হলে অবশ্যই সৎকর্মের পুঁজি প্রয়োজন হবে। কোনও কোনও হাদীছে যে জানাে হয়েছে জান্নাত লাভ হবে কেবল আল্লাহ তা'আলার রহমতে, তার সঙ্গে এ কথার কোনও বিরোধ নেই। কেননা তাঁর যে রহমত দ্বারা জান্নাত লাভ হবে, সে রহমত পাওয়ার জন্যই ইবাদত-বন্দেগী জরুরি। অর্থাৎ ইবাদত-বন্দেগী করার দ্বারা আল্লাহ তা'আলা খুলি হবেন। ফলে তিনি নিজ রহমত ও দয়ায় জান্নাত দান করবেন। কাজেই আল্লাহর রহমতে জান্নাতে যেতে চাইলে অবশ্যই তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে। এজন্যই বিভিন্ন আয়াতে জান্নাতলাভকে ইবাদত-বন্দেগী ও সৎকর্মের পুরস্কার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জান্নাতবাসীগণ জান্নাতে পৌছার পর আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে লক্ষা করে বলবেন-
وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي أُوْرِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
'এটাই সেই জান্নাত, তোমাদেরকে যার অধিকারী করা হয়েছে তোমাদের কর্মের বিনিময়ে।’ (সূরা যুখরুফ, আয়াত ৭২)
وَمِنَ الْيَقِيْنِ مَا تُهَوِّنُ عَلَيْنَا مَصَائِبَ الدُّنْيَا
‘এবং এ পরিমাণ ইয়াকীন দান করো, যা আমাদের জন্য দুনিয়ার বালা-মসিবতকে সহজ করে দেবে’।
ইয়াকীন হল ঈমান ও বিশ্বাসের উচ্চতর স্তর। ঈমান যে পর্যায়ে পৌঁছলে অন্তরে কোনওরূপ খটকা ও সংশয়-সন্দেহ প্রশ্রয় পায় না এবং অদৃশ্য জান্নাত ও জাহান্নাম দৃশ্যমান বিষয়ের মতো হয়ে যায়, তাকে ইয়াকীন বলে। অন্তরে ইয়াকীন এসে গেলে ইবাদত-বন্দেগী সহজ হয়ে যায় এবং বিপদ-আপদে ধৈর্য ধরা সহজ হয়ে যায়। বরং ধৈর্যের পুরস্কারে জান্নাতের যে মহা নি'আমত দান করা হবে, সে বিবেচনায় কঠিন থেকে কঠিন বিপদও তুচ্ছ বলে মনে হয়। মহাবিপদের সম্মুখীন হয়েও ইয়াকীনওয়ালা ব্যক্তি বলে ওঠে-
لَنْ يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلنَا
'আল্লাহ আমাদের জন্য (তাকদীরে) যা লিখে রেখেছেন, তাছাড়া অন্য কোনও কষ্ট আমাদেরকে কিছুতেই স্পর্শ করবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক।’ (সূরা তাওবা, আয়াত ৫১)
اللَّهُمَّ مَتِّعْنَا بِأَسْمَاعِنَا، وَأَبْصَارِنَا، وَقُوَّتِنَا مَا أَحْيَيْتَنَا
‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে যতদিন জীবিত রাখ, ততোদিন আমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্যান্য শক্তি দ্বারা আমাদেরকে উপকৃত করো’।
অর্থাৎ যতদিন জীবিত রাখ, ততোদিন যেন আমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং শরীরের ভেতরে ও বাইরে যতগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে প্রত্যেকটির শক্তি অবশিষ্ট থাকে। যাতে আমরা সেসব শক্তি দ্বারা উপকৃত হতে পারি। এমন যেন না হয় যে, বেঁচে থাকলাম অথচ শেষপর্যন্ত দেখার শক্তি, বলার শক্তি, চলার শক্তি বা অন্য কোনও শক্তি বাকি থাকল না। কেননা এরূপ কোনও শক্তি হারিয়ে গেলে বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে যায়। জীবন অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ইবাদত-বন্দেগী করাও কঠিন হয়ে যায়। সুতরাং হে আল্লাহ! অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজে নিজেই যাতে চলতে পারি এবং মৃত্যু পর্যন্ত সবগুলো অঙ্গ কাজে লাগিয়ে তোমার শোকরগুযার হয়ে থাকতে পারি, সেজন্য আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল ও সক্রিয় রেখো।
وَاجْعَلْهُ الْوَارِثَ مِنَّا
‘এবং এগুলোকে আমাদের ওয়ারিছ বানিয়ে দিয়ো’।
এখানে ওয়ারিছ দ্বারা 'বাকি' বা 'অবশিষ্ট' অর্থ বোঝানো হয়েছে। এর দুই ব্যাখ্যা হতে পারে। এক ব্যাখ্যা এই যে, আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের শক্তি এখনকার মতো ভবিষ্যতেও বাকি রেখো। কোনও ব্যক্তি মারা গেলে তার জায়গায় তার ওয়ারিছ বাকি থাকে। ঠিক তেমনি এখানেও বোঝানো হচ্ছে যে, আমার বর্তমান সময়টা চলে যাওয়ার পরও আমার শক্তিসমূহ যেন অবশিষ্ট থাকে। এ হিসেবে এই বাক্যটির কথা এর আগের বাক্যের অনুরূপ।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হল, আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যেন ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারি সেই তাওফীক আমাকে দান করো। যাতে আমার মৃত্যুর পরও আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ মানুষের মধ্যে টিকে থাকে এবং মানুষ তা দ্বারা উপকৃত হতে পারে। মানুষ মারা গেলে তার কাজও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মৃত্যুর পর তার আমলনামায় কোনও ছাওয়াব যুক্ত হয় না। তবে হাঁ, জীবিত অবস্থায় যদি এমন কোনও কাজ করা যায়, যা তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে যায় না; বরং তার পরেও তার কল্যাণধারা অব্যাহত থাকে, তবে যতদিন মানুষ সে কল্যাণ ভোগ করবে, ততোদিন মৃতব্যক্তির আমলনামায় তার ছাওয়াব লেখা হতে থাকবে। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
إذا مات الإنسان انقطع عنه عمله إلا من ثلاثةٍ: من صدقة جارية، أو علم ينتفع به، أو ولد صالح يدعو له
'মানুষ যখন মারা যায় তার আমল বন্ধ হয়ে যায় (তার আমলনামায় আর কোনও ছাওয়াব লেখা হয় না), তবে তিনটি ছাড়া- সদাকায়ে জারিয়া (-এর ছাওয়াব); ওই ইলম (বিস্তার করার ছাওয়াব), যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং নেক সন্তান, যে তার জন্য দু'আ করবে’।
(সহীহ মুসলিম: ১৬৩১; জামে' তিরমিযী: ১৩৭৬; সুনানে নাসাঈ ৩৬৫১; সুনানে আবু দাউদ : ২৮৮০; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৪২; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৬৪৫৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা। ২৪৯৪; সহীহ ইবনে হিব্বান; ৩০১৬, বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১২৬৩৫; শু'আবুল ঈমান: ৩১৭৩; সুনানে দারিমী: ৫৭৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৩৯)
وَاجْعَلْ ثَأْرَنَا عَلَى مَنْ ظَلَمَنَا
‘যে আমাদের উপর জুলুম করেছে, আমাদের পক্ষে তাঁর থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করো’।
অথবা এর অর্থ- যে আমার উপর জুলুম করেছে, তাঁর থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকে আমার জন্য সহজ করে দাও। এমন যেন না হয় যে, প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে অধিকতর জুলুমের শিকার হই কিংবা উল্টো আমি তাঁর উপর জুলুম করে বসি। এমনিতে তো জুলুমকারীকে ক্ষমা করাই উত্তম। যদি প্রতিশোধ গ্রহণ করার ইচ্ছা হয়, তবে এক তো প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা আছে কি না সেদিয়ে লক্ষ রাখাও জরুরি। দ্বিতীয়ত এ বিষয়েও সতর্ক থাকা দরকার যাতে জুলুমের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে উল্টো জুলুম করা না হয়। অর্থাৎ জালেমের জুলুমের তুলনায় প্রতিশোধের মাত্রা বেশি না হয়ে যায়।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ
'তোমরা যদি (কোনও জুলুমের) প্রতিশোধ নাও, তবে ঠিক ততটুকুই নেবে, যতটুক জুলুম তোমাদের উপর করা হয়েছে আর যদি সবর কর, তবে নিশ্চয়ই সবর অবলম্বনকারীদের পক্ষে তাই শ্রেয়।'
(সূরা নাহল, আয়াত ১২৬)
وَانْصُرْنَا عَلَى مَنْ عَادَانَا
‘যে আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে, তার বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করো’।
অর্থাৎ যারা অন্যায়ভাবে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করে, আমরা যাতে তাদের উপর জয়ী হতে পারি সেজন্য তুমি আমাদের সাহায্য করো। তুমি সাহায্য না করলে আমাদের এমন ক্ষমতা নেই, যা দ্বারা আমরা তাদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারব।
وَلَا تَجْعَلْ مُصِيبَتَنَا فِي دِيْنِنَا
‘আমাদের দীনের কোনও বিষয়ে আমাদেরকে বিপদ দিয়ো না’।
অর্থাৎ আমাদের উপর কাফের-বেঈমানদের আধিপত্য দিয়ো না, নাস্তিক- মুরতাদদের চাপিয়ে দিয়ো না এবং আমাদেরকে এমন কোনও পরীক্ষা ও এমন কোনও মসিবতে ফেলো না, যার কারণে আমাদের আকীদা-বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমাদের আমলে ভাটা পড়ে, আমাদের আখলাক-চরিত্র ক্ষুণ্ণ হয়। কেননা দুনিয়াবী বালা-মসিবত অপেক্ষা দীনী বিপদ-আপদের ক্ষতি অনেক বেশি। দুনিয়াবী বালা-মসিবতের ক্ষতি সাময়িক কালের। পক্ষান্তরে দীনী ক্ষতি তো অনন্তকালের। তাই দুনিয়াবী ক্ষতি অপেক্ষা দীনী ক্ষতি থেকে বাঁচা অনেক বেশি জরুরি। এর জন্য যেমন সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে, তেমনি আল্লাহ তা'আলার কাছে সাহায্যও চাইতে হবে। তাঁর সাহায্য ছাড়া নিজ দীন ও ঈমানের হেফাজত সম্ভব নয়। এ ফিতনা-ফাসাদের যমানায় আরও বেশি কঠিন।
وَلَا تَجْعَلِ الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا
‘দুনিয়াকে বানিয়ো না আমাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু’।
هَمّ এর অর্থ চিন্তা, দুঃখ, অভিপ্রায়, আসক্তি ইত্যাদি। অর্থাৎ এমন যেন না হয় যে, আমরা দুনিয়াকেই লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নিয়েছি। আমাদের শরীর-মনকে দুনিয়ার সঙ্গেই যুক্ত করে দিয়েছি। যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা কেবল দুনিয়ার জন্যই করছি। দীনের ক্ষতি অপেক্ষা দুনিয়ার ক্ষতিতেই বেশি দুঃখ-কষ্ট পাচ্ছি। এমন যদি হয়ে যাই, তবে আখিরাত থেকে গাফেল হয়ে পড়ব। কাজেই আমাদের ধ্যান, চিন্তা, মনোযোগ ও আসক্তিকে আখিরাতমুখী করে দাও, যাতে দুনিয়া অপেক্ষা আমরা আখিরাতকেই বড় করে দেখি।
বাক্যটিতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, দুনিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে নেই। প্রধান লক্ষ্যবস্তু আখিরাত হবে বটে, কিন্তু ইহজীবনে চলার জন্য যা-কিছু প্রয়োজন তা থেকেও বিমুখ হওয়া যাবে না।
وَلا مبلغ علمنا
‘এবং দুনিয়াকে বানিয়ো না আমাদের জ্ঞানের শেষ সীমানা’।
অর্থাৎ আমাদের যাবতীয় জ্ঞানবিদ্যার লক্ষ্যবস্তু যেন দুনিয়াই না হয়। কেবল এরই উদ্দেশ্যে যেন আমরা জ্ঞান আহরণ না করি। আমাদের জ্ঞানবিদ্যার দৌড় যেন দুনিয়া পর্যন্তই না হয়, যেমনটা কাফের ও অবিশ্বাসীদের হয়ে থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَعْلَمُونَ ظَاهِرًا مِنَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ عَنِ الْآخِرَةِ هُمْ غَافِلُونَ
'তারা পার্থিব জীবনের প্রকাশ্য দিকটাই জানে। আর আখিরাত সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ গাফেল’। (সূরা রূম, আয়াত ৭)
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
فَأَعْرِضْ عَنْ مَنْ تَوَلَّى عَنْ ذِكْرِنَا وَلَمْ يُرِدْ إِلَّا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا (29) ذَلِكَ مَبْلَغُهُمْ مِنَ الْعِلْمِ
'সুতরাং (হে রাসূল!) যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং পার্থিব জীবন ছাড়া অন্য কিছু কামনাই করে না, তুমি তাকে অগ্রাহ্য করো। তাদের জ্ঞানের দৌড় এ পর্যন্তই। (সূরা নাজম, আয়াত ২৯, ৩০)
সুতরাং যারা মুমিন-মুত্তাকী, তাদের এরকম হলে চলবে না। তারা যদি তাদের সবটা ধ্যান-জ্ঞান নিজ দুনিয়া গড়ার জন্যই নিয়োজিত করে এবং নিজ আখিরাত নির্মাণ থেকে উদাসীন হয়ে থাকে, তবে তা কত বড়ই না আফসোসের কথা! আমরা যাতে সেরকম না হই, সেজন্যই এ দু'আ আমাদের শেখানো হয়েছে।
وَلَا تُسَلِّطُ عَلَيْنَا مَنْ لَا يَرْحَمُنَا
‘যারা আমাদের প্রতি সদয় নয়, তাদেরকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ো না’।
অর্থাৎ কাফের, জালেম ও পাপিষ্ঠদেরকে আমাদের উপর আধিপত্য দিয়ো না এবং তাদেরকে আমাদের উপর প্রবল করো না। তাহলে তারা আমাদেরকে দাবিয়ে রাখবে, আমাদের নির্যাতন করবে, আমাদের ঈমান-আমলে বাধা দেবে। এভাবে দীন ও দুনিয়া সবদিক থেকে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এর মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মুমিনদের উপর বেঈমান ও পাপিষ্ঠদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠ আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাতেই হয়। মুমিনগণ যখন আপন দায়িত্বে অবহেলা করে, তখনই তারা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। কাজেই জালেম শাসক বা কোনও পাপি প্রভাবশালী ব্যক্তি দ্বারা মুমিন-মুসলিম ব্যক্তি নিপীড়িত হলে তখন তাদেরকে গালমন্দ না করে উচিত হল আল্লাহ তা'আলার শরণাপন্ন হওয়া এবং নিজ আমল-আখলাকের সংশোধনে মনোযোগ দেওয়া। তখন আল্লাহ তা'আলা পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দেবেন। হয় সেই জালেমকে ঈমানদার বানিয়ে দেবেন, নয়তো তার বিপরীতে মুমিনকে সাহায্য করবেন, তাকে শক্তিশালী করে তুলবেন। এরকম দু'আ কুরআন মাজীদেও বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আছে-
رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِلْقَوْمِ الظَّالِمِينَ (85) وَنَجِّنَا بِرَحْمَتِكَ مِنَ الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
'হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ওই জালেম সম্প্রদায়ের পরীক্ষার পাত্র বানিয়ো না। এবং নিজ রহমতে আমাদেরকে কাফের সম্প্রদায় হতে নাজাত দাও’।(সূরা ইয়ূনুস, আয়াত ৮৫, ৮৬)
এ বাক্যে কবরে আযাব দানকারী ও জাহান্নামের ফিরিশতাদেরকেও বোঝানো হতে পারে। ফিরিশতারা যখন পাপী ব্যক্তিকে কবরে ও জাহান্নামে শাস্তি দেবে, তখন কোনও দয়ামায়া করবে না। তাই এ বাক্যে তাদের থেকে পানাহ চাওয়া হয়েছে। যাতে আল্লাহ তা'আলা পূর্ণাঙ্গ ঈমান-আমলের তাওফীক দান করেন আর মুসলিমরূপে মৃত্যু দেন। এর ফলে আযাবের ফিরিশতাদের দেখাই মিলবে না। কবরেও শান্তি লাভ হবে এবং আখিরাতেও জান্নাত নসীব হবে।
এমনও হতে পারে যে, বাক্যে একইসঙ্গে জালেম ও নিপীড়ক এবং আযাবের ফিরিশতা উভয়কেই বোঝানো হয়েছে। বস্তুত মুমিন ব্যক্তির জন্য প্রয়োজন উভয় থেকে মুক্তি লাভ করা এবং উভয় জগতের নিরাপত্তা পাওয়া। তাই এ দু'আ করার সময় উভয়টার নিয়ত থাকাই ভালো।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কোনও বৈঠক ও মজলিসে অনুচিত ও অহেতুক কথা বলা উচিত নয়।
খ. আল্লাহর ভয় পাপকর্ম থেকে বাঁচার শক্তি যোগায়।
গ. ইবাদত-বন্দেগীই জান্নাতলাভের একমাত্র উপায়।
ঘ. ঈমান যত শক্তিশালী হয়, বিপদ-আপদে ধৈর্য ধরা ততো সহজ হয়।
ঙ.চোখ, কান, হাত, পা সহ প্রতিটি অঙ্গের শক্তি আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। নিজ অবহেলায় এ শক্তি নষ্ট করতে নেই। বরং যতদিন আয়ু থাকে ততোদিন এ শক্তির হেফাজত করার জন্য সচেষ্ট থাকা ও দু'আ করা জরুরি।
চ. জুলুমের প্রতিশোধ নেওয়ার বেলায়ও ইনসাফ করা উচিত।
ছ. শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়লাভে কেবল নিজ ক্ষমতা ও কৌশলই যথেষ্ট নয়; আল্লাহ তা'আলার সাহায্যও প্রয়োজন।
জ. নিজ দীনের ক্ষতি সবচে' বড় ক্ষতি। কাজেই কোনও বিপদ-আপদে যাতে এ ক্ষতির শিকার না হতে হয় সেজন্য চেষ্টা ও দু'আ দুই-ই জরুরি।
ঝ. দুনিয়ার অর্থবিত্ত ও বস্তুগত সাফল্যই জীবনের লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত নয়।
ঞ. জীবনরক্ষার জন্য যা-কিছু প্রয়োজন তা উপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয় নয়।
ট. মুমিন ব্যক্তির নিজ জ্ঞানবিদ্যার দৌড় দুনিয়া ও দুনিয়ার বস্তুসামগ্রী পর্যন্তই হওয়া উচিত নয়। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি ও আখিরাতের মুক্তিলাভ যে উপায়ে হয় তা জানাটাই আসল জ্ঞান।
ঠ. মুমিনদের সতর্ক থাকা উচিত এবং ব্যবস্থাও গ্রহণ করা উচিত যাতে কাফের-মুশরিক ও পাপিষ্ঠ সম্প্রদায় তাদের উপর চেপে বসতে না পারে।
ড. মৃত্যুর পর আযাবের ফিরিশতাদের কবলে যাতে পড়তে না হয়, ইহজীবনে সে লক্ষ্যে সৎকর্মের সাধনা করতে হবে।
চ. এ গুরুত্বপূর্ণ দু'আটি প্রত্যেক বৈঠক ও মজলিসের শেষে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
