আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

৩৭. কিয়ামত-মৃত্যুপরবর্তী জগতের বিবরণ

হাদীস নং: ২৪৭৭
আন্তর্জাতিক নং: ২৪৭৭
কিয়ামত-মৃত্যুপরবর্তী জগতের বিবরণ
শিরোনামবিহীন পরিচ্ছেদ।
২৪৮০. হান্নাদ (রাহঃ) ...... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সুফফাবাসী সাহাবীগণ ছিলেন মুসলিমদের মেহমান। তাদের কোন ঘর-সংসার বা ধন-সম্পদ ছিল না। আল্লাহর কসম, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নাই, ক্ষুধার জ্বালায় আমি আমার পেট মাটিতে চেপে ধরতাম; এমনিভাবে ক্ষুধার তাড়নায় আমার পেটে পাথর বাঁধতাম। সাহাবীরা যে পথ দিয়ে (মসজিদের উদ্দেশ্যে) বের হতেন তাদের সে পথে একদিন আমি বসে গেলাম। আবু বকর (রাযিঃ) আমার পাশ দিয়ে গেলেন। আমি তাঁকে আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি তাঁর সঙ্গে (তার ঘরে) আমাকে নিয়ে যাবেন এই আশা নিয়েই কেবল আমি এই আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। আমাকে সাথে নিয়ে গেলেন না। এরপর উমর (রাযিঃ) এই পথ দিয়ে গেলেন। তাঁকেও আমি আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। তিনি যেন আমাকে (তাঁর ঘরে) সঙ্গে নিয়ে যান এই আশা নিয়েই আমি প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি চলে গেলেন কিন্তু আমাকে সাথে নিলেন না। পরে আবুল কাসিম (ﷺ) এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই মুচকি হাসলেন। বললেনঃ আবু হুরায়রা!

আমি বললামঃ লাব্বাইকা, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেনঃ সঙ্গে চল। এরপর তিনি চলতে লাগলেন। আমিও তাঁর পেছনে পেছনে যেতে লাগলাম। তিনি তাঁর ঘরে প্রবেশ করলেন। আমিও প্রবেশ অনুমতি চাইলাম। আমাকেও প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হল। তিনি ঘরে একটি দুধের পেয়ালা পেলেন। বললেনঃ তোমাদের জন্য এই দুধ কোথা থেকে এসেছে? বলা হল অমুক ব্যক্তি আমাদের জন্য হাদিয়া পাঠিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন বললেনঃ আবু হুরায়রা! আমি বললামঃ লাব্বাইকা। তিনি বললেনঃ সুফফাবাসীদের কাছে যাও এবং তাদের ডেকে নিয়ে এস।

এরা ছিলেন মুসলিমদের মেহমান। এদের কোন ঘর-সংসার বা ধন-সম্পদ ছিল না। নবীজী (ﷺ) এর কাছে কিছু সাদ্‌কা আসলে তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন, এর থেকে নিজে কিছু গ্রহণ করতেন না। আর যদি তাঁর কাছে কিছু হাদিয়া আসত তবে তিনি তাদের কাছে পাঠাতেন এবং নিজেও তা থেকে কিছু গ্রহণ করতেন এবং এতে তাদেরকেও শরীক করতেন।

এতে আমি মনক্ষুণ্ণ হলাম। মনে মনে বললাম সুফফাবাসীদের মাঝে এই এক পেয়ালায় কি হবে? আর আমি তাদের মাঝে সংবাদ বাহক হচ্ছি। সুতরাং নবীজিতো আমাকেই তাদের সামনে তা পরিবেশন করতে হুকুম দিবেন। হয়ত আমার ভাগ্যে কিছু নাও জুটতে পারে।

অথচ আমি আশা করেছিলাম যে ক্ষুধা নিবারণের মত অংশ পাব। কিন্তু আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের আনুগত্য ছাড়া কোন উপায় নেই, তাই আমি তাদের কাছে গেলাম এভং তাদেরকে ডেকে নিয়ে এলাম। তারা এসে নিজ নিজ স্থানে বসে গেল তিনি বললেনঃ আবু হুরায়রা, পেয়ালাটি নাও এবং তাদের পরিবেশন কর।

আমি পেয়ালাটি নিলাম এবং এক একজনকে তা পরিবেশন করতে লাগলাম, তিনি তা থেকে পরিতৃপ্তির সাথে পান করছিলেন এবং আমাকে তা ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি তখন তা অপর জনকে দিচ্ছিলাম শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে তা নিয়ে পৌঁছলাম। ইতি মধ্যে উপস্থিত পুরা সম্প্রদায় পরিতৃপ্ত হয়ে গেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পেয়ালাটি নিয়ে হাতে রাখলেন এবং এরপর মাথা তুলে মুচকি হাসলেন। বললেনঃ আবু হুরায়রা, পান কর। আমি তা পান করলাম। তিনি পুনরায় বললেনঃ আরো পান কর। আমি পান করতে থাকলাম তিনি বলতে থাকলেন ’‘তুমি পান কর’’। শেষে আমি বললাম, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন সেই সত্তার কসম, আমি আর এ জন্য কোন পথ পাচ্ছি না। তিনি তখন পেয়ালাটি নিলেন, আল্লাহর হামদ করলেন এবং বিসমিল্লাহ বলে তা পান করে নিলেন।
أبواب صفة القيامة والرقائق والورع عن رسول الله صلى الله عليه وسلم
بَابٌ
حَدَّثَنَا هَنَّادٌ، حَدَّثَنَا يُونُسُ بْنُ بُكَيْرٍ، حَدَّثَنِي عُمَرُ بْنُ ذَرٍّ، حَدَّثَنَا مُجَاهِدٌ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ كَانَ أَهْلُ الصُّفَّةِ أَضْيَافَ أَهْلِ الإِسْلاَمِ لاَ يَأْوُونَ عَلَى أَهْلٍ وَلاَ مَالٍ وَاللَّهِ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ إِنْ كُنْتُ لأَعْتَمِدُ بِكَبِدِي عَلَى الأَرْضِ مِنَ الْجُوعِ وَأَشُدُّ الْحَجَرَ عَلَى بَطْنِي مِنَ الْجُوعِ وَلَقَدْ قَعَدْتُ يَوْمًا عَلَى طَرِيقِهِمُ الَّذِي يَخْرُجُونَ فِيهِ فَمَرَّ بِي أَبُو بَكْرٍ فَسَأَلْتُهُ عَنْ آيَةٍ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ مَا سَأَلْتُهُ إِلاَّ لِيَسْتَتْبِعَنِي فَمَرَّ وَلَمْ يَفْعَلْ ثُمَّ مَرَّ بِي عُمَرُ فَسَأَلْتُهُ عَنْ آيَةٍ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ مَا أَسْأَلُهُ إِلاَّ لِيَسْتَتْبِعَنِي فَمَرَّ وَلَمْ يَفْعَلْ ثُمَّ مَرَّ بِي أَبُو الْقَاسِمِ صلى الله عليه وسلم فَتَبَسَّمَ حِينَ رَآنِي وَقَالَ " أَبَا هُرَيْرَةَ " . قُلْتُ لَبَّيْكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ . قَالَ " الْحَقْ " . وَمَضَى فَاتَّبَعْتُهُ وَدَخَلَ مَنْزِلَهُ فَاسْتَأْذَنْتُ فَأَذِنَ لِي فَوَجَدَ قَدَحًا مِنْ لَبَنٍ فَقَالَ " مِنْ أَيْنَ هَذَا اللَّبَنُ لَكُمْ " . قِيلَ أَهْدَاهُ لَنَا فُلاَنٌ . فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " أَبَا هُرَيْرَةَ " . قُلْتُ لَبَّيْكَ . فَقَالَ " الْحَقْ إِلَى أَهْلِ الصُّفَّةِ فَادْعُهُمْ " . وَهُمْ أَضْيَافُ أَهْلِ الإِسْلاَمِ لاَ يَأْوُونَ عَلَى أَهْلٍ وَلاَ مَالٍ إِذَا أَتَتْهُ صَدَقَةٌ بَعَثَ بِهَا إِلَيْهِمْ وَلَمْ يَتَنَاوَلْ مِنْهَا شَيْئًا وَإِذَا أَتَتْهُ هَدِيَّةٌ أَرْسَلَ إِلَيْهِمْ فَأَصَابَ مِنْهَا وَأَشْرَكَهُمْ فِيهَا فَسَاءَنِي ذَلِكَ وَقُلْتُ مَا هَذَا الْقَدَحُ بَيْنَ أَهْلِ الصُّفَّةِ وَأَنَا رَسُولُهُ إِلَيْهِمْ فَسَيَأْمُرُنِي أَنْ أُدِيرَهُ عَلَيْهِمْ فَمَا عَسَى أَنْ يُصِيبَنِي مِنْهُ وَقَدْ كُنْتُ أَرْجُو أَنْ أُصِيبَ مِنْهُ مَا يُغْنِينِي وَلَمْ يَكُنْ بُدٌّ مِنْ طَاعَةِ اللَّهِ وَطَاعَةِ رَسُولِهِ فَأَتَيْتُهُمْ فَدَعَوْتُهُمْ فَلَمَّا دَخَلُوا عَلَيْهِ فَأَخَذُوا مَجَالِسَهُمْ فَقَالَ " أَبَا هُرَيْرَةَ خُذِ الْقَدَحَ وَأَعْطِهِمْ " . فَأَخَذْتُ الْقَدَحَ فَجَعَلْتُ أُنَاوِلُهُ الرَّجُلَ فَيَشْرَبُ حَتَّى يُرْوَى ثُمَّ يَرُدُّهُ فَأُنَاوِلُهُ الآخَرَ حَتَّى انْتَهَيْتُ بِهِ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَقَدْ رَوِيَ الْقَوْمُ كُلُّهُمْ فَأَخَذَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الْقَدَحَ فَوَضَعَهُ عَلَى يَدَيْهِ ثُمَّ رَفَعَ رَأْسَهُ فَتَبَسَّمَ فَقَالَ " أَبَا هُرَيْرَةَ اشْرَبْ " . فَشَرِبْتُ ثُمَّ قَالَ " اشْرَبْ " . فَلَمْ أَزَلْ أَشْرَبُ وَيَقُولُ " اشْرَبْ " . حَتَّى قُلْتُ وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ مَا أَجِدُ لَهُ مَسْلَكًا فَأَخَذَ الْقَدَحَ فَحَمِدَ اللَّهَ وَسَمَّى ثُمَّ شَرِبَ . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. নিজের অবস্থা বর্ণনা করছেন যে, কী রকম অনাহারের ভেতর দিয়ে তাঁর দিন যাচ্ছিল। ক্ষুধার কষ্ট সইতে না পেরে খালি বুকে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে থাকতেন। কষ্ট লাঘবের জন্য পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন। এরকম মাঝেমধ্যেই হতো।

নিজ জীবনের এ অবস্থা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য মানুষের কাছে কষ্টের কথা বলে বেড়ানো নয়, বরং মানুষকে ঈমানী চেতনার সঙ্গে পরিচিত করা। এত কষ্টের মধ্যেও তাঁরা কিভাবে দীন ও ঈমান ধরে রেখেছেন, কী কঠিন মুজাহাদার মধ্যে ইসলামের শুরু দিনগুলো কেটেছে, তা জানতে পারলে মানুষ দীন ও ঈমানের মূল্য বুঝবে, তাদের আখিরাতমুখিতা বাড়বে, দুনিয়ার আসক্তি ও অর্থবিত্তের মোহ থেকে তারা বাঁচতে পারবে।

মানুষের সামনে কেবল কষ্টের কথা প্রকাশ করাই নয়; বরং সে কষ্টের ভেতর তাদের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কেমন ছিল, কিভাবে তিনি তাদের সকলকে একত্রে নিয়ে চলতেন, কিভাবে তাঁদের মধ্যে সহমর্মিতা ও ঐক্য সম্প্রীতির চেতনা সঞ্চার করতেন, তার সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করাও উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বিশেষ একটি দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
(একদিন আমি মানুষের চলাচলপথে বসে থাকলাম)। অর্থাৎ লোকে যে পথ দিয়ে মসজিদে আসা-যাওয়া করত, সেই পথে বসে থাকলাম। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর অবস্থা দেখে হয়তো লোকে তাঁর ক্ষুধার কষ্টের কথা বুঝতে পারবে।

সাহাবীগণ তো সহজে মানুষের কাছে কিছু চাইতেন না। অন্যের কাছে হাত পাতা তাঁদের অভ্যাস ছিল না। অথচ অনাহারের যে কঠিন কষ্ট তাঁদের ভোগ করতে হচ্ছিল, এরকম অবস্থায় অন্যের কাছে হাত পাতা নাজায়েয় নয়। তবে তা নাজায়েয না হলেও তারা এক উচ্চতর আদর্শের উপর অধিষ্ঠিত ছিলেন। দীন ও ঈমানের এক পৰিত্ৰ জীবনবোধ তারা পালন করছিলেন। তাঁদের দৃষ্টিতে কোনও অবস্থায়ই মাখলুকের কাছে সরাসরি কিছু চাওয়া সে জীবনবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ওদিকে ছিল দুর্বিষহ ক্ষুধার যন্ত্রণা। তাই প্রয়োজন পুরণের তাগিদে তিনি পরোক্ষ পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। মানুষের যাতায়াতপথে বসে থাকলেন। হয়তো লোকে দেখে বুঝবে।

কখনও তিনি এমনও করতেন যে, কাছে যাকে পেতেন তাকে কুরআন মাজীদের কোনও আয়াত জিজ্ঞেস করতেন। হয়তো সে তাঁর আওয়াজ শুনে অনাহারের কারণ বুঝতে পারবে।

এদিন লোক আসা-যাওয়া করল ঠিকই, কিন্তু কেউ তার অবস্থা আঁচ করতে পারল না। একপর্যায়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সেখান দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি তাঁর অবস্থা আঁচ করতে পারলেন। তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিলেন। সাহাবীদের কাছে সে হাসিও এক খাবার বটে। প্রাণের খোরাক। এমন প্রাণজুড়ানো হাসি কে কবে কোথায় দেখেছে? সেইসঙ্গে যদি হয় মধুর সম্ভাষণও। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(হে আবু হিরর)। আবু হুরায়রা রাযি. প্রিয় সম্ভাষণে হয়ে গেলেন আবু হিরর, যেমন তিনি আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে ডাক দিতেন 'আয়েশু'। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. হয়তো স্নেহের সে স্পর্শে আনন্দে ভাসছিলেন। তিনি সাড়া দিলেন-
(লাব্বায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ)। আমি হাজির ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হাজির: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিজের সঙ্গে চলতে বললেন। তিনি তাঁর পেছনে পেছনে চললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ঘরে প্রবেশ করলেন। ভেতরে একটা পেয়ালায় কিছু দুধ দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন কেউ তা হাদিয়া হিসেবে পাঠিয়েছে। তিনি হাদিয়া গ্রহণ করতেন। তা নিজে খেতেন, অন্যদেরও খাওয়াতেন। সদাকা হলে তা খেতেন না, উপযুক্ত লোককে খাওয়াতেন।

কিছুটা খাদ্য যখন পাওয়া গেল, তখন তিনি সকলকে নিয়ে তা ভাগাভাগি করে খেতে চাইলেন। তিনি হযরত আবূ হুরায়রা রাযি.কে হুকুম দিলেন যেন সুফ্ফায় অবস্থিত সাহাবীদের ডেকে আনেন। সুফ্ফার সে সাহাবীগণ কারা? হযরত আবু হুরায়রা রাযি. তাঁদের পরিচয় দিচ্ছেন-
(সুফ্ফাবাসীগণ ছিলেন ইসলামের অতিথি। তাদের কোনও পরিবার-পরিজন, অর্থ-সম্পদ ছিল না এবং আশ্রয় নেওয়ার মত কোনও লোক তাদের ছিল না)। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. নিজেও তাঁদের একজন ছিলেন। সুফফা হল মসজিদে নববী-সংলগ্ন চতুর। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, বাহির থেকে কেউ মদীনায় আসলে আর মদীনায় তার পরিচিত কেউ থাকলে সে তার পরিচিত সেই ব্যক্তির মেহমান হয়ে যেত। আর পরিচিত কেউ না থাকলে সে সুফফায় অবস্থিত সাহাবীদের সঙ্গী হয়ে যেত। এ সাহাবীগণ মসজিদেই ঘুমাতেন। রাত হলে তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা করতেন। তিনি স্থানীয় সাহাবীদেরকে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী যে যত জনকে পারে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলতেন। তিনি হুকুম দিতেন-
যার কাছে দুজনের খাবার আছে সে তৃতীয় একজনকে নিয়ে যাক। যার কাছে চারজনের খাবার আছে, সে পঞ্চম বা ষষ্ঠ একজনকে নিয়ে যাক।

তারপর যারা অবশিষ্ট থাকত তাদেরকে তিনি নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সংখ্যা কখনও দশজন, কখনও তার কম বা বেশি হতো। এ হাদীছে আবু হুরায়রা রাযি. জানাচ্ছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোনও সদাকা আসলে তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। নিজে তা থেকে কিছু গ্রহণ করতেন না। আর যখন হাদিয়া আসত, তা তাদের কাছেও পাঠাতেন এবং নিজেও তা থেকে গ্রহণ করতেন আর তাদেরকে তাতে শরীক করতেন।

যাহোক, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সুফ্ফার সাহাবীদের ডাকতে বললেন, তখন হযরত আবু হুরায়রা রাযি.এর মনের অবস্থা কী হয়েছিল সে সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁর এ কথা আমাকে অখুশি করল। আমি (মনে মনে) বললাম, এতটুকু দুধে সুফফাবাসীদের কী হবে? আমিই তো এ দুধ পান করে শক্তি অর্জনের বেশি হকদার ছিলাম। তারপর তারা যখন আসবে, তখন তিনি আমাকেই (পরিবেশনের) হুকুম দেবেন। আমি তাদেরকে তা দিতে থাকব আর সম্ভবত এ দুখ থেকে আমার ভাগে কিছুই পড়বে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ পালন না করেও আমার কোনও উপায় ছিল না। অগত্যা তিনি তাদের ডেকে আনলেন। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন-
(তারা চলে আসল এবং প্রবেশের অনুমতি চাইল। তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন। তারা ঘরে জায়গা নিয়ে বসে পড়ল)। বোঝা গেল কাউকে নিজ বাড়িতে আসার সংবাদ পাঠালেও তাদের আসার পর ঘরে প্রবেশের জন্য অনুমতি চাওয়া উচিত। বিনা অনুমতিতে প্রবেশ জায়েয নয়।

যারা এসেছিলেন, এ বর্ণনায় তাদের সংখ্যা বলা হয়নি। অন্য কোনও বর্ণনা থেকে তা জানা যায় না। সুফফায় সাহাবীদের সংখ্যা সব সময় একরকম থাকত না। কখন ৪০ জন থাকত, কখনও এর বেশি, কখনও কম। যখন কোনও যুদ্ধভিযানে চলে যেতেন, তখন সুফফায় অবশিষ্ট সাহাবী খুব কমই থাকত।

সুফফার সর্বমোট সাহাবী কতজন তাও নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। বিভিন্নজন বিভিন্ন সংখ্যা বলেছেন। ইমাম আবু নুআয়ম রহ. 'আল-হিলয়া গ্রন্থে বলেছেন, তাদের সংখ্যা ছিল একশ'র কাছাকাছি। ইমাম সাহরাওয়ার্দী রহ. "আওয়ারিফুল মাআরিফ" গ্রন্থে তাদের সংখ্যা বলেছেন চারশ।

সকলে আসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ হুরায়রাকে তাদের মধ্যে দুধ পরিবেশন করতে বললেন। তিনি বলেন, আমি পেয়ালা নিয়ে একেকজনকে দিতে থাকলাম। প্রত্যেকে পরিতৃপ্ত হয়ে পান করছিল, তারপর পেয়ালা আমার হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। তারপর আমি অন্যজনকে তা দিচ্ছিলাম। সেও পরিতৃপ্ত হায় পান করে আমার হাতে পেয়ালা ফিরিয়ে দিচ্ছিল। এভাবে সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছলাম।

এর দ্বারা বোঝা গেল খাদ্য পরিবেশনকারী যখন পেয়ালায় করে অতিথিদের একজনের পর একজনকে খাদ্য বা পানীয় দেবে, তখন প্রত্যেকে খাওয়ার পর পেয়ালাটি পরিবেশনকারীর হাতে ফিরিয়ে দেবে। পরিবেশনকারীই তা পরবর্তীজনকে দেবে। অতিথি নিজে দেবে না। পরিবেশনকারীও তা দেওয়ার ভার অতিথির উপর ছাড়বে না।

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. অতিধিদের দুধ পান করানো শেষ হওয়ার পর পেয়ালাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে রাখলেন। তিনি বলেন-
(তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন)। অর্থাৎ তিনি যেন হযরত আবু হুরায়রা রাযি.-এর মনের কথা পড়তে পেরেছিলেন। মুচকি হাসি দিয়ে তিনি তার জবাব দিয়ে দেন। যেন বোঝাচ্ছিলেন, হে আবূ হুরায়রা! তুমি তো ভাবছিলে সকলকে পান করানোর পর পেয়ালায় অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না আর তোমার ভাগে কিছুই পড়বে না; তোমাকে অভুক্তই থাকতে হবে। এখন দেখলে তো, সবাই পরিতৃপ্তির সঙ্গে পান করার পরও কেমন থেকে গেল?

মুচকি হাসার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ হুরায়রা রাযি.-কে লক্ষ্য করে বললেন, এখন বাকি আছি আমি আর তুমি। তিনি বললেন, ঠিকই বলেছেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! অর্থাৎ আপনি আর আমিই বাকি আছি। অন্য সকলের খাওয়া হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(বসো, পান করো)। বোঝা গেল পানাহারকালে বসা সুন্নত। এছাড়া অন্যান্য হাদীছ দ্বারাও এরকম শিক্ষা পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বসে বসে পান করলেন। একবার পান করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আরও পান কর। এভাবে একের পর এক তিনি পান করতে বলছিলেন আর আবু হুরায়রা রাযি. পান করে যাচ্ছিলেন। সবশেষে বললেন-
যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম। পান করার জন্য (আমার পেটে আর খালি জায়গা পাচ্ছি না। অর্থাৎ তিনি দুধপান করে সম্পূর্ণ পেট ভরে ফেলেছেন, আর তা করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশেই। কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে, অন্যান্য হাদীছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ পেট ভরে খেতে নিষেধ করেছেন? এর কী জবাব?

জবাব হল, সব সময় পেট ভরে খাওয়া উচিত নয়। সম্পূর্ণ পেট ভরে পানাহারে অভ্যস্ত হওয়ার দ্বারা পানাহার সামগ্রীর প্রতি লোভ-লালসা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া এতে শরীরে আলস্য দেখা দেয়। অতিরিক্ত খাওয়ার পর ইবাদত-বন্দেগী ও কাজকর্মের প্রতি উদ্যম-উদ্দীপনা থাকে না। তাই পানাহারের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম হল পেটের তিন ভাগের একভাগ পরিমাণ খাওয়ার জন্য, একভাগ পানি পান করার জন্য, আর একভাগ রাখবে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য, যেমনটা বিভিন্ন হাদীছে এসেছে। কখনও কখনও এর ব্যতিক্রম হলে তাতে দোষ নেই, বিশেষত তাতে যদি কোনও দীনী ফায়দাও থাকে। হযরত আবু হুরায়রা রাযি.-এর এই পেট ভরে দুধ পান করাটা নিতান্তই ব্যতিক্রম ঘটনা। তিনি এটা করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে। তিনি এর দ্বারা তাঁর সামনে নিজ মু'জিযার মহিমা পরিস্ফুট করতে চাচ্ছিলেন।

সবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহপ্রদত্ত বরকতের জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলে শোকর আদায় করলেন এবং বিসমিল্লাহ বলে অবশিষ্ট দুধ নিজে পান করলেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল মু'জিযা সত্য। সামান্য একটু দুধে কিভাবে এত সংখ্যক লোক পরিতৃপ্ত হয়ে গেল।

খ. ক্ষুধার কষ্টের কথা প্রকাশ করা ভালো নয়। কষ্ট অসহ্য হয়ে গেলে তখনও মুখে কিছু না বলে অন্য কোনও পন্থায় বা ভাবভঙ্গি দ্বারা তা বোঝানো চাই।

গ. বসে বসে পানাহার করা সুন্নত।

ঘ. পানাহারের আগে বিসমিল্লাহ বলা সুন্নত।

ঙ. যে-কোনও নি'আমত লাভের পর আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শোকর আদায় করা চাই।

চ. কারও ঘরে প্রবেশর আগে অবশ্যই অনুমতি গ্রহণ করতে হবে।

ছ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিয়া গ্রহণ করতেন, হাদিয়ার খাবার খেতেন। এবং তাতে অন্যদেরও শরীক রাখতেন। এটা সুন্নত।

ছ. অল্প খাদ্যও নিজে একা ভোগ না করে অন্যদের নিয়ে খাওয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ।

জ. অভাব-অনটন ও অনাহারের কষ্ট যত বেশিই হোক না কেন, তথাপি শরী'আতের আদেশ অবশ্যই মান্য করতে হবে, যেমন হযরত আবু হুরায়রা রাযি. ক্ষুধার অসহ্য কষ্ট সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ মান্য করেছেন।

ঞ. অধীনস্থদের যে-কোনও কষ্টে তাদের প্রতি সহমর্মী আচরণ ও তাদের কষ্ট লাঘবের সর্বাত্মক চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
জামে' তিরমিযী - হাদীস নং ২৪৭৭ | মুসলিম বাংলা