আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

২৭. সুন্দর ব্যবহার ও আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অধ্যায়

হাদীস নং: ১৯৬৮
আন্তর্জাতিক নং: ১৯৬৮
যিয়াফত এবং যিয়াফতের শেষ সীমা কয় দিন?
১৯৭৪। ইবনে আবী উমর (রাহঃ) ......... আবু শুরায়হ আল-কা’বী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, মেহমানদারী হল তিন দিন। জায়েযা হল এক দিন ও এক রাতের সম্বল প্রদান। মেহমানের জন্য এরপর যা ব্যয় করবে তা হল সাদ্‌কা। এতদিন কারো কাছে অবস্থান করা যে শেষ পর্যন্ত যে বিরক্ত হয়ে উঠে মেহমানের জন্য তা জায়েয নয়। لاَ يَثْوِي عِنْدَهُ কথাটির মর্ম হল মেহমান এতদিন কারো কাছে অবস্থান করবে না যে বাড়িওয়ালার জন্য তাঁর অবস্থান কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। الْحَرَجُ হল সংকোচ সৃষ্টি হওয়া। حَتَّى يُحْرِجَهُ অর্থ হল এমনকি শেষ পর্যন্ত সে বাড়িওয়ালার জন্য সংকট সৃষ্টি করে তুলল।
باب مَا جَاءَ فِي الضِّيَافَةِ وَغَايَةِ الضِّيَافَةِ كَمْ هُوَ
حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي عُمَرَ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنِ ابْنِ عَجْلاَنَ، عَنْ سَعِيدٍ الْمَقْبُرِيِّ، عَنْ أَبِي شُرَيْحٍ الْكَعْبِيِّ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " الضِّيَافَةُ ثَلاَثَةُ أَيَّامٍ وَجَائِزَتُهُ يَوْمٌ وَلَيْلَةٌ وَمَا أُنْفِقَ عَلَيْهِ بَعْدَ ذَلِكَ فَهُوَ صَدَقَةٌ وَلاَ يَحِلُّ لَهُ أَنْ يَثْوِيَ عِنْدَهُ حَتَّى يُحْرِجَهُ " . وَفِي الْبَابِ عَنْ عَائِشَةَ وَأَبِي هُرَيْرَةَ . وَقَدْ رَوَاهُ مَالِكُ بْنُ أَنَسٍ وَاللَّيْثُ بْنُ سَعْدٍ عَنْ سَعِيدٍ الْمَقْبُرِيِّ . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ . وَأَبُو شُرَيْحٍ الْخُزَاعِيُّ هُوَ الْكَعْبِيُّ وَهُوَ الْعَدَوِيُّ اسْمُهُ خُوَيْلِدُ بْنُ عَمْرٍو . وَمَعْنَى قَوْلِهِ " لاَ يَثْوِي عِنْدَهُ " . يَعْنِي الضَّيْفَ لاَ يُقِيمُ عِنْدَهُ حَتَّى يَشْتَدَّ عَلَى صَاحِبِ الْمَنْزِلِ وَالْحَرَجُ هُوَ الضِّيقُ إِنَّمَا قَوْلُهُ " حَتَّى يُحْرِجَهُ " . يَقُولُ حَتَّى يُضَيِّقَ عَلَيْهِ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

কোন কোন বর্ণনায় আছে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন সম্মানজনকভাবে তার অতিথিকে তার প্রাপ্য আতিথেয়তা দান করে। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার প্রাপ্য আতিথেয়তা কী? তিনি বললেন, এক দিন ও এক রাত (তার সমাদর করা)। আর যিয়াফাত হল তিন দিন। এর অতিরিক্ত করা হলে তা হবে অতিথির প্রতি দান স্বরূপ।
সহীহ মুসলিমে আছে, মুসলিম ব্যক্তির জন্য তার ভাইয়ের নিকট এ পরিমাণ অবস্থান করা বৈধ নয়, যা তাকে গুনাহগার বানাবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কীভাবে তাকে গুনাহগার বানাবে? তিনি বললেন, সে তার নিকট অবস্থান করবে, অথচ তার কাছে এমন কিছু নেই, যা দ্বারা তার মেহমানদারি করবে।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

মেজবান তার মেহমানের মেহমানদারি কতদিন করবে? এ ক্ষেত্রে মেহমানের হক কী? কতদিন মেহমানদারি করা হলে তার সে হক আদায় হবে? সে হক আদায় হয়ে গেলে মেহমান আরও বেশি দিনের মেহমানদারি দাবি করতে পারবে কি না? সে ক্ষেত্রে মেজবানের করণীয় কী?

এ বিষয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্পষ্ট নির্দেশনা দান করেছেন। তিনি মেহমানদারিকে তিন ধাপে ভাগ করেছেন। এ হাদীছে সে তিন ধাপের প্রথম ধাপের নাম দেওয়া হয়েছে جَائِزَة। দ্বিতীয় ধাপের নাম الضيافة। আর তৃতীয় ধাপকে বলা হয়েছে صَدَقَةٌ।

হাদীছটিতে এক দিন ও এক রাত মেহমানদারি করাকে جَائِزة বলা হয়েছে। এটা করা অবশ্যকর্তব্য। এটা মেহমানের হক। কারও বাড়িতে মেহমান আসলে সে যদি মুমিন হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই তাকে এক দিন এক রাত মেহমানের মেহমানদারি করতে হবে। এটা ইসলামী শারাফাত ও ভদ্রতার জরুরি অঙ্গ। এতে অবহেলার দ্বারা মুসলিম ব্যক্তির ভদ্রতা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। একজন ঈমানদারের জন্য তা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। এ মেহমানদারি করতে হবে সম্মানজনকভাবে। অর্থাৎ গৃহস্থ তার সামর্থ্য অনুযায়ী মেহমানের জন্য উত্তম থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করবে।

মেহমান যদি এর মধ্যে চলে না যায়, তবে গৃহস্থ তিনদিন পর্যন্ত তার সেবাযত্ন করতে থাকবে। এর নাম যিয়াফাত। এ তিনদিন কি প্রথম দিনসহ না তার অতিরিক্ত, এ নিয়ে দু'রকম মত পাওয়া যায়। অধিকতর গ্রহণযোগ্য মত হল প্রথম দিনসহ তিন দিন। অতিরিক্ত দু'দিন প্রথম দিনের মতো বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে না। অতিথির ইকরাম ও সম্মান রক্ষার জন্য সহজে যে ব্যবস্থা করা যায় তাই যথেষ্ট।

মেহমান এর পরও যদি অবস্থান করে, তবে গৃহকর্তা দৈনন্দিন যে পানাহার করে তা দ্বারাই মেহমানদারি করবে। এটা তার জন্য সদাকা গণ্য হবে। অর্থাৎ দান-সদাকা করলে যে ছাওয়াব পাওয়া যায়, এটাও সেরকম এক দান-সদাকা। মুমিন ব্যক্তির তো ছাওয়াবই লক্ষ্যবস্তু। কাজেই মেহমান যতদিন থাকে, বিশেষ কষ্ট না হলে সে ছাওয়াব অর্জনের লক্ষ্যে সাধারণভাবে তার মেহমানদারি করতে থাকবে।

তবে হাঁ, মেহমানকেও সতর্ক হতে হবে। গৃহকর্তাকে কষ্ট দেওয়া কিছুতেই উচিত হবে না। যখন লক্ষ করবে তার থাকার দ্বারা গৃহকর্তার কষ্ট হচ্ছে, তখন অবশ্যই তাকে বিদায় নিতে হবে। এ বিষয়ে মুসলিম শরীফের বর্ণনায় আছে-
لَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يُقِيمَ عِنْدَ أَخِيهِ حَتَّى يُؤْثِمَهُ (মুসলিম ব্যক্তির জন্য তার ভাইয়ের নিকট এ পরিমাণ অবস্থান করা বৈধ নয়, যা তাকে গুনাহগার বানাবে)। লক্ষণীয়, এ হাদীছে গৃহকর্তাকে মেহমানের ভাই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত মুমিনগণ সকলে একে অন্যের ভাই। অর্থাৎ দীনী ভাই। এক মুমিনের সঙ্গে অপর মুমিনের যাবতীয় আচরণ যেন সুন্দর ও আন্তরিকতাপূর্ণ হয়, তার প্রতি তাগিদ করার জন্য কুরআন ও হাদীছে 'ভাই' শব্দটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং কেউ যখন কারও বাড়িতে অতিথি হয়, তখন সে অনাত্মীয় হলেও গৃহকর্তাকে নিজ ভাই গণ্য করবে। অনুরূপ গৃহকর্তাও। এক ভাইয়ের যেমন অন্য ভাইকে নিজের কোনও কর্মপন্থা দ্বারা গুনাহগার বানানো উচিত নয়, তেমনি মেহমানেরও উচিত নয় নিজ কর্মপন্থা দ্বারা তার মেজবান ভাইকে গুনাহগার বানানো। মেহমান মেজবানকে কীভাবে গুনাহগার বানাতে পারে, এ প্রশ্ন করা হলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
يُقِيمُ عِنْدَهُ وَلَا شَيْءَ لَهُ يُقْرِيهِ بِهِ (সে তার নিকট অবস্থান করবে, অথচ তার কাছে এমন কিছু নেই, যা দ্বারা তার মেহমানদারি করবে)। এ অবস্থায় গৃহকর্তা অতিথির প্রতি বিরক্ত হয়ে যাবে। ফলে সে তার সম্পর্কে হয়তো কোনও কটুক্তি করবে বা তার গীবত ও নিন্দা করবে। এমনও হতে পারে যে, তার মেহমানদারি করার জন্য সে কারও কাছ থেকে ঋণ করবে। সেই ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে নানা টালবাহানা করবে। হয়তো পাওনাদারের সঙ্গে মিথ্যা বলবে কিংবা ওয়াদা করবে অথচ তা রক্ষা করতে পারবে না। এ সবই গুনাহ। গৃহকর্তা এসব গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে অতিথির অসচেতনতার কারণে। সে যদি গৃহকর্তার অবস্থা বুঝে আগে আগেই বিদায় গ্রহণ করত, দীর্ঘ সময় থেকে গৃহকর্তার বোঝা হয়ে না দাঁড়াত, তবে গৃহকর্তার এসব গুনাহে লিপ্ত হতে হতো না।

অপর এক বর্ণনায় আছে- وَلَا يَحِلُّ لَهُ أَنْ يَثْوِيَ عِنْدَهُ حَتَّى يُحرِجَهُ (তার জন্য তার কাছে এভাবে অবস্থান করতে থাকা বৈধ নয় যে, সে তাকে অসুবিধায় ফেলে দেবে) (সহীহ বুখারী: ৬১৩৫)
অর্থাৎ অতিথির উচিত গৃহকর্তার সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় রাখা। অন্যথায় সে হয়তো এতটা দীর্ঘ সময় তার কাছে অবস্থান করবে, যদ্দরুন সে তাকে নিয়ে বিপদে পড়ে যাবে। হয়তো তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে না কিংবা তাকে থাকতে দেওয়ার কারণে অন্যদের সমস্যায় পড়তে হবে।

উল্লেখ্য, থাকা ও খাওয়া দু'টোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মেহমানের জন্য উভয়েরই এন্তেজাম করতে হয়। গৃহকর্তার সে ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকলে মেহমানকে নিয়ে তার কিছু না কিছু সমস্যা হবেই। কখনও সে সমস্যা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই মেহমানের সেদিকে লক্ষ রেখেই মেজবানের বাড়িতে অবস্থান করতে হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অতিথির সমাদর করা ঈমানের দাবি।

খ. গৃহকর্তার কর্তব্য এক দিন এক রাত আপন সামর্থ্য অনুযায়ী অতিথির জন্য ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা।

গ. তিন দিন পর্যন্ত সাধারণভাবে অতিথির সেবাযত্ন করা বাঞ্ছনীয়।

ঘ. তিন দিনের বেশি আতিথেয়তা করাটা গৃহকর্তার এখতিয়ার। করলে ভালো। তাতে সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যাবে। না করাটা দূষণীয় হবে না।

ঙ. অতিথিকে অবশ্যই গৃহকর্তার আর্থিক অবস্থা ও জায়গার সামর্থ্যের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে, যাতে তার আতিথেয়তা করতে গিয়ে সে অসুবিধায় না পড়ে যায় কিংবা তার গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা না দেয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
জামে' তিরমিযী - হাদীস নং ১৯৬৮ | মুসলিম বাংলা