আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

২৭. সুন্দর ব্যবহার ও আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অধ্যায়

হাদীস নং: ১৯১৪
আন্তর্জাতিক নং: ১৯১৪
কন্যা ও বোনদের জন্য ব্যয় করা।
১৯২০. মুহাম্মাদ ইবনে ওয়াযীর আল-ওয়াসিতী (রাহঃ) ......... আবু বকর ইবনে উবাইদিল্লাহ ইবনে আনাস ইবনে মালিক (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি দুটো মেয়ে সন্তান লালন-পালন করবে সে আর আমি এভাবে পাশাপাশি জান্নাতে প্রবেশ করব। এরপর তিনি দুটো আঙ্গুল ইশারা করে দেখালেন।
باب مَا جَاءَ فِي النَّفَقَةِ عَلَى الْبَنَاتِ وَالأَخَوَاتِ
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ وَزِيرٍ الْوَاسِطِيُّ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عُبَيْدٍ، هُوَ الطَّنَافِسِيُّ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ الرَّاسِبِيُّ، عَنْ أَبِي بَكْرِ بْنِ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، عَنْ أَنَسٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ دَخَلْتُ أَنَا وَهُوَ الْجَنَّةَ كَهَاتَيْنِ " . وَأَشَارَ بِأَصْبُعَيْهِ . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে কন্যাসন্তানকে বালেগা হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করার ফযীলত বলা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে বিবাহ দেওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করার দ্বারাই এ ফযীলত লাভ হয়। বালেগা হওয়া পর্যন্ত বলার কারণ ইসলাম মূলত মেয়েদেরকে বালেগা হওয়ামাত্রই বিবাহ দিতে উৎসাহ দেয়। এ হাদীছেও পরোক্ষভাবে সে উৎসাহই দেওয়া হয়েছে। যেন বলা হচ্ছে, বালেগা হওয়ার পর তুমি তো তাকে বিবাহই দিয়ে দেবে। এরপর দায়িত্ব চলে যাবে স্বামীর হাতে। তখন তার জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সে-ই সরবরাহ করবে। তার আগ পর্যন্ত যেহেতু তোমার কাছে আছে, তাই এখন তার ভার তোমার উপর। তুমি যদি আন্তরিকতার সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন কর, তবে হাদীছে বর্ণিত ফযীলতের অধিকারী হবে।
প্রকাশ থাকে যে, লালন-পালন বলতে কেবল ভাত-কাপড় যোগানোই বোঝায় না। তার ইহজীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ তো করতেই হবে, সেইসঙ্গে তার পরকালীন জীবন যাতে সাফল্যমণ্ডিত হয় সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি। এর জন্য কর্তব্য তাকে জরুরি দীনী ইলম শিক্ষা দেওয়া। অর্থাৎ একজন মুসলিম নারী হিসেবে তার যা-কিছু করণীয় তা সবই তাকে শিক্ষা দেওয়া চাই। যেমন আকীদা- বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, হালাল-হারামের মাসাইল, উত্তম আখলাক-চরিত্র, স্বামী ও সন্তানের প্রতি কর্তব্য, আত্মীয়-স্বজনের হক ইত্যাদি।
কন্যাসন্তান লালন-পালনের এ ফযীলত দ্বারা ধারণা পাওয়া যায় ইসলামে কন্যাসন্তানের কী মর্যাদা। ইসলামের আগে তার এ মর্যাদা ছিল না। কন্যাসন্তান জন্ম নেওয়া পিতার পক্ষে লাঞ্ছনাকর গণ্য হত। তাই জন্ম নেওয়ামাত্র তাকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতেও ফেলা হত। কাউকে তার কন্যাসন্তান জন্মের সংবাদ দেওয়া হলে তার পক্ষে তা চরম বিব্রতকর মনে হত। কুরআন মাজীদে সে চিত্র এভাবে আঁকা হয়েছে-

وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ (58) يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ (59)

‘যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তান ( জন্মগ্রহণ)-এর সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে মনে মনে দুঃখ-ক্লিষ্ট হয়। সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে মানুষ থেকে লুকিয়ে বেড়ায় (এবং চিন্তা করে), হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে। জেনে রেখ, তারা যে সিদ্ধান্ত স্থির করে তা অতি মন্দ!২৯৮
ইসলাম তার অনুসারীদেরকে এ গ্লানি থেকে মুক্ত করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে কন্যাসন্তানের জন্ম লাঞ্ছনাকর নয়; বরং মর্যাদাকর। তার দ্বারা পিতামাতার পক্ষে জান্নাতের পথ সুগম হয়; বরং জান্নাতের উচ্চমর্যাদা লাভ হয়। সুতরাং এ হাদীছে কেবল একটি কন্যাসন্তান নয়, একাধিক কন্যাসন্তানের প্রতি আগ্রহ প্রদান করা হয়েছে। দীনের সহীহ বুঝ যাদের মধ্যে নেই তারা একটি কন্যাসন্তানের জন্মেও মন খারাপ করে ফেলে। এ হাদীছ বলছে, আল্লাহ তাআলা যদি তোমাকে দুটি কন্যাসন্তান দেন আর তুমি উত্তমভাবে তার লালন-পালন কর, তবে তুমি জান্নাতে তাঁর রাসূলের প্রতিবেশী হয়ে থাকবে। অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

مَنْ عَالَ ثَلَاثَ بَنَاتٍ، فَأَدَّبَهُنَّ ، وَزَوَّجَهُنَّ، وَأَحْسَنَ إِلَيْهِنَّ ، فَلَهُ الْجَنَّةُ

‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যাসন্তানের লালন-পালন করে, তাদেরকে দীনী শিক্ষাদান করে, তাদের বিবাহ সম্পন্ন করে এবং তাদের প্রতি সদাচরণ করে, তার জন্য জান্নাত।২৯৯

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, এটি অতি উৎকৃষ্ট হাদীছসমূহের একটি।

جارية-এর মূল অর্থ কিশোরী, তরুণী। কন্যা বোঝানোর জন্য بنت বা ابنة শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আলোচ্য হাদীছে جارية শব্দ ব্যবহার করে বোঝানো হচ্ছে যে, এ ফযীলত নিজের কন্যাকে লালন-পালন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বোন, ভাতিজী, নাতনী বা এরকম যে-কোনও দুই মেয়েকে লালন-পালন করলেও এ ফযীলত অর্জিত হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছাকাছি জান্নাতে থাকা বড়ই সৌভাগ্যের ব্যাপার। সুতরাং এ সৌভাগ্য অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের উচিত অত্যন্ত মায়া-মমতার সাথে মেয়েদের লালন-পালন করা এবং কোনওক্রমেই মেয়ে হল বলে তাদেরকে অবহেলা ও অগ্রাহ্য না করা।

২৯৮. সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৫৮-৫৯

২৯৯. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫৪১৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১১৯২৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১১৫৪২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৫৬; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ৬৩৯
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান