আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৮- নবীগণের আঃ আলোচনা

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৩৩৬
২০০১. আত্মাসমূহ (রুহজগতে) একত্র ছিল। লাঈস (রাহঃ) .... আয়িশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ)- কে বলতে শুনেছি, সমস্ত রূহ সেনাবাহিনীর ন্যায় একত্রিত ছিল। সেখানে তাদের যে সমস্ত রূহের পরস্পর পরিচয় ছিল, এখানেও তাদের মধ্যে পরস্পর সম্প্রীতি থাকবে। আর সেখানে যাদের মধ্যে পরস্পর পরিচয় হয়নি, এখানেও তাদের মধ্যে পরস্পর মতানৈক্য ও মতবিরোধ থাকবে।* ইয়াহয়া ইবনে আইয়ুব (রাহঃ) বলেছেন, ইয়াহয়া ইবনে সাইদ (রাহঃ) আমাকে এরূপ বর্ণনা করেছেন।
*অত্র হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে, সকল মানুষের আত্মা আদম (আ)-কে সৃষ্টি করার পূর্বেই সৃষ্টি করা হয়েছিল, সুতরাং আত্মাসমূহ পরস্পরে পরিচিত ছিল। আত্মার জগতে যে সকল লোকের আত্মার মধ্যে পরস্পরের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিচয় ছিল, পার্থিব জগতেও তাদের সাথে পরস্পর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হবে, আর যাদের আত্মার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল না, ইহজগতেও তাদের মধ্যে সম্পর্ক হবে না। (আইনী)
৩১০১। আবদান (রাহঃ) .... ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদা জনসমাবেশে দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করলেন, তারপর দাজ্জালের উল্লেখ করে বললেন, আমি তোমাদেরকে তার থেকে সতর্ক করছি, আর প্রত্যেক নবীই নিজ নিজ সম্প্রদায়কে এ দাজ্জাল থেকে সতর্ক করে দিয়েছেন। নূহ (আলাইহিস সালাম)-ও নিজ সম্প্রদায়কে দাজ্জাল থেকে সতর্ক করেছেন। কিন্তু আমি তোমাদেরকে তার সম্বন্ধে এমন একটা কথা বলছি, যা কোন নবী তাঁর সম্প্রদায়কে বলেন নি। তা হল তোমরা জেনে রেখ, নিশ্চয়ই দাজ্জাল কানা, আর আল্লাহ কানা নন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্কীকরণ

বিদায় হজ্জের দীর্ঘ ভাষণে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন জরুরি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। তার মধ্যে একটা ছিল দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করা ও তার কিছু আলামত বলে দেওয়া।

দাজ্জালকে ‘মাসীহুদ-দাজ্জাল' বলা হয়ে থাকে। ‘মাসীহ' শব্দের বিভিন্ন অর্থ আছে, যেমন- অত্যধিক ভ্রমণকারী, হাতের স্পর্শে রোগ নিরাময়কারী। দাজ্জালের মধ্যে এ দু'টি বিশেষত্ব থাকবে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকেও মাসীহ বলা হয়ে থাকে। কেননা তিনিও দাওয়াতী কাজে খুব সফর করতেন এবং তাঁর হাতের স্পর্শে অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগী নিরাময় লাভ করত। এদিক থেকে দাজ্জালের সঙ্গে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সাদৃশ্য আছে। তাই তো দাজ্জালকে বধ করার জন্য হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে এখনও পর্যন্ত আসমানে জীবিত ও নিরাপদ রাখা হয়েছে। দাজ্জালের আবির্ভাবের পর তাঁকে দুনিয়ায় পাঠানো হবে। তাঁর হাতেই দাজ্জালের বিনাশ ঘটবে।

'মাসীহ'-এর আরেক অর্থ- যা মুছে ফেলা হয়েছে। দাজ্জালের ডান চোখের স্থান মুছে ফেলা। অর্থাৎ সেখানে চোখ নেই। জায়গাটি সম্পূর্ণ ভরাট, সমতল। তার থাকবে শুধু বাম চোখ। তাও উপরের দিকে তোলা।

নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের চোখকে এমন একটি আঙ্গুরদানার সাথে তুলনা করেছেন, যে দানাটি সন্নিবদ্ধ আঙ্গুর থোকার ওপর আলাদাভাবে ভাসমান। এমনিই ডান চোখ নেই। সে জায়গাটি চামড়া দিয়ে ঢাকা সম্পূর্ণ সমতল। আছে কেবল বাম চোখ। তাও এভাবে উপরে তোলা। তিনি জানানঃ-

إنَّ ربكم ليس بأعور، وإنه أعور عين اليمنى، كأن عينه عنبة طافية

তোমাদের প্রতিপালক কানা নন, অথচ সে হবে ডান চোখের কানা। তার চোখ যেন (আঙ্গুরের থোকার) উপরে ভেসে থাকা একটি আঙ্গুর।

এই যার চোখের অবস্থা, দেখতে সে কতই না কুৎসিত ও বীভৎস হবে! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের এই বিদঘুটে রূপটির প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এ কারণে যে, দাজ্জাল অনেক তেলেসমাতি দেখাবে- মৃতকে জীবিত করবে, বৃষ্টি নামিয়ে দেখাবে, আবার বৃষ্টি বন্ধ করে খরার অবস্থা বানাবে, সঙ্গে জান্নাত ও জাহান্নামের আকৃতি রাখবে আর এসবের ভিত্তিতে নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করবে। তো ঈমানদার ব্যক্তি যাতে এসব দেখে বিভ্রান্ত না হয়, তাই বিশেষভাবে বিদঘুটে চোখের আলামতটি উল্লেখ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন- সে যদি তোমাদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে, তবে তার অবস্থা সম্পর্কে তোমাদের যা-কিছুই অজানা থাকুক না কেন, এ বিষয়টা তো অজানা থাকতে পারে না যে, তোমাদের প্রতিপালক কানা নন, অথচ সে হবে ডান চোখের কানা। তার চোখ যেন (আঙ্গুরের থোকার) উপরে ভেসে থাকা একটি আঙ্গুর।

বস্তুত দাজ্জালের ফিতনা হবে অত্যন্ত ভয়ংকর। আল্লাহ তা'আলা যাকে হেফাজত করবেন কেবল সে-ই তার ফিতনা থেকে বাঁচতে পারবে। তার ফিতনা এমনকি কবরবাসীদেরকেও স্পর্শ করবে। এজন্যই হযরত নূহ আলাইহিস সালাম থেকে পরবর্তী সমস্ত নবী-রাসূল আপন আপন উম্মতকে তার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তবে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা বেশি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। তার আলামতসমূহের মধ্যে একটা বিশেষ আলামত এই যে, তার কপালে ك ف ر লেখা থাকবে। তা দেখে মু'মিনগণ বুঝে ফেলবে যে, সে এক ঘোর কাফের। যার কুফর এতই পূর্ণাঙ্গ ও বলিষ্ঠ যে, তার আছর অন্তর ও দেহের স্থূলতা ভেদ করে কপালেও পরিস্ফুট হবে। মোটকথা কেউ যাতে তার ফিতনায় পড়ে ঈমান না হারায় সেজন্য তিনি তার আলামতসমূহ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। আমাদেরকে তার ফিতনা থেকে বাঁচার দু'আও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। যেমন একটি দু'আ হচ্ছে-

«اللهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ النَّارِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ»

হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে, আপনার কাছে আশ্রয় চাই জাহান্নামের আযাব থেকে, আপনার কাছে আশ্রয় চাই মাসীহুদ-দাজ্জালের ফিতনা থেকে এবং আপনার কাছে আশ্রয় চাই জীবন ও মৃত্যুর যাবতীয় ফিতনা থেকে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৮৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৮৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৮৮০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৪৯৪; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ১৩০৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৯০৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৬৭)

এ দু'আটি নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও পড়তেন। এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেনঃ-

من حفظ عشر آيات من أول سورة الكهف، عصم من فتنة الدجال

যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, তাকে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা করা হবে। (সহীহ মুসলিম,হাদীছ নং ৮০৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩২৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩১০৫; নাসাঈ, হাদীছ নং ৮০২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৭১২; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৩৩৯১: শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৬৬৮৩)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কিয়ামতের আগে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। তাঁর ফিতনা সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, এটা সত্য। এতে বিশ্বাস রাখতে হবে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন