আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৮- নবীগণের আঃ আলোচনা

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৩৩৫
২০০০. নবীগণের আলোচনা অধ্যায়ঃ আদম (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সন্তানদের সৃষ্টির বর্ণনা।
৩১০০। উমর ইবনে হাফস ইবনে গিয়াস (রাহঃ) .... আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, কোন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে, তার এ খুনের পাপের একাংশ আদম (আলাইহিস সালাম)- এর প্রথম ছেলের (কাবিলের) উপর বর্তায়। কারণ সেই সর্বপ্রথম হত্যার প্রচলন করেছে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নরহত্যা সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, সর্বপ্রথম অন্যায়ভাবে এ কাজ করেছিল হযরত আদম ‘আলাইহিস সালামের প্রথম পুত্র। তার নাম কাবীল। সে তার যে ভাইকে হত্যা করেছিল তার নাম হাবীল। কুরআন মাজীদে তাদের সে ঘটনা সংক্ষেপে এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ-

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ إِنِّي أُرِيدُ أَنْ تَبُوءَ بِإِثْمِي وَإِثْمِكَ فَتَكُونَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ فَطَوَّعَتْ لَهُ نَفْسُهُ قَتْلَ أَخِيهِ فَقَتَلَهُ فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَاسِرِينَ فَبَعَثَ اللَّهُ غُرَابًا يَبْحَثُ فِي الْأَرْضِ لِيُرِيَهُ كَيْفَ يُوَارِي سَوْءَةَ أَخِيهِ قَالَ يَاوَيْلَتَا أَعَجَزْتُ أَنْ أَكُونَ مِثْلَ هَذَا الْغُرَابِ فَأُوَارِيَ سَوْءَةَ أَخِي فَأَصْبَحَ مِنَ النَّادِمِينَ

অর্থ : এবং (হে নবী!) তাদের সামনে আদমের দু' পুত্রের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পড়ে শোনাও, যখন তাদের প্রত্যেকে একেকটি কুরবানী পেশ করেছিল এবং তাদের একজনের কুরবানী কবুল হয়েছিল, অন্যজনের কবুল হয়নি। সে (দ্বিতীয়জন প্রথমজনকে) বলল, আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব। প্রথমজন বলল, আল্লাহ তো মুত্তাকীদের পক্ষ হতেই (কুরবানী) কবুল করেন। তুমি যদি আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আমার দিকে হাত বাড়াও, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তোমার দিকে হাত বাড়াব না।
আমি তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ভয় করি। আমি চাই, তুমি আমার ও তোমার উভয়ের পাপভার বহন কর এবং জাহান্নামীদের মধ্যে গণ্য হও। আর এটাই জালিমদের শাস্তি। পরিশেষে তার মন তাকে ভ্রাতৃ-হত্যায় প্ররোচিত করল, সুতরাং সে তার ভাইকে হত্যা করে ফেলল এবং অকৃতকার্যদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। অতঃপর আল্লাহ একটি কাক পাঠালেন, যে তার ভাইয়ের লাশ কিভাবে গোপন করবে তা তাকে দেখানোর লক্ষ্যে মাটি খনন করতে লাগল। (এটা দেখে) সে বলে উঠল, হায় আফসোস! আমি কি এই কাকটির মতও হতে পারলাম না, যাতে আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করতে পারি! এভাবে পরিশেষে সে অনুতপ্ত হল। (সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ২৭-৩১)

হযরত আদম আলাইহিস সালামের দুই পুত্রের মধ্যে যখন এ ঘটনা ঘটে, তখন পৃথিবীতে মানব বসতি বলতে কেবল হযরত আদম আলাইহিস সালামের পরিবারবর্গই ছিল। তাঁর স্ত্রীর গর্ভে প্রতিবার দুটি জমজ সন্তানের জন্ম হত। একটি পুত্র ও একটি কন্যা। তাদের দু'জনের পরস্পরে বিবাহ তো জায়েয ছিল না, কিন্তু এক গর্ভের পুত্রের সাথে অপর গর্ভের কন্যার বিবাহ হালাল ছিল। কাবীলের সাথে যে কন্যার জন্ম হয় সে ছিল রূপসী। কিন্তু জমজ হওয়ার কারণে কাবীলের সাথে তার বিবাহ জায়েয ছিল না। তা সত্ত্বেও কাবীল গোঁ ধরে বসেছিল তাকেই বিবাহ করবে। হাবীলের পক্ষে সে মেয়ে হারাম ছিল না। তাই সে তাকে বিবাহ করতে চাচ্ছিল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তা নিষ্পত্তির জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করবে। আল্লাহ তা'আলা যার কুরবানী কবুল করবেন তার দাবি ন্যায্য মনে করা হবে। সুতরাং উভয়ে কুরবানী পেশ করল। বর্ণনায় আছে যে, হাবীল একটি দুম্বা কুরবানী দিয়েছিল আর কাবীল পেশ করেছিল কিছু কৃষিজাত ফসল। সেকালে কুরবানী কবুল হওয়ার আলামত ছিল এই যে, কুরবানী কবুল হলে আসমান থেকে আগুন এসে তা জ্বালিয়ে দিত। সুতরাং আসমান থেকে আগুন আসল এবং হাবীলের কুরবানী জ্বালিয়ে দিল। এভাবে প্রমাণ হয়ে গেল যে, তার কুরবানী কবুল হয়েছে। কাবীলের কুরবানী যেমনটা তেমন পড়ে থাকল। তার মানে, তার কুরবানী কবুল হয়নি। এ অবস্থায় কাবীলের তো উচিত ছিল সত্য মেনে নেওয়া, কিন্তু তার বিপরীতে সে ঈর্ষাকাতর হল এবং এক পর্যায়ে হাবীলকে হত্যা করতে প্রস্তুত হয়ে গেল।

যদিও আত্মরক্ষার কোনও উপায় পাওয়া না গেলে আক্রমণকারীকে হত্যা করা জায়েয, কিন্তু এ ক্ষেত্রে হাবীল পরহেজগারী তথা উচ্চতর নৈতিকতামূলক পন্থা অবলম্বন করলেন এবং নিজের সে অধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকলেন। তিনি বোঝাচ্ছিলেন, আমি আত্মরক্ষার অন্য সব পন্থা অবলম্বন করব, কিন্তু তোমাকে হত্যা করতে কিছুতেই সচেষ্ট হব না। সেই সঙ্গে তাকে জানিয়ে দিলেন যে, তুমি যদি সত্যিই আমাকে হত্যা করে বস, তবে মজলুম হওয়ার কারণে আমার গুনাহসমূহ তো ক্ষমা করা হবে বলে আশা করতে পারি, কিন্তু তোমার ওপর যে কেবল নিজের পাপের বোঝা চাপবে তাই নয়, বরং আমাকে হত্যা করার কারণে আমার কিছু পাপ-ভারও তোমার ওপর চাপানো হতে পারে। কেননা আখিরাতে জালিমের পক্ষ হতে মজলুমের হক আদায়ের একটা পন্থা হাদীসে এরূপ বর্ণিত হয়েছে যে, জালিমের পুণ্য মজলুমকে দেওয়া হবে। তারপরও যদি হক বাকি থেকে যায়, তবে মজলুমের পাপ জালিমের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হবে।

কাবীলের দেখা এটাই যেহেতু ছিল মৃত্যুর প্রথম ঘটনা, তাই লাশ দাফনের নিয়ম তার জানা ছিল না। তাই আল্লাহ তা'আলা একটি কাক পাঠিয়ে দিলেন। কাকটি মাটি খুঁড়ে একটা মৃত কাক দাফন করছিল। এটা দেখে কাবীল কেবল লাশ দাফনের নিয়মই শিখল না, নিজ অজ্ঞতার কারণে লজ্জিতও হল। (তাওযীহুল কুরআন)

যাহোক কাবীল যেহেতু অন্যায় মানবহত্যার সূচনাকারী আর যে-কোনও ব্যক্তি কোনও অন্যায় কাজের সূচনা করলে তার অনুসরণে পরবর্তীকালে যারাই সে অন্যায় কাজটি করবে, তাদের সকলের সমপরিমাণ গুনাহ তার ওপর বর্তায়, সে হিসেবে এ হাদীছে জানানো হয়েছে যে, দুনিয়ায় যত অন্যায় নরহত্যা হয় তার গুনাহের একটি অংশ কাবীলের ওপরও বর্তায়।

ভাবা যায়! অন্যায় মানবহত্যার কী পরিমাণ পাপ কাবীলের আমলনামায় এ যাবৎকাল লেখা হয়েছে এবং আরও লেখা হচ্ছে? যুগে যুগে কত মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়; বরং প্রতিদিনই কত মানুষ অন্যায় হত্যার শিকার হয়! এ পর্যন্ত যত অন্যায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার সর্বমোট সংখ্যা কত তা কারও জানা নেই। কিন্তু এতটুকু তো অনুমান করা যায় যে, এ সংখ্যা হবে কোটি কোটি। আল্লাহ তা'আলার দফতরে প্রকৃত সংখ্যা লেখাও আছে। এই কোটি কোটি নরহত্যাকারীর সর্বমোট পাপের সমপরিমাণ পাপ কাবীলের আমলনামায়ও যুক্ত হয়েছে। আল্লাহর পানাহ! কী ভয়াবহ ব্যাপার!!

আমরা হাবীলের ব্যাপারে এর বিপরীত আশা করতে পারি যে, ধৈর্য ধরে ভাইকে হত্যা করার কাজ থেকে বিরত থাকার যে মহান আদর্শ তিনি পেশ করেছেন তার অনুসরণে পরবর্তীকালে যত লোক ভ্রাতৃ-হত্যা থেকে বিরত থাকবে, তাদের সকলের সমান ছাওয়াব হযরত আদম আলাইহিস সালামের এ মহান পুত্রের আমলনামায়ও লেখা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এভাবে লেখা হতে থাকবে।

কেউ প্রশ্ন করতে পারে, কুরআন মাজীদে তো জানানো হয়েছে এক ব্যক্তির গুনাহের ভার অন্য ব্যক্তির ওপর পড়ে না। যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ-
وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى
এবং কোনও ভার বহনকারী অন্য কারও ভার বহন করবে না। (সূরা আন'আম (৬), আয়াত ১৬৪) তাহলে কি এ হাদীছটি ওই আয়াতের বিপরীত হল না?
উত্তর হচ্ছে—না। কেননা আয়াতে এক ব্যক্তির গুনাহ অন্য ব্যক্তি বহন করবে না। বলে যে কথা জানানো হয়েছে তা ওই গুনাহ, যা কাজটি করার কারণে সে ব্যক্তির নিজের হয়েছে। তার গুনাহ তারই থাকবে। তাওবা ছাড়া সে তা থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। হাঁ, তার সেই গুনাহের কাজে যদি অন্য কারও কোনওরকম ভূমিকা থাকে, যেমন সে যদি আদেশ ও উৎসাহদাতা হয় বা সে ওই কাজটির প্রচলনকারী হয়, যার দেখাদেখি দ্বিতীয় ব্যক্তি ওই কাজটি করে, তবে এ কারণে দ্বিতীয় ব্যক্তির গুনাহের সমান গুনাহ তার ওপরও চাপবে। এটা আয়াতে অস্বীকার করা হয়নি।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অন্যায় নরহত্যা অত্যন্ত কঠিন পাপ। কোনও অবস্থায়ই এ কঠিন পাপে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়।

খ. যে-কোনও মন্দ কাজ থেকে এ কারণেও বেঁচে থাকা জরুরি যে, এর দেখাদেখি অন্য কেউ সে কাজটি করতে পারে। ফলে নিজ আমলনামায় অতিরিক্ত গুনাহ লেখা হতে থাকবে।

গ. কোনও পাপকাজ চালু করার একটা দুনিয়াবী কুফল এইও যে, ইতিহাসে সে ব্যক্তি ওই মন্দ কাজটির প্রবর্তক হিসেবে কুখ্যাত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে আখিরাতের দুর্গতি ও দুনিয়ার কুখ্যাতি থেকে হেফাজত করুন।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন