আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪৮- নবীগণের আঃ আলোচনা
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৩৩১
২০০০. নবীগণের আলোচনা অধ্যায়ঃ আদম (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সন্তানদের সৃষ্টির বর্ণনা।
৩০৯৬। আবু কুরায়ব ও মুসা ইবনে হিযাম (রাহঃ) .... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমরা নারীদেরকে উত্তম উপদেশ দিবে। কেননা নারী জাতিকে পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড়গুলোর মধ্যে উপরের হাড়টি অধিক বাঁকা। তুমি যদি তা সোজা করতে যাও, তাহলে তা ভেঙ্গে ফেলবে, আর যদি ছেড়ে দাও, তাহলে সব সময় তা বাকাই থেকে যাবে। কাজেই নারীদের সাথে উপদেশপূর্ণ কথাবার্তা বলবে।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
স্ত্রীদের প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ
ইসলাম-পূর্বকালে স্ত্রীদের প্রতি মানবিক ব্যবহারই করা হত না। সবরকম মৌলিক অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হত। ইসলাম সে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটায়। ইসলাম স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের সম্পূরক সাব্যস্ত করেছে। দাম্পত্যসম্পর্ক পারস্পরিক শান্তি ও স্বস্তির উৎস এবং এটা মানবপ্রজন্ম সচল রাখার প্রকৃষ্ট ব্যবস্থা।
কুরআন ও হাদীছে দম্পতির জন্য মৌলিকভাবে زوج শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। زوج মানে জোড়া। স্বামী-স্ত্রী দু'জন মিলে একজোড়া। জোড়ার একটি ছাড়া অন্যটি যেমন অপূর্ণ, তেমনি স্বামী-স্ত্রীর একজন ছাড়া অন্যজন অপূর্ণ। কুরআন মাজীদ ইরশাদ করছে هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ “তারা তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরাও তাদের জন্য পোশাক।
অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর একের প্রতি অন্যের প্রয়োজনটি পোশাকেরই মত। পোশাক ছাড়া যেমন কোনও মানুষ চলতে পারে না, তেমনি কোনও পুরুষ স্ত্রী ছাড়া এবং স্ত্রীও স্বামী ছাড়া যথার্থরূপে চলতে পারে না। পোশাক দ্বারা শরীরের হেফাজত হয়, লজ্জা নিবারণ হয়, দৈহিক সৌন্দর্য বর্ধন হয়, ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে ও সামাজিক মান-মর্যাদা রক্ষা হয়, তেমনি স্বামী-স্ত্রীর একের দ্বারা অন্যের চরিত্র হেফাজত হয়, সামাজিক লজ্জা-শরম নিবারণ হয়, স্বাস্থ্য রক্ষা পায়, পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের বিকাশ হয় এবং তারা একে অন্যের শোভাও বটে।
দাম্পত্যজীবনের এসব কল্যাণ এবং এর মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কেবল তখনই অর্জিত হতে পারে, যখন স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের মূল্যায়ন করবে, একে অন্যের হক সম্পর্কে সচেতন থাকবে এবং পারস্পরিক কল্যাণ অনুধাবন করে একে অন্যের প্রতি সম্মানজনক ও প্রীতিপূর্ণ আচরণ করবে।
জাহিলী যুগে স্ত্রীর হক সম্পর্কে মানুষের কোনও ধারণা ছিল না। আরব-আজম নির্বিশেষে সর্বত্র মানবিক সব অধিকার পুরুষের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। ইসলামই প্রথম এ জুলুম-অবিচারের মূলোৎপাটন করে। কুরআন ঘোষণা করে وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ ‘আর স্ত্রীদেরও ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে, যেমন তাদের প্রতি (স্বামীদের) অধিকার রয়েছে।
স্বামী তো তার অধিকার বুঝে নিতই, কিন্তু স্ত্রী দুর্বল হওয়ায় সে সবদিক থেকে বঞ্চিত থাকত। তাই ইসলাম একদিকে পুরুষের উপর নারীরও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে, অন্যদিকে তার সে অধিকার আদায়ের জন্য পুরুষের উপর জোর তাগিদ করেছে। পুরুষ যাতে কোনওভাবে তার উপর জুলুম না করে এবং তার সর্বপ্রকার অধিকার আদায়ে বিশেষভাবে যত্নবান থাকে, সে ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা অত্যন্ত পূর্ণাঙ্গ।
হাদীসে আছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন استوصوا بالنساء خيرا (তোমরা আমার নিকট থেকে নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করার উপদেশ গ্রহণ কর)। استوصوا আজ্ঞাসূচক ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি وصية থেকে। অর্থ আদেশ ও উপদেশ। অর্থ তোমরা আমার উপদেশ গ্রহণ কর এবং সে অনুযায়ী আমল কর। অর্থাৎ স্ত্রীদের প্রতি কোমল আচরণ করবে এবং জীবনযাপনে তাদের প্রতি সদ্ভাব বজায় রাখবে।
হাদীসে আছে, স্ত্রীদের প্রতি সদাচরণ কেন করতে হবে? এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- فإن المرأة خلقت من ضلع وإن اعوج مافي الضلع اعلاه (কেননা নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরের হাড় দ্বারা। পাঁজরের হাড়ের মধ্যে উপরেরটা সবচেয়ে বেশি বাঁকা)। অর্থাৎ প্রথম মানবী হযরত হাওয়া আলাইহাস সালামকে প্রথম মানব হযরত আদম আলাইহিস সালামের বাম পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। পাঁজরের হাড় বাঁকা হয়ে থাকে। তার মধ্যেও উপরের হাড়টি বেশি বাঁকা। তা দ্বারাই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। ফলে সে বক্রতার আছর নারীর স্বভাবেও নিহিত আছে। এটা অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই।
বলাবাহুল্য, আল্লাহ তাআলা যাকে যেভাবে চান সৃষ্টি করেন। এতে কারও আপত্তি তোলার কোনও অবকাশ নেই। এমনিভাবে নারী স্বভাবে বক্রতা আছে বলে তাকে হেয়জ্ঞান করারও সুযোগ নেই। এটাও ভাবা সমীচীন নয় যে, এ কথা বলে নারীকে ছোট করা হয়েছে। সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটন দ্বারা কাউকে ছোট করা হয় না। হাঁ, আনুমানিক কথা বলা দোষ। কিন্তু এটা অনুমান নয়। নবী যা বলেন, ওহীর ভিত্তিতেই বলেন। ওহীর কথা সত্য ও সঠিক।
তবে নারী স্বভাবের বক্রতা পুরুষের পক্ষে এক পরীক্ষা বটে। নারীকে বলা হয়নি যে, তুমি সোজা হয়ে যাও। পুরুষকে বলা হয়েছে, তুমি তাকে সমঝে চল। তার প্রতি সদা সদাচরণ কর। এটা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপদেশ। উম্মতের জন্য তা মেনে চলা জরুরি। তা জরুরি এ কারণেও যে, এটা মেনে চলার দ্বারাই দাম্পত্যজীবন স্থায়ী হতে পারে এবং দাম্পত্যজীবন শান্তিপূর্ণ হতে পারে। হাদীছে আছে- فان ذهبت تقيمه كسرته وإن تركته لم يزل أعوج (কাজেই তুমি যদি সেটি সোজা করতে যাও তবে ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি সেটি ছেড়ে দাও তবে সর্বদা বাঁকাই থাকবে)। অর্থাৎ পাঁজরের হাড় যেমন সোজা করা যায় না, সোজা করতে গেলে ভেঙ্গে যাবে, তেমনি নারীস্বভাবকে সোজা করতে যাওয়ার চেষ্টা ভুল। সেই চেষ্টা করতে গেলে তাকে ভেঙ্গে ফেলা হবে। পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে ফেলার মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই; বরং কল্যাণ সেটি বাঁকা থাকার মধ্যেই। হাড়গুলো বাঁকা বলেই বক্ষপিঞ্জর তৈরি হতে পেরেছে, যা কিনা বুকের ভেতরকার অঙ্গগুলোকে সুরক্ষা দিয়েছে। বাঁকা না হলে তা দ্বারা এ কল্যাণ লাভ হত না। তদ্রূপ নারীস্বভাবের বক্রতাও কল্যাণকরই বটে। তার মধ্যকার কল্যাণ ততক্ষণই অর্জিত হবে, যতক্ষণ তা বাঁকা থাকবে। সে কথাই হাদীছে বলা হয়েছে যে, বুকের হাড় সোজা করতে গেলে ভেঙ্গে যাবে আর ছেড়ে দিলে বাঁকা থাকবে। বলাবাহুল্য বাঁকা থাকার দ্বারাই তার স্থায়ীত্ব বজায় থাকে। তদ্রূপ স্ত্রী-স্বভাবকে সোজা করতে গেলে ভেঙ্গে যাবে অর্থাৎ দাম্পত্যজীবনের বিপর্যয় ঘটবে এবং পরিস্থিতি তালাক পর্যন্ত গড়াবে। হাদীছে ভেঙ্গে ফেলার দ্বারা তালাক হয়ে যাওয়া বোঝানো হয়েছে। আর যদি যেমন আছে তেমনই রেখে দেওয়া হয়, তবে দাম্পত্যজীবন স্থায়ী হবে। সুতরাং দাম্পত্যজীবনের স্থায়ীত্বের স্বার্থে সোজা করার ইচ্ছাই পরিত্যাগ করতে হবে।
হাদীসে আছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন وإن استمتعت بها استمتعت وفيها عوج (তুমি তাকে সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে ফেলবে আর তুমি যদি তার দ্বারা উপকৃত হতে চাও, তবে তার মধ্যে বক্রতা থাকা অবস্থায়ই তার দ্বারা উপকৃত হতে পারবে)। অর্থাৎ তুমি যদি চাও দাম্পত্যজীবন শান্তিপূর্ণ হোক, কোনও ঝগড়াঝাটি না হোক, তোমার ঘর ও ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্রের হেফাজত হোক, তোমার অর্থ-সম্পদ ও কামাই-রোযগারে বরকত হোক, তোমার সন্তান-সন্ততি নেককার হোক, তাদের উত্তম পরিচর্যা হোক, তাদের বুনিয়াদী দীনী শিক্ষাদীক্ষা হোক, তারা ইসলামী আদব-কায়দায় অভ্যস্ত হোক এবং বিবাহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পুরোপুরি অর্জিত হোক, তবে তা ততক্ষণই সম্ভব হবে, যতক্ষণ তাকে তার বক্র অবস্থায়ই থাকতে দেবে।
হাদীসে আছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন 'সুতরাং তোমরা আমার নিকট থেকে নারীদের সম্পর্কে (সদ্ব্যবহার করার) উপদেশ গ্রহণ কর। অর্থাৎ তোমরা উল্লিখিত বক্তব্য অনুধাবন কর এবং সেমতে আমার উপদেশ অনুযায়ী স্ত্রীদের প্রতি সর্বদা সদাচরণ কর।
বস্তুত হাদীসে পুরুষকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে সে যেন তার স্ত্রীকে পুরোপুরি সোজা করার কথা না ভাবে। সে তাকে সরল সোজা আখলাক-চরিত্রের উপর নিয়ে আসতে চাইলে তাকে বরং বিগড়েই দেবে। তারচে' যেমন আছে তেমন রাখলে তার দ্বারা উপকৃত হতে পারবে। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, নারীচরিত্রের কিছুটা বক্রতা তার জন্য দোষের নয়, যেমন দোষের নয় পাজরের হাড় বাঁকা হওয়া। তাই পুরুষের জন্য সমীচীন নয় নারীর মধ্যে পুরুষ-চরিত্র খোঁজা। কেননা আল্লাহ তাআলা পুরুষ ও নারীর প্রত্যেককে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যা অপর শ্রেণীর মধ্যে পাওয়া যায় না।
প্রকাশ থাকে যে, নারীকে পাঁজরের হাড়ের সঙ্গে তুলনা করার অর্থ এ নয় যে, তাদেরকে সংশোধন করার চেষ্টা বা সৎকাজের আদেশ করা যাবে না। বোঝানো উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদেরকে সংশোধন করতে হবে নম্র-কোমল পন্থায়। এমন কঠোর পন্থা অবলম্বন করা যাবে না, যা তাদের ভেঙ্গে ফেলে অর্থাৎ বিগড়ে দেয়। সংশোধনের চেষ্টা একদম না করাটাও ঠিক নয়। তাতে বরং বক্রতা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। সংশোধনের চেষ্টা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই জরুরি। আল্লাহ তাআলা হুকুম দেন يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا 'হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা কর জাহান্নাম থেকে,
সুতরাং স্ত্রী যদি শর'ঈ কর্তব্য পালনে অবহেলা করে বা কোনও পাপকর্মে লিপ্ত থাকে, তবে অবশ্যই তাকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। এরকম বক্রতার উপর তাকে ছেড়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। এরূপ ক্ষেত্রে তাকে উপদেশ দেওয়া, তিরস্কার করা কিংবা লঘু মারারও অবকাশ আছে। ইরশাদ হয়েছে وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ ‘আর যে সকল স্ত্রীর ব্যাপারে তোমরা অবাধ্যতার আশঙ্কা কর, (প্রথমে) তাদেরকে বোঝাও এবং (তাতে কাজ না হলে) তাদেরকে শয়ন শয্যায় একা ছেড়ে দাও এবং (তাতেও সংশোধন না হলে) তাদেরকে প্রহার করতে পার।
হাঁ, শরীআত যা ওয়াজিব ও আবশ্যিক করেনি, এমন ক্ষেত্রে তাদের আচার আচরণ ও কথাবার্তা অপসন্দনীয় ও অপ্রীতিকর বোধ হলে সে ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া বাঞ্ছনীয়, যদি না তাতে সুস্পষ্ট কোনও ক্ষতি লক্ষ করা যায়।
মোটকথা হাদীসে স্ত্রীদেরকে সংশোধনের চেষ্টা করতে নিষেধ করা হয়নি। নিষেধ করা হয়েছে কেবল সংশোধনের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করতে। সেইসঙ্গে উৎসাহ দিচ্ছে যেন তাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করা হয়, তাদের প্রতি ক্ষমাসুন্দর আচরণ করা হয়, তাদের পক্ষ থেকে অপ্রীতিকর আচরণের ক্ষেত্রে সবরের পরিচয় দেওয়া হয় এবং হিকমত ও সহনশীলতার সঙ্গে সহাবস্থান করা হয়। এর মধ্যেই দাম্পত্যজীবনের সুখ শান্তি নিহিত। এটাই বিবাহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের পক্ষে বেশি সহায়ক।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
প্রত্যেক স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর প্রতি সর্বদা সদ্ভাব বজায় রাখা। এ বিষয়ে বিশেষভাবে উপদেশ দেওয়ার দ্বারা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
ইসলাম-পূর্বকালে স্ত্রীদের প্রতি মানবিক ব্যবহারই করা হত না। সবরকম মৌলিক অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হত। ইসলাম সে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটায়। ইসলাম স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের সম্পূরক সাব্যস্ত করেছে। দাম্পত্যসম্পর্ক পারস্পরিক শান্তি ও স্বস্তির উৎস এবং এটা মানবপ্রজন্ম সচল রাখার প্রকৃষ্ট ব্যবস্থা।
কুরআন ও হাদীছে দম্পতির জন্য মৌলিকভাবে زوج শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। زوج মানে জোড়া। স্বামী-স্ত্রী দু'জন মিলে একজোড়া। জোড়ার একটি ছাড়া অন্যটি যেমন অপূর্ণ, তেমনি স্বামী-স্ত্রীর একজন ছাড়া অন্যজন অপূর্ণ। কুরআন মাজীদ ইরশাদ করছে هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ “তারা তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরাও তাদের জন্য পোশাক।
অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর একের প্রতি অন্যের প্রয়োজনটি পোশাকেরই মত। পোশাক ছাড়া যেমন কোনও মানুষ চলতে পারে না, তেমনি কোনও পুরুষ স্ত্রী ছাড়া এবং স্ত্রীও স্বামী ছাড়া যথার্থরূপে চলতে পারে না। পোশাক দ্বারা শরীরের হেফাজত হয়, লজ্জা নিবারণ হয়, দৈহিক সৌন্দর্য বর্ধন হয়, ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে ও সামাজিক মান-মর্যাদা রক্ষা হয়, তেমনি স্বামী-স্ত্রীর একের দ্বারা অন্যের চরিত্র হেফাজত হয়, সামাজিক লজ্জা-শরম নিবারণ হয়, স্বাস্থ্য রক্ষা পায়, পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের বিকাশ হয় এবং তারা একে অন্যের শোভাও বটে।
দাম্পত্যজীবনের এসব কল্যাণ এবং এর মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কেবল তখনই অর্জিত হতে পারে, যখন স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের মূল্যায়ন করবে, একে অন্যের হক সম্পর্কে সচেতন থাকবে এবং পারস্পরিক কল্যাণ অনুধাবন করে একে অন্যের প্রতি সম্মানজনক ও প্রীতিপূর্ণ আচরণ করবে।
জাহিলী যুগে স্ত্রীর হক সম্পর্কে মানুষের কোনও ধারণা ছিল না। আরব-আজম নির্বিশেষে সর্বত্র মানবিক সব অধিকার পুরুষের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। ইসলামই প্রথম এ জুলুম-অবিচারের মূলোৎপাটন করে। কুরআন ঘোষণা করে وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ ‘আর স্ত্রীদেরও ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে, যেমন তাদের প্রতি (স্বামীদের) অধিকার রয়েছে।
স্বামী তো তার অধিকার বুঝে নিতই, কিন্তু স্ত্রী দুর্বল হওয়ায় সে সবদিক থেকে বঞ্চিত থাকত। তাই ইসলাম একদিকে পুরুষের উপর নারীরও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে, অন্যদিকে তার সে অধিকার আদায়ের জন্য পুরুষের উপর জোর তাগিদ করেছে। পুরুষ যাতে কোনওভাবে তার উপর জুলুম না করে এবং তার সর্বপ্রকার অধিকার আদায়ে বিশেষভাবে যত্নবান থাকে, সে ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা অত্যন্ত পূর্ণাঙ্গ।
হাদীসে আছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন استوصوا بالنساء خيرا (তোমরা আমার নিকট থেকে নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করার উপদেশ গ্রহণ কর)। استوصوا আজ্ঞাসূচক ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি وصية থেকে। অর্থ আদেশ ও উপদেশ। অর্থ তোমরা আমার উপদেশ গ্রহণ কর এবং সে অনুযায়ী আমল কর। অর্থাৎ স্ত্রীদের প্রতি কোমল আচরণ করবে এবং জীবনযাপনে তাদের প্রতি সদ্ভাব বজায় রাখবে।
হাদীসে আছে, স্ত্রীদের প্রতি সদাচরণ কেন করতে হবে? এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- فإن المرأة خلقت من ضلع وإن اعوج مافي الضلع اعلاه (কেননা নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরের হাড় দ্বারা। পাঁজরের হাড়ের মধ্যে উপরেরটা সবচেয়ে বেশি বাঁকা)। অর্থাৎ প্রথম মানবী হযরত হাওয়া আলাইহাস সালামকে প্রথম মানব হযরত আদম আলাইহিস সালামের বাম পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। পাঁজরের হাড় বাঁকা হয়ে থাকে। তার মধ্যেও উপরের হাড়টি বেশি বাঁকা। তা দ্বারাই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। ফলে সে বক্রতার আছর নারীর স্বভাবেও নিহিত আছে। এটা অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই।
বলাবাহুল্য, আল্লাহ তাআলা যাকে যেভাবে চান সৃষ্টি করেন। এতে কারও আপত্তি তোলার কোনও অবকাশ নেই। এমনিভাবে নারী স্বভাবে বক্রতা আছে বলে তাকে হেয়জ্ঞান করারও সুযোগ নেই। এটাও ভাবা সমীচীন নয় যে, এ কথা বলে নারীকে ছোট করা হয়েছে। সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটন দ্বারা কাউকে ছোট করা হয় না। হাঁ, আনুমানিক কথা বলা দোষ। কিন্তু এটা অনুমান নয়। নবী যা বলেন, ওহীর ভিত্তিতেই বলেন। ওহীর কথা সত্য ও সঠিক।
তবে নারী স্বভাবের বক্রতা পুরুষের পক্ষে এক পরীক্ষা বটে। নারীকে বলা হয়নি যে, তুমি সোজা হয়ে যাও। পুরুষকে বলা হয়েছে, তুমি তাকে সমঝে চল। তার প্রতি সদা সদাচরণ কর। এটা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপদেশ। উম্মতের জন্য তা মেনে চলা জরুরি। তা জরুরি এ কারণেও যে, এটা মেনে চলার দ্বারাই দাম্পত্যজীবন স্থায়ী হতে পারে এবং দাম্পত্যজীবন শান্তিপূর্ণ হতে পারে। হাদীছে আছে- فان ذهبت تقيمه كسرته وإن تركته لم يزل أعوج (কাজেই তুমি যদি সেটি সোজা করতে যাও তবে ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি সেটি ছেড়ে দাও তবে সর্বদা বাঁকাই থাকবে)। অর্থাৎ পাঁজরের হাড় যেমন সোজা করা যায় না, সোজা করতে গেলে ভেঙ্গে যাবে, তেমনি নারীস্বভাবকে সোজা করতে যাওয়ার চেষ্টা ভুল। সেই চেষ্টা করতে গেলে তাকে ভেঙ্গে ফেলা হবে। পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে ফেলার মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই; বরং কল্যাণ সেটি বাঁকা থাকার মধ্যেই। হাড়গুলো বাঁকা বলেই বক্ষপিঞ্জর তৈরি হতে পেরেছে, যা কিনা বুকের ভেতরকার অঙ্গগুলোকে সুরক্ষা দিয়েছে। বাঁকা না হলে তা দ্বারা এ কল্যাণ লাভ হত না। তদ্রূপ নারীস্বভাবের বক্রতাও কল্যাণকরই বটে। তার মধ্যকার কল্যাণ ততক্ষণই অর্জিত হবে, যতক্ষণ তা বাঁকা থাকবে। সে কথাই হাদীছে বলা হয়েছে যে, বুকের হাড় সোজা করতে গেলে ভেঙ্গে যাবে আর ছেড়ে দিলে বাঁকা থাকবে। বলাবাহুল্য বাঁকা থাকার দ্বারাই তার স্থায়ীত্ব বজায় থাকে। তদ্রূপ স্ত্রী-স্বভাবকে সোজা করতে গেলে ভেঙ্গে যাবে অর্থাৎ দাম্পত্যজীবনের বিপর্যয় ঘটবে এবং পরিস্থিতি তালাক পর্যন্ত গড়াবে। হাদীছে ভেঙ্গে ফেলার দ্বারা তালাক হয়ে যাওয়া বোঝানো হয়েছে। আর যদি যেমন আছে তেমনই রেখে দেওয়া হয়, তবে দাম্পত্যজীবন স্থায়ী হবে। সুতরাং দাম্পত্যজীবনের স্থায়ীত্বের স্বার্থে সোজা করার ইচ্ছাই পরিত্যাগ করতে হবে।
হাদীসে আছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন وإن استمتعت بها استمتعت وفيها عوج (তুমি তাকে সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে ফেলবে আর তুমি যদি তার দ্বারা উপকৃত হতে চাও, তবে তার মধ্যে বক্রতা থাকা অবস্থায়ই তার দ্বারা উপকৃত হতে পারবে)। অর্থাৎ তুমি যদি চাও দাম্পত্যজীবন শান্তিপূর্ণ হোক, কোনও ঝগড়াঝাটি না হোক, তোমার ঘর ও ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্রের হেফাজত হোক, তোমার অর্থ-সম্পদ ও কামাই-রোযগারে বরকত হোক, তোমার সন্তান-সন্ততি নেককার হোক, তাদের উত্তম পরিচর্যা হোক, তাদের বুনিয়াদী দীনী শিক্ষাদীক্ষা হোক, তারা ইসলামী আদব-কায়দায় অভ্যস্ত হোক এবং বিবাহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পুরোপুরি অর্জিত হোক, তবে তা ততক্ষণই সম্ভব হবে, যতক্ষণ তাকে তার বক্র অবস্থায়ই থাকতে দেবে।
হাদীসে আছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন 'সুতরাং তোমরা আমার নিকট থেকে নারীদের সম্পর্কে (সদ্ব্যবহার করার) উপদেশ গ্রহণ কর। অর্থাৎ তোমরা উল্লিখিত বক্তব্য অনুধাবন কর এবং সেমতে আমার উপদেশ অনুযায়ী স্ত্রীদের প্রতি সর্বদা সদাচরণ কর।
বস্তুত হাদীসে পুরুষকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে সে যেন তার স্ত্রীকে পুরোপুরি সোজা করার কথা না ভাবে। সে তাকে সরল সোজা আখলাক-চরিত্রের উপর নিয়ে আসতে চাইলে তাকে বরং বিগড়েই দেবে। তারচে' যেমন আছে তেমন রাখলে তার দ্বারা উপকৃত হতে পারবে। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, নারীচরিত্রের কিছুটা বক্রতা তার জন্য দোষের নয়, যেমন দোষের নয় পাজরের হাড় বাঁকা হওয়া। তাই পুরুষের জন্য সমীচীন নয় নারীর মধ্যে পুরুষ-চরিত্র খোঁজা। কেননা আল্লাহ তাআলা পুরুষ ও নারীর প্রত্যেককে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যা অপর শ্রেণীর মধ্যে পাওয়া যায় না।
প্রকাশ থাকে যে, নারীকে পাঁজরের হাড়ের সঙ্গে তুলনা করার অর্থ এ নয় যে, তাদেরকে সংশোধন করার চেষ্টা বা সৎকাজের আদেশ করা যাবে না। বোঝানো উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদেরকে সংশোধন করতে হবে নম্র-কোমল পন্থায়। এমন কঠোর পন্থা অবলম্বন করা যাবে না, যা তাদের ভেঙ্গে ফেলে অর্থাৎ বিগড়ে দেয়। সংশোধনের চেষ্টা একদম না করাটাও ঠিক নয়। তাতে বরং বক্রতা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। সংশোধনের চেষ্টা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই জরুরি। আল্লাহ তাআলা হুকুম দেন يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا 'হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা কর জাহান্নাম থেকে,
সুতরাং স্ত্রী যদি শর'ঈ কর্তব্য পালনে অবহেলা করে বা কোনও পাপকর্মে লিপ্ত থাকে, তবে অবশ্যই তাকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। এরকম বক্রতার উপর তাকে ছেড়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। এরূপ ক্ষেত্রে তাকে উপদেশ দেওয়া, তিরস্কার করা কিংবা লঘু মারারও অবকাশ আছে। ইরশাদ হয়েছে وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ ‘আর যে সকল স্ত্রীর ব্যাপারে তোমরা অবাধ্যতার আশঙ্কা কর, (প্রথমে) তাদেরকে বোঝাও এবং (তাতে কাজ না হলে) তাদেরকে শয়ন শয্যায় একা ছেড়ে দাও এবং (তাতেও সংশোধন না হলে) তাদেরকে প্রহার করতে পার।
হাঁ, শরীআত যা ওয়াজিব ও আবশ্যিক করেনি, এমন ক্ষেত্রে তাদের আচার আচরণ ও কথাবার্তা অপসন্দনীয় ও অপ্রীতিকর বোধ হলে সে ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া বাঞ্ছনীয়, যদি না তাতে সুস্পষ্ট কোনও ক্ষতি লক্ষ করা যায়।
মোটকথা হাদীসে স্ত্রীদেরকে সংশোধনের চেষ্টা করতে নিষেধ করা হয়নি। নিষেধ করা হয়েছে কেবল সংশোধনের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করতে। সেইসঙ্গে উৎসাহ দিচ্ছে যেন তাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করা হয়, তাদের প্রতি ক্ষমাসুন্দর আচরণ করা হয়, তাদের পক্ষ থেকে অপ্রীতিকর আচরণের ক্ষেত্রে সবরের পরিচয় দেওয়া হয় এবং হিকমত ও সহনশীলতার সঙ্গে সহাবস্থান করা হয়। এর মধ্যেই দাম্পত্যজীবনের সুখ শান্তি নিহিত। এটাই বিবাহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের পক্ষে বেশি সহায়ক।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
প্রত্যেক স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর প্রতি সর্বদা সদ্ভাব বজায় রাখা। এ বিষয়ে বিশেষভাবে উপদেশ দেওয়ার দ্বারা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
