আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪৮- নবীগণের আঃ আলোচনা
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৩৩২
২০০০. নবীগণের আলোচনা অধ্যায়ঃ আদম (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সন্তানদের সৃষ্টির বর্ণনা।
৩০৯৭। উমর ইবনে হাফস (রাহঃ) .... আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, সত্যবাদী-সত্যনিষ্ট হিসাবে স্বীকৃত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান স্বীয় মাতৃগর্ভে চল্লিশ দিন পর্যন্ত জমা রাখা হয়। এরপর অনুরূপভাবে (চল্লিশ দিনে) তা আলাকা (রক্তপিন্ড) রূপে পরিণত হয়। তারপর অনুরূপভাবে (চল্লিশ দিনে) তা গোশতের টুকরার রূপ লাভ করে। এরপর আল্লাহ তার কাছে চারটি বিষয়ের নির্দেশ নিয়ে একজন ফিরিশতা পাঠান। সে তার আমল, মৃত্যু, রিযক এবং সে কি পাপি হবে না পুণ্যবান হবে, এসব লিখে দেন। তারপর তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেয়া হয়।
(ভূমিষ্টের পর) এক ব্যক্তি একজন জাহান্নামীর আমলের ন্যায় আমল করতে থাকে এমনকি তার ও জাহান্নামের মধ্যে এক হাতের ব্যবধান থেকে যায়, এমন সময় তার ভাগ্যের লিখন এগিয়ে আসে। তখন সে জান্নাতবাসীদের আমলের ন্যায় আমল করে থাকে। ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করে। আর এক ব্যক্তি (প্রথম হতেই) জান্নাতবাসীদের আমলের অনুরূপ আমল করতে থাকে। এমন কি শেষ পর্যন্ত তার ও জান্নাতের মাঝে মাত্র এক হাতের ব্যবধান থেকে যায়। এমন সময় তার ভাগ্যের লিখন এগিয়ে আসে। তখন সে জাহান্নামীদের আমলের অনুরূপ আমল করে থাকে এবং পরিণতিতে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে।
(ভূমিষ্টের পর) এক ব্যক্তি একজন জাহান্নামীর আমলের ন্যায় আমল করতে থাকে এমনকি তার ও জাহান্নামের মধ্যে এক হাতের ব্যবধান থেকে যায়, এমন সময় তার ভাগ্যের লিখন এগিয়ে আসে। তখন সে জান্নাতবাসীদের আমলের ন্যায় আমল করে থাকে। ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করে। আর এক ব্যক্তি (প্রথম হতেই) জান্নাতবাসীদের আমলের অনুরূপ আমল করতে থাকে। এমন কি শেষ পর্যন্ত তার ও জান্নাতের মাঝে মাত্র এক হাতের ব্যবধান থেকে যায়। এমন সময় তার ভাগ্যের লিখন এগিয়ে আসে। তখন সে জাহান্নামীদের আমলের অনুরূপ আমল করে থাকে এবং পরিণতিতে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটি বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে الصادق المصدوق (মহা সত্যবাদী) বিশেষণের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
الصادق অর্থ সত্যবাদী, যিনি সত্য কথা বলেন, সত্য সংবাদ দেন, সত্য সাক্ষ্য দেন, সকল ক্ষেত্রে সত্যনিষ্ঠ থাকেন।
المصدوق অর্থ সত্যে সম্ভাষিত, যাকে লক্ষ্য করে সত্য বলা হয়েছে, যাকে সত্য ওয়াদা দেওয়া হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সত্যবাদী ছিলেন এবং আল্লাহ তাআলা তাঁকে যা কিছু বলেছেন সত্য বলেছেন। তাঁর উপর সত্যবাণী নাযিল করেছেন এবং তাঁর সঙ্গে যা-কিছু ওয়াদা করেছেন তা সত্যে পরিণত করেছেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. ছাড়াও আরও অনেক সাহাবী الصادق المصدوق (মহা সত্যবাদী) বিশেষণের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম নিয়েছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন হযরত মুগীরা ইবন শু'বা রাযি. হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. প্রমুখ।
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতৃগর্ভে মানবশিশুর বেড়ে উঠার যে পর্যায়ক্রম বর্ণনা করেছেন, তা আল্লাহ তাআলার কুদরত ও সৃষ্টিকৌশলের এক সুস্পষ্ট নিদর্শন। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَكِينٍ ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَحْمًا ثُمَّ أَنْشَأْنَاهُ خَلْقًا آخَرَ فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ
'আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির সারাংশ দ্বারা। তারপর তাকে স্খলিত বিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত স্থানে রাখি। তারপর আমি সেই বিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করি। তারপর সেই জমাট রক্তকে গোশতপিণ্ড বানিয়ে দিই। তারপর সেই গোশতপিণ্ডকে অস্থিতে রূপান্তরিত করি। তারপর অস্থিরাজিতে গোশতের আচ্ছাদন লাগিয়ে দিই। তারপর তাকে অন্য এক সৃষ্টিরূপে গড়ে তুলি। বস্তুত সকল কারিগরের শ্রেষ্ঠ কারিগর আল্লাহ কত মহান!
আল্লাহ তাআলা চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ মানবশিশুর রূপ দান করতে পারতেন। কিন্তু মায়ের প্রতি আসানীসহ আরও বহুবিধ কল্যাণার্থে এ পর্যায়ক্রমিক ধারা চালু করেছেন। যে ব্যক্তি তার সৃষ্টির উপর দৃষ্টিপাত করবে আর চিন্তা করবে কিভাবে সে এক তুচ্ছ শুক্রবিন্দু হতে ধাপে ধাপে এক সুন্দর সুদৃশ্য আকৃতির পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হলো, সেইসঙ্গে আকল-বুদ্ধি ও বাকশক্তিসহ বহুবিচিত্র শক্তি-ক্ষমতার সমাহারে এক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মাখলূকের মর্যাদা লাভ করল, সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ সৃষ্টিকর্তার অস্তিতৃস্বীকারে বাধ্য হবে এবং তাঁর কৃতজ্ঞতায় অবনমিত হয়ে কেবল তাঁরই ইবাদত বন্দেগী ও তাঁরই আনুগত্য করাকে নিজের জন্য অবধারিত করে নেবে।
সকলের জানা, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরক্ষর ছিলেন। বিশেষ কোনও বিদ্যা শেখেননি। বিশেষ কোনও শাস্ত্রীয় বই-পুস্তক কখনও পড়েননি। পড়তেই জানতেন না। কোনও শিক্ষকের সামনে জানু পেতে বসারই সুযোগ তাঁর কখনও হয়নি। তা সত্ত্বেও ভ্রূণ সম্পর্কিত জ্ঞান তিনি কোথায় পেলেন? সন্দেহ নেই এটা আল্লাহ তাআলার নিকট থেকেই পাওয়া। সুতরাং তিনি যে একজন সত্যনবী ছিলেন এবং আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে ওহী মারফত তিনি জ্ঞান লাভ করতেন, এ হাদীছটি তার এক উজ্জ্বল প্রমাণ।
তাকদীর লেখা সম্পর্কে কিছু কথা
এ হাদীছে বলা হয়েছে, ফিরিশতা মাতৃগর্ভে শিশুর চারটি বিষয় লিখে থাকে। বাহ্যত বোঝা যায় লেখার কোনও পাত্রেই তা লেখা হয়। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় স্পষ্টই আছে ثم تطوى الصحف، فلا يزاد فيها ولا ينقص ‘তারপর সহীফা (রেজিস্ট্রার) ভাঁজ করে ফেলা হয়। তাতে আর কিছু বাড়ানো ও কমানো হয় না।৩৪৭
কিন্তু হযরত আবূ যার রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে ثم يكتب بين عينيه ما هو لاق ‘তারপর তার দুই চোখের মাঝখানে (কপালে) লিখে দেয় সে যা-কিছুর সম্মুখীন হবে তা সব।৩৪৮
বাস্তবিকপক্ষে উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। হাদীছে বর্ণিত বিষয়গুলো যেমন কোনও রেজিস্ট্রারে লেখা হয়, তেমনি শিশুর ললাটেও লিখে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন হতে পারে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা তো জানা যায় তাকদীর লেখা হয়েছে মানবসৃষ্টির অনেক আগে, যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে كتب الله مقادير الخلائق قبل أن يخلق السماوات والأرض بخمسين ألف سنة “আল্লাহ মাখলুকাতের তাকদীর লিখেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।৩৪৯
উভয় বর্ণনা কি পরস্পরবিরোধী নয়?
উত্তর হলো, না, পরস্পরবিরোধী নয়। কেননা মুসলিম শরীফের এ হাদীছে যে তাকদীর লিখনের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে লাওহে মাহফূযের লেখা, যাকে ‘উম্মুল কিতাব'ও বলা হয়। সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা তাতে সমস্ত মাখলূক সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় লিপিবদ্ধ করেছেন। হযরত উবাদা ইবনুস সামিত রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে أول ما خلق الله : القلم، ثم قال له: أكتب قال: وما أكتب؟ قال: القدر، قال فكتب ما يكون وما هو كائن إلى أن تقوم الساعة “আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে জিনিস সৃষ্টি করেছেন তা হলো কলম। তাকে বললেন, লেখ। সে বলল, কী লিখব? বললেন, তাকদীর। তখন কলম কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত যা-কিছু ঘটবে সব লিখল।৩৫০
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা নিজ 'ইলম ও কুদরতে যা-কিছু সৃষ্টি করবেন বলে স্থির করেছেন এবং প্রত্যেক সৃষ্টির আনুষাঙ্গিক যা-কিছু নির্ধারণ করেছেন তা সব সে আদি কলম দ্বারা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সে লেখার কোনও পরিবর্তন নেই। এটি অপরিবর্তনীয় তাকদীর। তারপর ফিরিশতাদের দ্বারা মাতৃগর্ভে যে তাকদীর লেখানো হয় বলে আমাদের আলোচ্য এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, এটা স্বতন্ত্র লিখন, যা প্রত্যেক মানবশিশুর জন্য পৃথক পৃথকভাবে লেখা হয়ে থাকে। এ লেখায় পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকে। বিভিন্ন হাদীছে যে বিভিন্ন আমলের দ্বারা আয়ু বাড়া-কমার উল্লেখ পাওয়া যায়, তার সম্পর্কও এ লেখার সঙ্গেই। কুরআন মাজীদেও এর প্রতি ইশারা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ 'আল্লাহ যা চান (অর্থাৎ যে বিধানকে ইচ্ছা করেন) রহিত করে দেন এবং যা চান বলবৎ রাখেন। সমস্ত কিতাবের যা মূল, তা তাঁরই কাছে।৩৫১
মাতৃগর্ভে যে চারটি বিষয় লেখা হয়
এ হাদীছে যে চারটি জিনিস লেখা হয় বলে জানানো হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো রিযিক। এর দ্বারা আমাদেরকে পরিতুষ্টির গুণ অর্জনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের প্রত্যেকের রিযিক যখন নির্ধারিত আছে, তখন অহেতুক লোভ করো না। বাড়তি উপার্জনের জন্য উন্মত্ত হয়ে যেও না। চেষ্টা অবশ্যই করবে, তবে তাতে বাড়াবাড়ি করবে না। যখন যা অর্জিত হয় তাতে সন্তুষ্ট থাকবে। আরও কেন অর্জিত হলো না সে আক্ষেপ করবে না।
দুনিয়ায় কে কতদিন বাঁচবে তাও লিখে দেওয়া হয়। কাজেই যার যতদিন আয়ু সে ততদিনই বাঁচবে, তার বেশিও নয় কমও নয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ "যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে, তখন তারা এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারে না এবং ত্বরাও করতে পারে না।৩৫২
সুতরাং যার যখন মৃত্যু হয়, তা তার নির্দিষ্ট সময়ই হয়। তার প্রিয়জনদের উচিত আল্লাহ তাআলার ফয়সালা হিসেবে তা মেনে নেওয়া। এমন কোনও কথা বলা উচিত নয়, যা তাকদীর বা আল্লাহ তাআলার ফয়সালার বিরুদ্ধে অভিযোগ বলে মনে হয়।
বস্তুত তাকদীরের উপর বিশ্বাস রাখা ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। এ বিশ্বাস ছাড়া কেউ মুমিনই হতে পারে না। মৃত্যু তো বটেই, ছোটখাটো কোনও আঘাতও তাকদীরের লিখন ছাড়া হয় না। যে-কোনও অর্জন বা যে-কোনও ক্ষয় ও বিয়োগ তাকদীর অনুযায়ীই হয়ে থাকে। এতে বিশ্বাস রাখাতেই দুনিয়ার প্রশান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما بلغ عبد حقيقة الإيمان، حتى يعلم أن ما أصابه لم يكن ليخطئه، وما أخطأه لم يكن ليصيبه
“কোনও বান্দা ঈমানের প্রকৃত স্তরে পৌঁছতে পারে না, যতক্ষণ না সে মনেপ্রাণে জেনে নেয় যে, যা সে লাভ করেছে তা তার হারানোর ছিল না, আর যা সে হারিয়েছে তা তার পাওয়ার ছিল না।৩৫৩
প্রকাশ থাকে যে, তাকদীরের বিষয়টি আল্লাহ তাআলার এক গুপ্ত রহস্য। এর প্রকৃত স্বরূপ আল্লাহ তাআলাই জানেন। এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত নয়। ঘাঁটাঘাটি করলে এর কুলকিনারা পাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং তাতে অস্থিরতাই বাড়ে। এমনকি পদস্খলিত হওয়ারও যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। উলামায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা নিজ হিকমতে তাকদীরের জ্ঞান মানুষের থেকে আড়াল করে রেখেছেন। কারও আকল-বুদ্ধি তা আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন তাকদীরের আলোচনা আসে, তখন তোমরা ক্ষান্ত হয়ে যেও। বলা হয়ে থাকে, জান্নাতবাসীগণ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখনই তাদের কাছে তাকদীরের রহস্য উন্মোচিত হবে, তার আগে নয়।
এমনিভাবে লেখা হয়—–কে ভাগ্যবান আর কে হতভাগা তাও। এর মানে আমলও লেখা হয়। কেননা যার আমল ভালো সে জান্নাত লাভ করবে। আর যে জান্নাত লাভ করবে সেই ভাগ্যবান। যার আমল মন্দ সে জাহান্নামে যাবে। আর যে জাহান্নামে যাবে সেই হতভাগা।
জান্নাতলাভে আমলের ভূমিকা প্রসঙ্গ
বোঝা গেল জান্নাত ও জাহান্নামে প্রবেশের সঙ্গে আমলের সম্পর্ক আছে। যে ব্যক্তি জান্নাতে যাওয়ার আশা রাখে, তাকে অবশ্যই সৎকর্ম করতে হবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“নিশ্চয়ই যারা বলেছে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, তারপর এতে অবিচল থেকেছে, তাদের কোনও ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। তারা হবে জান্নাতবাসী। সেখানে তারা থাকবে সর্বদা। তারা যা করত তার প্রতিদানস্বরূপ।৩৫৪
অপর এক আয়াতে ইরশাদ سَلَامٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ 'তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা যে আমল করতে, তার ফলে জান্নাতে প্রবেশ কর।৩৫৫
এরকম আরও বহু আয়াত আছে, যা দ্বারা স্পষ্টই বোঝা যায়, জান্নাত দেওয়া হবে বান্দার আমলের প্রতিদানে। এ কথা ঠিক যে, কোনও কোনও হাদীছে এরকমও আছে যে, কেউ নিজ আমল দ্বারা মুক্তি পাবে না। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
«ما من أحد يدخله عمله الجنة»، فقيل: ولا أنت يا رسول الله؟ قال: «ولا أنا، إلا أن يتغمدني ربي برحمة»
“তোমাদের কাউকে তার আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকেও নয়? তিনি বললেন, আমাকেও নয়, যদি না আমার প্রতিপালক নিজ রহমত দ্বারা আমাকে আচ্ছন্ন করে নেন।৩৫৬
প্রকৃতপক্ষে আয়াতের সঙ্গে এ হাদীছের কোনও বিরোধ নেই। কেননা আয়াতে যে আমল দ্বারা জান্নাত পাওয়া যাবে বলে জানানো হয়েছে, সে আমল তো আল্লাহ তাআলার তাওফীক হলেই করা সম্ভব। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাওফীক লাভ হয় একান্তই তাঁর রহমত ও দয়ায়। তাছাড়া সৎকর্ম আল্লাহ তাআলার রহমত পাওয়ার অছিলাও বটে।
হাদীছটিতে বান্দার আমল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- فيسبق عليه الكتاب (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়ে যায়। তোমাদের একেকজন সারা জীবন জান্নাতবাসীদের আমলের মত আমল করতে থাকে, এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাতের দূরত্ব থাকে। ঠিক এ অবস্থায় (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়। তখন সে জাহান্নামবাসীদের আমলের মত আমল করতে শুরু করে। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। একই কথা বলা হয়েছে জাহান্নামীদের সম্পর্কেও।
এর অর্থ হলো, বান্দার চালিয়ে যাওয়া আমল এবং তার সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য সম্পর্কিত লিখনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। তাতে লিখন জয়ী হয়ে যায়। তারপর বান্দা সে লিখন অনুযায়ীই আমল করতে থাকে। এটিকেই فيسبق عليه الكتاب (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়ে যায়' বাক্যে ব্যক্ত করা হয়েছে। কেননা প্রতিযোগিতায় যে অগ্রগামী হয়, সেই তার উদ্দেশ্যে সফল হয়। যে পেছনে পড়ে যায় সে সফল হতে পারে না। বিষয়টি এভাবে বোঝা যেতে পারে যে, আমল ও লিখনকে যদি পৃথক দুই ব্যক্তি কল্পনা করা হয় আর তারা দু'জন দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তবে সেই দৌড়ে ‘লিখন' নামক ব্যক্তি আগে চলে যাবে এবং 'আমল' নামক ব্যক্তি পেছনে পড়ে থাকবে।
মৃত্যু নেক আমলের অবস্থায় হওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ
এর দ্বারা বোঝা গেল শেষ সময়ের আমলই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমদিকে যত ভালো আমলই করুক, যদি নেক আমলের অবস্থায় মৃত্যু না হয়, তবে তার পরিণাম অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। তাই মনে খুব ভয় রাখা দরকার। বর্তমান ভালো অবস্থার কারণে গর্বিত হওয়া বা আত্মমুগ্ধতায় ভোগার কোনও সুযোগ নেই। তাই তো এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا عليكم أن لا تعجبوا بأحد، حتى تنظروا بم يختم له، فإن العامل يعمل زمانا من عمره، أو برهة من دهره، بعمل صالح، لو مات عليه دخل الجنة، ثم يتحول فيعمل عملا سيئا، وإن العبد ليعمل البرهة من دهره بعمل سيئ، لو مات عليه دخل النار، ثم يتحول فيعمل عملا صالحا، وإذا أراد الله بعبد خيرا استعمله قبل موته»، قالوا: يا رسول الله، وكيف يستعمله؟ قال: «يوفقه لعمل صالح، ثم يقبضه عليه.
“তোমরা কারও আমল দেখে আশ্চর্যবোধ করো না, যতক্ষণ না দেখতে পাও তার মৃত্যু কোন আমলের উপর হয়। কেননা কোনও কোনও আমলকারী জীবনভর বা জীবনের দীর্ঘ একটা কাল সৎকর্মে রত থাকে। যদি ওই অবস্থায় সে মারা যেত, অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করত। কিন্তু পরে তার অবস্থার পরিবর্তন হয় এবং সে অসৎকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এমনিভাবে কোনও কোনও বান্দা জীবনের একটা দীর্ঘকাল অসৎকর্মে লিপ্ত থাকে। সেই অবস্থায় মারা গেলে অবশ্যই জাহান্নামে যেত। পরে তার পরিবর্তন ঘটে। সে সৎকর্মে লিপ্ত হয়। আল্লাহ তাআলা তার যে বান্দার কল্যাণ চান, তাকে তার মৃত্যুর আগে আমলে লাগিয়ে দেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিভাবে আমলে লাগান? তিনি বললেন, তাকে সৎকর্মের তাওফীক দেন। তারপর সে অবস্থায় তাকে মৃত্যু দেন।৩৫৭
মৃত্যুর আগে যেহেতু অবস্থা পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, তাই যাদেরই নেক আমলের তাওফীক লাভ হয়, তাদের আল্লাহ তাআলার কাছে এ দুআ করাও জরুরি যেন তিনি মৃত্যু পর্যন্ত সে তাওফীক জারি রাখেন এবং সর্বাবস্থায় সৎকর্মে অবিচল থাকতে সাহায্য করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ শিক্ষা দিয়েছেন يا مقلب القلوب ثبت قلبي على دينك “হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আপনি আমার অন্তর আপনার দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন।'রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ দুআ খুব বেশি পড়তেন।৩৫৮
উল্লেখ্য, এ হাদীছটি মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের সত্যতার পক্ষে এক শক্তিশালী দলীল। কেননা যে মহান আল্লাহ মাতৃগর্ভে তুচ্ছ শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে, তারপর মাংসপিণ্ডে, তারপর সুবিন্যস্ত অস্থিকাঠামোয় পূর্ণাঙ্গ মানবরূপ দিয়ে তার ভেতর রূহ ফুঁকে দিতে পারেন, তারপর তার মধ্যে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বহুবিচিত্র গুণের সমাহার ঘটিয়ে এ নশ্বর জগতে নিয়ে আসতে পারেন, তিনি তাকে তার মৃত্যুর পর বিচূর্ণ বিক্ষিপ্ত অংশসমূহ একত্র করে পুনর্জীবিত করতে পারবেন না কেন? নিশ্চয়ই পারবেন। মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার পক্ষে কোনওকিছুই অসম্ভব নয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. তাকদীরের লিখন সত্য। মানুষের রিযিক, আয়ু সবই লেখা আছে।
খ. রিযিক ও অর্থ-সম্পদের জন্য লোভ-লালসা না করে আপন অবস্থায় পরিতুষ্ট থাকা ও পরিমিত চেষ্টা করাই কাম্য।
গ. প্রিয়জনের মৃত্যুতে তাকদীর-বিরোধী অনুচিত মন্তব্য করা হতে বিরত থেকে আল্লাহর ফয়সালায় রাজি থাকাই ঈমানের দাবি।
ঘ. আল্লাহ তাআলার রহমত ও জান্নাতলাভের জন্য আমল সহায়ক। তাই আমলে অবহেলা উচিত নয়।
ঙ. নিজের বা অন্যের আপাতকালীন আমল দেখে ধোঁকায় পড়া উচিত নয়। যে-কারও ভালো আমল শেষটায় মন্দ আমলে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার যে-কোনও মন্দ আমলকারীও শেষটায় ভালো আমলে মনোযোগী হতে পারে বলে আশা থাকে।
চ. নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও মাতৃগর্ভে ভ্রূণের পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধি সম্পর্কে সংবাদ দেওয়াটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতার পক্ষে একটি মজবুত দলীল।
ছ. এ হাদীছ দ্বারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সম্পর্কেও ধারণা মেলে।
৩৪৬. সূরা মু'মিনূন (২৩), আয়াত ১২-১৪
৩৪৭. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৪৪; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৮৪৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬১৪২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩০৩৮, তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ২৬৬৩
৩৪৮. সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬১৭৮; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৫৭৭৫
৩৪৯. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৫৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৫৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৫৭৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৬১৩৮: তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮০
৩৫০. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৩১৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৭০৭; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৭০০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১২২২৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৭০৩
৩৫১. সূরা রা'দ (১৩), আয়াত ৩৯
৩৫২. সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৩৪
৩৫৩. তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৬০৬০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৪৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৪৪; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২১০
৩৫৪. সূরা আহকাফ (৪৬), আয়াত ১৩-১৪
৩৫৫. সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৩২
৩৫৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৪৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮১৬; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭২১৮
৩৫৭. মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২২১৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৩৭৫৬
৩৫৮. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৪০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৩৮৩৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২১০৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৯১৯৬; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৬৮৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৫৯; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪২; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ২৩১৮
الصادق অর্থ সত্যবাদী, যিনি সত্য কথা বলেন, সত্য সংবাদ দেন, সত্য সাক্ষ্য দেন, সকল ক্ষেত্রে সত্যনিষ্ঠ থাকেন।
المصدوق অর্থ সত্যে সম্ভাষিত, যাকে লক্ষ্য করে সত্য বলা হয়েছে, যাকে সত্য ওয়াদা দেওয়া হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সত্যবাদী ছিলেন এবং আল্লাহ তাআলা তাঁকে যা কিছু বলেছেন সত্য বলেছেন। তাঁর উপর সত্যবাণী নাযিল করেছেন এবং তাঁর সঙ্গে যা-কিছু ওয়াদা করেছেন তা সত্যে পরিণত করেছেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. ছাড়াও আরও অনেক সাহাবী الصادق المصدوق (মহা সত্যবাদী) বিশেষণের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম নিয়েছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন হযরত মুগীরা ইবন শু'বা রাযি. হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. প্রমুখ।
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতৃগর্ভে মানবশিশুর বেড়ে উঠার যে পর্যায়ক্রম বর্ণনা করেছেন, তা আল্লাহ তাআলার কুদরত ও সৃষ্টিকৌশলের এক সুস্পষ্ট নিদর্শন। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَكِينٍ ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَحْمًا ثُمَّ أَنْشَأْنَاهُ خَلْقًا آخَرَ فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ
'আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির সারাংশ দ্বারা। তারপর তাকে স্খলিত বিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত স্থানে রাখি। তারপর আমি সেই বিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করি। তারপর সেই জমাট রক্তকে গোশতপিণ্ড বানিয়ে দিই। তারপর সেই গোশতপিণ্ডকে অস্থিতে রূপান্তরিত করি। তারপর অস্থিরাজিতে গোশতের আচ্ছাদন লাগিয়ে দিই। তারপর তাকে অন্য এক সৃষ্টিরূপে গড়ে তুলি। বস্তুত সকল কারিগরের শ্রেষ্ঠ কারিগর আল্লাহ কত মহান!
আল্লাহ তাআলা চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ মানবশিশুর রূপ দান করতে পারতেন। কিন্তু মায়ের প্রতি আসানীসহ আরও বহুবিধ কল্যাণার্থে এ পর্যায়ক্রমিক ধারা চালু করেছেন। যে ব্যক্তি তার সৃষ্টির উপর দৃষ্টিপাত করবে আর চিন্তা করবে কিভাবে সে এক তুচ্ছ শুক্রবিন্দু হতে ধাপে ধাপে এক সুন্দর সুদৃশ্য আকৃতির পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হলো, সেইসঙ্গে আকল-বুদ্ধি ও বাকশক্তিসহ বহুবিচিত্র শক্তি-ক্ষমতার সমাহারে এক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মাখলূকের মর্যাদা লাভ করল, সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ সৃষ্টিকর্তার অস্তিতৃস্বীকারে বাধ্য হবে এবং তাঁর কৃতজ্ঞতায় অবনমিত হয়ে কেবল তাঁরই ইবাদত বন্দেগী ও তাঁরই আনুগত্য করাকে নিজের জন্য অবধারিত করে নেবে।
সকলের জানা, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরক্ষর ছিলেন। বিশেষ কোনও বিদ্যা শেখেননি। বিশেষ কোনও শাস্ত্রীয় বই-পুস্তক কখনও পড়েননি। পড়তেই জানতেন না। কোনও শিক্ষকের সামনে জানু পেতে বসারই সুযোগ তাঁর কখনও হয়নি। তা সত্ত্বেও ভ্রূণ সম্পর্কিত জ্ঞান তিনি কোথায় পেলেন? সন্দেহ নেই এটা আল্লাহ তাআলার নিকট থেকেই পাওয়া। সুতরাং তিনি যে একজন সত্যনবী ছিলেন এবং আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে ওহী মারফত তিনি জ্ঞান লাভ করতেন, এ হাদীছটি তার এক উজ্জ্বল প্রমাণ।
তাকদীর লেখা সম্পর্কে কিছু কথা
এ হাদীছে বলা হয়েছে, ফিরিশতা মাতৃগর্ভে শিশুর চারটি বিষয় লিখে থাকে। বাহ্যত বোঝা যায় লেখার কোনও পাত্রেই তা লেখা হয়। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় স্পষ্টই আছে ثم تطوى الصحف، فلا يزاد فيها ولا ينقص ‘তারপর সহীফা (রেজিস্ট্রার) ভাঁজ করে ফেলা হয়। তাতে আর কিছু বাড়ানো ও কমানো হয় না।৩৪৭
কিন্তু হযরত আবূ যার রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে ثم يكتب بين عينيه ما هو لاق ‘তারপর তার দুই চোখের মাঝখানে (কপালে) লিখে দেয় সে যা-কিছুর সম্মুখীন হবে তা সব।৩৪৮
বাস্তবিকপক্ষে উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। হাদীছে বর্ণিত বিষয়গুলো যেমন কোনও রেজিস্ট্রারে লেখা হয়, তেমনি শিশুর ললাটেও লিখে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন হতে পারে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা তো জানা যায় তাকদীর লেখা হয়েছে মানবসৃষ্টির অনেক আগে, যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে كتب الله مقادير الخلائق قبل أن يخلق السماوات والأرض بخمسين ألف سنة “আল্লাহ মাখলুকাতের তাকদীর লিখেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।৩৪৯
উভয় বর্ণনা কি পরস্পরবিরোধী নয়?
উত্তর হলো, না, পরস্পরবিরোধী নয়। কেননা মুসলিম শরীফের এ হাদীছে যে তাকদীর লিখনের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে লাওহে মাহফূযের লেখা, যাকে ‘উম্মুল কিতাব'ও বলা হয়। সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা তাতে সমস্ত মাখলূক সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় লিপিবদ্ধ করেছেন। হযরত উবাদা ইবনুস সামিত রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে أول ما خلق الله : القلم، ثم قال له: أكتب قال: وما أكتب؟ قال: القدر، قال فكتب ما يكون وما هو كائن إلى أن تقوم الساعة “আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে জিনিস সৃষ্টি করেছেন তা হলো কলম। তাকে বললেন, লেখ। সে বলল, কী লিখব? বললেন, তাকদীর। তখন কলম কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত যা-কিছু ঘটবে সব লিখল।৩৫০
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা নিজ 'ইলম ও কুদরতে যা-কিছু সৃষ্টি করবেন বলে স্থির করেছেন এবং প্রত্যেক সৃষ্টির আনুষাঙ্গিক যা-কিছু নির্ধারণ করেছেন তা সব সে আদি কলম দ্বারা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সে লেখার কোনও পরিবর্তন নেই। এটি অপরিবর্তনীয় তাকদীর। তারপর ফিরিশতাদের দ্বারা মাতৃগর্ভে যে তাকদীর লেখানো হয় বলে আমাদের আলোচ্য এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, এটা স্বতন্ত্র লিখন, যা প্রত্যেক মানবশিশুর জন্য পৃথক পৃথকভাবে লেখা হয়ে থাকে। এ লেখায় পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকে। বিভিন্ন হাদীছে যে বিভিন্ন আমলের দ্বারা আয়ু বাড়া-কমার উল্লেখ পাওয়া যায়, তার সম্পর্কও এ লেখার সঙ্গেই। কুরআন মাজীদেও এর প্রতি ইশারা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ 'আল্লাহ যা চান (অর্থাৎ যে বিধানকে ইচ্ছা করেন) রহিত করে দেন এবং যা চান বলবৎ রাখেন। সমস্ত কিতাবের যা মূল, তা তাঁরই কাছে।৩৫১
মাতৃগর্ভে যে চারটি বিষয় লেখা হয়
এ হাদীছে যে চারটি জিনিস লেখা হয় বলে জানানো হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো রিযিক। এর দ্বারা আমাদেরকে পরিতুষ্টির গুণ অর্জনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের প্রত্যেকের রিযিক যখন নির্ধারিত আছে, তখন অহেতুক লোভ করো না। বাড়তি উপার্জনের জন্য উন্মত্ত হয়ে যেও না। চেষ্টা অবশ্যই করবে, তবে তাতে বাড়াবাড়ি করবে না। যখন যা অর্জিত হয় তাতে সন্তুষ্ট থাকবে। আরও কেন অর্জিত হলো না সে আক্ষেপ করবে না।
দুনিয়ায় কে কতদিন বাঁচবে তাও লিখে দেওয়া হয়। কাজেই যার যতদিন আয়ু সে ততদিনই বাঁচবে, তার বেশিও নয় কমও নয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ "যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে, তখন তারা এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারে না এবং ত্বরাও করতে পারে না।৩৫২
সুতরাং যার যখন মৃত্যু হয়, তা তার নির্দিষ্ট সময়ই হয়। তার প্রিয়জনদের উচিত আল্লাহ তাআলার ফয়সালা হিসেবে তা মেনে নেওয়া। এমন কোনও কথা বলা উচিত নয়, যা তাকদীর বা আল্লাহ তাআলার ফয়সালার বিরুদ্ধে অভিযোগ বলে মনে হয়।
বস্তুত তাকদীরের উপর বিশ্বাস রাখা ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। এ বিশ্বাস ছাড়া কেউ মুমিনই হতে পারে না। মৃত্যু তো বটেই, ছোটখাটো কোনও আঘাতও তাকদীরের লিখন ছাড়া হয় না। যে-কোনও অর্জন বা যে-কোনও ক্ষয় ও বিয়োগ তাকদীর অনুযায়ীই হয়ে থাকে। এতে বিশ্বাস রাখাতেই দুনিয়ার প্রশান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما بلغ عبد حقيقة الإيمان، حتى يعلم أن ما أصابه لم يكن ليخطئه، وما أخطأه لم يكن ليصيبه
“কোনও বান্দা ঈমানের প্রকৃত স্তরে পৌঁছতে পারে না, যতক্ষণ না সে মনেপ্রাণে জেনে নেয় যে, যা সে লাভ করেছে তা তার হারানোর ছিল না, আর যা সে হারিয়েছে তা তার পাওয়ার ছিল না।৩৫৩
প্রকাশ থাকে যে, তাকদীরের বিষয়টি আল্লাহ তাআলার এক গুপ্ত রহস্য। এর প্রকৃত স্বরূপ আল্লাহ তাআলাই জানেন। এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত নয়। ঘাঁটাঘাটি করলে এর কুলকিনারা পাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং তাতে অস্থিরতাই বাড়ে। এমনকি পদস্খলিত হওয়ারও যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। উলামায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা নিজ হিকমতে তাকদীরের জ্ঞান মানুষের থেকে আড়াল করে রেখেছেন। কারও আকল-বুদ্ধি তা আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন তাকদীরের আলোচনা আসে, তখন তোমরা ক্ষান্ত হয়ে যেও। বলা হয়ে থাকে, জান্নাতবাসীগণ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখনই তাদের কাছে তাকদীরের রহস্য উন্মোচিত হবে, তার আগে নয়।
এমনিভাবে লেখা হয়—–কে ভাগ্যবান আর কে হতভাগা তাও। এর মানে আমলও লেখা হয়। কেননা যার আমল ভালো সে জান্নাত লাভ করবে। আর যে জান্নাত লাভ করবে সেই ভাগ্যবান। যার আমল মন্দ সে জাহান্নামে যাবে। আর যে জাহান্নামে যাবে সেই হতভাগা।
জান্নাতলাভে আমলের ভূমিকা প্রসঙ্গ
বোঝা গেল জান্নাত ও জাহান্নামে প্রবেশের সঙ্গে আমলের সম্পর্ক আছে। যে ব্যক্তি জান্নাতে যাওয়ার আশা রাখে, তাকে অবশ্যই সৎকর্ম করতে হবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“নিশ্চয়ই যারা বলেছে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, তারপর এতে অবিচল থেকেছে, তাদের কোনও ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। তারা হবে জান্নাতবাসী। সেখানে তারা থাকবে সর্বদা। তারা যা করত তার প্রতিদানস্বরূপ।৩৫৪
অপর এক আয়াতে ইরশাদ سَلَامٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ 'তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা যে আমল করতে, তার ফলে জান্নাতে প্রবেশ কর।৩৫৫
এরকম আরও বহু আয়াত আছে, যা দ্বারা স্পষ্টই বোঝা যায়, জান্নাত দেওয়া হবে বান্দার আমলের প্রতিদানে। এ কথা ঠিক যে, কোনও কোনও হাদীছে এরকমও আছে যে, কেউ নিজ আমল দ্বারা মুক্তি পাবে না। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
«ما من أحد يدخله عمله الجنة»، فقيل: ولا أنت يا رسول الله؟ قال: «ولا أنا، إلا أن يتغمدني ربي برحمة»
“তোমাদের কাউকে তার আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকেও নয়? তিনি বললেন, আমাকেও নয়, যদি না আমার প্রতিপালক নিজ রহমত দ্বারা আমাকে আচ্ছন্ন করে নেন।৩৫৬
প্রকৃতপক্ষে আয়াতের সঙ্গে এ হাদীছের কোনও বিরোধ নেই। কেননা আয়াতে যে আমল দ্বারা জান্নাত পাওয়া যাবে বলে জানানো হয়েছে, সে আমল তো আল্লাহ তাআলার তাওফীক হলেই করা সম্ভব। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাওফীক লাভ হয় একান্তই তাঁর রহমত ও দয়ায়। তাছাড়া সৎকর্ম আল্লাহ তাআলার রহমত পাওয়ার অছিলাও বটে।
হাদীছটিতে বান্দার আমল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- فيسبق عليه الكتاب (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়ে যায়। তোমাদের একেকজন সারা জীবন জান্নাতবাসীদের আমলের মত আমল করতে থাকে, এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাতের দূরত্ব থাকে। ঠিক এ অবস্থায় (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়। তখন সে জাহান্নামবাসীদের আমলের মত আমল করতে শুরু করে। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। একই কথা বলা হয়েছে জাহান্নামীদের সম্পর্কেও।
এর অর্থ হলো, বান্দার চালিয়ে যাওয়া আমল এবং তার সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য সম্পর্কিত লিখনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। তাতে লিখন জয়ী হয়ে যায়। তারপর বান্দা সে লিখন অনুযায়ীই আমল করতে থাকে। এটিকেই فيسبق عليه الكتاب (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়ে যায়' বাক্যে ব্যক্ত করা হয়েছে। কেননা প্রতিযোগিতায় যে অগ্রগামী হয়, সেই তার উদ্দেশ্যে সফল হয়। যে পেছনে পড়ে যায় সে সফল হতে পারে না। বিষয়টি এভাবে বোঝা যেতে পারে যে, আমল ও লিখনকে যদি পৃথক দুই ব্যক্তি কল্পনা করা হয় আর তারা দু'জন দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তবে সেই দৌড়ে ‘লিখন' নামক ব্যক্তি আগে চলে যাবে এবং 'আমল' নামক ব্যক্তি পেছনে পড়ে থাকবে।
মৃত্যু নেক আমলের অবস্থায় হওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ
এর দ্বারা বোঝা গেল শেষ সময়ের আমলই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমদিকে যত ভালো আমলই করুক, যদি নেক আমলের অবস্থায় মৃত্যু না হয়, তবে তার পরিণাম অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। তাই মনে খুব ভয় রাখা দরকার। বর্তমান ভালো অবস্থার কারণে গর্বিত হওয়া বা আত্মমুগ্ধতায় ভোগার কোনও সুযোগ নেই। তাই তো এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا عليكم أن لا تعجبوا بأحد، حتى تنظروا بم يختم له، فإن العامل يعمل زمانا من عمره، أو برهة من دهره، بعمل صالح، لو مات عليه دخل الجنة، ثم يتحول فيعمل عملا سيئا، وإن العبد ليعمل البرهة من دهره بعمل سيئ، لو مات عليه دخل النار، ثم يتحول فيعمل عملا صالحا، وإذا أراد الله بعبد خيرا استعمله قبل موته»، قالوا: يا رسول الله، وكيف يستعمله؟ قال: «يوفقه لعمل صالح، ثم يقبضه عليه.
“তোমরা কারও আমল দেখে আশ্চর্যবোধ করো না, যতক্ষণ না দেখতে পাও তার মৃত্যু কোন আমলের উপর হয়। কেননা কোনও কোনও আমলকারী জীবনভর বা জীবনের দীর্ঘ একটা কাল সৎকর্মে রত থাকে। যদি ওই অবস্থায় সে মারা যেত, অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করত। কিন্তু পরে তার অবস্থার পরিবর্তন হয় এবং সে অসৎকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এমনিভাবে কোনও কোনও বান্দা জীবনের একটা দীর্ঘকাল অসৎকর্মে লিপ্ত থাকে। সেই অবস্থায় মারা গেলে অবশ্যই জাহান্নামে যেত। পরে তার পরিবর্তন ঘটে। সে সৎকর্মে লিপ্ত হয়। আল্লাহ তাআলা তার যে বান্দার কল্যাণ চান, তাকে তার মৃত্যুর আগে আমলে লাগিয়ে দেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিভাবে আমলে লাগান? তিনি বললেন, তাকে সৎকর্মের তাওফীক দেন। তারপর সে অবস্থায় তাকে মৃত্যু দেন।৩৫৭
মৃত্যুর আগে যেহেতু অবস্থা পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, তাই যাদেরই নেক আমলের তাওফীক লাভ হয়, তাদের আল্লাহ তাআলার কাছে এ দুআ করাও জরুরি যেন তিনি মৃত্যু পর্যন্ত সে তাওফীক জারি রাখেন এবং সর্বাবস্থায় সৎকর্মে অবিচল থাকতে সাহায্য করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ শিক্ষা দিয়েছেন يا مقلب القلوب ثبت قلبي على دينك “হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আপনি আমার অন্তর আপনার দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন।'রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ দুআ খুব বেশি পড়তেন।৩৫৮
উল্লেখ্য, এ হাদীছটি মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের সত্যতার পক্ষে এক শক্তিশালী দলীল। কেননা যে মহান আল্লাহ মাতৃগর্ভে তুচ্ছ শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে, তারপর মাংসপিণ্ডে, তারপর সুবিন্যস্ত অস্থিকাঠামোয় পূর্ণাঙ্গ মানবরূপ দিয়ে তার ভেতর রূহ ফুঁকে দিতে পারেন, তারপর তার মধ্যে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বহুবিচিত্র গুণের সমাহার ঘটিয়ে এ নশ্বর জগতে নিয়ে আসতে পারেন, তিনি তাকে তার মৃত্যুর পর বিচূর্ণ বিক্ষিপ্ত অংশসমূহ একত্র করে পুনর্জীবিত করতে পারবেন না কেন? নিশ্চয়ই পারবেন। মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার পক্ষে কোনওকিছুই অসম্ভব নয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. তাকদীরের লিখন সত্য। মানুষের রিযিক, আয়ু সবই লেখা আছে।
খ. রিযিক ও অর্থ-সম্পদের জন্য লোভ-লালসা না করে আপন অবস্থায় পরিতুষ্ট থাকা ও পরিমিত চেষ্টা করাই কাম্য।
গ. প্রিয়জনের মৃত্যুতে তাকদীর-বিরোধী অনুচিত মন্তব্য করা হতে বিরত থেকে আল্লাহর ফয়সালায় রাজি থাকাই ঈমানের দাবি।
ঘ. আল্লাহ তাআলার রহমত ও জান্নাতলাভের জন্য আমল সহায়ক। তাই আমলে অবহেলা উচিত নয়।
ঙ. নিজের বা অন্যের আপাতকালীন আমল দেখে ধোঁকায় পড়া উচিত নয়। যে-কারও ভালো আমল শেষটায় মন্দ আমলে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার যে-কোনও মন্দ আমলকারীও শেষটায় ভালো আমলে মনোযোগী হতে পারে বলে আশা থাকে।
চ. নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও মাতৃগর্ভে ভ্রূণের পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধি সম্পর্কে সংবাদ দেওয়াটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতার পক্ষে একটি মজবুত দলীল।
ছ. এ হাদীছ দ্বারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সম্পর্কেও ধারণা মেলে।
৩৪৬. সূরা মু'মিনূন (২৩), আয়াত ১২-১৪
৩৪৭. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৪৪; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৮৪৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬১৪২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩০৩৮, তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ২৬৬৩
৩৪৮. সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬১৭৮; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৫৭৭৫
৩৪৯. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৫৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৫৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৫৭৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৬১৩৮: তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮০
৩৫০. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৩১৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৭০৭; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৭০০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১২২২৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৭০৩
৩৫১. সূরা রা'দ (১৩), আয়াত ৩৯
৩৫২. সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৩৪
৩৫৩. তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৬০৬০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৪৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৪৪; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২১০
৩৫৪. সূরা আহকাফ (৪৬), আয়াত ১৩-১৪
৩৫৫. সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৩২
৩৫৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৪৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮১৬; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭২১৮
৩৫৭. মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২২১৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৩৭৫৬
৩৫৮. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৪০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৩৮৩৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২১০৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৯১৯৬; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৬৮৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৫৯; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪২; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ২৩১৮
