আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪৭- সৃষ্টি জগতের সূচনা
৩০৩৯। আলী (রাহঃ) .... আবু ওয়াইল (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উসামা (রাযিঃ)- কে বলা হল, কত ভাল হত! যদি আপনি ঐ ব্যক্তির (উসমান) (রাযিঃ)- এর কাছে যেতেন এবং তাঁর সঙ্গে (বিদ্রোহ দমনের বিষয়ে) আলোচনা করতেন। উত্তরে তিনি বললেন, আপনারা মনে করেছেন যে, আমি তার সঙ্গে (বিদ্রোহ দমনের ব্যাপারে) আপনাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলব। অথচ আমি তাঁর সঙ্গে (দাঙ্গা দমনের ব্যাপারে) গোপনে আলোচনা করছি, যেন আমি (বিদ্রোহের) একটি দ্বার খুলে না বসি। (এ বিদ্রোহের) আমি দ্বার উন্মুক্তকারীর প্রথম ব্যক্তি হতে চাই না। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কিছু শুনেছি, যার পরে আমি কোন ব্যক্তিকে যিনি আমাদের আমীর নির্বাচিত হয়েছেন সে জন্য তিনি আমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তি এ কথা বলতে পারি না।
লোকেরা তাঁকে বলল, আপনি তাঁকে কি বলতে শুনেছেন? উসামা (রাযিঃ) বললেন, আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আনয়ন করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে ফেলা দেয়া হবে। তখন আগুনে পুঁড়ে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। এ সময় সে এমন ভাবে ঘুরতে থাকবে যেমন গাধা তার চাকা নিয়ে তার চারপাশে ঘুরতে থাকে। তখন জাহান্নামবাসীরা তার কছে একত্রিত হয়ে তাকে বলবে, হে অমুক ব্যক্তি! তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি না আমাদিগকে সৎকাজের আদেশ করতে আর অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করতে? সে বলবে, আমি তোমাদেরকে সৎকাজে আদেশ করতাম বটে, কিন্তু আমি তা করতাম না, আর আমি তোমাদেরকে অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করতাম, অথচ আমিই তা করতাম। এ হাদীসটি গুনদার (রাহঃ) শুবা (রাহঃ) সূত্রে আমাশ (রাহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
অন্যকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে নিজে তার বিপরীত করার কঠিন শাস্তি 'আমর বিল মা'রূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার তথা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব এজন্যই দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষ অসৎকাজ ছেড়ে দিয়ে সৎকাজে লিপ্ত হয়, এককথায় তারা শরী'আতের ওপর চলে। এ দায়িত্ব কোনও বিনোদনমূলক শিল্প নয় যে, কিছু লোক যত্নের সাথে এটা শিখবে, তারপর সুন্দর উপস্থাপনা ও আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গি দ্বারা তা মঞ্চস্থ করে দর্শক ও শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করবে। বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সংশোধন ও তাদের আমল-আখলাকের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদেরকে আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত বান্দারূপে গড়ে তোলা, যাতে তারা আখিরাতে জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে জান্নাত লাভের উপযুক্ত হতে পারে। আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত বান্দা হয়ে ওঠা যেমন দর্শক ও শ্রোতার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বক্তার নিজেরও। যাকে সৎকাজের আদেশ করা হবে তার যেমন সৎকাজ করা দরকার, তেমনি তা দরকার আদেশদাতারও। অসৎকাজ থেকে বিরত থাকা যেমন অসৎ কাজকারীরও দরকার, তেমনি দরকার যে ব্যক্তি তাকে নিষেধ করবে তারও। সুতরাং যারা 'আমর বিল মারূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার'-এর দায়িত্ব পালন করবে, তাদের নিজেদেরও কর্তব্য সৎকাজ আঞ্জাম দেওয়া ও অসৎকাজ থেকে বিরত থাকায় যত্নবান হওয়া। এ ব্যাপারে তাদের যত্নবান হওয়ার প্রয়োজন এ কারণেও যে, নিজের আমল ঠিক না থাকলে আদেশ-নিষেধের বিশেষ আছর হয় না। বরং যাদেরকে আদেশ-নিষেধ করা হয় তারা এটাকে তামাশা হিসেবে দেখে এবং মনে মনে তিরস্কার করে যে, এহ্, নিজে আমল করে না আবার অন্যকে নসীহত করে বেড়ায়। এমনকি আমলবিহীন বক্তার বক্তব্যে অন্যরা আমলের প্রতি উৎসাহী তো হয়ই না; উল্টো তাদের অন্তর থেকে আমলের গুরুত্ব হালকা হয়ে যায়। এটা তো অতি গুরুতর ব্যাপার হল যে, যে ওয়াজ-নসীহতের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে আমলওয়ালা বানানো, উল্টো তা তাদের আমলবিমুখ হওয়ার কারণ হয়ে গেল। নিশ্চয়ই এ জাতীয় ওয়াজ-নসীহত করা অপেক্ষা না করাই ভালো। তাই কুরআন ও হাদীছে এ জাতীয় ওয়াজ-নসীহতের কঠোর নিন্দা করা হয়েছে এবং আখিরাতে এরূপ লোকদের কঠিন শাস্তিতে নিপতিত হওয়ার সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, ওয়াজ-নসীহতের জন্য নিজের আমল পুরোপুরি ঠিক থাকা শর্ত নয়। শর্ত হচ্ছে আমলের প্রতি গাফেল না থাকা। যে ব্যক্তি নিজে আমলে সচেষ্ট থাকে, তারপর কিছু ভুলত্রুটিও হয়ে যায়, তার জন্য ওয়াজ-নসীহত ও আদেশ-নিষেধ করা নিষেধ নয়; বরং এরূপ ব্যক্তির আদেশ-নিষেধ অন্যদের সংশোধনের পাশাপাশি নিজ সংশোধনের পক্ষেও সহায়ক হয়। আদেশ-নিষেধ ও ওয়াজ-নসীহতের জন্য পরিপূর্ণ আমলওয়ালা হওয়ার শর্ত করা হলে এ কাজ করার লোকই পাওয়া যাবে না। তাতে শরী'আতের এ গুরুত্বপূর্ণ বিধানটি সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে যাবে। ফলে অন্যায়-অসৎকর্ম বাড়তেই থাকবে। তা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। এ হাদীছে বেআমল আদেশ-নিষেধকারী সম্পর্কে কঠোর সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে। বলা হয়েছে, জাহান্নামে নিক্ষেপ করার পর তার নাড়িভূড়ি বের হয়ে পড়বে, তারপর সেই যন্ত্রণায় সে গাধা যেমন ঘানির চারদিকে ঘোরে তেমনি নাড়িভূড়ির চারদিকে ঘুরতে থাকবে। অথবা এর অর্থ নাড়িভুঁড়ি নিয়ে সে ঘুরতে থাকবে। কোনও কোনও ব্যাখ্যাকার বলেন, নাড়িভুঁড়ি তাকে পেচিয়ে ধরবে আর এ অবস্থায় সে ঘুরতে থাকবে। তার জাহান্নামে প্রবেশ এবং এরকম কঠিন শাস্তিতে নিপতিত দেখে অন্যান্য জাহান্নামীগণ, যাদেরকে সে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করত আর তাতে কর্ণপাত না করায় তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, আশ্চর্য হয়ে যাবে। কেননা সে যেহেতু তাদেরকে সৎকাজের আদেশ করত ও অসৎকাজ করতে নিষেধ করত, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার নিজের সে অনুযায়ী চলার কথা, আর সে হিসেবে তার ঠিকানা হওয়ার কথা জান্নাত। তার পরিবর্তে সে জাহান্নামে কেন? কেনই বা তার শাস্তি তাদেরচে'ও কঠিন? তারা তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করবে। সে উত্তরে বলবে, আমি আদেশ-নিষেধ করতাম বটে, কিন্তু নিজে আমল করতাম না। সেজন্যই তার এ পরিণতি। সে যখন আদেশ-নিষেধ করত, তখন তো তার জানা ছিল আল্লাহর অবাধ্যতা করার পরিণাম কী। সে হিসেবে তার অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকা উচিত ছিল এবং উচিত ছিল সে ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর অবাধ্যতা হতে দূরে থাকা ও কোনও পাপকর্মে লিপ্ত না হওয়া। সে তার ইলম অনুযায়ী আমল করেনি বিধায় আজ তাকে জাহান্নামে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে জাহান্নামে শাস্তি থেকে রক্ষা করুন এবং ইলম অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দিন- আমীন। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার পাশাপাশি নিজে সে অনুযায়ী আমল করা চাই । খ. যে আলেম তার ইলম অনুযায়ী আমল করে না, তার শাস্তি ইলমবিহীন বেআমল অপেক্ষা কঠিন। তাই ইলমওয়ালা ব্যক্তির উচিত আমলের প্রতি অন্যদের তুলনায় বেশি মনোযোগী থাকা। গ. জাহান্নামে কেবল আগুনে জ্বলাই নয়; তাছাড়াও নানারকম শাস্তি আছে। প্রত্যেকটি শাস্তি দুঃসহ। সুতরাং সর্বদা জাহান্নামের শাস্তি থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া উচিত। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সকলকে জাহান্নামের আযার থেকে রক্ষা করুন।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন