আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৬- জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩১৪৮
১৯৫৯. নবী (ﷺ) ইসলামের প্রতি যাদের মন আকৃষ্ট করার প্রয়োজন তাদেরকে ও অন্যদেরকে খুমুস ইত্যাদি থেকে দান করতেন।
২৯২৭। আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুল্লাহ ওয়াইসী (রাহঃ) .... জুবাইর ইবনে মুতঈম (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গে ছিলেন, আর তখন তাঁর সঙ্গে আরো লোক ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন হুনাইন থেকে আসছিলেন। বেদুঈন লোকেরা তাঁর কাছে গনীমতের মাল চাইতে এসে তাঁকে আকড়িয়ে ধরল। এমনকি তারা তাঁকে একটি বাবলা গাছের সাথে ঠেকিয়ে দিল এবং কাঁটা তার চাদর আটকে ধরল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থামলেন। তারপর বললেন, ‘আমার চাঁদরখানি দাও। আমার নিকট যদি এ সকল কাঁটাদার বন্য বৃক্ষের সমপরিমাণ পশু থাকত, তবে সেগুলো তোমাদের মধ্যে বণ্টন করে দিতাম। এরপরও আমাকে তোমরা কখনো কৃপণ, মিথ্যাবাদী এবং দুর্বল চিত্ত পাবে না।’

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে হুনায়নের যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনকালীন একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন বিখ্যাত সাহাবী হযরত জুবায়র ইবন মুত‘ইম রাযি.। তিনি তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিল প্রচুর গনীমতের মাল। আর তা ছিল শত শত উট ও ছাগল। তা দেখে আরব বেদুঈনরা তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। তারা চাচ্ছিল গনীমতের সেই মালামাল থেকে তাদেরকে যেন কিছু দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি উটনীর উপর সওয়ার ছিলেন। তাদের ভিড়ের চাপে উটনীটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সেটি সরতে সরতে একটা বাবলা গাছের কাছে চলে যায়। তাতে তাঁর গায়ের চাদর গাছের কাঁটায় আটকে যায়। তখন তিনি উটনীটিকে দাঁড় করালেন এবং বললেন-
أَعْطُوْنِيْ رِدَائِي، فَلَوْ كَانَ لِيْ عَدَدُ هذِهِ العِضَاهِ نَعَمًا، لَقَسَمْتُهُ بَيْنَكُمْ (তোমরা আমার চাদর দাও। যদি এই গাছের কাঁটা পরিমাণ উটও আমার কাছে থাকত, তবে আমি তা তোমাদের মধ্যে বণ্টন করে দিতাম)। চাদরটি গাছের কাঁটায় আটকে যাওয়ায় তিনি তা ছাড়িয়ে দিতে বলেছেন। তারপর তাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন যে, তাঁর কাছে গনীমতের যে মালামাল আছে, তা তিনি বণ্টন করেই দেবেন। তাতে কোনও কৃপণতা করবেন না। কৃপণতা তাঁর স্বভাবেই নেই। যিনি নিজ সম্পদে কৃপণতা করেন না, তিনি গনীমতের মালে কী কৃপণতা করতে পারেন? সে মাল যত বিপুলই হোক না কেন, বাবলা গাছের কাঁটার মতো অগণিতই হোক না কেন, তাও তিনি অনায়াসে বণ্টন করে দেবেন। তবে ধৈর্য তো ধরতে হবে! বণ্টনের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলছেন-
ثُمَّ لَا تَجِدُوْنِي بَخِيْلًا وَلَا كَذَّابًا وَلَا جَبَانًا (তারপরও তোমরা আমাকে বখিল, মিথ্যুক ও ভীরু পেতে না)। কেননা আমি বখিল নই, দানশীল; মিথ্যুক নই, সত্যনিষ্ঠ এবং ভীরু নই, সাহসী। সাহসী ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস থাকে যে, দান করার দ্বারা যা কমবে, পরে রোজগার করে তা পূরণ করে ফেলতে পারবে। ফলে সে কখনও কৃপণতা করে না। কাউকে কিছু দেওয়ার ওয়াদা করলে সে ওয়াদা রক্ষা করে। ওয়াদাভঙ্গের মিথ্যায় লিপ্ত হয় না। বরং স্বভাবগতভাবেই যখন দানশীল এবং সত্যনিষ্ঠও, তখন দেওয়ার ওয়াদা রক্ষায় অধিকতর যত্নবান থাকে। উলামায়ে কেরাম বলেন, দানশীলতা, সত্যনিষ্ঠা ও সাহসিকতা সকল সদগুণের মূল। এ তিনওটি গুণ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে ছিল পূর্ণ মাত্রায়। এর দ্বারা বোঝা যায় অন্যসব সদগুণও তাঁর মধ্যে পরিপূর্ণরূপেই বিদ্যমান ছিল। তিনি তো দুনিয়ায় এসেছিলেন সদগুণসমূহের শিক্ষাদাতারূপে। আর তিনি মানুষকে যা-কিছু শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁর নিজ জীবন ছিল তার বাস্তব নমুনা। সুতরাং তাঁর সত্তা ছিল সদগুণসমূহের বাস্তবরূপ।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কৃপণতা, অসততা ও ভীরুতা নিন্দনীয় গুণ। এর থেকে নিজ স্বভাব-চরিত্র মুক্ত রাখা জরুরি।

খ. যে ব্যক্তি মুসলিমদের ইমাম ও নেতা হবে, তার মধ্যে এসব নিন্দনীয় গুণ থাকা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।

গ. এ হাদীছ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহনশীলতা, ধৈর্য, দানশীলতা প্রভৃতি উত্তম চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়।

ঘ. অন্যের কুধারণা জন্মানোর আশঙ্কা থাকলে তা রোধ করার জন্য নিজ উত্তম গুণের কথা প্রকাশ করার অবকাশ আছে। এটা অহংকারের মধ্যে পড়বে না।

ঙ. অজ্ঞ ও অশিক্ষিত শ্রেণির লোক অমার্জিত আচরণ করলে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা উচিত।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন